যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-৯+১০

0
368

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৯.
এদিকে পরপর দুইবার স্যালাইন খেয়ে খুব জোর বাথরুম পেয়েছে সিদ্রার। ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে খালা খালা বলে, কোন সাড়াশব্দ নেই। ব্যাপার কি! বাথরুমও আর চেপে রাখা যাচ্ছেনা। এবার ডাকের সাথে নানারকম আল্টিমেটাম দেয়াও শুরু করল সিদ্রা।

“খালা, দরজা না খুললে কিন্তু ঘরে টয়লেট হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি খুলেন” এসব বলার পরেও যখন খালার দেখা পাওয়া গেলনা, তখন অসাধ্য সাধন করে ফেলল সিদ্রা। খাটটাকে টেনে জানালার কাছে আনল। তারপর বহু কসরৎ করে শরীরটা মোচড়ামুচড়ি করে জানালা দিয়ে বের করে আনল। মোটামুটি জান বের হয়ে গেল এতটুকু জানালা দিয়ে বের হতে গিয়ে। আর ওইপাশে তো কিছু ছিলনা, পায়ে একটু ব্যাথাও পেল। ভাগ্য ভাল যে ভাঙেনি কি মচকায়নি।

এর আগেও একবার এই চেষ্টা করেছিল ও, একদম প্রথমদিন সকালে। কিন্তু সেদিন কিছুতেই বের হতে পারেনি। আজকে প্রয়োজনের তাগিদেই হোক, আর না খেয়ে শুকিয়ে যাওয়ার কারণেই হোক, সফল হল সিদ্রা। পায়ে ব্যাথা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতেই সোজা বাথরুমে দৌড় দিল।

আহ! শান্তি!! বাথরুম করেও যে এত শান্তি পাওয়া যায়, আজকে জীবনের প্রথম উপলব্ধি করলাম, ভাবল সিদ্রা। গোপাল ভাঁড়ের গল্পটা কি আর এমনি এমনি হয়েছে!!!

এবার মাথায় এল আসল চিন্তা। লোকটাও নেই আর মহিলাটাও নেই। এটাই তো সুযোগ পালানোর। বোরকাটা পরে আসি জলদি। যেই ভাবা সেই কাজ, দৌড়ে বারান্দায় আসল সিদ্রা। তালা কি করে খুলব, এই চিন্তা করতেই দেখে দরজার সাইডেই একটা হুঁকে চাবি ঝোলান। আলহামদুলিল্লাহ্‌! বলে তালা খুলে ফেলল সিদ্রা। তাড়াতাড়ি করে বোরকাটা পরে ওই শাড়িছেড়া ওড়নাটা দিয়ে ভালভাবে নেকাব পরে ফেলল। বারান্দা থেকে নামার সময় একটু কৌতূহল হল, চলেই তো যাচ্ছি, পাশের ঘরটা কেমন ছিল একটু উঁকি মেরে যাই। এবং ভুলটা করল এখানেই।

আস্তে করে হেঁটে উঁকি মারতেই দেখে, খালা মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। দৌড়ে গেল সিদ্রা উনার কাছে। ডাক দিল, সাড়া নেই। গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা, হাত রাখা যাচ্ছেনা। জ্বরের প্রকোপেই অজ্ঞান হয়ে গেছে, বুঝল ও। দোটানায় পড়ে গেল সিদ্রা। কি করব আমি? পালাবো নাকি উনার জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করব? পালানোর এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলব? কিন্তু একজন অজ্ঞান মানুষকে ফেলে যাই কি করে, এতটা অমানবিক কি করে হব?

একটু পরেই দেখা গেল সিদ্রা ওকে পরতে দেয়া শাড়িটার একপাশ ছিড়ে সেটা দিয়ে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। আর শরীর ভেজা গামছা দিয়ে মুছে জ্বর কমানোর চেষ্টা করছে। পালিয়ে ও যেতেই পারতো, কিন্তু বিবেক সায় দিলনা। ওরা অমানুষ বলে কি ওকেও অমানুষ হতে হবে নাকি!

