যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-২৫+২৬

0
361

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

২৫.
“কার কথা বলছেন?” সচকিত হল রাইয়্যান, দেখেনি সিদ্রাকে, ও তখন মনযোগ দিয়ে সই করছিল।

“থ্রিপিস পরা একটা মেয়ে মনে হল, চেহারা দেখতে পাইনি” সিদ্রার মনে হল ও শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছে, আজই মনে হয় মুনিরার জীবনের শেষ দিন। হায় আল্লাহ্‌! এটা কি করলাম আমি!!

“ও, উনি আপনাদের ম্যাডাম, আমার ওয়াইফ” এক মুহূর্তও দেরী না করে উত্তর দিল রাইয়্যান।

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলনা সিদ্রা, অসাড় হয়ে গেল গোটা শরীর, চায়ের কাপটা পড়ে গেল হাত থেকে। কাপ পিরিচ ভাঙার শব্দে বুঝতে পারল রাইয়্যান, সিদ্রা শুনে ফেলেছে ওর কথা। ম্যানেজার আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, রাইয়্যান বলল, “সবকথা পরে বলবো, এখনকার মত আপনি যান” প্রায় মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে রাইয়্যান ছুটে এল রান্নাঘরে। দেখল, সিদ্রা দাঁড়িয়ে আছে চায়ের সাগরে, রাগে কাঁপছে থরথর করে, চোখে পানি। ভাঙা কাপ পিরিচে পা কেটে রক্ত পড়ছে, কোন খেয়াল নেই ওর। গরম চা পড়েছে সেজন্য আগে ঠাণ্ডা পানি দিবে, নাকি তাতে আবার কাটার ক্ষতি হবে, বুঝতে পারছেনা রাইয়্যান।

রাইয়্যান কাছে আসতেই শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ওর গালে একটা থাপ্পড় মারল সিদ্রা। এবার আর আগেরবারের মত মনে হলনা, এ আমি কি করলাম! মনে হল, যা করেছি ঠিক করেছি, আরো আগে করা উচিত ছিল।

“ওই!” রাগে হিসিয়ে উঠলো রাইয়্যান। উলটো চড় কষানোর জন্য হাতটা তুলেও অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত করল ও, “শুধু এই এক্সিডেন্টটা করেছিস বলে বেঁচে গেলি”

“কেন? বাঁচাবেন কেন? মারুন, মেরে ফেলুন আমাকে। তিলেতিলে মরার থেকে একবারে মরে যাওয়া ভাল। মারুন আমাকে, মারুন” পাগলের মত চিৎকার করে কথাগুলো বলল সিদ্রা।

“একদম চুপ! কোন কথা না। আর একটা কথা বললে সত্যি সত্যি খুন করে দিব” এই বলে সাবধানে সিদ্রাকে কোলে তুলে নিল রাইয়্যান। হাত পা ছুড়ে যুদ্ধ শুরু করে দিল সিদ্রা, আমল দিলনা রাইয়্যান, ওকে নিয়ে গিয়ে সোফায় শুইয়ে দিল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করে সিদ্রাকে চোখ পাকিয়ে চুপ থাকতে বলল।

“হ্যালো বুবু” কথা শুরু করল রাইয়্যান।

“আচ্ছা, আচ্ছা, ওইসব বিচার তুমি পরে কইরো, এখন আমি একটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনে আছি। গরম চা ভর্তি কাপ পড়ে গেছে পায়ের ওপর, আর ভাঙা কাঁচে পাও কেটে গেছে, কি করব এখন?”

“না না, আমার না, তুমি আগে বলোতো, তারপর জলদি তোমার জিনিশপত্র নিয়ে এখানে আসো” ওপাশের কথা শুনে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওর।

“আরে তাইতো। এখনি করছি। তুমি জলদি আসো”

“আরে বাবা, খালারও না। তুমি এখানে আসো তো আগে, তারপর শুনো” ফোন রেখে রাইয়্যান আবার রান্নাঘরে দৌড়াল।

একটা বাটিতে করে বরফ নিয়ে আসল রাইয়্যান। টি টেবিলটা এগিয়ে তাতে বসে প্রথমে টিস্যু দিয়ে সাবধানে রক্ত মুছতে গেল। সিদ্রা পা সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু এমন একটা অগ্নিদৃষ্টি দিল লোকটা, থেমে গেল ও। রক্ত মুছার পর পায়ের ওপর বরফের টুকরা ধরল। পাটা এতক্ষণ জ্বলে যাচ্ছিল, রাগের চোটে পাত্তা দিচ্ছিলনা সিদ্রা, এখন বরফের ছোঁয়ায় আরাম লাগল। কিন্তু ও বুঝতে পারছেনা, খালাকে না বলে উনি নিজে কেন এসব করছেন।

খালাও রাইয়্যানের দেখাদেখি আরেক পায়ে বরফের টুকরা ঘষতে শুরু করল। রাইয়্যান উদ্বিগ্ন চোখে সিদ্রার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “একটু আরাম লাগছে?”

