যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-২৭+২৮

0
372

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

২৭.
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে রাইয়্যানকে দেখতে পেলনা সিদ্রা। ওকে এদিকওদিক তাকাতে দেখে খালাই উত্তর দিয়ে দিল, রাইয়্যান বাইরে গেছে। ধরা পড়ে গিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল সিদ্রা, চুপচাপ নাস্তা খেতে থাকল।

খালা ওকে এই পা নিয়ে কিছুই করতে দিলনা, সারাদিন শুয়ে বসে বই পড়েই কাটিয়ে দিল সিদ্রা। বিকেলে নিচে নেমে অবাক হয়ে গেল, বড় সোফাটা শপিং ব্যাগ দিয়ে ভরা।

“এগুলো কি খালা?” জিজ্ঞেস না করে পারলনা ও।

“তোর থুড়ি, আমার বউয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র” ওর পেছন থেকে উত্তর দিল রাইয়্যান।

“প্লিজ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবেননা, ফারদার আমার সামনে বউ কথাটা উচ্চারণ করবেননা আপনি” ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল সিদ্রা, চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন।

“উপস! তাই নাকি? কিন্তু কি করি বল, সবাই তো এখন জেনে গেছে তুই আমার বউ, না ডেকে কিভাবে থাকি!”

উফ! এই লোকের কথা শুনে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে, আমি বরং উনার সামনে থেকে যাই, সিঁড়ির দিকে এগোল সিদ্রা। ওর হাত ধরে ফেলল লোকটা, “ওয়েট! আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আমার সামনে থেকে যাওয়ার সাহস পায়না, আই ডোন্ট লাইক দ্যাট”

হাতটা ছাড়িয়ে নিল সিদ্রা, “ফালতু কথা শুনতে আমার ইচ্ছে করছেনা, এখন এজন্য কি আমাকে গুলি করবেন না ফাঁসি দিবেন?”

“যাচ্চলে! আমি কোথায় তোর জন্য এতকিছু কিনে আনলাম, তুই উল্টে আমাকেই ভাব দেখাচ্ছিস!”

“আমার কিছু দরকার নেই, যেভাবে আছি, সেভাবেই থাকব, ধন্যবাদ”

“তোর দরকার নাই, কিন্তু আমার আছে। আমার একটা রেপুটেশন আছে। তুই এখন এই টি এস্টেটের মালকিনের রোল প্লে করছিস। তোর সাজপোশাক সেই অনুসারে হতে হবে তো! নাইলে কি আমার মান-সম্মান থাকবে?”

সিদ্রার ওড়নার কোনাটা তুলে ধরল রাইয়্যান, “আজ থেকে এই দুইটা ড্রেস রিজেক্টেড। নতুন আনা ড্রেসগুলো বাদ দিয়ে যদি এগুলো পরতে দেখেছি, তোর কপালে অশেষ দুঃখ আছে”

আগুন চোখে রাইয়্যানের দিকে তাকাল সিদ্রা, কিন্তু কিছু বললনা।

“আর হ্যাঁ, বুবু জিজ্ঞেস করেছিল তোর কথা, আমি বলেছি তুই দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছিস। আজকে রাতে বুবুর বাসায় আমাদের দাওয়াত। সেজন্যই এত সাত তাড়াতাড়ি করে এগুলো কিনতে হল। যা, রেডি হয়ে নে, আমরা সন্ধ্যার পর বের হব”

“আমি কোথাও যাবোনা। এখানে এসে আমার বোরকাটা খুঁজে পাইনি। আপনারা মনে হয় সেটা জঙ্গলেই ফেলে এসেছেন। বোরকা ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারবোনা”

রাইয়্যান কিছু বলতে যাচ্ছিলো, সিদ্রা থামিয়ে দিল ওকে, “আর হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমাকে মুনিরা কেন, আমার চৌদ্দ গুষ্টির মৃত্যুর ভয় দেখালেও কাজ হবেনা। আমি পর্দার সাথে কোন কম্প্রোমাইজ করতে পারবোনা”

“তুই না দিনে দিনে বড্ড বাজে বকছিস। না জেনে এত কথা বলিস কেন? নতুন বোরকাও আছে ব্যাগের মধ্যে, যা এবার রেডি হ জলদি জলদি”

শপিং ব্যাগ এতগুলো যে দুই হাতে নিয়েও শেষ করতে পারলোনা সিদ্রা, বাকিগুলো খালা নিয়ে চলল ওর পেছন পেছন। হায়রে, লোকটা মনে হচ্ছে পুরো বাজার তুলে এনেছে! সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভাবল সিদ্রা।

