যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-৩+৪

0
516

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৩.
এবার সিদ্রার ঘুম ভাঙ্গল লাত্থি আর চিৎকারে। কেউ একজন ক্রমাগত লাত্থি মারছে ওকে। সাথে বলছে, “ওঠ! তোকে কি আমি আরামে ঘুমানোর জন্য এনেছি। এ অবস্থাতেও তোর ঘুম আসছে, না?”

শোয়া থেকে তাড়াতাড়ি উঠে গুটিসুটি মেরে দেয়ালের দিকে সেঁটে গেল সিদ্রা। লোকটা ওর মুখের সামনে উবু হয়ে ওর গালদুটো ডান হাত দিয়ে টিপে ধরল।

“তা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাকে স্বপ্নে দেখছিলি? আমিও একটু শুনি”

আ! করে অস্ফুট আর্তনাদ করে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল ও, পারলো না। লোকটা এবার মুখ ছেড়ে খাটের ওপর থালার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “খাসনি কেন?”

“আমি খাবনা, আমি বাসায় যাব”

হো হো করে হেসে উঠলো লোকটা।
“বাসায় যাবি? এটাই এখন থেকে তোর বাসা। চুপচাপ খেয়ে নে”

“আমি খাবনা” আরো শক্ত কন্ঠে বলল সিদ্রা। নিজের কন্ঠস্বরে নিজেই চমকে গেল ও।

“শোন, ভাল কথা বলছি, যখন খেতে দিব, চুপচাপ খেয়ে নিবি। আমি অবাধ্যতা পছন্দ করিনা”

থালাটা ঠেলে দিল ওর দিকে। অবাক হল সিদ্রা, ওর ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু এমন অবস্থায় মানুষের ক্ষুধা কিভাবে লাগতে পারে, সেটাই ও বুঝতে পারলনা। লাগুক ক্ষুধা, খাবনা আমি, স্থির করল ও।

“আমি খাবোনা। আমি বাসায় যাবো। আমাকে ছেড়ে দেন। আপনি কেন ধরে এনেছেন আমাকে?”

“এক কথা বারবার বলতে ভাল লাগেনা আমার। বলেছি তো, কথা বলার অনেক সময় পাবি। এখন আগে খা।“ আবার রেগে যাচ্ছে লোকটা। “নাকি খাবার পছন্দ হয়নি, পোলাও বিরিয়ানি দিতে হবে নাকি তোকে?”
সিদ্রা এবার থালার দিকে নজর দিল। বাসি পান্তা, অর্ধেকটা পেঁয়াজ আর একটা কাঁচামরিচ। পান্তার টক গন্ধ এখান থেকেই পাচ্ছে।

“আমি খাবো না। পোলাও-বিরিয়ানি দিলেও না। আমাকে ছেড়ে না দিলে আমি কিছুতেই খাবো না।“ জেদ চেপে গেছে ওর।

“খাবিনা? দেখি তুই কেমনে না খাস।“ ডাক ছাড়ল লোকটা, “খালা, ও খালা!”

খালা ঘরে ঢুকতেই কৌতুকের স্বরে বলল, “আমাদের সম্মানিত অতিথিকে একটু আপ্যায়ন করেন, খেতে চাইছেনা যে”

মহিলা মাথা ঝাঁকিয়ে ওর সামনে বসল, থালা হাতে নিয়ে ভাত মাখল। লোকমা তুলতেই ও দু হাত দিয়ে পেছনে হটল। মহিলা বাম হাত দিয়ে ওর গাল ধরে মুখ ফাঁক করার চেষ্টা করতেই ও দুহাত দিয়ে মহিলার হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে লাগল। ওদের ধস্তাধস্তি দেখে লোকটা এসে এক হাত দিয়ে ওর দুহাত পেছনে নিয়ে ধরে রাখল, আর আরেক হাতে চুলের মুঠি ধরল, আর মহিলা ওর মুখ ফাঁক করে একগাদা ভাত ঠুসে দিল। হঠাৎ করে টক ভাত গলায় চলে যাওয়ায় ওয়াক করে উঠল ও। থু করে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতেই দ্বিতীয়বারের মত চড় খেল সিদ্রা। এবারেরটা এত জোরে ছিল যে, ওর কান ঝাঁ ঝঁ করতে লাগল। মাথাটাও বোঁ করে ঘুরে উঠলো। রাগের চোটে থু করে ফেলে দিল ভাতগুলা। সাথে সাথে লোকটা ওর দুইগালে কয়টা যে চড় মারল, ও নিজেও বলতে পারবেনা। দুর্বল শরীর আর নিতে পারলনা, জ্ঞান হারাল সিদ্রা।

সিদ্রাকে নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখে হুঁশ ফিরল যেন লোকটার। ছেড়ে দিল চুলের মুঠি আর হাত। খালাকে বলল পানি আনতে। পানি আনলে পুরো জগের পানি সিদ্রার মুখের ওপর ঢেলে দিল। জ্ঞান ফিরতেই হকচকিয়ে গেল ও। এদিক ওদিক তাকিয়ে পুরো পরিস্থিতি বুঝতে খানিকটা সময় লাগল ওর।