“আমার আরাম নিয়ে তো কোনদিন ভাবেননি, আজকেও ভাবতে হবেনা। আমার পা পুড়ে গেল কি পচে গেল তাতে আপনার কি? আপনি আমাকে বলেন, আপনি ওই লোকটাকে মিথ্যা কথা কেন বললেন?”

“আমার ইচ্ছা হয়েছে বলেছি। তোকে কোন কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য না”

সিদ্রার মনে হল রাগের চোটে ওর ভেতরটা বার্স্ট হয়ে যাবে, শক্ত করে হাত মুঠো করল ও, আরেকদফা পানি বেরিয়ে এল চোখ দিয়ে।

“বেশি বাড়াবাড়ি করিসনা হ্যাঁ, কান খুলে শুন কি বলছি। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বুবু আসছে। আমি যা যা বলব, তাতে সায় দিয়ে যাবি। বুবু অনেক প্রশ্ন করবে, আমার সাথে তাল মিলিয়ে উত্তর দিবি। যদি কোন কথার উত্তর কি দিবি বুঝতে না পারিস, ব্যথায় কাতরে উঠার ভান করবি। যদি বেফাঁস কিছু করেছিস বা বলেছিস, বিকালের খবরে তোর বোনের মৃত্যুসংবাদ দেখবি। এন্ড আই মিন ইট! কথাটা মনে রাখিস!” সিদ্রার মাথা ফাঁকা হয়ে গেল লোকটার হুমকি শুনে, আর কিছু ভাবতে পারলনা ও।

কথাটা বলাও শেষ হল, আর কলিংবেল বাজল। খালা গেল দরজা খুলতে। খালার সাথে যে মহিলাটা ঢুকল, তাকে যে কেউ এক নজরেই পছন্দ করে ফেলবে। মধ্যবয়সী একজন মহিলা, সুন্দরী বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। হাসিমাখা মুখে এখন চিন্তার ছাপ লেগে থাকলেও কাঁধের একটু নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুলে উনাকে মহিলা কম মেয়ে বেশি লাগছে। চোখে চশমা, গলায় স্টেথোস্কোপ আর গায়ে এপ্রোন। ইনি যে একজন ডাক্তার, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

রাইয়্যান উঠে দাঁড়াল, মহিলাটা এসে রাইয়্যানের জায়গায় বসল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল কিভাবে কি হয়েছে। সব উত্তর দিল রাইয়্যান, সিদ্রা মুখে কুলুপ এটে বসে রইল।

“চা মনে হয় একদম ফুটন্ত ছিলনা, পোড়া নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। এই ক্রিমটা সবসময় লাগিয়ে রাখতে হবে। ধুয়ে বা মুছে গেলেই আবার লাগিয়ে নিতে হবে, ঠিক আছে? কাটাগুলোই শুধু সারতে যা একটু সময় নিবে” দুই পায়ের কাটার উপর ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করার পর একথা বলে মহিলা বেসিনে গেল হাত ধুতে।

আর ঠিক তারপরেই এ যাবৎকালের সবথেকে অদ্ভুত দৃশ্য দেখল সিদ্রা, মহিলা রান্নাঘর থেকে একটা খুন্তি নিয়ে তাড়া করেছে লোকটাকে।

“তুই আমাকে না জানায়ে এতবড় কাজটা করতে পারলি?”

“আরে বুবু, আগে আমার কথাটা শুনো”

“কিসের কথা হ্যাঁ, কিসের কথা? আসার সময় ম্যানেজারের সাথে দেখা না হলে তো জানতেও পারতামনা”

লোকটা দৌড়াচ্ছে আগে আগে, মহিলা পিছে পিছে, এত হাস্যকর একটা দৃশ্য, হাসবেনা হাসবেনা করেও হেসে ফেলল সিদ্রা।

“আরে আমাকে বলার সুযোগটা তো দিবা”

“কবে বলতি তুই? বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পরে বলতি আমাকে?”

“না না, কিযে বলনা। বাচ্চা হওয়ার আগেই বলতাম, নাইলে ডেলিভারি কে করবে?”