***
বিছানার উপর সবগুলো জিনিস বের করে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সিদ্রা। ড্রেসই আছে মনে হয় কমপক্ষে দশটা। তারপর আছে হালকা, ভারী কয়েক ধরণের সোনার গয়না, ডায়মন্ড জুয়েলারি, তেল শ্যাম্পু সহ সব ধরণের কসমেটিকস, মেকআপ কিট, কয়েক সাইজের হ্যান্ডব্যাগ, বেশ কয়েক জোড়া জুতা-স্যান্ডেল, আর দুই সেট বোরকা। সবগুলোই যে অনেক দামী আর ব্র‍্যান্ডেড, বুঝতে অসুবিধা হলনা ওর। উনি কি পাগল! একটা মানুষের কি এতগুলো জিনিস লাগে! বাকিগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম, এতগুলা জুতা আর ব্যাগ দিয়ে মানুষ কি করে! এমন না যে, সিদ্রাদের ফ্যামিলি গরীব। আর্থিক সামর্থ্য আল্লাহ্‌ যথেষ্টই দিয়েছেন। কিন্তু অপচয় পছন্দ করেনা ওরা, সবসময় পরিমিত জিনিস ব্যবহারে অভ্যস্ত।

সিদ্রা সবথেকে অবাক হল ড্রেসগুলো দেখে। থ্রিপিস আর হাল ফ্যাশনের লং ড্রেস, কোনটা গর্জিয়াস আবার কোনটা বাসায় পরার মত সাধারণ। কিন্তু সবগুলোই বড় ওড়না আর বড় হাতা ওয়ালা। একটা ওড়না বা হাতাও শিফন কিংবা পাতলা ফিনফিনে নয়। মোটকথা একটা ড্রেসও এমন নয় যে ও পরতে আপত্তি করবে। উনি কিভাবে বুঝলেন, আমি এমন ড্রেস ছাড়া পরিনা। এমন ড্রেস খুঁজে পাওয়া যে কত কষ্টকর, ভালই জানা আছে সিদ্রার। বাজারে এমন ঢিলেঢালা আর পর্দা সম্মত পোষাক খুঁজে পেতে সবসময়ই ঝামেলা পোহাতে হয় ওদের, পুরো মার্কেট চষতে হয় অনেকসময়। সেখানে উনি এতগুলো পোষাক কিভাবে পেলেন, আল্লাহ্‌ জানে। বোরকা দুটোর দিকে নজর দিল এবার। দুইটাই একদম ও যেমন পরে। সাথে আবার দুই জোড়া করে হাত-পায়ের মোজাও আছে। এরপর আর কিছুতেই লোকটার ওপর রাগ করে থাকতে পারলোনা ও।

খালা ওকে তৈরি হতে সাহায্য করল। খালার জোরাজুরিতে গোল্ডেন কালারের অসম্ভব সুন্দর একটা গর্জিয়াস ড্রেস পরতে হল ওকে, সিদ্রাও খুব বেশি আপত্তি করলনা কারণ বোরকা তো উপরে পরবেই। তারপর সবথেকে ভারী সোনার গয়নাগুলো পরিয়ে আয়নার সামনে ওকে যখন খালা দাঁড় করাল, নিজেকে চিনতে পারছিলোনা সিদ্রা। কোন সাজগোজ ছাড়াই ওকে একদম নতুন বউ এর মত লাগছে।

খালা এবার মেকআপ কিটটা নিয়ে আসল ওর সামনে, সরে গেল সিদ্রা। “না খালা, পোশাক পরেছি, গয়না পরেছি, কিন্তু কোন সাজগোজ না, প্লিজ!”

খালা অন্তত কাজলটা দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই রাজি হলনা সিদ্রা। বোরকা পরে রেডি হয়ে নিল।

***
বুবুর বাসায় যেতে পায়ে হেঁটে মাত্র পাঁচ মিনিট লাগলো। ঠিকই ধরেছিল সিদ্রা, বাংলোটা একটা বড়সড় টিলার ওপর। চওড়া একটা রাস্তা সেই টিলা ঘুরে ঘুরে নিচে নেমেছে। আবার বুবুর বাসাটাও আকারে ছোট আরেকটা বাংলো, পাশেই আরেকটা ছোট টিলার ওপর।

কাজের লোক এসে দরজা খুলে দিলে বুবু এসে সিদ্রাকে জড়িয়ে ধরে ওয়েলকাম করলো। বুবু আজকে একটা শাড়ি পরে আছে। কথায় আছে না, বড় বোন মায়ের সমান, বুবুকে দেখে কথাটার সত্যতা অনুভব করল সিদ্রা।

