যদি হঠাৎ ইচ্ছে হয় পর্ব-০২

0
81

#যদি_হঠাৎ_ইচ্ছে_হয়
#পর্ব_২
#Saji_Afroz

রাতে খেতে বসেছে ফুয়াদ। রুমের মাঝে থাকা ওর ফোনটা বেজে উঠেছে। খানিক আগে দিশাকে ও ফোন করেছিল, শরীর কেমন লাগছে তা জানতে। কিন্তু ফোনে পায়নি। হয়তো দিশা ফোন করেছে এই ভেবে নিজের রুমে চলে যায় ও। ফুয়াদের মা ফাতেমা বেগম বললেন, খাবার ছেড়ে উঠছিস কেন?
-জরুরী ফোন।

এই বলে ও রুমে আসে। কিন্তু স্ক্রিনে সিনথিয়ার নাম দেখে হতাশ হয় ও। ফোন রিসিভ না করে খেতে চলে আসে। ফাতেমা বেগম বললেন, সে কী! ধরলি না?
-জরুরী না।

ফুয়াদ খেতে বসে। বেশ কয়েকবার ফোন বাজলেও ও আর রুমে গেল না। খাবার শেষ করে এসে সিনথিয়ার এতগুলা কল দেখে ফোন করলো ওকে।
সিনথিয়া ওর হালচাল জিজ্ঞাসা করে বলল, একটা কথা বলতাম ভাইয়া।
-বলো?
-আমিও ফ্যাশন শো করছি।
-তাই! বেশ তো।
-আমাকে বলছিল, কোনো পার্টনার থাকলে ভালো হত।
-যেটা ভালো মনেহয় করো।
-আমার সেভাবে কেউ নেই। না মানে যার সঙ্গে হাঁটলে অন্যকেউ মাইন্ড করবে না।
-মাইন্ড করার কী আছে! এটা একটা অনুষ্ঠান। যে কারো সাথেই অংশগ্রহণ করতে পারো।
-আমি ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে করি?
-মানে!
-মানে আপনার সঙ্গে করলে বাসার কেউ কিছু মনে করবে না।
-তাহলে তো তুমি তোমার ভাইয়ার সাথেই করতে পারো। একেবারেই কিছু মনে করবে না এতে।
-ভাইয়া করছে না এসব।
-আমিও করছি না। আমি দায়িত্বে আছি। এসবে না।

দিশার ফোন আসে। তা দেখে ফুয়াদ তাড়াহুড়ো করে সিনথিয়ার ফোনের লাইন কেটে দেয়।
দিশা রিসিভ করতেই ও বলল, পা এর কী অবস্থা? আর বেশিদিন নেই।
-আমি বুঝতে পারছি না। নড়লে ভীষণ যন্ত্রণা করে পা এ।
-খুব বেশি হলে বাদ দেবে?
-এখনো সেইরকম কিছু ভাবছি না।
-বেশি চিন্তা করো না। যা হবে ভালো হবে।
-জি।

কথা শেষে মা এর ডাকে ড্রয়িংরুমে আসলো ফুয়াদ। তিনি ছুরি দিয়ে আপেল কাটতে কাটতে বললেন, তোর বাবা নেই। বোনেরও বিয়ে হলো। সারাদিন আমি থাকি একা। আগেও একবার বলেছিলাম। পাত্তা দিসনি।
-কী?
-কী আবার! ঘরে বউ আনার কথা বলছি।

ফুয়াদ মুচকি হাসে। তিনি বললেন, একটা পাত্রী আছে হাতে। দেখতে যাব ভাবছি তোকে নিয়ে।
-না মা।
-না মানে! নিজেরও পছন্দ নাই। আমার পছন্দেও বিয়ে করবি না। করতে চাস কী? বয়স কী কম হলো!

আপেলের টুকরো হাতে নিয়ে ফুয়াদ বলল, আরেকটু সবুর করো।

তিনি বকবক করতে করতে নিজের রুমে চলে যান। এদিকে ফুয়াদ হাসে।
এতদিন বিয়ে নিয়ে ভাবেনি ফুয়াদ৷ বাবা মারা যাওয়ার পর বোনের বিয়ের দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ও। বাবার ওত বেশি জমানো কিছু ছিল না যে, সেসব দিয়ে বোনের বিয়ে হয়ে যাবে। ওদের পড়াশোনা ও ঘর সামলানোতেই অনেক টাকা খরচ হত। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে ফুয়াদ। ভেবেছে, একটু সময় নিয়ে কিছু টাকা জমিয়ে তারপর বিয়েটা করবে। নতুন বউ এর কোনো শখ অপূরণ রাখতে দেবে না। কিন্ত আবারও মাঝপথে বাধা পড়ে মা এর অসুস্থতার জন্য। অপারেশনে আবারও বিরাট অঙ্কের টাকা চলে যায়। তবে এখন আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় ও আছে।
দিশা মেয়েটাকে ওর ভালো লাগে। ও কে কোন নজরে দিশা দেখে জানে না। কিন্তু দিশাকে নিয়ে যদি সামনে ও এগুতেই চায়, পারিবারিকভাবে আগাবে। প্রেম করার সেই বয়স কী ওর আছে এখন! এই ভেবে আবারও হাসে ফুয়াদ।