লোকটা খালাকে আবার ইশারা করল। খালা এসে ওর মুখে আবার ভাত ঠুসে দিল। আর কোন জোরজবরদস্তি করলনা সিদ্রা, চুপচাপ গিলে ফেলল। আসলে ইচ্ছা না থাকলেও জোর করার মত শক্তি অবশিষ্ট নেই।

পান্তাভাত এর আগে সিদ্রা কখনো খায়নি, তা না। উল্টো আলুভাজি আর মুরগির গোস্ত দিয়ে পান্তা ওর খুবই পছন্দের। বাসায় রাতের খাবারে এ দুটো আইটেমের কোনটা থাকলেই ও আম্মুর কাছে পান্তাভাত রাখার জন্য বায়না করে। কিন্তু এত দুর্গন্ধযুক্ত আর টক পান্তা, মানুষ কেন, কোন পশুও মনে হয় খেতে পারবেনা। অনেক কষ্টে বমি আটকে রাখল সিদ্রা।

আম্মুর কথা মনে পড়তেই চোখ দিয়ে অটোমেটিক পানি বের হয়ে গেল। কারো হাতে ভাত খাইয়ে নিতে সিদ্রা খুবই ভালবাসে। আম্মুর কাছে মাঝেমাঝেই খাইয়ে নেয়ার আবদার করত, আর সবসময় বোনটাও এসে তাল মেলাত। অথচ আজকে ও না চাইতেই ওকে কেউ খাইয়ে দিচ্ছে, কিন্তু দুইটার মধ্যে কতইনা তফাৎ। ওইটাতে থাকে আদর-ভালবাসা, আর এ মহিলার চোখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছেনা।

লোকটার দিকে তাকিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বিছানায় বসে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন কোন সার্কাস পার্টি হচ্ছে, আর সেটা দেখে উনি খুব মজা পাচ্ছেন। একটা ঘুষি মেরে লোকটার নাকমুখ ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ও জানে, ওর দ্বারা এটা করা এককথায় অসম্ভব!

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৪.
খাওয়া শেষ হতেই লোকটা খালার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই খালা বের হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই হাতে করে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ঢুকলে লোকটা বলল, “মেঝেটা পরিষ্কার কর। এবারের মত শাস্তি মাফ করলাম। এরপর সময়মত না খেলে আর কথা না শুনলে তোর কপালে বহুত দুঃখ আছে।”

এমনিতে যেন কত সুখে আছি! ভাবল সিদ্রা। তর্ক করতে ইচ্ছে করছে ওর, কিন্তু চড়-থাপ্পড়্গুলোর কথা মনে পড়তেই চুপচাপ ন্যাকড়াটা নিয়ে মেঝেটা মুছে দিল। লোকটা আবার ওর গায়ে হাত দেক, চায়না ও। মুছার পর খালা ন্যাকড়াটা নিয়ে চলে গেল। লোকটা উঠে দাঁড়াল।

“আজকের মত তোর শাস্তি এটুকুই। রাতে খাবার দিবে, খেয়ে নিবি। কাল থেকে শুরু হবে তোর নতুন জীবন!”

দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই ডুকরে কেঁদে উঠল সিদ্রা। কাঁদতে কাঁদতে ওই বেশেই সেজদায় পড়ে গেল, আর আল্লাহর কাছে কাঁদতে শুরু করল। এটা ওর বহুদিনের অভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই ও একটু চাপা স্বভাবের। সবার সাথে তেমন মিশতে পারেনা বলে বন্ধুত্ব্বও হতনা সহজে। এমনকি আপন বোনের সাথেও মন খুলে কথা বলতে পারতো না, কারণ দুইজনের প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। তখন থেকেই মনের কথা আল্লাহর সাথে শেয়ার করা শুরু। মাদ্রাসায় কিংবা অন্য কোথাও, কেউ কিছু বললে বা করলে তখনকার মত নিজেকে সামলে নিয়ে বাসায় এসে সোজা জায়নামাজ নিয়ে বসে যেত। কখনো মোনাজাতে কখনো সেজদায়, কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহ্‌র কাছে বিচার দিত। এজন্য বোনের কাছে কাঁদুনি বুড়ি উপাধি পেয়েছে।

যখন বুঝতে শিখল যে কারো খারাপ চাইতে নেই, তখন থেকে শুধু নিজের কষ্টগুলোই বলতো, অভিযোগ করতো না। আর যে ওকে কষ্ট দিয়েছে, তার হেদায়াতের জন্য দোয়া করতো। কারণ একবার আল্লাহকে সবকিছু খুলে বলার পর আর কোন কষ্টই যেন থাকতো না। বড় হয়ে কয়েকটা বান্ধবী হলেও আল্লাহর সাথে কথা বলার এই অভ্যাস ওর থেকেই গেছে।

