যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-১+২

0
924

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

১.
পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙল সিদ্রার। কি ব্যাপার? ঢাকা শহরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙা তো কল্পনাই করা যায়না। অভ্যাসবশত আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যাথায় আহ করে উঠলো। খেয়াল করে দেখে বিছানার রেলিঙ এর সাথে হাতদুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানেও একই অবস্থা। এবার ঘুমটা যেন এক চটকায় ছুটে গেল। চোখ বুলাল চারিদিকে। এটা তো ওর ঘর না, এমনকি কোনদিন এমন আজব ঘর দেখেছে বলেও মনে পড়ছেনা। ঘরের দেয়াল কাঠের, চাল টিনের, মেঝেটা আবার পাকা। কোথায় আমি? এখানে কিভাবে আসলাম? ভাবতে গিয়ে আস্তে আস্তে সবটা মনে পড়তে লাগল।

প্রতিদিনকার মত হেঁটে মাদ্রাসায় যাচ্ছিল সিদ্রা। বাসা থেকে মাদ্রাসা মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা। সকালবেলার মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে ওর বেশ লাগে। বড় রাস্তার ভীড় এড়ানোর জন্য যে শর্টকাটটা ও ব্যবহার করে, সেখানে এই সময়ে কেউ থাকেনা বললেই চলে। যদিও ফাঁকা গলিতে একটু ভয় লাগে, কিন্তু গলিটা পার হতে ১ মিনিটের বেশি লাগেনা। গলিতে ঢুকতেই হঠাৎ একটা গাড়ি এসে ওর একদম গা ঘেঁষে ব্রেক করে। চমকে দাঁড়িয়ে যায় ও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রাইভিং সিট থেকে এক লোক নেমে এসে ওর মুখের ওপর একটা কিছু চেপে ধরে। তারপরেই আর কিছু মনে নেই।

এখন বুঝতে পারছে ওইটা ক্লোরফরম ভেজানো কিছু ছিল। আমাকে কি কেউ কিডন্যাপ করেছে? কিন্তু কিডন্যাপ তো ছোট বাচ্চাদের করা হয়। আমার মত একটা ২০ বছরের মেয়েকে কেউ কেন কিডন্যাপ করবে। তাহলে কি………. ভয়াবহ সম্ভাবনাটার কথা চিন্তা করে শিউরে উঠলো সিদ্রা। শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখে বোরকাটা গায়ে আছে কিন্তু মাথা ফাঁকা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও স্কার্ফটা চোখে পড়লনা। আল্লাহ্‌ জানে কতজন ওকে এই বেপর্দায় দেখে ফেলেছে, সবার প্রথমে এই চিন্তাই আসল মাথায়। আসবেনা কেন, সেই এতটুকু বয়স থেকে বোরকা পরে। নেকাব পরে ক্লাস ফাইভ থেকে। কোনদিন কোন পরপুরুষ ওর হাতগুলাও দেখেনি, চেহারা তো দূরের কথা! সেখানে ও এই বেশে কোথায় না কোথায় পড়ে আছে ভেবে এই প্রথম কান্না পেল ওর।

হাত পা মোচড়ামুচড়ি করে বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু হাত পায়ে লাল লাল দাগ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপকারই হলনা। বাধ্য হয়ে থামতে হল। আস্তে আস্তে ডাক দিল, “কেউ আছেন? ……আমাকে খুলে দিননা…..কেউ কি আছেন…..কেউ শুনতে পাচ্ছেন…..প্লিজ আমাকে বাঁচান……” ভয়ে গলার স্বর উঁচু হচ্ছেনা। কেউ আসছেনা দেখে আস্তে আস্তে গলার আওয়াজ বাড়াল। আরেকবার ভাল করে তাকাল ঘরটার দিকে। ওর নিজের ঘরের চার ভাগের একভাগ ঘরটার সাইজ। মেডিকেলের বেডের মত একটা খাটে ও শোয়া। খাট ছাড়াও একটা সস্তা কাঠের আলমারি আর একটা স্টিলের ট্রাংক চোখে পড়ল। মাথার দিকে আর ডান দিকে ছোট ছোট দুটো জানালা। পাল্লাগুলো খোলা, ঘন সবুজ গাছ দেখা যাচ্ছে, এতই ঘন যে উপরে আকাশও দেখা যাচ্ছেনা। ঘরের একটামাত্র দরজা, বন্ধ।

বাবা-মা আর বোনের কথা মনে পড়ল। বাসায় নিশ্চয় সবাই খুব টেনশন করছে। আম্মু-আব্বুর প্রেসার নিশ্চয় হাই হয়ে গেছে। চারদিক নিশ্চয় পাগলের মত ওকে খুঁজছে। কিন্তু আমি কোথায়? আমাকে যখন কিডন্যাপ করেছে, তখন কেউ কি দেখেনি, ভাবল ও। কিন্তু ওই সময় রাস্তার ওই অংশটা একদম ফাঁকা থাকে। ভয়ে আর আশংকায় বুক কাঁপতে লাগল ওর।

