যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-১১+১২

0
395

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

১১.
নিভে যাওয়া চুলা আবার ধরাতে হল সিদ্রাকে। এইসব নানান চিন্তাভাবনা করতে করতে আর বারবার নিভে যাওয়া চুলা জ্বালাতে জ্বালাতে ভাত রান্না করতেই লেগে গেল প্রায় এক ঘণ্টা। তারপর চুলায় তরকারি তুলে দিয়ে আন্দাজ করে মশলাপাতি দিয়ে দিল। যা হয় হবে, আল্লাহ ভরসা।

অনভ্যস্ত হাতে অবশেষে যখন রান্না শেষ করে ও উঠে দাঁড়ালো, কালিঝুলি মেখে, ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বেলাও গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। গোসল করতে হবে, এটাই প্রথম মাথায় আসল। লোকটার দিকে তাকাতেই দেখে, লোকটা কেমন একটা চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর লোকটা যা বলল, তাতে আরো একবার মন খারাপ হয়ে গেল সিদ্রার।

***
একটা বালতি হাতে জঙ্গলের মাঝে দিয়ে একটা সরু রাস্তা ধরে হাঁটছে সিদ্রা। পেছনে ওই লোকটা। বাথরুমের বালতি আর রান্নাঘরের ড্রাম, দুই জায়গার পানিই শেষ হয়ে গেছে। এখন থেকে পানি তোকেই আনতে হবে বলে লোকটা ওকে বালতি হাতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ও বুঝতে পারছেনা। তবে ওইদিন যেদিকে গেছিলো, সেদিকে না। রাস্তাটা এতই অস্পষ্ট যে বুঝা যাচ্ছে, তেমন মানুষ চলাচল নেই এ রাস্তা দিয়ে। মাঝে মাঝে লোকটা ডান বাম শুধরে দিচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গিয়েও চুপ করে গিয়েছে, আসলে আর নিতে পারছেনা ও। লোকটার কথা ওকে আরো দুর্বল করে দিয়েছে।

“এটাই তোর উপযুক্ত লুক” লোকটা সন্তুষ্টির সাথে বলেছিল ওর কালিঝুলি মাখা চেহারার দিকে তাকিয়ে।

প্রথমে ও বুঝতে পারেনি। তখন লোকটা ওকে ধরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সারামুখে কালি আর ঘামে ওকে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। বারবার চুলার কালিমাখা হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছাতে গিয়ে এই দশা হয়েছে। আর এই কালিমালিপ্ত মুখটাই ওর উপযুক্ত চেহারা! ও এত খারাপ এই লোকটার কাছে!!

“ডানে” আবার চিন্তার জগত থেকে ফিরে এল সিদ্রা। জংলা রাস্তা দিয়ে হাঁটার অভ্যেস নেই, তার ওপর ঝোপঝাড়ের কাঁটায় বারবার বোরকা আটকে যাচ্ছে বলে দেরী হচ্ছে আর লোকটা বিরক্ত হচ্ছে।

“ঢং করে আবার বোরকা পরে আসা হয়েছে” বিড়বিড় করে বলল লোকটা।

যখন সিদ্রার মনে হতে লাগল যে, এ পথ আর শেষ হবেনা, সেই মুহূর্তেই এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল যে বিস্ময়ে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল। এত সুন্দর! কিছুক্ষণের জন্য ও সকল কিছু ভুলে গিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকল।

“সুবহানআল্লাহ!” মুখ দিয়ে স্বভাবতই বেরিয়ে এল আল্লাহর প্রশংসা।

সামনে একটা পাহাড়ের দেয়াল। একটা ছোট ঝর্ণা ঝিরঝির করে নামছে পাহাড়ের গা বেয়ে। কান পাতলেই তার মধুর আওয়াজ কানে আসছে। ঝর্ণার পানি পড়ে একটা বড় দিঘীর সাইজের জলাশয় তৈরি হয়েছে। জলাশয়ের পাড়্গুলো ঝোপঝাড়ে ভরা, আর তাতে অজস্র রঙবেরঙ এর বুনোফুল ফুটে আছে। আর পানি তো একদম টলটলে, দেখলেই ইচ্ছে করে একটা ডুব দিয়ে আসি। আশেপাশে পাখির কলরব আর বুনোফুলের গন্ধে যেন পুরো মেতে আছে জায়গাটা। লোকটা যেন ওর মনের কথা পড়ে ফেললো। এক ধাক্কায় যখন ওর হুঁশ ফিরে এল, ততক্ষণে ও পানিতে।