এ অবস্থায় এসব নিয়েও মজা করছে, লোকটা কি দিয়ে তৈরি আল্লাহ্‌ মালুম। তবে ইনিও যে কাউকে ভয় করেন, এটা দেখেই শান্তি লাগল সিদ্রার।

সারা ঘরময় দৌড়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি বসিয়ে ক্লান্ত হয়ে মহিলা ক্ষান্ত দিল। দুইজন দুই সোফায় ধপাস করে বসে পড়ল। খালা পানি এনে দিল দুজনকে।

পানি খেয়ে দম নিয়ে মহিলা বলল, “এবার বল, ডিটেইলসে বলবি, কিছু যদি বাদ দিয়েছিস! খুন্তি কিন্তু এখনো হাতে আছে। এই মেয়ে, তুই কিন্তু ধরিয়ে দিবি, ও যদি কিছু বাদ দেয়” সিদ্রার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল মহিলা। হালকা মাথা নেড়ে সায় দিল সিদ্রা, যদিও জানেনা লোকটা কি বলবে।

শুরু করল রাইয়্যান, “ওর নাম সিদ্রা, সিদ্রাতুল মুনতাহা। ফেসবুকে আলাপ আমাদের। তারপর যা হয়, বন্ধুত্ব ভালবাসা এই আর কি। কিন্তু হঠাৎ করে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। তখন ও বাসায় বলে আমাদের কথা। কিন্তু ওর ফ্যামিলির আমাকে পছন্দ হয়নি। তাড়াহুড়ো করে কালকে রাতেই বিয়ে ঠিক করে ফেলে ওর। কিন্তু আমরা তো একে অন্যকে ছাড়া বাঁচবোনা। তাই ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি”

বুবুর সাথে সিদ্রাও হা করে তাকিয়ে রইল রাইয়্যানের দিকে। লোকটা এমন অবলীলায় এতগুলো কথা বানিয়ে বানিয়ে কিভাবে বলছে! আমি উনাকে ছাড়া বাঁচবোনা বলে উনার সাথে পালিয়ে এসেছি। ইশ! মনে হচ্ছে উনাকে খুন করতে পারলে গায়ের জ্বালা জুড়াবে আমার!!

“বিয়ে করেছিস?”

“হ্যাঁ, কালকেই করেছি, কাজী অফিসে”

“আমার না কেমন ঘাপলা লাগছে, ঢপ দিচ্ছিস না তো? তোকে জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেখলামনা, আর সেই তুই এতদিন ধরে প্রেম করে সোজা বিয়ে করে চলে এসেছিস, কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা”

“কি বল বুবু? আমি কি তোমাকে মিথ্যা বলব? তুমিই বল, কালকের এত ঝামেলার মধ্যে কখন বলতাম তোমাকে? প্লিজ এবারের মত মাফ করে দাও, এরপরে আর এমন হবেনা”

“এরপরে মানেটা কি? তোর কি আরো কয়েকটা বিয়ে করার প্ল্যান আছে নাকি?” ভ্রু কুঁচকে বলল মহিলা।

“আরে না না, কি যে বল। সেকথা বলিনি, বলেছি আর কোনদিন তোমার কাছে কিছু গোপন করবোনা”

কত্তবড় বাটপার, সমানে বানিয়ে বানিয়ে কিচ্ছা শোনাচ্ছে, আবার কথাও দিচ্ছে, ছি ছি ছি ছিহ! মনে মনে বলল সিদ্রা।
“কতদিন ধরে সম্পর্ক তোদের?” সন্দেহ এখনো যায়নি বুবুর।

“পরিচয় হয়েছে, এই ধরো এক বছর” সিদ্রার মনে হল ও অজ্ঞান হয়ে যাবে।

“অসম্ভব! তুই কয়মাস আগেও বিয়ে করতে রাজি হসনি, আর এখন এক বছরের সম্পর্ক হয়ে গেল!?” ভ্রু কুঁচকাল বুবু।

“বিয়ে করতে রাজি হইনি কারণ ও এত ছোট, ওর ফ্যামিলি হয়তো বিয়ে দিতে রাজি হবেনা, তাই”

“কিন্তু ওর কথা বলিসনি কেন আমাদের?”

“কারণ ওর ফিলিংস সম্পর্কে আমি শিওর ছিলামনা, তাই। কি করছো বুবু? এমনভাবে জেরা করছো যেন তোমার কাছে আমি সবসময় মিথ্যে বলি। সত্যি বলছি আমি, বিশ্বাস কর, মাফ করে দাও প্লিজ ”

“হুম, ঠিক আছে, মাফ করলাম। কিন্তু তোর জন্য না, এর জন্য” সিদ্রার কাছে এসে ওর মুখটা দুহাতে ধরল মহিলা। “কি মিষ্টি দেখতে, আমার কিন্তু তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। যাক, এতদিনে যে তোর উসিলায় আমার ভাইটুর মাথায় শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে, তাতেই আমি খুশি। আমরা তো বিয়ের কথা বলতে বলতে হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়” সিদ্রা মুখে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে রাখল, কারণ লোকটা ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।