সোফায় বসতেই বুবু তেড়ে উঠলো, বোরকা না খুলে কিছুতেই বসা যাবেনা। অপ্রস্তুত হয়ে গেল সিদ্রা, এমনটা হতে পারে ভাবেইনি। আপত্তি করতে যাচ্ছিল ও, চোখ গরম করল শয়তান লোকটা। তবু মিনিমিন করে বলার চেষ্টা করল ওড়না আনেনি, ওমনি খালা বিশ্বাসঘাতকের মত হাসিমুখে ওড়নাটা বের করে দিল। কখন আমার চোখ এড়িয়ে ওড়নাটা ঢুকিয়েছিল আল্লাহ্‌ই জানে। বিরূপ মনে পাশের ঘরে ঢুকল সিদ্রা বোরকা খুলতে। খালা, আপনি এভাবে আমাকে ফাঁসাবেন জানলে আমি আপনার কথা কিছুতেই শুনতামনা, এখন এই পোশাকে ওই লোকটার সামনে যেতে হবে আমাকে?

ওড়নাটা ভালভাবে পরল সিদ্রা, সবসময়ের মত শুধু মুখটা খোলা। কিন্তু জানে, ওড়নাটা এত সুন্দর যে, এটুকুতে ওর চেহারার সৌন্দর্য ঢাকার পরিবর্তে আরো প্রকট হচ্ছে। আল্লাহ্‌! নিজের না, বোনের জীবন রক্ষার্থে আজ এভাবে পর্দার খেলাফ করতে হচ্ছে আমাকে। আমি কি ঠিক করছি, না ভুল? আমাকে ক্ষমা করো প্রভু, দয়া করে আমাকে পথ দেখাও, আমি যে ঠিক ভুল সব দিশা হারিয়ে ফেলছি! বুবু বাইরে থেকে ডাক দিতেই চোখে চলে আসা পানিটা মুছে বের হল সিদ্রা।
রাইয়্যান সিদ্রাকে দেখে পুরো হা হয়ে গেল, অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো, মেয়েটা আসলেই এত সুন্দর নাকি ও স্বপ্ন দেখছে! বুবু তো খুশিতে প্রায় লাফালাফি শুরু করে দিল, “ভাইটু, তুই ড্রেসটা ওকে দিয়েছিস! পরিয়েও এনেছিস! থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু, আমি খুব খুব খুব খুশি হয়েছি”

সিদ্রা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বুবুর কথা শুনে। বুঝিয়ে বলল বুবু, “তোর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, ওই মুখচোরাটা কিছু বলেনি তোকে“ ওকে ধরে রাইয়্যানের পাশে বসিয়ে দিল, জড়সড় হয়ে একটু সরে গেল সিদ্রা, বুবু খুশির চোটে বিষয়টা খেয়াল করলনা।

“আমি বলছি শুন, গত ঈদের শপিং এর সময় এ ড্রেসটা রাইয়্যানের অনেক পছন্দ হয়। আমাকে ছাড়া তো আর কোন মেয়েকে চিনেনা এই ছাগলটা, বলে কিনা আমাকে কিনে দিবে। তুই বল, এসব পরার বয়স আছে আমার? তখন আমি ওকে জোর করে এটা কিনে দিয়েছিলাম, যাতে ও এটা বিয়ের পর ওর বউকে দেয়। আর আজ ও আমার কথা রেখেছে, আই এম জাস্ট টু….. হ্যাপি! তোকে ভীষণ মানিয়েছে ড্রেসটাতে, জাস্ট অপূর্ব লাগছে! কিরে, দেখেছিস আমি যা করি, ঠিকই করি” শেষের কথাটা রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে বলল বুবু।

“হুম, তুমি কি আর ভুল হতে পারো! কাভি নেহি!” দুইহাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে রাইয়্যান এপ্রিসিয়েট করল বুবুকে। সিদ্রা ওড়নার নিচে দুহাত মুঠো করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করতে লাগল। দিস ইজ জাস্ট টু মাচ, উনার বউয়ের জন্য কেনা ড্রেস উনি আমাকে দিবেন কেন? খালা এজন্যই এত জোর করে পরিয়েছে ড্রেসটা। নাহ! খালা আজ যা করল, এরপর খালাকেও আর বিশ্বাস করতে পারবনা। বুবুর হাতের ছোঁয়ায় ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এল সিদ্রা।

“কানে গলায় কি পরেছিস দেখি?” সিদ্রার হাত দুটো নিয়ে চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখার পর হাত বাড়িয়ে নিজেই ওড়নাটা খুলতে গেল বুবু। কোনমতে আটকাল সিদ্রা, নিজেই ওড়নাটা আলগা করে দুহাত দিয়ে এমন করে ধরল, যাতে বুবু দেখতে পায় কিন্তু পাশে থাকা লোকটা দেখতে না পায়।