একেতো ওর জন্য বৃষ্টিতে ভিজে খালার এই দশা। আবার এত তাপ গায়ে, তার মানে জ্বর অনেক আগেই এসেছে, সকালে হয়ত জ্বর গায়েই ওর জন্য রান্না করেছে। আর লোকটারো দুদিন ধরে পাত্তা নেই, কখন আসবে সেটাও তো বোঝা যাচ্ছেনা। ততক্ষণে মহিলার বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে যেতে পারে। এছাড়া এই ঘন জংগল থেকে যে ও নিজে আসলেই পালাতে পারবে, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই, কিছুই চিনেনা ও। বরং একটা মানুষের প্রাণ বাঁচানোই আগে দরকার, নাহলে পালিয়ে বাঁচলেও নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারতোনা সিদ্রা।

ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতেই নড়ে উঠল মহিলা। মুখ ফাঁক করল, যেন কিছু বলতে চাইছে। সিদ্রা কি করবে বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি করে চামচ দিয়ে পানি দিল ঠোঁটের ফাঁকে, খেয়ে নিল মহিলা। এভাবে বেশ খানিকটা পানি খাওয়ানোর পর মনে হল ওষুধ খাওয়াতে হবে। কিন্তু তার আগে তো কিছু খাওয়ানো দরকার।

রান্নাঘরে পাতিলে ভাত তরকারি সবই পেল সিদ্রা। জ্ঞান এসেছে ঠিকই, কিন্তু হুঁশ এখনো ফেরেনি মহিলার। গলার ভেতর থেকে গোঁ গোঁ একটা আওয়াজ আসছে, কথা বলতে পারলে হয়তো প্রলাপ বকত এতক্ষণ। অনেক চেষ্টা করেও কয়েক লোকমার বেশী খাওয়াতে পারলনা। এবার ওষুধ খোঁজার পালা।

এতক্ষণে ঘরটার দিকে ভাল করে নজর দেয়ার সুযোগ পেল সিদ্রা। ও যেটাতে ছিল, তার থেকে বেশ বড় ঘরটা। আর অনেক সুন্দর করে সাজানো গুছানো, যেন আধুনিক হোটেল রুম কিংবা কোন ভ্যাকেশন হোম। ঘরের মাঝখানে মশারি টানানোর স্ট্যান্ডসহ মাঝারি সাইজের সুন্দর একটা খাট, স্ট্যান্ডগুলোর সাথে সুন্দর করে মশারি বেঁধে রাখা। খাটের দুপাশে বেডসাইড টেবিল, একপাশে দারুণ একটা কাঠের আলমারি, ম্যাচিং ড্রেসিং টেবিল, জানালার পাশে একটা কফি টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি দুটো আরামদায়ক সোফা।

বাব্বাহ! এখানে এসে নিশ্চয় কেউ সময় কাটায়, ভাবল সিদ্রা। ওই মহিলার নিজের ঘর এটা হতেই পারেনা।

আলমারি, বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার কোথাও কোন ওষুধ পেলনা সিদ্রা। লাস্ট বাকি আছে শুধু ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার। “আল্লাহ্‌! এখানেই যেন পাই, তুমি দেখো” বলে ড্রয়ার খুলল সিদ্রা।

“আলহামদুলিল্লাহ্‌”, প্যারাসিটামল সহ ইমার্জেন্সিতে প্রয়োজন এমন সব ওষুধই আছে ড্রয়ারে। তাড়াতাড়ি করে একটা প্যারাসিটামল গুলে খাইয়ে দিল খালাকে।

বিকালের দিকে জ্বর কমে আসল। এর মধ্যে সিদ্রা খালি দুইবার নামাজ পড়ার জন্য উঠেছে, এছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও জলপট্টি দেয়া থামায়নি। যতবার চোখ খুলেছে মহিলা ততবার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছে ওর দিকে। হয়ত ভাবতে পারছেনা সিদ্রা এখানে কিভাবে এল অথবা সিদ্রা উনার সেবা করছে সেটা বিশ্বাস করতে পারছেনা কিংবা দুটোই।