“তুই করে বলছি বলে রাগ করলিনাতো? ওদের এভাবেই ডাকি আমি, পছন্দ না হলে চেঞ্জ করে নিচ্ছি”

“না না, ঠিক আছে” মহিলার তুই বলার মধ্যে কোন তাচ্ছিল্য নেই লোকটার মতো, বরং বড় বোনের প্রচ্ছন্ন স্নেহ অনুভব করছে সিদ্রা, ভালই লাগছে শুনতে।

“কিন্তু, আমার ভাইটুর মত হীরের টুকরো ছেলেকে কেন কেউ পছন্দ করবেনা, সেটাই তো বুঝলাম না”

“আরে, কি বল তুমি? সিদ্রা কেমন মেয়ে তুমি তো জানোইনা। ও হাফেজা, মাদ্রাসায় পড়ে, হাত মোজা পা মোজা পর্যন্ত পরে। এরকম মেয়ের জন্য কি আমার মত ক্লিনশেভড ছেলেকে পছন্দ করবে ওর ফ্যামিলি? ওরা তো হুজুর টাইপ কাউকে পছন্দ করবে, তাইনা?” শুধু মহিলা না, সিদ্রাও অবাক হয়ে গেছে রাইয়্যানের কথা শুনে। এত কিছু বুঝেন আপনি, শুধু আমাকেই বুঝলেননা। অবশ্য আপনারই বা কি দোষ, দোষ তো আমারই বোনের। হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সিদ্রার ভেতর থেকে।

“তুমি হাফেজা? মা শা আল্লাহ! তোমার মত মেয়ে ওর পাল্লায় কি কিরে পড়লা?”

সিদ্রা কি বলবে বুঝতে পারছেনা, ওকে উদ্ধার করল লোকটা, “বুবু, ওকে এখন একটু রেস্ট নিতে দিলে ভাল হতোনা?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। নে, ওকে উঠিয়ে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দে”

“কি! তুমি ওর ওজন জানো? রান্নাঘর থেকে এখানে আনতেই দম বের হয়ে গেছে আমার। সিঁড়ি বাইতে পারবোনা ওকে নিয়ে”

যে কিনা আমাকে নিয়ে পাহাড়ে উঠানামা করেছে, সে এখন সিঁড়ি বাইতে ভয় করছে, হুহ! আসলে বুবুর সামনে তো এখন আমাকে নিজের ঘরে নিতে হবে, এজন্যই এত টালবাহানা। বেচারা! নিজের ফাঁদে নিজেই ফেঁসে গেছে, মনে মনে হাসল সিদ্রা।

“আমি ঠিক আছি বুবু, সোফায় আরাম লাগছে, সমস্যা নাই। বিছানায় পরে গেলেও হবে, এমনিতেও একা একা ঘরে শুয়ে থাকতে ভাল লাগবেনা” মনে মনে বলল, আপনার কোলে উঠার আমারও কোন শখ লাগেনাই!

“আচ্ছা ঠিক আছে, তাই থাক। তোর সাথে তো ভালো করে আলাপই হলনা, কিন্তু আমাকে উঠতে হবে, সব রোগীরা লাইন ধরে অপেক্ষা করছে। আমি পরে আবার আসব, কেমন?”

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল সিদ্রা।

একটু এগিয়ে আবার ফিরে তাকাল, “আচ্ছা ভাল কথা, কাল কখন ফিরেছিস? বাসর হয়েছে তোদের? নাকি আজ আমি এসে ঘর সাজিয়ে দিব?” দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল মহিলা।

সিদ্রার গালদুটো লাল হয়ে গেল। ধুর! আমি কেন লজ্জা পাচ্ছি, আমি কি আর সত্যি সত্যি উনার বউ নাকি!!

রাইয়্যানও যেন লজ্জা পেল, কিন্তু সামলে নিল মূহুর্তেই, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা, কালকে আসার সময়ই ফুল টুল নিয়ে এসেছিলাম আমি” দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিল লোকটা, দেখে প্রশমিত রাগটা আবার ফিরে এল সিদ্রার।

রাইয়্যান বুবুর ব্যাগ নিয়ে উনাকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিল, ফিরে আসতেই সম্মুখীন হতে হল সিদ্রার প্রশ্নের, “এসব কি করছেন আপনি? আমাকে আপনি মিথ্যাবাদী প্রতারক বলেন না, আপনি নিজে কি? বানিয়ে বানিয়ে কথা বলারও একটা লিমিট থাকে। আপনার কি মনে হচ্ছেনা, আপনি সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন?”