“মা শা আল্লাহ্‌! আমার ভাইয়ের চয়েস আছে। একদম রাণীর মত লাগছে তোকে। উঁহু, ভুল বললাম, তুই তো রাণীই” থুতনিটা ধরে আঙুলে চুমু খেল বুবু। হুহ! রাণী! বন্দি দাসী আমি বুবু, আপনি আর কি জানেন, মনে মনে বলল সিদ্রা।
আবার আগের মত করে ওড়নাটা পরে নিতেই বুবু আপত্তি করে উঠলো, “ওইভাবেই রাখনা, গয়নাগুলো দেখা গেলে বেশি সুন্দর লাগছে” আরেকটু হলেই জোরে প্রতিবাদ করে ফেলছিল, সামলে নিল সিদ্রা, আস্তে করে বলল, “প্লিজ বুবু, আমি সতর ঢাকা অবস্থায় থাকতেই বেশি পছন্দ করি”

ওর কথা শুনে বুবু একটু অবাক হয়ে গেল, স্বামীর সাথে আবার কিসের সতর? কয়েক মুহূর্ত কি বলবে যেন বুঝতে পারলনা। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, “তোদের নিশ্চয় ক্ষুধা লেগে গেছে, আয় খেতে খেতে কথা বলি”

খেতে বসে তেমন কিছুই বললনা সিদ্রা, শুধু হু হা করে গেল, আর বুবুর মুখে যেন কথার ফুলঝুরি। একটা জিনিস ভালভাবে উপলব্ধি করল সিদ্রা। বুবু অনেক একলা একজন মানুষ, কারো সাথে প্রাণখুলে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। আজ ওকে পেয়ে উনার বাঁধ ভেঙে গেছে।

খাওয়ার মাঝখানে যখন রাইয়্যান সিদ্রার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে একটু পানি ঢেলে দাওতো”, সিদ্রার তো বিষম খাওয়ার যোগাড়। লোকটা তো ভালই পারে, বুবুর সামনে কি সুন্দর ভাল হাজবেন্ডের মত তুমি তুমি করছে! আমাকে সবসময় নাটুকে বলা, এদিকে নিজে যে অভিনয়ে সিদ্ধহস্ত তার দিকে কোন খেয়াল নাই, হুহ!

কিন্তু বিপদ বাঁধল তখন, যখন সিদ্রা রাইয়্যানকে আপনি করে বলল।
“এই তোরা নাকি ভালবেসে বিয়ে করেছিস, তাহলে এসব আপনি আজ্ঞে আসছে কোথা থেকে?” বুবু যেন আকাশ থেকে পড়েছে।

রাইয়্যানের রাগ আঁচ করতে পারলো সিদ্রা, বুঝতে পারলো, ওকেই ব্যাপারটা সামলাতে হবে। বলল,
“আসলে বুবু, আমার আম্মুকে সবসময় দেখেছি আব্বুকে আপনি আপনি করে বলে, তো আমিও সেজন্য উনাকে আপনি করে বলি” চট করে ব্যাপারটা মাথায় আসায় মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।

“এ্যাঁ, এই আধুনিক যুগে এমন সেকেলে চিন্তা তোর মাথায় কিভাবে আসলো, আমি তো সেটাই বুঝতে পারছিনা। না না, এসব চলবেনা, তুমি বলতে হবে”

রাইয়্যান সিদ্রার উপর রেগে ফায়ার হয়ে গেছিল, কিন্তু এত বুদ্ধি করে উত্তর দিবে সিদ্রা সেটা আশা করেনি, হতবাক হয়ে গেছিল তাই, এখন সায় দিল বুবুর কথায়।

“প্লিজ তুমিই কিছু কর বুবু, আমি তো বলতে বলতে হাল ছেড়ে দিয়েছি”

“এরপরে আপনি আজ্ঞে শুনলে না, ওকে পিট্টি দিব আমি”

“না বুবু প্লিজ প্লিজ, এমন করবেননা। আপনি অনেক ভাল, আমার এভাবে ডাকতেই ভাল লাগে, প্লি…..জ!” মুখটাকে যতটা সম্ভব করুণ করার চেষ্টা করলো সিদ্রা।

“ওরে পটানি রে, আচ্ছা মানতে পারি, কিন্তু একটা শর্ত আছে”

“কি শর্ত?”