মাথায় পানি ঢাললে হয়ত আরো তাড়াতাড়ি জ্বর নামতো, কিন্তু সমস্যা হল মহিলা এত ভারী যে, সিদ্রা চেষ্টা করেও উনাকে খাটের উপরে তুলতে পারেনি, সেজন্য মাথায় পানি ঢালা সম্ভব হয়নি।
আলমারি থেকে চাদর বের করে মেঝেতে বিছিয়ে উনাকে গড়িয়ে ওইটার ওপর এনেছে। তারপর গায়ে কাঁথা দিয়ে দিয়েছে।

যাই হোক, মাগরিবের আগে আগে পুরোপুরি জ্বর ছেড়ে গেল। মহিলা তখন ঘুমাচ্ছে। সিদ্রা ভাবছিল, এখন পালাবে কিনা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত হয়ে যাবে। অচেনা জংগলে যেখানে দিনে কিভাবে পালাবে সেটা বুঝতে পারছিলনা, সেখানে এখন তো আরো অসম্ভব। তার ওপর ওইদিন গাছে আটকে থাকার সময় রাত হয়ে যাওয়ার পর যে ভয় পেয়েছিল, সেটা ভেবেও বুক কেঁপে উঠলো ওর। তাই, আপাতত বাদ দিল পালানোর চিন্তা। আল্লাহ্‌ যদি আমার কপালে মুক্তি লিখে রাখেন, তাহলে সুযোগ আবার আসবে, ইন শা আল্লাহ্‌, ভাবল সিদ্রা।

রাতের বেলা ফিরে এল লোকটা।

এশার নামাজ শেষ করে সোফার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে নামাজের পরের তসবিগুলো গুনছিল সিদ্রা। বুদ্ধি করে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে এসেছে, যাতে লোকটা এসে দরজা খুলতে গেলে ও শব্দ শুনে বুঝতে পারে। আর এ ঘরের দরজাও ভেজিয়ে রেখেছে।

একটু তন্দ্রা এসে গেছিল সিদ্রার, সে সময়ই শুনল ওর ঘরের দরজা খোলার শব্দ। তন্দ্রা ছুটে গেলেও ঘুমের ভান করে পড়ে রইল সিদ্রা। মুখটা এমনভাবে হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে যাতে চোখ বন্ধ দেখে বুঝা যায় যে ও ঘুমাচ্ছে।

“খালা, খালা, মেয়েটা কোথায়?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকল লোকটা। ঢুকেই থমকে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল, যেন পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। জল পট্টি দেয়ার বাটি আর কাপড় খালার পাশেই পড়ে আছে, যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে। হালকা করে খুলে চোখের কোণ দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সিদ্রা। তেলের বাতির আলো-আঁধারি ওর অভিনয় আরো সহজ করে দিল। লোকটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে, যেন ঘুম ভাঙাতে চাইছেনা। ওর দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে চোখ বুজে ফেলল সিদ্রা।

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

১০.
লোকটা একদম সিদ্রার মুখের কাছে এসে বোঝার চেষ্টা করল, ও আসলেই ঘুমাচ্ছে কিনা। তারপর খালার শিওরে বসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরখ করল। তারপর আস্তে করে ডাকল খালাকে।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল খালা। হাত নাড়িয়ে কথা বলতে লাগল ইশারায়, সব বুঝতে পারলনা সিদ্রা, তবে মাঝেমাঝে ওর দিকে ইশারা করল। লোকটা যেন পুরো হতভম্ব হয়ে গেছে।

“আপনি জানেননা ও কিভাবে বেরিয়েছে?”
“চোখ খুলে দেখলেন ও আপনার মাথায় জল পট্টি দিচ্ছে?”
“আপনাকে খাইয়েও দিয়েছে?”

প্রতিটা প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল মহিলা। লোকটা সিদ্রার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। “আনবিলিভেবল! এই মেয়ের মধ্যে দয়ামায়া বলে কিছু আছে!! কিন্তু তালা লাগানো ঘর থেকে ও বের হল কিভাবে এটাই তো বুঝতে পারছিনা, যাদু জানে নাকি?” চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লোকটা।

“যাকগে, সেবা যখন করেছে তখন ঘুমাক, ডাকবনা এখন। তুমিও রেস্ট নাও। আমি একটু দেখি, কোন খাবার আছে নাকি। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে”

এইরে, আমিও তো কিছু খাইনি রাতে, মনে পড়ল সিদ্রার, এখন তো না খেয়েই থাকতে হবে। খালা অবশ্য লোকটাকে উঠতে দিলনা, নিজেই উঠে গেল। একটু পরেই থালায় করে সকালের ভাত তরকারি নিয়ে এসে দিল।

“ভাত? আমি না তোমাকে বলেছি ওকে ভাল খাবারদাবার না দিতে!”