“কই নাতো? সব তো ঠিকই আছে। থিংক ইট এজ ইয়োর গ্রেটেস্ট পানিশমেন্ট! বিয়ে না করেও আমার ওয়াইফের পরিচয়ে বাকি জীবন কাটাবি তুই”

রাগে ক্ষোভে মাথা খারাপ হয়ে উঠলো সিদ্রার, হাতের কাছে থাকলে নিশ্চিত একটা না বেশ কয়েকটা চড় খেত লোকটা ওর হাতে। মনে হয় বুঝেশুনেই সেফ ডিসট্যান্স রাখছে। রাগের চোটে সোফার কুশনটকে কচলাতে লাগলো ও। লোকটা এসে তার পছন্দের সিংগেল সোফাটায় বসল।

“অবশ্য, তোর কাছে আরেকটা অপশন আছে। তুই চাইলে আমি কাজী ডেকে আনতে পারি, সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিতে পারিস আমাকে। তবে তাতে যে তোর লাইফস্টাইলে কোন পরিবর্তন আসবে, তার গ্যারান্টি দিতে পারবোনা”

কুশনটা ছুড়ে মারল সিদ্রা, একদম লোকটার মুখ বরাবর। কিন্তু প্রস্তুত ছিল লোকটা, ধরে ফেলল।

“আপনার মত লোককে বিয়ে করার থেকে সারাজীবন কুমারী থাকব আমি!”

“সে তোর যা ইচ্ছা। শুধু একটা জিনিস মনে রাখিস। আমার ওয়াইফ সেজে থাকবি, সবাই সেলাম ঠুকবে তোকে, তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু…….এই পরিচয়ের সদ থুড়ি বদ্ব্যবহার করে যদি পালানোর ফিকির করিস, তাহলে যে কি হবে, তাতো তুই ভাল করেই জানিস। আমাকে জাস্ট একটা ফোন করতে হবে। যে কষ্ট রাতদিন আমি ভোগ করছি, তার থেকে হাজারগুণ কষ্ট তুই ভোগ করবি। কারণ আমার ভাইকে হারানোর জন্য আমি দায়ী নই, কিন্তু তোর বোনের মৃত্যুর জন্য তুই দায়ী থাকবি! পালাতে হয়তো পারবি এখান থেকে, কিন্তু নিজের বোনের হত্যার দায় নিয়ে জীবন কাটাতে পারবি তো?”

শিউরে উঠলো সিদ্রা বিষয়টা কল্পনা করে। নাহ! এখান থেকে পালানোর কথা কল্পনা করাও সম্ভব না!!

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

২৬.
পায়ের নিচের দিকে কাটেনি বলে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছেনা সিদ্রার, যোহরের ওয়াক্ত হতেই তাই উঠে চলে এল নিজের ঘরে। আসরের নামাজের পর খালা এল ওর কাছে, কিছু লাগবে কিনা জানতে চাইল। সিদ্রা মাথা নাড়ল, খালা চলে না গিয়ে বসল ওর পাশে। ওড়না খুলে চুল আঁচড়ে দিতে লাগল। সিদ্রা বাধা দিল, লোকটা যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। ঘরে ঘুমাচ্ছে উনি, আশ্বস্ত করল ওকে খালা।

চুল আঁচড়ে বেণী গেঁথে খালা ওর মুখোমুখি বসল। ওর হাতদুটো নিয়ে নিজের কোলে রাখল। ইশারায় কি যেন জিজ্ঞেস করল ওকে, বুঝতে পারলোনা সিদ্রা। খালা আবার বোঝাল, তাও বুঝলোনা ও। কয়েকবার চেষ্টার পর বুঝতে পারল সিদ্রা।

“আপনি জিজ্ঞেস করছেন, আমি উনাকে বিয়ে করতে কেন রাজি হলাম না?”

মাথা ঝাঁকাল খালা। হতভম্ব হয়ে গেল সিদ্রা।

“খালা, আপনি আমাকে এ কথা কিভাবে জিজ্ঞেস করতে পারছেন? উনি আমার সাথে যা যা করেছেন এবং করছেন, এরপর আপনি ভাবছেন কি করে যে আমি উনাকে বিয়ে করতে পারি!”

এর উত্তরে খালা যা বোঝাতে চাইলো তা হল, বিয়েই সবথেকে ভাল সমাধান। লোকটা তো কোনদিন ওকে এখান থেকে মুক্তি দিবেনা, সেক্ষেত্রে ওর একটা সত্যিকারের পরিচয় হয়ে যাবে। আর উনি আসলে অনেক ভাল মনের একজন মানুষ, এখন যা করছে সব রাগ থেকে করছে। এক সময় খালার মত উনিও ওকে ঠিক ভালবেসে ফেলবে, তখন আর ওর কোন কষ্ট থাকবেনা।
মনযোগ দিয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল সিদ্রা। খালা একদিক দিয়ে ঠিকই বলেছে, এভাবে প্রতিদিন পর্দার খেলাফ হয়ে যে গুনাহ হচ্ছে, অন্তত সেটা থেকে তো বাঁচা যেত! কিন্তু না, শুধু সেই কারণে ও এই লোককে বিয়ে করতে কিছুতেই পারবেনা। আস্তে আস্তে মাথা নাড়লো ও।