“এখন এই মুহূর্ত থেকে আমাকে তুমি করে বলতে হবে”

বুবু কি না কি শর্ত দেয়, ভীষণ টেনশনে পড়ে গিয়েছিল সিদ্রা, কিন্তু বুবুর কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল। উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বুবুকে, “বুবু, তুমি না অনেক সুইট”

সিদ্রার কষ্ট দেখে আনন্দ পাওয়ার কথা, আর আনন্দ দেখে কষ্ট। অথচ সিদ্রার হাসিমাখা মিষ্টি মুখটা দেখে এত ভাল কেন লাগছে, কিছুতেই বুঝতে পারলনা রাইয়্যান।

“কিন্তু জাস্ট কিছুদিনের জন্য, তার পরেও চেঞ্জ করতে না দেখলে তোর খবর আছে”

বাপরে! এরা ভাইবোন তো কথায় কথায় সবার খবর করে ছাড়ে! ভাবল সিদ্রা।

এরপর বুবু ওর হাতে মোটা মোটা একজোড়া বালা পরিয়ে দিল, এগুলো নাকি ওর শাশুড়িমায়ের স্মৃতি! বুবুকে দিয়েছিল, এখন উনি সিদ্রাকে দিচ্ছে। এত খারাপ লাগলো সিদ্রার, কার না কার হক, ওকে দিচ্ছে। লোকটার উপর আরও রাগ উঠলো ওর, এমন একজন ভালমানুষকে কিভাবে ঠকাচ্ছে লোকটা।

চলে আসার সময় সিদ্রাকে প্রমিস করতে হল বুবুর কাছে, উনার ভাইটু এখানে না থাকলে ও বুবুর কাছে এসে গল্প করবে।

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

২৮.
বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই রাইয়্যান বলল, “আরেকটু হলেই তো দিয়েছিলি ভেজাল পাকিয়ে! কাজটা মোটেও ভাল করিসনি। এখন এর শাস্তিস্বরূপ কফি বানিয়ে খাওয়া আমাকে, তবে তার আগে বোরকাটা খুলে নিতে পারিস!”

কোন উত্তর দিলোনা সিদ্রা, বিরক্তি নিয়ে উঠে গেলো নিজের ঘরে। ড্রেসটা খুলে ওর মনে হল, বিশাল একটা বোঝা নামল শরীর থেকে। আজকেই প্রথম আর আজকেই শেষ, এটা কেন আর কোন ভারী ড্রেসই পরবো না আমি, সিদ্ধান্ত নিল সিদ্রা। ফ্রেশ হয়ে বেছে বেছে তুলনামূলক সবথেকে নরমাল থ্রিপিসটা পরে নিচে এলো আবার।

“কোনটা? আপনারটা না আমারটা?” রাইয়্যানের কাছে এসে জানতে চাইল সিদ্রা।

“মানে কি?” টিভিতে কি একটা দেখে হাসছিল রাইয়্যান, সিদ্রার প্রশ্ন শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল ওর দিকে।

“কফি, কোন ভাবে বানাবো সেটা জানতে চাইছি”

“ও! ইউজ করতে জানিসনা টানিসনা, শেষে আমার অত দামী কফি মেকারটা নষ্ট করবি।তার থেকে বরং তোর মত করেই বানিয়ে আন” উত্তর দিল রাইয়্যান।

মনে মনে হাসলো সিদ্রা। বুঝতে পারছে ওর কফি ভালোই পছন্দ হয়েছে লোকটার, তবু একটু বাজিয়ে দেখল,
“না না, আমি অত খারাপ স্টুডেন্ট না, আমি পারব কফি মেকারে বানাতে, এক্ষুনি বানিয়ে আনছি”

“যেটা বলেছি সেটা কর, এত অতিরিক্ত প্যাঁচাল পাড়িস কেন?” বিরক্ত কণ্ঠে বলল রাইয়্যান। মুচকি হেসে কফি বানাতে গেল সিদ্রা।

কফির মগটা এনে টেবিলে রেখে ভেবে রাখা কথাটা বলার সিদ্ধান্ত নিল সিদ্রা, কিন্তু কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা। ও যে দাঁড়িয়ে আছে, খেয়াল করলো রাইয়্যান।

“কিছু বলবি?”

“হুম! ভেবেছিলাম নিজের জন্য আপনাকে কোন খরচ করাব না, কিন্তু আজ যখন আপনি এতসব ফালতু জিনিস কিনে এত টাকা খরচ করে ফেলেছেন, তখন আমি কি কিছু চাইতে পারি?”

“হুম পারিস, কিন্তু আশা করি এমন কিছু চাইবিনা যেটা আমি তোকে দিবনা” কফিতে চুমুক দিল রাইয়্যান।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আপনার কাছে আমার মুক্তি চাইতে আসিনি, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন” বলল সিদ্রা, “আপনাদের লাইব্রেরিতে আমি না কোন কুরআন শরীফ দেখেছি আর না কোন ইসলামিক বই। যদিও আমি মুখস্থই তেলাওয়াত করতে পারি, তবুও অর্থসহ একটা কুরআন শরীফ পেলে ভাল হত, আর সাথে কিছু ইসলামিক বই”

রাইয়্যান এত অবাক হল, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলোনা। এই ওর চাওয়া! অথচ আমি ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না যে কি না কি চাইবে।

“আয় আমার সাথে” বলে কফির মগ রেখে লাইব্রেরির দিকে এগোল রাইয়্যান।

কোণার একটা বুক সেল্ফ এর সব উপরের তাকটা অন্যগুলোর মত কাঁচের না, পাল্লা দেয়া, ওইটাই খুলল রাইয়্যান।

“এটা নিশ্চয় খুলে দেখিসনি”

আরে তাইতো, মায়ারেফুল কুরআন সহ অনেকগুলো তাফসীর গ্রন্থ আছে। হাফেজী কুরআন শরীফ ও চোখে পড়ল একটা, খুশি হল সিদ্রা।

“জাজাকাল্লাহ! আমি আসলেই দেখিনি এটা, কিন্তু……..”