এসময় হঠাৎ দরজাটা নড়ে উঠল। দুচোখভরা আতঙ্ক নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল সিদ্রা। দরজা খুলে প্রবেশ করল এক অচেনা লোক। গুণ্ডা টাইপের কাউকে দেখবে এমন চিন্তা ছিল ওর। কিন্তু প্রথম দর্শনে লোকটাকে আর যাই হোক, গুন্ডা লাগছেনা। দেখতে ভয়ংকর না হলে কি হবে, লোকটার চোখ দুটোতে যেন রাগ আর কৌতুক খেলা করছে। নিজের অবস্থার কথা স্মরণ হতেই কুঁকড়ে গেল সিদ্রা। বন্দী অবস্থার থেকে ওর বেপর্দা অবস্থা ওকে বেশী পীড়া দিচ্ছে।

“বাহ! ঘুম ভেঙেছে দেখছি।” কৌতুকের স্বরে বলল লোকটা। লোকটার পেছনে একটা মহিলাও ঢুকল ঘরে, অনেকটা ওর বড় খালার বয়সী। চোখ দিয়ে ইশারা করতেই মহিলাটা এসে ওর হাতের বাঁধন খুলে দিল। উঠে বসেই ও জিজ্ঞেস করল,

“আপনি কে? আমাকে কেন ধরে এনেছেন?”

“আস্তে…..’ হিশিয়ে উঠলো লোকটা, “এত তাড়া কিসের! সারাজীবন তো পড়ে আছে কথা বলার জন্য”

মাথাটা চোঁ করে ঘুরে উঠলো সিদ্রার। কি বলছে লোকটা! সারাজীবন মানেটা কি!!

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

২.

“কি বলছেন এগুলো আপনি? সারাজীবন মানে?”

“অত স্বপ্ন দেখার কিছু নাই। ভাবিসনা যে তোকে আমি ভালবেসে বিয়ে করার জন্য তুলে এনেছি। তোর মত মেয়েকে ভালবাসার থেকে একটা সাপকে ভালবাসাও ভাল।”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সিদ্রা। একটা অপরিচিত লোক তার সাথে তুইতোকারি করছে! কিন্তু কেন?

“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি কোন অপরাধ করেছি। কি করেছি আমি?”

“তুই জানিসনা তুই কি করেছিস? ন্যাকামো হচ্ছে আমার সাথে? ওই ন্যাকামি দিয়ে তুই তোর প্রেমিকদের ভুলাতে পারবি, আমাকে না”

লোকটার কি মাথা খারাপ নাকি! যে কোনদিন কোন ছেলের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলেনা, তার আবার প্রেমিক!!

“আপনি এসব কি বলছেন, আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছিনা। কিসের প্রেমিক!?

লোকটা যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। এগিয়ে এসে ঠাস করে একটা চড় মারল ওর গালে।

“ঢং! ফিডার খাস নাকি!! রাতদিন ছেলেদের সাথে প্রেম করে বেড়িয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কিসের প্রেমিক!!! যেন দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। আমি মিথ্যা কথা একদম পছন্দ করিনা। একেকটা মিথ্যা বলবি তো এভাবেই চড় খাবি” চোখ-মুখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে লোকটার।

ঘটনার আকস্মিকতায় সিদ্রা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর মনে হল ও একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। চোখ খুললেই দেখবে বোনের সাথে বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু চোখটা যে কেন খুলছেনা, আর দেখতে চায়না ও স্বপ্নটা। লজ্জায় আর অপমানে দুচোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল।

“আবার কাঁদছিস! কাঁদ যত ইচ্ছা। কিন্তু ভাবিসনা তোর কান্না দেখে আমি গলে যাবো। অনেকজনকে ভুলিয়েছিস, আর যেন না পারিস, সেজন্যই তো ধরে নিয়ে এলাম। দেখি এবার, গাছগাছালি আর পশুপাখিদের কেমন ভোলাতে পারিস। কিন্তু ওরা মনে হয় তোর রূপ দেখে ভুলবেনা” হো হো করে হেসে উঠলো লোকটা।

আর সহ্য করতে পারলোনা সিদ্রা।
“চুপ করেন!” ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল, “তখন থেকে কিসব আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছেন!! কার প্রেমিক, কিসের প্রেমিক। আমার কোন প্রেমিক ট্রেমিক নাই। আপনার কথার আগামাথা আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। আপনার কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। আমি এমন মেয়ে নই।”

“নারে, আমার কোথাও কোন ভুল হয়নি।” ডান হাত দিয়ে ওর গালদুটো জোরে টিপে ধরলো লোকটা, ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো ও।

“তুই যত না না করছিস, আমার বিশ্বাস ততই পাকা হচ্ছে যে আমি ঠিক মেয়েকেই তুলে এনেছি। এবার থাক এখানে, মিস সিদ্রাতুল মুনতাহা”

একদম চমকে গেল সিদ্রা। লোকটা ওর পুরো নাম ঠিক ঠিক বলেছে!