“খালা, উনি বুবুর সামনে যে কথাগুলো বলেছেন, বানিয়ে বললেও সেগুলোই সত্যি। আমি আমার হাজবেন্ড হিসেবে একজন হাফেজ আলেমকেই আশা করি। যদি হাফেজ আলেম নাও হয়, অন্তত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়া, নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা, সুন্নাতি দাড়ি রাখা, পায়জামা পাঞ্জাবি নাইবা পরলো, কিন্তু টাখনুর ওপরে পোশাক পরা ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক জিনিসগুলো তাকে মেনে চলতে হবে। কিন্তু উনার মধ্যে তো আমি এসবের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাইনা খালা।“ একটু থামল সিদ্রা।

“এরকম কাউকে বিয়ে করার জন্য কি প্রতিদিন মোনাজাতে “রব্বানা হাবলানা মিন আঝওয়াজিনা, ওয়া জুররিয়্যাতিনা, ক্বুররতা আ’য়ুনিও ওয়াজয়া’লনা লিলমুত্তাক্বীনা ইমামা(উত্তম জীবনসঙ্গী ও সন্তান লাভের দোয়া)” পাঠ করি? না খালা, এটা সম্ভব না। আমি যাকে চাই, তাকে শুধু দুনিয়ার জন্য না, দুনিয়া আখিরাত উভয়ের জন্য চাই। হ্যাঁ, আমার ভাগ্যে কি আছে, সেটা আমি জানিনা, কিন্তু আল্লাহ্‌ তো আর চাইতে নিষেধ করেননি। আমি চাওয়ার কাজ চাবো, দেয়ার মালিক আল্লাহ্‌। অবশ্য এখন যে অবস্থার মধ্যে পড়ে আছি, তাতে এসব বড্ড হাস্যকর শোনাচ্ছে জানি। কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করি, তিনি যা করবেন, মঙ্গলের জন্যই করবেন। আর তেমন না মিললে বরং আমি রাবেয়া বসরির মত বিয়ে না করেই জীবন পার করে দিতে চাই! আল্লাহ্‌ আমাকে জান্নাতে আমার কাঙ্ক্ষিত জীবনসঙ্গী মিলিয়ে দিবেন, ইন শা আল্লাহ্‌”

একসাথে এতগুলো কথা বলে দম নিল সিদ্রা। খালা পুরো হা হয়ে ওর কথা শুনছিল, আর কোন উত্তর নেই উনার কাছে।

“আর তাছাড়া…….. উনিও তো আমাকে ঘৃণা করেন। আমাকে নিজ ভাইয়ের হত্যাকারী বলে মনে করেন। এতদিনে যেটুকু বুঝেছি, উনি যদি চান তাহলে মেয়েদের লাইন লেগে যাবে উনাকে বিয়ে করার জন্য। সেখানে শুধু শুধু প্রতিশোধের নেশায় আমাকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করতে যাবেন! নিজের সুখের আশায় উনার জীবনটা তো আমি নষ্ট করে দিতে পারিনা খালা”

খালার সাথে আরো একজন দরজার বাইরে স্তম্ভিত হয়ে সিদ্রার কথাগুলো গিলছিল। ঘুম ভেঙে পানির গ্লাস খালি পেয়ে পানি নিতে উঠে এসেছিল রাইয়্যান, আর সিদ্রার গলার আওয়াজ শুনে আটকে গেছে ওর ঘরের সামনে। মনের ভেতর থেকে একটা কন্ঠ যেন বলে উঠলো, এখনো কি তুমি ওকে খারাপ, ছলনাময়ী মেয়ে বলবে?

***
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে সিদ্রা, কিছুতেই ঘুম আসছেনা। সারাদিনে এতকিছু ঘটে গেল, মাথায় চিন্তা গিজগিজ করছে, ওর মনে হচ্ছে ও পাগল হয়ে যাবে। চিন্তা দূর করতে হলে অন্য কিছু করতে হবে, কিন্তু এই রাতের বেলা আর কি করব! বই পড়ে দেখি। লাইট জ্বালিয়ে ঘরের কোথাও যে বইটা পড়ছিলো, সেটা দেখতে পেলনা। কোথায় রাখলাম বইটা? মনে পড়ল, ভোরে বাগানে নিয়েছিলাম পড়তে, তারপর…… মনে পড়েছে, ড্রয়িংরুমের সাইড টেবিলের ওপর রেখেছিলাম। যাই, নিয়ে আসি।