আর মাত্র একদিন বাকি অনুষ্টানের। জমকালো ভাবে সাজানো হয়ে গেছে বিদ্যালয়। স্টেজও তৈরী। আর আজ সন্ধ্যায় সকল অংশগ্রহণকারীরা এসেছে, স্টেজে অনুশীলন করার জন্য। যাতে অনুষ্টানের দিন সবারটা ভালো হয়।
দিশাও আসলো। চারদিকে লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। ও সেই লাইট গুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছে। এটা ওদের বিদ্যালয় যেন মনেই হচ্ছে না! এত সুন্দর লাগছে সবকিছু! ফুয়াদ ওর কাছে ছুটে আসে। পা এ খুব বেশি জোর না দিতে বলল। এরপর ওকে নাচের রুমে নিয়ে আসে শেষবারের মতো সবাইকে অনুশীলন করানোর জন্য। কিন্তু পুরো রুম ফাঁকা। নাচের বেশিরভাগ মেয়েই নাকি এখন স্টেজে ফ্যাশন শো প্রাকটিস করছে। আর বাকিরা রাদিনকে দেখতে ব্যস্ত। রাদিনকে নিয়ে চারদিকে বেশ মাতামাতি হচ্ছে। এত সুদর্শন ছেলেকে দেখে প্রায় মেয়েরাই ওর প্রতি আকর্ষিত হয়েছে। রাত্রীও ওকে দেখতে ছুটে যায়। ফাঁকা রুমে দিশা ও ফুয়াদ। দিশা বলল, আমি বসি। আপনি কাজ সেরে নিন।
-তুমিও চলো। দেখবে ফ্যাশন শো।
-ইচ্ছে নেই। ওদের শেষ হলে পাঠিয়ে দিন। অনুশীলনের পর স্টেজে যাব।

ফুয়াদের সঙ্গে একা বসতে দিশা ইচ্ছুক নয় বুঝে বেরিয়ে যায় ও। এমন কোমলমতি মেয়েই তো ওর পছন্দ!

সকল জল্পনাকল্পনা শেষে চলে আসে সেই দিন। দিশা সাদা রঙের একটি গাউন পরে। ওকে দেখে এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় ফুয়াদ। এত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! না জানে কত জনের নজর লেগে যায়! দিশার পা ব্যথা পুরোপুরি সারেনি। তবুও ও নাচবে ঠিক করে। তবে ওর চেয়েও ওকে নিয়ে বেশি চিন্তিত ফুয়াদ। বেশ কয়েকবার ওকে বারণও করেছে ও।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজে না আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই ভাবনায় থাকে ফুয়াদ।
দিশাকে বসার জন্য আলাদা আসন ঠিক করে দেয় ও। এদিকে দিশাকে এত যত্ন করছে বলে অনেকেই হিংসার চোখে দেখছে ওকে। পুরাতন এক বান্ধবী এসে ওর স্যান্ডেল দেখে বলল, এত ভালো পোশাক পরলি কিন্তু পা এ স্যান্ডেল কেন? না মানে পোশাকের মতো কী জুতা ধার করতে পারিসনি?

একথা শুনে দিশা হেসে উড়িয়ে দিলেও রাত্রী দেয় জবাব, ওর পা এ ব্যথা। এইজন্য জুতা পরতে পারেনি। আরামের জন্য স্যান্ডেল পরেছে। না জেনে কত কথা বলিস! এত বড়ো হয়েও স্বভাব বদলানো না তোদের।

মেয়েটি লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে প্রস্থান নেয়। রাত্রী বলল, কিছু বলিস না বলে এরা পার পেয়ে যায়।

কোরআন তেলাওয়াত, আবৃত্তি, গান এসব শেষে আসে নাচের পালা। ফুয়াদকে ভীষণ চিন্তিত দেখায় দিশার জন্য। দলীয় সহ ওর তিনটে নাচ রয়েছে। তাছাড়া নাচের পুরোটা দায়িত্ব ওর উপরে। সামলে নিতে পারবে তো মেয়েটা!