পানিতে হাবুডুবু খেতে লাগল সিদ্রা, সাঁতার জানেনা ও। লোকটা কি আমাকে পানিতে ডুবিয়ে মারবে নাকি! বোরকা পানিতে ভিজে ভারী হয়ে গেছে আর শরীর তো আগে থেকেই দুর্বল হয়ে আছে। হাত পাও সেভাবে ছুড়তে পারছেনা। অনেক্ষন হাবুডুবু খেয়ে যখন হাল ছেড়ে দিয়ে নিচে নামতে লাগল, মারা যাচ্ছে মনে করে ইস্তেগফার পড়া শুরু করল। আব্বু-আম্মু আর বোনের চেহারা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। কান্না পেল সিদ্রার কিন্তু পানিতে কি আর কাঁদা যায়। পুরো জীবন যেন ফ্ল্যাশব্যাক এর মত চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে হল, আব্বু আম্মু আর বোনকে আরেকবার দেখতে পাওয়া ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই ওর। ওদের থেকে অনেক দূরে এক অজানা স্থানে ও ডুবে মরছে। ওরা হয়ত কোনদিন জানতেও পারবেনা। আল্লাহ্‌ তুমি ওদের ভাল রেখো, শেষ প্রার্থনা করল সিদ্রা।

যখন মনে হল দম ফুরিয়ে আসছে, ঠিক তখনি ওর পা মাটিতে ঠেকল, আর ও অটোমেটিক্যালি ধাক্কা দিয়ে উপরে উঠলো। বুকভরে শ্বাস নিল সিদ্রা। আহ! বেঁচে থাকা যে কত আনন্দের, হাড়ে হাড়ে টের পেল ও। কিন্তু সে আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলনা।

পা সোজা করতেই পুরো বোকা বনে গেল সিদ্রা। গলা পর্যন্ত পানির মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। এতক্ষণ শুধু আতঙ্কেই এসব করছিলাম আমি! ছি ছি!! শয়তান লোকটার সামনে পুরো গাধা হয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখল লোকটা প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন মজা দেখছে। এ আর নতুন কি, আমার সব কাজেই তো উনি মজা পান। আর এটা তো পুরা গাধার মত কাজ হয়েছে, ভাবল সিদ্রা।

মুখ দিয়ে কেমন চু চু শব্দ করল লোকটা। “ইশ! প্ল্যানটা সফল হলনা, না? ভেবেছিলি, সিনেমার হিরোদের মত তোকে বাঁচাতে ঝাঁপ দিব। তারপর তোকে তুলে আনব। বুকে চাপ দিয়ে পানি বের করব। তারপর জ্ঞান না ফিরলে মুখে মুখ লাগিয়ে তোর জ্ঞান ফিরাব, তাইনা?” পায়চারি করতে করতে হাত নেড়ে নেড়ে অভিনয় করে বলছিল লোকটা কথাগুলো।

ছি ছি! লজ্জায় পানিতেই আবার ডুবে মরতে ইচ্ছে হচ্ছে সিদ্রার। নিজের বোকামির জন্য কত নোংরা কথা শুনতে হচ্ছে। নিজের সাফাই গাওয়ারও মুখ রইলো না। মুখ নিচু করে মিনমিন করে বলল,
“আমি সাঁতার জানিনা, তাই হঠাৎ করে ভয় পেয়ে গেছিলাম। তার জন্য এত বাজে কথা শোনানোর কি আছে!”

তখনি মনে পড়ল, লোকটাই তো ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। ঝট করে তাকালো ও।
“আপনি আমাকে ধাক্কা মেরেছিলেন কেন?”

“আমার ইচ্ছা। যেভাবে হা করে তাকিয়েছিলি, আমি ভাবলাম একটু ভাল করে কাছ থেকে দেখ” কেমন একটা বিচ্ছিরি হাসি দিল লোকটা। দেখে আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সিদ্রার।

যাক, পানিতে যখন নেমেই গেছে, তখন মুখ হাত এখানেই ধুয়ে নিই। যেই ভাবা সেই কাজ। পানিকে আয়না বানিয়ে কচলে কচলে মুখ ধুয়ে নিল সিদ্রা। কিন্তু উঠতে গিয়ে টনক নড়ল ওর। সব তো ভিজে গেছে। এখন এই ভেজা কাপড়ে এই লোকের সামনে কিভাবে উঠব!