হঠাৎ খেয়াল হল সিদ্রার, নামাজ! কালকে থেকে পুরো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অলরেডি কাজা হয়ে গেছে। জানালার আলো অনেক কমে গেছে, তার মানে আর দেরী করলে আজকের যোহরও কাজা হয়ে যাবে। তলপেটেও চাপ অনুভব করল, বাথরুমে যাওয়াও দেখি ফরজ, ভাবল ও।

আবার দরজা ধাক্কানো শুরু করল সিদ্রা। “খালা, আমি বাথরুমে যাবো, দরজা খুলেন। খালা, ও খালা!”
দরজা খুলে যেতেই উঠে দাঁড়াল সিদ্রা। খালা ওর দিকে তাকিয়ে যেন বুঝার চেষ্টা করল, ও নাটক করছে নাকি সত্যি বলছে। কিন্তু সিদ্রার ঠোঁট কামড়ে বাথরুম চেপে রাখার চেষ্টা দেখে যেন বিশ্বাস করল, হাত শক্ত করে ধরে বাইরে নিয়ে আসল ওকে।

ঘরের বাইরে একটা বারান্দার মত। একপাশে চালা আর কাঠ দিয়ে ঘেরা। সেখানে চুলা আর হাঁড়ি-পাতিলসহ রান্নার জিনিসপত্র রাখা। আর ও যে ঘরে ছিল তার পাশে আরেকটা ঘর। এছাড়া আশেপাশে আর কোন ঘর নেই। চারদিকে তাকিয়ে ঘন গাছপালা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলনা সিদ্রা। এমনকি সূর্যের আলোটাও ঠিকমতো আসছেনা। কোথায় আছি আমি? ঢাকায় থাকার কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনা। গাজীপুর কি, নাকি আরো দূরে কোথাও!

মহিলা ওকে নিয়ে আসল চালার পেছনদিকে। সেখানে চালার তৈরি আরেকটা ছোট ঘর দেখা গেল। ভেতরে ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে দিল মহিলা। এত ছোট আর নোংরা বাথরুম কোনদিন দেখেনি সিদ্রা। একটু আগে খাওয়া টক পান্তা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোনমতে সামলাল ও নিজেকে। একটা বালতিতে পানি আর একটা মগ রাখা। কোনমতে নিজের কাজ শেষ করে বাইরে এসে বুকভরে দম নিল ও।

মহিলাকে বলল, “আমি অজু করব, ভাল পানি কোথায় পাবো?”

মহিলা ওর কথা শুনে একটা তাচ্ছিল্যমার্কা হাসি দিয়ে ওকে রান্নার জায়গায় টেনে আনল। সেখানে রাখা ড্রাম থেকে পানি দিল ওকে। একজন গায়রে মাহরাম (যাদের সাথে পর্দা ফরজ) ওর গায়ে হাত দিয়েছে ভেবেই গা কেমন ঘিনঘিন করছিল সিদ্রার। গোসল করলে ভাল হত। কিন্তু ড্রামে পানির পরিমাণ দেখে, আর নামাজের কথা ভেবে বাদ দিল গোসলের চিন্তা। অজু করা শেষে পশ্চিম কোনদিকে জিজ্ঞেস করল ও। মহিলা আবার সেই একই রকম হাসি দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিল। মহিলার বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য দেখে আবার জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হল,
“আপনারা কি চান বলেনতো? আমি বুঝতে পারছিনা, এমন কেন করছেন আপনারা আমার সাথে? আমি কি একটা ক্রিমিনাল নাকি!” মহিলা কিছু বললনা, কিন্তু চোখের দৃষ্টি এত ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে ভয় পেল সিদ্রা। মহিলা ওর হাত ধরে জোরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর যথারীতি দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।

বাপরে বাপ! এই বয়সেও মহিলার গায়ে কি জোর, কি খায় কে জানে। নিজের চিন্তার ধরণ দেখে মনে মনে হাসল সিদ্রা। বন্দীখানায় বসে, যে ওকে বন্দী করে রেখেছে তার খাওয়ার কথা চিন্তা করছে! এও সম্ভব!!

যাকগে, আগে নামাজটাতো পড়ি, ভাবল ও। বোরকা খুলে স্কার্ফটা মাথায় পেঁচিয়ে খালি মেঝেতেই দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে যোহর, আর তারপর সিরিয়ালি কাজা নামাজগুলো আদায় করল। তারপর হৃদয়ের সমস্ত আকুতি নিয়ে এ বিপদ থেকে মুক্তি পাবার জন্য অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করল সিদ্রা। মোনাজাত শেষে সবসময়ের মত এত হালকা লাগল ওর, মনে হল আল্লাহ্‌ ওর সব সমস্যা দূর করে দিবেন। কিন্তু বেচারি সিদ্রা! ও জানেনা, আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা!!