খালা উত্তরে মনে হয় সিদ্রার ডায়রিয়া হওয়ার খবর দিল।

“তাহলে ভালই করেছো, সামান্য ডায়রিয়াতে টুস করে মরে গেলে আমার জ্বালা মিটতোনা। প্রতিশোধ কমপ্লিট হতনা। আমি ওকে তিলেতিলে মারব। আমাকে দেয়া কষ্টগুলো শতশত গুণ করে আমি ওকে ফিরিয়ে দিব”

আরো কিছু বলুক, কোন কষ্ট কিসের কষ্ট, সব খুলে বলুক লোকটা, মনেপ্রাণে চাইছে সিদ্রা। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আর কিছু বললনা লোকটা।

খাওয়া শেষে বলল, “খালা, আমি পাহারায় থাকছি, তুমি আজ রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমাও।” এই বলে আলমারি থেকে কয়েকটা জিনিস নিয়ে বের হয়ে গেল লোকটা।

খালা থালাবাটি এসব পরিষ্কার করে বাতিটা নিভিয়ে দিল। সিদ্রার গায়ের ওপর কিছু একটা চাপিয়ে দিল। হাত বুলিয়ে দেখল কাঁথা, মুচকি হাসি ফুটে উঠল সিদ্রার ঠোঁটে। খালার মন ওর প্রতি নরম হয়েছে, বুঝল সিদ্রা। আলহামদুলিল্লাহ্‌, পালাতে না পারলেও অনেক বড় উপকার হয়েছে আমার। শব্দে বুঝল, বিছানায় শুয়ে পড়ল খালা। পেটে ক্ষুধা নিয়েও বন্দী জীবনে প্রথমবারের মত মনে প্রশান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সিদ্রা।

***
একটা পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সিদ্রা। চারিদিকে অন্ধকার। সামনেই পূবাকাশে ভোরের আভাস দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে উঠছে চারপাশ। এত সুন্দর দৃশ্য কোনদিন দেখেনি সিদ্রা। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়, সারবেঁধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝ দিয়ে রূপালী ফিতার মত একটা নদী বইছে। ও যেটাতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাই যেন সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভোরের সূর্যোদয়ের দম আটকানো সৌন্দর্য উপভোগ করছে সিদ্রা। সারা পৃথিবী যেন সূর্যের আলোয় আস্তে আস্তে প্লাবিত হচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করল, ও একদম পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আর নিচে অতল খাদ মুখ ব্যাদান করে আছে। আচমকা কে যেন ধাক্কা মারল। পড়তে শুরু করল ও, চিৎকার করে উঠলো সজোরে, কিন্তু নিজে নিজের চিৎকার শুনতে পাচ্ছেনা। স্লো মোশানে নিচে পড়ছে তো পড়ছেই, তল পাচ্ছেনা কোন, এ অবস্থাতেই কেউ একজন ওর হাত ধরল। এসময় ঘুমটা ভেঙে গেল।

আতঙ্কিত হয়ে সোফায় সোজা হয়ে বসল সিদ্রা। পুরো শরীর ঘামে চপচপ করছে। অস্বাভাবিক ভাবে ঘুমানোর জন্য ঘাড় সোজা করতে পারছেনা। কোনমতে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হল সিদ্রা। বুঝলো, তাহাজ্জুদের সময় হয়ে গেছে বলেই ঘুম ভেঙেছে। বাথরুমে যাবার জন্য দরজা খুলতেই দেখল, দরজার বাইরেই লোকটা ওর ওই খাটে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। এমনভাবে যে, খাট না সরিয়ে ওইপাশে যাবার উপায় নেই।