সাবধানে বেড়ালের মত সিঁড়ি বেয়ে নেমে অন্ধকারেই আন্দাজে হাতড়ে বইটা নিল সিদ্রা, ফিরে আসবে কিন্তু থমকে গেল লোকটার গলার আওয়াজ শুনে, বাগান থেকে আসছে মনে হচ্ছে। এত রাতে উনি বাগানে কার সাথে কথা বলছেন, দেখিতো। জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল সিদ্রা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে বাগান, অপার্থিব সুন্দর লাগছে দেখতে। লোকটা বসে আছে দোলনায়, একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এত সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে, অথচ আমার মনের আকাশ জুড়ে ঘোর অমাবস্যা! লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা।

***
বিকেলে সিদ্রার কথাগুলো শোনার পর থেকে মনটা বড্ড চঞ্চল হয়ে আছে রাইয়্যানের। মনের যে অংশটা সবসময় বলে তুমি ভুল করছো, সেটা আজকে যেন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কিচ্ছু ভাল লাগছেনা ওর। বাগানে পায়চারী করে মন শান্ত করার চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু সে আর হচ্ছে কই!

আজকে যা যা ঘটেছে, তার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল রাইয়্যান। এমনি এমনি কি আর এত সফলতার সাথে বিজনেস ওয়ার্ল্ডে রাজত্ব করছে। প্রেডিকশন ক্ষমতা অনেক ভাল ওর। ও ভাল করেই জানতো, বাংলোয় সিদ্রাকে আনলে একদিন না একদিন কারো না কারো চোখে পড়বেই। তখন ওর পরিচয় কি দিবে সেটা নিয়ে অনেক ভেবে এটাই বেস্ট মনে হয়েছে ওর। বোন বলা যাবেনা, বুবু কাছের দূরের সব আত্মীয়-স্বজনদের চিনে। বান্ধবী বললে এতদিন ধরে এখানে থাকায় সবার মনে প্রশ্ন উঠবে। শুধুমাত্র ওয়াইফ পরিচয় দিলেই সেই সমস্যা আর থাকবেনা। আর তাছাড়া, মেয়েদের প্রতি আগ্রহ ওর কোনকালেই ছিলনা, বিয়ে শাদী তো দুরের কথা। সবসময় ভাবতো, একটা ভাইয়ের আবদারই রক্ষা করতে পারিনা, সাথে বউ-বাচ্চা জুটলে তো ব্যবসাপাতি লাটে উঠবে। আর এখন ফারহান চলে যাবার পর নতুন কোন পিছুটানের তো প্রশ্নই উঠেনা। অনেক হারিয়েছি আমি, আর কিছু হারানোর রিস্ক নিতে পারবোনা, সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।

আজকে বুবুকে যা যা বলেছে, সেসব মনে মনে অনেক বার প্র‍্যাক্টিস করা ছিল, নাহলে কি আর এত অবলীলায় বলতে পারতো! এর পেছনে ফারহানেরও কিছুটা অবদান আছে। ওর পছন্দ ছিল রোমান্টিক মুভি আর রাইয়্যানের একশন। কিন্তু একসাথে মুভি দেখতে বসলে ফারহানের প্যাঁচে পড়ে ওকেও ওইসব অখাদ্য গিলতে হতো। এখন এই গল্প বানাতে সেসব কাজে লেগেছে আর ভবিষ্যতেও লাগবে, সেটা খুব ভাল করে বুঝতে পারছে।

কিন্তু, আমি কি সত্যিই খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি! একটা মেয়ের সারা জীবন নষ্ট করে দিচ্ছি আমি। লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে যাচ্ছে নাতো? কিসের লঘুপাপ? খুন করেছে ও আমার ভাইকে। কিন্তু ও যে সবকিছু অস্বীকার করে? ওসব তো নাটক, নিজের পাপ স্বীকার করার মত সৎসাহসও নেই ওই মেয়ের। কিন্তু আজকে যে বলল, আমাকে বিয়ে করে আমার জীবন নষ্ট করতে চায়না, খারাপ মেয়ে হলে তো নিজের স্বার্থই আগে দেখতো। হুহ! আমার জীবন না ছাই, নিজে যে রাজপুত্রের আশায় বসে আছে, আমি তো তার ধারেকাছে দিয়েও যাইনা, সেটাই আসল কারণ। পাওয়াচ্ছি তোকে রাজপুত্র আমি! এভাবেই ওর মনের মধ্যে দুপক্ষের দ্বন্দ্ব চলছে, কিছুতেই থামাতে পারছেনা রাইয়্যান।

হঠাৎ খেয়াল করল, কখন যেন খালা এসে দাঁড়িয়েছে। পায়চারী থামিয়ে দোলনায় বসল রাইয়্যান।

“খালা, প্লিজ একটু বসোনা, কথা বলি তোমার সাথে!” খালা একটা বেতের চেয়ার টেনে বসল।
“তুমিও আমাকে খুব খারাপ ভাবছো, তাইনা খালা? আজকাল তোমার দৃষ্টিতে আগের সেই ভালবাসা দেখতে পাইনা, হতাশা আর করুণা দেখতে পাই। মনে হয়, তুমিও আমাকে ভুল বুঝছো, কষ্ট পাচ্ছো আমার কাজেকর্মে। এটা কি সত্যি খালা? তোমারও কি মনে হচ্ছে আমি ভুল করছি?”