“ইসলামিক বই তো, ঠিক আছে। নাম লিখে দিস, এনে দিব”

এত সহজে লোকটা ওর কথা মেনে নিবে কল্পনাও করেনি, কিছুটা অবাক হয়েই লাইব্রেরি থেকে রাইয়্যানের পেছন পেছন বের হয়ে এলো সিদ্রা। বসার ঘরে ফিরে এসে রাইয়্যান পা বাড়াল সোফার দিকে আর সিদ্রা সিঁড়ির দিকে। আমাকে কুরআন শরীফ দেখাতে গিয়ে তো উনার কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, গরম করে দিব নাকি, মনে মনে ভাবল সিদ্রা। ধুর! এতো দরদ দেখিয়ে কি হবে, খাক উনি ঠাণ্ডা কফি, আমার কি?

রাইয়্যান পেছন থেকে বলে উঠল, “গুড জব!” ঘুরে দাঁড়াল সিদ্রা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল রাইয়্যানের দিকে।

“বুবুর সামনে ব্যাপারটা সুন্দর করে ম্যানেজ করেছিস” বলল রাইয়্যান, “তুই বুবুর সামনে আমাকে তুমি করে বলতে পারিস, আমি কিছু মনে করব না”

“আপনার মনে করা না করায় কিছু এসে যায়না। আমি আপনার মত ক্ষণে ক্ষণে ডাক বদল করতে পারব না। আর আমি আমার কাছের মানুষদের ছাড়া অন্যদের তুমি বলিনা” কাটাকাটা স্বরে জবাব দিল সিদ্রা।

“তো, বুবু তোর কাছের মানুষ?” একপাশের ভ্রু সামান্য উঁচু করে জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান।

“অবশ্যই। বুবু আমাকে মাত্র দুবার দেখেছে আর তাতেই কত ভালবেসে ফেলেছে দেখেছেন? আমার কাছের মানুষ হওয়ার জন্য সেটুকুই এনাফ”

“সে তো আমি তোকে বউ বলে পরিচয় দিয়েছি বলে। তোর কি মনে হয় আসল কথা জানলে বুবু তোকে এমন ভালবাসতো?”

বড়সড় একটা ধাক্কা খেল সিদ্রা, কিন্তু রাইয়্যানের সামনে প্রকাশ করল না সেটা, উলটে বলল, “আসল কথা তো খালাও জানে, তাইনা?” শক্ত কন্ঠে জবাবটা দিয়েই সিঁড়ির দিকে এগোল সিদ্রা, কিন্তু মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে ওর। সত্যিই তো, লোকটা ভুল কিছু বলেনি। বুবু আমাকে ভালবাসছে শুধু ওই কারণেই, আমার নিজের তো এতে কোন ক্রেডিট নেই!

বরাবরের মত হতভম্ব হয়ে গেল রাইয়্যান। আসলেই তো, খালা সবকিছু জেনেও এই মেয়েকে এত ভালবাসছে, বুবুও কি তেমনটাই করবে! শুধু আমিই কি…….. আনমনে কফির মগটা নিয়ে চুমুক দিয়েই মুখ বিকৃত করে ফেলল, এহহে! পুরো পানি হয়ে গেছে।

মধ্যরাত। খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে অন্ধকার ঘরে। সেজদায় পড়ে আছে সিদ্রা, কেঁপে কেঁপে উঠছে গোটা শরীর, কাঁদছে ও। আর মেনে নিতে পারছেনা ও এসব। এতদিন যাও সব কষ্ট সহ্য করে নিচ্ছিল, কিন্তু এই বউ সেজে থাকার বাড়াবাড়িটা যেন সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। আজ বুবুর বাড়িতে ও যেমন অপ্রস্তুত হয়েছে, সত্যিই কি এভাবে কাটাতে হবে ওকে বাকি জীবন? কিভাবে সহ্য করবে ও? আল্লাহ্‌র কাছে আজ সেই ফরিয়াদই জানাচ্ছে সিদ্রা।