কি করবে বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। লোকটার ঘুম ভেঙে গেলে হয়তো নামাজ পড়াই বাদ হয়ে যাবে। অন্যদিনের মত খাওয়ার পানি দিয়েই বরং অজু করে ফেলি। আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে নিঃশব্দে অজু নামাজ সেরে নিল সিদ্রা। আজকে আর বোকামি করলনা, মোনাজাতও আস্তে আস্তেই করল। তারপর সোফায় বসে জানালার ঠাণ্ডা বাতাসে চোখ বুজল। কি অদ্ভুত জায়গা, ভাবছিল সিদ্রা, যেন দুনিয়ার বাইরে কোথাও। পাখিদের কিচিরমিচির ছাড়া কোন শব্দও শুনতে পাইনা। আজানও শোনা যায়না, লোকালয় মনে হয় অনেক দূরে। জানালা দিয়ে ভোরের আলো প্রবেশ করতেই স্বপ্নের কথা স্মরণ হল সিদ্রার।

ভোরের আলো, তবে কি শিগগিরই মুক্তি পাব আমি! কিন্তু তারপরে তো আবার কে যেন ফেলে দিল খাদের ভেতরে। তাহলে কি আরো বড় বিপদে পড়ব? আবার কেউ একটা হাতও ধরল। কিন্তু পড়তে পড়তে হাত ধরলেই বা কি, বাঁচাতে তো পারবেনা। আদৌ কি কোন তাবীর আছে এ স্বপনের, নাকি পুরোটাই আমার কল্পনা, কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলনা সিদ্রা।

দরজা খুলে লোকটা ঘরে ঢুকতেই স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে এল সিদ্রা, তাকাল উনার দিকে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা চেহারা, মাথার চুল পুরো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে, একটু হাস্যকর আর বোকাবোকা দেখাচ্ছে লোকটাকে। সিদ্রাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যেন একটু বিব্রত হল লোকটা। কিছু না বলেই বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দিল বাইরে থেকে। এসবে এখন অভ্যস্ত সিদ্রা, আর কিছুই মনে হয়না। আর কালকের পর কেন যেন মনের বিশ্বাস বেড়েছে, পালাতে পারবে ও।

***
চুলায় ভাতের পাতিল বসিয়ে তরকারি কাটছে সিদ্রা। লোকটা হুকুম দিয়েছে, আজকে রান্নাবান্না সব কাজ সিদ্রা করবে। খালা অবশ্য আপত্তি করছিল, বুঝতে পেরেছে সিদ্রা, কিন্তু লোকটা মানেনি। সকালের নাস্তায় সবাই চা মুড়ি খেয়েছে, অবশ্যই চা টা সিদ্রাকেই বানাতে হয়েছে।

রান্না না করলেও মাঝে মাঝে আম্মুকে হেল্প করতো সিদ্রা। তরকারি কাটতে জানি, রান্নাও হয়ত করতে পারব। কিন্তু আমি এসব করছি কেন? আলু কাটতে কাটতে ভাবল ও। একজন অসুস্থ মানুষের জন্য রান্না করছি, নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিল সিদ্রা।

আজকে চুলা জ্বালাতে আগের দিনের মত কষ্ট হয়নি। লোকটা সেই আগের দিনের মত চেয়ারে আয়েশ করে বসে পা দুটো টেবিলে তুলে দিয়েছে। তবে পার্থক্য হল, আজকে সারাক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে না থেকে মোবাইল টিপছে আর মাঝেমাঝে তাকাচ্ছে। মোবাইলটা কোনভাবে হাত করে বাসায় ফোন দিতে হবে, ভাবছে সিদ্রা। কিন্তু আমি কোথায় সেটাই তো জানিনা, কি বলব আমি? অবশ্য আমি কোথা থেকে ফোন করেছি, সেটা হয়ত পুলিশ বের করতে পারবে। কিন্তু মোবাইলটা হাতে পেলে তো!

লোকটা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, ও কিভাবে বের হয়েছে ঘর থেকে। ও কোন উত্তর দেয়নি। বলে দিলেই যে জানালাটা আর থাকবেনা সেটা ও ভালই বুঝতে পারছে। লোকটা আর জোরাজোরি করেনি তখন, কিন্তু পরে আবার জানতে চাইবে বলে মনে হয়েছে সিদ্রার।

“মহারাণী, চুলা তো নিভে গেল” লোকটার কথায় বাস্তবে ফিরে আসল সিদ্রা।

চলবে।