খালা কোন উত্তর দিলনা, মাথা নিচু করে বসে রইল।

“নিরবতাই সম্মতির লক্ষণ। সবাই আমাকে খারাপ ভাবছে, সবাই! ওই মেয়েটার জীবনে তো আমার থেকে ঘৃণিত কেউ নেই আর এখন তুমিও!! আমার কথা তো ভাবছোনা!!! এ বিশাল পৃথিবীতে নিজের বলতে শুধু আমার ভাইটা ছিল, ওকে যে এই অসময়ে আমার থেকে কেড়ে নিল, সেটা তো দেখছোনা। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত ভাই হারানোর কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি আমি, আমার কষ্টটা তো বুঝছোনা। কেন খালা, কেন? আমার ভাইকে আমি ওই মেয়েটার জন্য হারিয়েছি খালা, ওই মেয়েটার জন্য! তবু তুমি ওই মেয়েটার কষ্ট দেখছো খালা, আমারটা না?”

করুণ আর্তনাদের মত শোনাল কন্ঠটা, জানালার ওপাশে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো সিদ্রার।

“এ বাসার প্রতিটা ঘরে, প্রতিটা জিনিসে ফারহানের স্মৃতি। এই দোলনাটার কথা মনে আছে তোমার খালা? আগে এটা একজনের বসার মত ছিল, আমার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল বাবা। কিন্তু ফারহান হওয়ার পর দুজনে মিলে দোলনায় বসা নিয়ে ঝগড়া করতাম বলে ওইটা সরিয়ে এ দোলনাটা বসিয়েছিল, যাতে দুজনেই বসে দোল খেতে পারি”

তাহলে উনার ভাইয়ের নাম ফারহান, কখনো ভুলেও কি মুনিরা উচ্চারণ করেছে নামটা? নাহ! করেনি, মনে পড়ছেনা আমার, ভাবল সিদ্রা।

“আর ওই যে মাটির চুলাটা, আগে যখন তুমি এটাতে পিঠা বানাতা, দুই ভাই মিলে অপেক্ষা করতাম, পিঠা কখন উঠবে, তারপর প্রথম পিঠাটা নিয়ে লাগাতাম কাড়াকাড়ি। যদিও আমি যথেষ্ট বড় ছিলাম, কিন্তু ফারহানকে জ্বালিয়ে কাঁদাতে খুব মজা লাগতো আমার। যদি জানতাম যে ও এমন অকালে চলে যাবে, এক ফোটাও জ্বালাতাম না ওকে আমি, বিশ্বাস কর খালা, যা যা চেয়েছিল সব এক বাক্যে দিয়ে দিতাম। একটুও কাঁদাতাম না ওকে, একটুওনা” কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এল কথাগুলো।

“আমি কি দোষ করেছি খালা? শুধু যে আমার ভাইকে কেড়ে নিয়েছে, তাকে নিজের মতো করে শাস্তি দিচ্ছি। আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে পারিনি, এটাই কি আমার অপরাধ? আমি কি করব বলো? আমি যে ফারহানের এই অকাল মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছিনা খালা, কিছুতেই না” এবারের কথাগুলো কান্নার সাথেই বেরিয়ে আসলো ওর। খালা উঠে এসে রাইয়্যানের মাথায় হাত রেখে ওর পাশে বসল। রাইয়্যান খালার কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে গেল দোলনার ওপর আর খালা চোখ মুছে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।

জানালার পাশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে এসব কিছু দেখল আর শুনল সিদ্রা। লোকটা কাঁদছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছে ও। খেয়াল করল, কখন কখন দুচোখ দিয়ে পানি পড়ে বুকের কাছের জামা ওড়না ভিজে গেছে।

“মুনিরা রে, কি করলি তুই এটা! কয়দিনের একটা মজার জন্য দুই দুইটা জীবন নষ্ট করে দিলি!!” বিড়বিড় করে বলল সিদ্রা, “না, দুইটা নাতো, তিনটা! নিজেকে কেন বাদ দিচ্ছি আমি?”
সারাদিনের সব রাগ যেন চোখের জলে ধুয়ে গেল, চোখ মুছে ওখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সিদ্রা, আরো কিছু শোনার অপেক্ষায়।

চলবে।