***
বারান্দায় থাকা ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিদ্রা। রেশমের মত চুলগুলো চেয়ারের গা বেয়ে মেঝেতে লুটোচ্ছে। এত নিশ্চিন্তে ভেজা চুল খুলে শুয়ে আছে কারণ লোকটা নেই, ঢাকায় গেছে, কালকে আসবে। এতদিন কখন যেতো, কোথায় যেতো, কখন আসবে কিছুই জানত না সিদ্রা। পরশু হঠাৎ যাওয়ার আগে বলে গেল, কারণ নাকি বুবু জিজ্ঞেস করলে যদি উত্তর না দিতে পারে, তাহলে বুবু সন্দেহ করবে।

কোলের ওপর রিয়াদুস সালেহীনের প্রথম খন্ড রাখা। ইসলামিক বই বলতে আপাতত শুধু রিয়াদুস সালেহীন এর চারটা খন্ডই আনিয়েছে সিদ্রা। বিষয়ভিত্তিক হাদীসের এই গ্রন্থটিতে কোন দুর্বল হাদীস নেই, সব সিহাহ সিত্তাহ থেকে নির্বাচিত সহী হাদীস। অপরিসীম ঈমানী শক্তি পাওয়া যায় এর প্রতিটা হাদীস থেকে, সবর করার শক্তি এখন ও এই গ্রন্থ থেকেই পায়।

কেটে গেছে আরো কিছু দিন, কিন্তু নতুন কিছুই ঘটেনি। এক জায়গাতেই থমকে আছে সিদ্রার জীবন। আজ ও বই না পড়ে চা বাগানের শোভা দেখছিল, কিন্তু আসলেই কি তাই? এই বারান্দার মনোরম চা বাগানের দৃশ্য প্রথমদিনের মতই কি মনে দোলা দিচ্ছে ওর? প্রথমদিন বারান্দায় বেরিয়েই মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সিদ্রা। মনে পড়ে গিয়েছিল কয়েক বছর আগের দার্জিলিং ভ্রমণের স্মৃতি। দাখিল পরীক্ষার পর সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। অফিসের বাৎসরিক লটারিটা জিতেছিল ওর আব্বু, সেখানে কাপল দার্জিলিং ট্রিপের সুযোগ ছিল। তার সাথে নিজেদের খরচে ওদের দুই বোনকেও নিয়ে গিয়েছিল। চা বাগান আর পাহাড়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সিদ্রা। মনে হয়েছিল, সারাজীবন এমন একটা বাড়িতে কাটালে কেমন হয়, যেখানে জানালা খুললেই মেঘের ছোঁয়া পাওয়া যাবে, দু চোখ ভরে উপভোগ করা যাবে পাহাড় আর চা বাগানের সৌন্দর্য। আল্লাহ্‌ কি তবে ওর মনের ওই চাওয়াটাই কবুল করে নিয়েছিলেন!

কিন্তু আব্বু বলেছিল, “সুন্দর জিনিস মাঝেমাঝে দেখলেই তার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, প্রতিদিন দেখতে থাকলে সেটার আর আলাদা করে কোন গুরুত্ব থাকেনা” সেদিন আব্বুর কথা মানতে মন চায়নি কিন্তু আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে। এই যে এত সুন্দর দৃশ্য, আজ কি ওর মন ভোলাতে পারছে? সিলেটের চা বাগান দেখার জন্য কতইনা বায়নাক্কা করেছে, ভাগ্যের ফেরে আজ সেখানেই বাস করতে হচ্ছে ওকে। অথচ আজ এ অপার সৌন্দর্যের সিদ্রার কাছে কোন মূল্যই নেই।

আর বই! বই পড়ার কত আগ্রহ! নতুন বইয়ের তালাশে থাকতো সবসময় সিদ্রা। যেদিন খালা প্রথম লাইব্রেরির দরজাটা খুলে দিয়েছিল, চোখ কপালে উঠেছিল ওর। বন্দিজীবনে অন্তত নিজের পছন্দের কিছু করতে পারবে ভেবেই আনন্দ পেয়েছিল। কিন্তু এখন আর বই পড়তে ভাল লাগেনা ওর। ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে যায়, এক বর্ণ মাথায় ঢুকেনা। আবার কখনো দৃষ্টি থাকে বইয়ের দিকে, কিন্তু মন পড়ে থাকে অন্যখানে। জীবন যেখানে থমকে গেছে, নেই কোন স্বপ্ন, আশা কিংবা ভবিষ্যৎ, সেখানে কোন কিছুই কি আর ভাল লাগতে পারে?