“কিরে, আমি কি তোকে সাঁতার কাটতে এনেছি! উঠে আয় তাড়াতাড়ি, সারাদিন পড়ে নেই আমার”

“আমি উঠতে পারবনা”

“উঠতে পারবিনা কেন? এই যে এপাশের নিচু ঢাল দিয়ে উঠে আয়” ডানদিকে নির্দেশ করে বলল লোকটা।

মাথা নাড়লো ও। “আমি উঠতে পারবোনা আপনার সামনে, আপনি গিয়ে খালাকে পাঠান”

“আমাকে কি গাধা পেয়েছিস? আমি যাই খালাকে ডাকতে, আর তুই পালানোর চেষ্টা কর”

আরে তাইতো, এটাতো ভাবেনি। লোকটা নিজেই ওকে বুদ্ধি দিয়ে দিল। থ্যাংকইউ, মনে মনে খুশি হয়ে গেল সিদ্রা। কিন্তু পরের কথা শুনেই দমে গেল।

“অবশ্য পালাতে তো আর পারবিনা, কোনদিক দিয়েই পালানো সম্ভব না। শুধু শুধু আমাদের হয়রানি করবি। এখন ফালতু প্যাঁচাল না পেড়ে উঠে আয়।“

জোরে জোরে মাথা নাড়ল ও। “আমি মরে গেলেও ভেজা কাপড়ে আপনার সামনে উঠতে পারবনা।“

“ওরে ঢং! একটু আগে আমাকে সিডিউস করার জন্য পানিতে ডুবার নাটক করছিলি, আর এখন সতী সাজছিস!! তুই পারিস বটে!!! এমনি এমনি কি আর ছেলেদের ঘোল খাওয়াস!!!”

রেগে গেল সিদ্রা, “আমি কোন ঢং করছিনা। আমি ভয়ে আতঙ্কে ওরকম করেছি, ইচ্ছা করে না। আপনি বিশ্বাস না করলে না করেন। কিন্তু আমি ভেজা কাপড়ে আপনার সামনে উঠতে পারবনা মানে পারবনা”

“ঠিক আছে। আমিও দেখি তুই কতক্ষণ থাকতে পারিস পানিতে” লোকটা একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে পড়ল।

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

১২.
লোকটা গাছে হেলান দিয়ে বসে মোবাইল টিপছে আর একটু পর পর সিদ্রার দিকে তাকাচ্ছে।

মেয়েটাকে যত দেখছে, আস্তে আস্তে অবাক হচ্ছে লোকটা। একদম চুপ করে মাথা নিচু করে গলা পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। সদ্যস্নাত চেহারাটা বড্ড নিষ্পাপ লাগছে। কিন্তু সে খুব ভাল করেই জানে, এই নিস্পাপ চেহারাটা একটা মুখোশ। ও একটা শয়তান মেয়ে। ওকে দেখলে কে বলবে, ওর ভেতরটা এত কুৎসিত! ওই নিষ্পাপ চেহারায় মায়ায় সে ফাঁসবে না। কিন্তু তার জানার সাথে মিলছেনা কেন মেয়েটার কোন কাজ। মানুষ কি এতখানি অভিনয় করতে পারে? কি জানি, এমন মেয়েরা হয়ত পারে।

যেমন, কালকে ও খালার জন্য যেভাবে সেবা করেছে, সেটা একেবারেই অকল্পনীয়। ওর মত একটা মেয়ে, যার কাছে মানুষের আবেগ-অনুভূতি খেলার জিনিস, সে ওই কাজটা কেন করল। প্রতিদিনের নামাজ-কালাম আর বেশী বেশী পর্দা করা যে ঢং, সেটা তো আমি আগেই বুঝেছি। কিন্তু কালকে ও যখন বের হতে পারল, তখন পালিয়েই তো যেতে পারতো। সেটা না করে খালার সেবা কেন করতে গেল, এখনো বুঝতে পারছিনা। এটাও কি আমার কাছে নিজেকে ভাল প্রমাণ করার চেষ্টা? হুম, সেটাই হবে, সিদ্ধান্তে পৌঁছল লোকটা।