“তোর পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে, এবার সেই সব পাপের শাস্তি আমি তোকে দিব। এমন শাস্তি দিব যে তুই কল্পনাও করতে পারছিসনা”

“আপনি ভুল করছেন। আমি……… এই যে, শুনেন, আমার কথাটা শুনেন , এই যে……” ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।

সিদ্রা যেন বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মাথা কাজ করছেনা ওর। লোকটা অন্য কারো সাথে ওকে গুলিয়ে ফেলছে, নাকি লোকটা আসলে পাগল! কিসব আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে। রাতদিন ছেলেদের সাথে প্রেম, রূপ দেখিয়ে ভোলানো, ছি!

পায়ে কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল সিদ্রার। মহিলাটা ওর পায়ের বাঁধন খুলে দিচ্ছে। কিন্তু মহিলাটার চোখের দিকে চাইতেই চমকে উঠলো ও। একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে, যেন কোন নোংরা জিনিসে অনিচ্ছা সত্বেও হাত পড়েছে।

“আমাকে প্লিজ ছেড়ে দেন। বাসায় সবাই চিন্তা করছে। ওই লোকটা যা বলছে সেগুলা সত্যি না। আমি ভাল মেয়ে, ওইসব কিছুই আমি করিনি, করতে পারিনা। আমাকে বিশ্বাস করেন প্লিজ।” মহিলাটার হাত ধরতে গেল ও।

এক ঝটকায় হাত সরিয়ে অগ্নিদৃষ্টি হানল মহিলা ওর দিকে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খাট থেকে নামল সিদ্রা। অনেক্ষণ একভাবে থাকায় পায়ে সাড় পেতে সময় লাগল। নিচে ওর স্কার্ফটা পড়ে থাকতে দেখল। উঠিয়ে নিয়ে মাথায় পরল সেটা। ঘর থেকে বেরোতে যাবে, মহিলাটা আবার ঢুকল, হাতে একটা থালা। ও বের হতে যাচ্ছিল বুঝতে পেরে রেগে গেল মহিলা। ওর হাত ধরে ঘরের ভেতরে টানতে লাগল। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল সিদ্রা, বারবার ছেড়ে দেয়ার জন্য কাকুতিমিনতি করতে লাগল। মহিলা এক ঝটকা টানে ওকে বিছানায় ফেলল। হাতের থালাটা বিছানায় রেখে হাত নেড়ে আর চোখ ঘুরিয়ে কি জানি বোঝাতে চাইল ওকে।

“আপনি কথা বলছেননা কেন? বোবা নাকি!?” মহিলাটা যেন মুহূর্তের জন্য আহত হল ওর কথা শুনে। হাত নেড়ে আবার ইশারা করল আগের মত। মাঝে একবার দড়ি দিয়ে হাত বাঁধার মতও করল। এবার বুঝল সিদ্রা, ঘর থেকে বের হতে চাইলে ওকে বেঁধে রাখা হবে। মহিলা তার মানে আসলেই বোবা, কিন্তু কালা না।

তবে মহিলা ওর বোঝা না বোঝার ধার ধারলনা। অবজ্ঞার একটা দৃষ্টি হেনে মুখ ঘুরিয়ে দরজা টেনে বের হয়ে গেল। ছুটে গেল ও, দরজা ধাক্কাতে লাগল জোরে জোরে, “আমার কথা শুনেন। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দেন। আমি কিছু করিনি, প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করেন, প্লিজ। খালা, আমার কথা শুনেন খালা, আমাকে প্লিজ বের হতে দেন। আমাকে বাসায় যেতে দেন, প্লিজ। আমি কিছু করিনি, আমাকে বিশ্বাস করেন।”

বাইরে তালা লাগানোর শব্দ শোনা গেল। তবু থামলনা সিদ্রা, দরজা ধাক্কাতেই থাকল, সাথে মুখে অনুনয় বিনয় তো আছেই। ওর মনে হচ্ছিল, ও রিকোয়েস্ট করলে, বুঝিয়ে বললেই হয়ত ওর কথা বিশ্বাস করবে। কিন্তু কেউ আসলনা। কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে গেল সিদ্রা। তাও দরজার পাশে বসে গিয়ে আস্তে আস্তে ক্ষীণ স্বরে ডাকতেই থাকল। যখন বুঝল ওর ডাক শোনার মত কেউ নেই, তখন বাধ্য হয়ে থেমে গেল। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা ও, হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল। একটু পর মাথা উঠিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
“আল্লাহ্‌! আল্লাহ্‌ গো!! এসব কি হচ্ছে আল্লাহ!!! আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আল্লাহ, তুমি আমাকে বাঁচাও, এ বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা কর তুমি, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা” এভাবে আল্লাহ্‌কে ডেকে ডেকে কেঁদে চলল সিদ্রা। একটু পরে আব্বু আম্মুর কথা মনে পড়ল, তাতে কান্না আরো বেড়ে গেল ওর। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।