প্রথম কয়েকজনের পর আসে দিশার পালা। ভয়ে ভয়ে স্টেজে উঠে ও। শরীর কাঁপছে। মাঝপথে যদি পা এর যন্ত্রণায় থেমে যেতে হয় ওকে! কিন্তু সবাইকে অবাক করে ও নেচে ফেললো। শুধু এটা নয়। ওর তিনটা নাচই ও সেরে নেয়। নাচ শুরু করার পরমুহূর্তেই যেন সমস্ত ব্যথা ও ভুলে গেছে। বরং সবার চেয়ে দিশার নাচই ভালো হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এতদিন পর দিশার নাচ দেখে আনন্দিত হয়।
এদিকে রাত্রী একটা বিষয় খেয়াল করলো। দিশা নাচ করার সময় রাদিন স্টেজের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্য কারো ক্ষেত্রে এমনটা ও করেনি। কিন্তু দিশার তিনটে নাচের সময়ই ও এসেছে এবং অনবরত হাত তালি দিয়েছে। বিষয়টা আসলেই ভাবার মতো!

নাচের পরেই শুরু হয় ফ্যাশন শো। দিশা খুব মনোযোগ দিয়ে এটা দেখে চলেছে। রাদিন আসতেই সবাই করতালি দিয়ে উঠে। ও একটি সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। এই প্রথম দিশা রাদিনকে ভালো করে লক্ষ্য করলো। আসলেই ছেলেটা অনেক সুদর্শন। সচারাচর চারপাশে সুন্দরী মেয়ে দেখা গেলেও এমন সুন্দর ছেলে খুব কমই দেখা যায়। লম্বা, ফর্সা, গালে চাপদাড়ি, বিড়াল চোখা এমন একটা ছেলে মেয়েদের স্বপ্ন পুরুষ। শুনেছে, বেশ টাকা পয়সার মালিক এই ছেলে। ওর জীবনে যেই মেয়েটি আছে, আসলেই ও ভাগ্যবতী।

সব শেষে সঙ্গীত শিল্পীর গানের তালে সবাই নাচতে শুরু করলেও দিশা পারে না। একপাশে বসে থাকে ও। স্টেজে নাচার কারণে পা এর ব্যথাটা উঠেছে। আবার এসব ছেড়ে ওর যেতেও ইচ্ছে করছে না বাসায়। তাছাড়া একা যাবেও কিভাবে? রাত্রীর সঙ্গে যেতে হবে। আর এই মুহুর্তে রাত্রী সবার সাথে নাচতে ব্যস্ত। তাই একা একাই বসে সবার নাচ দেখছে দিশা।

সঙ্গীত শিল্পী চলে যাওয়ার সাথে সাথে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্ব চলে আসে। উপস্থাপক সিনথিয়ার ভাই সাকিব। যারা এই অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ ভাবে অবদান রেখেছে সবাইকে স্টেজে ডেকে ধন্যবাদ দেওয়া হচ্ছে।
সব পালা শেষে এইবার আসে নাচের পালা। সাকিব বলল, একটা অনুষ্ঠানে নাচের পার্টটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। এইটির জন্যই আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে সকলে। নাচ মনোরঞ্জনের প্রধান মাধ্যম। যারা আমাদের এই নাচের মাধ্যমে আনন্দ দিয়েছে সবাইকে ধন্যবাদ। তবে বিশেষভাবে ধন্যবাদ টিম লিডারকে। যার নির্দেশনায় এই পর্বটা এত সুন্দর হয়েছে।

এই কথা শুনে দিশা দাঁড়াতে যাবে তখন সাকিব বলল, স্টেজে আসার অনুরোধ করছি সিনথিয়াকে।

একথা শুনে দিশা থমকে যায়। স্টেজে ফুয়াদও অন্যদের সঙ্গে ছিল। সে সাকিবকে কিছু বলতে চেয়েও সবার সামনে পারলো না। শিক্ষকরাও রয়েছে এখানে। সিনথিয়া আসে। বাকি সবাই এক সঙ্গে ছবি তুলতে শুরু করে। দিশা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। রাত্রীর মেজাজ খারাপ হয়। ও বলল, আমি এখুনি ফুয়াদ ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করব এমন করার কারণ।
-তুই প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা এখন।
-কিন্তু…
-প্লিজ!

রাত্রীর সঙ্গে দিশা বেরিয়ে আসে। ফুয়াদ স্টেজে থেকে নিচে তাকিতে দিশাকে খুঁজে পায় না। তৎক্ষনাৎ ওর কী করার উচিত বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে। সাকিব এমনটা কেন করলো! ওকে তো জানালো হয়েছিল দিশার কথা।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই দিশার বাড়ি চলে আসে। যেহেতু কাছেই ওর বাসা। নিজের ফোনটা বন্ধ করে দেয় ও। কোনো কিছুর আশায় ও দায়িত্ব পালন করেনি। কিন্তু ওর কষ্টের মূল্য অন্য কেউ পাবে এটাও ও মানতে পারছে না। ফুয়াদ এটা কিভাবে হতে দিলো! ওকে খাটিয়ে সব প্রশংসার দাবিদার বানালো সিনথিয়া কে! খুব খারাপ করেছে ও। খুব খারাপ!
.
চলবে