পলপল করে বয়ে যাচ্ছে সময়, সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, খেয়াল করল সিদ্রা। লোকটা বুঝতে চাইছেনা কেন, অবশ্য লোকটার যে ধারণা ওর সম্পর্কে তাতে ওকে বিশ্বাস না করাই স্বাভাবিক। কিন্তু লোকটার এসব ধারণার উৎস আর আমার এই দুর্ভোগের কারণ কি আমি কোনদিন জানতে পারব? ভাবছিল সিদ্রা। লোকটা না নিজে কিছু খুলে বলছে, না আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করলে সিদ্রা সাহস করে বলে উঠলো,
“আপনি এমন করছেন কেন? নামাজ কাযা হয়ে যাচ্ছে তো! আপনি না হয় নিজে নামাজ পড়েননা, তাই বলে কি অন্যকেও পড়তে দিবেননা?”

“এত জ্ঞান দিসনা তো, খুব নামাজের প্রতি মোহাব্বত দেখাচ্ছে, নটংকী কোথাকার। তোর মত মেয়ের মুখে এসব ধর্মের জ্ঞান শুনলে আরো রাগ উঠে আমার। তোকে কি আমি উঠতে না করেছি, নিজেই তো উঠছিসনা।“

“ধুর! সবসময় এক কথা” মনে মনে বলল সিদ্রা।

আস্তে আস্তে আলো কমে আসছে, দেখল সিদ্রা। তাকিয়ে দেখল লোকটাও অধৈর্য হয়ে উঠছে, উসখুস করছে। ফোনের কি চার্জ শেষ নাকি? এই অবস্থাতেও হাসি পেল ওর কথাটা চিন্তা করে।

“তুই কি সত্যিই উঠবিনা?” অবশেষে নিরবতা ভাঙল লোকটা।

“না” দৃঢ় স্বরে বলল সিদ্রা। ওর স্বরে কি যেন একটা ছিল, লোকটা উঠে দাঁড়ালো। “ঠিক আছে, আমি তোর কথা মানব, কিন্তু একটা শর্ত আছে”

“কি শর্ত?”

“আমাকে সত্যি সত্যি বলতে হবে তুই কাল ঘর থেকে কিভাবে বের হয়েছিস। যদি মিথ্যে বলিস, আমি তোকে সারারাত এই পানিতেই চুবিয়ে রাখবো।“

হা হয়ে গেল সিদ্রা, বলে কি লোকটা!

“আর আমি যে চাইলেই সেটা করতে পারি, তাতে আশা করি তোর কোন সন্দেহ নাই। সো, জলদি জলদি সত্যি কথাটা বলে দে”

ঢোক গিলল সিদ্রা, কি করবে বুঝতে পারছেনা।

“জলদি!” তাড়া দিল লোকটা।

ঠিক আছে, সত্যি বলে দেয়াই ঠিক মনে করল সিদ্রা। “আমি জানালা দিয়ে বের হয়েছি”

এবার লোকটার হা হওয়ার পালা। “তুই ওইটুকু একটা জানালা গলে বের হয়ে এলি! মাই গড!! তুই যে এত চিকনাচাকনা, তোকে দেখে তো বোঝা যায়না” কিছু বললনা সিদ্রা।

“আচ্ছা, তোর কথা আপাতত আমি বিশ্বাস করলাম, যাচ্ছি আমি খালাকে ডাকতে, তুই উঠে আয়” অনেকক্ষণ তো হল, যেই পোষাকে ও আমার সামনে উঠে আসছেনা, সেই পোষাকে ও পালাতে যাবেনা। আর সন্ধ্যে হয়ে আসছে, রাতের বেলা অচেনা জংগলে পালানোর সাহস হওয়ার কথা না। আরও বেশিক্ষণ থাকলে শেষে জ্বর বাঁধাবে, এসব ভেবে হাঁটা দিল লোকটা।

লোকটা গাছের আড়াল হতেই ভয় লাগতে লাগল সিদ্রার। বনে জঙ্গলে সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। আলো ফুরিয়ে আসছে। উনি যাওয়ার পর খালা আসতে আসতে তো রাত হয়ে যাবে, আর ততক্ষণ এখানে একা থাকলে আমি ভয়েই মরে যাবে। এত ঝোপঝাড়, সাপ-খোপ থাকা বিচিত্র নয়। তাড়াতাড়ি করে পাড়ে উঠলো সিদ্রা।