অনেক ভেবেছে সিদ্রা, কোন কূল-কিনারা পায়নি। পালিয়ে গেলে লোকটা মুনিরাকে মেরে ফেলবে, আর সত্যি কথা খুলে বললে লোকটা যদি ওকে ছেড়ে দিয়ে মুনিরাকে ধরে আনে, তখন? আমি তো সেটাও সহ্য করতে পারবোনা। তার থেকে এই ভালো, জীবন আর কয়দিনের! নাহয় কাটিয়ে দিব এভাবেই, যা কিছু পাওয়া হলনা এ জীবনে, আল্লাহ্‌র কাছে নাহয় আখিরাতে চেয়ে নিব। আমার বোন বরং এসব থেকে দূরে থাক। আমি প্রতিনিয়ত দুয়া করছি, আল্লাহ্‌ ওকে যেন সহি বুঝ দান করেনন, ও যেন ওর ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। নিজের ভাগ্য নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিয়েছে তাই, ছেড়ে দিয়েছে সব এখন আল্লাহ্‌র হাতে।

এখন ভাবছে ও বুবুর কথা। বুবুর কথামতো এখন মাঝেমাঝেই দুপুরের পর খালার সাথে বুবুর বাসায় যায় সিদ্রা। যদিও কি বলতে কি বলে ফেলবে, এই ভয় থাকে, কিন্তু এতদিনে একজন গল্প করার মত মানুষ পাওয়া গেছে, না গিয়ে পারেনা ও। আর লোকটাও কোন আপত্তি করেনি, শুধু মনে করিয়ে দিয়েছে, ভুলভাল কিছু বললে তার পরিণতি কি হবে। তবে বুবু যথেষ্ট বিবেচক একজন মানুষ। জানে যে বাবা মার কথা তুললে মন খারাপ হবে সিদ্রার, তাই সে বিষয় কখনো তুলেনা। তবে ওদের রিলেশন কখন হল, কিভাবে হল, সে বিষয়ে অনেক কৌতূহল বুবুর, প্রথমদিকে সেসব নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন করতো। সবসময় শুধু একটা কথা বলেই এড়িয়ে গেছে সিদ্রা, “শয়তানে ধরেছিল বুবু, পাপের সাগরে ডুবে যাচ্ছি বুঝতে পারিনি। তখন শয়তানের পাল্লায় যা করেছি করেছি, এখন ওইসব পাপের কথা আমি মুখে আনতে পারব না। আমাকে তুমি প্লিজ জিজ্ঞেস করোনা, পারলে তোমার ভাইয়ের থেকে জেনে নিও” অনেকবার চেষ্টা করে বুবু অবশেষে ক্ষান্ত দিয়েছে।

অনেকটা এই কারণেই দুপুরবেলায় যায় ও, বুবু ওইসময় রোগী দেখতে ব্যস্ত থাকে। সিদ্রা চুপচাপ বসে বসে বুবুর ডাক্তারি দেখে। রোগীরা সবাই এই চা বাগানের শ্রমিক। উপজাতি তো, ওদের কথা একটুও বুঝতে পারেনা সিদ্রা। অথচ বুবু কি সুন্দর করে ওই ভাষাতেই ওদের সাথে কথা বলে, হা করে তাকিয়ে থাকে ও। নতুন কেউ এলেই বুবু ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মালকিন বলে। শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মানুষগুলোর, এত লজ্জা লাগে সিদ্রার ব্যাপারটা। ওই লোক আর বুবুর প্রতি মানুষগুলোর ভালবাসা খুব ভালভাবে টের পায় ও। প্রতিদিন কেউ না কেউ এটাসেটা নিয়ে আসে বুবুর জন্য, যার বেশিরভাগই রান্না করা খাবার। গরীব মানুষ, এর বেশি দেবার ক্ষমতা নেই, কিন্তু তার ভেতরের ভালবাসার গভীরতাটা অনুভব করতে পারে সিদ্রা। রোগী দেখা শেষ হবার পর ওগুলো খেতে খেতে গল্প করে ওরা।

বুবু বলেছে ওকে, এই সব শ্রমিকদের চিকিৎসা ফ্রি। বুবুকে কোম্পানি থেকে বিশাল এমাউন্টের স্যালারি দেয়া হয়, বলতে গিয়ে হেসে ফেলেছিল বুবু, “আমার কিছুই লাগেনা জানিস, সবকিছু তো ভাইটুই ব্যবস্থা করে দেয়। বছর বছর শুধু আমার ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ছে”

গতকাল বুবুকে এমনিই জিজ্ঞেস করেছিল ও, বিয়ে করেনি কেন বুবু? বলেই বুঝেছিল, প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি, কারণ মুখটা ভারী হয়ে গিয়েছিল বুবুর। কিন্তু বুবু এড়িয়ে না গিয়ে বলেছিল, “অনেক লম্বা কাহিনী, সময় করে একদিন বলবো তোকে” এখন সেটাই ভাবছে সিদ্রা, কি এমন কাহিনী থাকতে পারে বুবুর জীবনে?

চলব।