গায়ে সেঁটে থাকা বোরকাটা আলগা করার ব্যার্থ চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। না পেরে নিচের দিকটা একটু চিপে, ঝেড়ে নিল। ওড়নাটাও খুলে দ্রুত হাতে চিপে নিল, তারপর ঝেড়ে আবার গায়ে পেঁচাল এমনভাবে, যাতে যথাসম্ভব কম শরীর বোঝা যায়। এরপর বালতি নিয়ে নিচে নেমে পানি ভরলো। কিন্তু ভরা বালতি নিয়ে তো আর পাড়ে আর উঠতে পারেনা। খালি পানি পড়ে যায়। একবার তো পা পিছলে ধপাস করে পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথা পেল। কোনমতে ব্যথা সামলে উঠে ভাবল, লোকটা থাকলে হয়ত বালতিটা ধরতো। কি করবে এখন! এই পানি দিয়েই রাত পার করতে হবে ওর। আরও কয়েকবার চেষ্টার পর আধ বালতি পানি নিয়ে পাড়ে উঠতে সক্ষম হল। এবার কোমরের ব্যথাকে যথাসম্ভব অগ্রাহ্য করে দ্রুত পথ চলতে শুরু করল সিদ্রা। সন্ধ্যা হয়ে গেলে আর রাস্তা দেখতে পাবোনা, এই ভেবে হাঁটার গতি আরো দ্রুত করল। কিন্তু শীত করছে কেন এত? ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল সিদ্রা। শরীরটাও দুর্বল লাগছে, কিন্তু হাঁটা থামালনা। মাথাও ঘুরতে লাগল একটু পর। বুঝতেও পারলনা ও, রাস্তা ছেড়ে ঢুকে যাচ্ছে বনের মধ্যে।

***
গাছের আড়াল হলেও চলে যায়নি লোকটা। তার ধারণা ছিল মেয়েটা পালাবে, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল সিদ্রা কি করে। তাড়াহুড়ো করে পাড়ে ওঠা আর বালতি নিয়ে ওর নাজেহাল অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসছিল। আছাড় খাওয়া দেখে তো আরেকটু হলেই জোরেই হেসে ফেলেছিল, কোনমতে মুখে হাত দিয়ে আটকিয়েছে।

সিদ্রা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলে লোকটা পিছু নিল ওর। তারপর যখন ও রাস্তা ছেড়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল, রাগতে শুরু করল লোকটা। আচ্ছা, তাহলে ঠিকই ভেবেছি! দেখছি, তুই পালিয়ে কতদূর যাস!

কিন্তু একটু পর যখন হাত থেকে বালতি পড়ে গেল আর এদিক ওদিক আঁকাবাঁকা করে পা ফেলতে লাগল, তখন বুঝল লোকটা, মেয়েটা স্বাভাবিক নেই। দৌড়ে ওর কাছে যেতে না যেতেই আহ! করে একটা চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল সিদ্রা। লোকটা এসে দেখল একটা মোটা ডালে মাথা ঠুকে জ্ঞান হারিয়েছে ও। আর পায়ে একটা শুকনা কাঁটাওয়ালা ডাল বিধে আছে।

সিদ্রার গায়ে হাত দিতেই দেখল প্রচণ্ড তাপ বেরোচ্ছে গা দিয়ে। যা ভয় করেছিলাম, তাই! এতো ভারী জ্বালা হল। এজন্যই বলেছিলাম উঠে আসতে। আস্ত ত্যাঁদড় মেয়ে, সেই তো আমি দেখলামই ওর ভেজা জামাকাপড়। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ানো।

প্রথমে টান দিয়ে কাঁটা ছুটাল লোকটা, রক্ত বের হল খানিকটা। তারপর বালতি থেকে হাতের চোলে পানি নিয়ে মুখে ছিটাল। ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়ে চোখ খুলল সিদ্রা। লোকটা ওর কথা বলার অপেক্ষা না করে আগের দিনের মত বাম কাঁধে সিদ্রাকে তুলে নিল। বুঝতে পারল, আগের দিনের থেকে কত হালকা হয়ে গেছে মেয়েটা। আজ আর বাধা দিলনা সিদ্রা, অবশ্য সেই হুঁশ থাকলে না দিবে।

ডান হাতে বালতিটা নিয়ে হাঁটা শুরু করল লোকটা। আরিব্বাস! গায়ের তাপে দেখি জামাকাপড় শুকিয়ে যাচ্ছে। একদিনেই মরে গেলে তো সব প্ল্যান মাটি হয়ে যাবে, জোরে পা চালাল লোকটা।

চলবে।