যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-২৯+৩০

0
355

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

২৯.
সিদ্রার ঘুম ভাঙলো এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে। বিছানা হাতড়ে খালি বোতল আবিষ্কার করে নিচে নামল পানি খাওয়ার জন্য। উপরে উঠতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করল ও। কোণার ঘর, যেটা ও ফারহানের বলে আন্দাজ করে, সেটার দরজাটা ভেজানো। ফাঁক দিয়ে নরম একটা আলোর রেখা চোখে পড়ছে। ভুতে বিশ্বাস না করলেও ভয় পেল সিদ্রা, কিন্তু কিসের আলো জানতেও ইচ্ছে করছে। শেষমেশ ভয় হার মানল কৌতূহলের কাছে। কিন্তু ঘরে উঁকি মেরে যা দেখলো, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা ও।

পুরো ঘর মোমবাতি, বেলুনসহ আরো নানা জিনিস দিয়ে সাজানো। সামনের দেয়ালে বড় করে লেখা “HAPPY BIRTHDAY FARHAN”। সাথে সাথে মনে পড়ল সিদ্রার, আজ দুপুরে বুবুর মন অনেক খারাপ ছিল। কি হয়েছে জানতে চাইলে কেঁদে ফেলেছিল বুবু। বলেছিল, “কাল ফারহানের জন্মদিন। আমরা দুই ভাইবোন ওকে প্রতি বছর নানারকম সারপ্রাইজ দিই এই দিনে। কিন্তু ও নিজেই এক বিশাল সারপ্রাইজ দিয়ে আমাদের সব সারপ্রাইজের ঋণ শোধ করে গিয়েছে! ছেলেটা যে কেন এমন করলো!”

চুপ করে গিয়েছিলো সিদ্রা, অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছিল ওকে। এসব কিছুর জন্য দায়ী ওর বোন, জেনে হোক আর না জেনেই হোক। ভাবলেই প্রচণ্ড কষ্ট হয় ওর।

চারিদিকে চোখ বুলিয়ে লোকটাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল সিদ্রা। ওর আর লোকটার ঘরের থেকে একটু আলাদা এ ঘরটা। বলতে গেলে প্রায় ফাঁকা একটা ঘর, আসবাবপত্র অনেক কম, একদম শুধু যা না থাকলেই নয়। বুঝতে পারলো, ফারহান ছেলেটা একটু অন্যরকম ছিল। শুধু একটা মিল আছে, দুই ভাইয়ের হাসিমুখের ওই বড় ছবিটা এঘরেও লাগানো। কিন্তু এসব আয়োজন যদি ওই লোকটা করে থাকে, তাহলে উনি কোথায়? ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যিনি এতকিছু করতে পারেন, তার যে আজকের দিনে কতটা কষ্ট লাগতে পারে, কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে সিদ্রা।

এবার ওর নজর পড়ল ঘরের টি টেবিলটার ওপর। সেখানে একটা কেক রাখা, উপরের মোমবাতিগুলো গলে গলে একদম নিভু নিভু। পাশে কিছু র‍্যাপ করা গিফটও চোখে পড়ছে। আরে, ওইতো টেবিলের ওপাশে মাথা রেখে উল্টোদিকে মুখ করে কার্পেটের উপর বসে আছে লোকটা। এসময় আমাকে দেখলে তো উনার কষ্ট আরও বেড়ে যাবে, চলে যাবো নাকি? কিন্তু কেন যেন মনটা সায় দিলনা ওর। মনে হল, আমার উপর রাগ দেখিয়েই নাহয় উনার মনের কষ্ট একটু কমুক!

আরেকটু এগোল সিদ্রা। ঘরের চারদিকে সাজানো বাকি মোমবাতিগুলো একটু মোটা মোটা, কয়েকটা আবার কাঁচের জারের ভেতর রাখা। নিভে যায়নি ওগুলো, এখনো ভালোই আলো দিচ্ছে, আর সেই আলোতে লোকটার মায়াবী মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো বোজা, হয়তো ভাইয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, ভাবতেই বড্ড মায়া লাগল সিদ্রার। ঘরের জানালাগুলো বন্ধ, এসিও চালায়নি লোকটা, কপালে ঘাম চকচক করছে।

কিছু করবে কি করবেনা খানিকক্ষণ ভাবল সিদ্রা। শেষমেশ থাকতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে জানালাগুলো খুলে দিল। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসে ভরে গেল ঘর, মোমবাতির শিখাগুলো নেচে উঠলো, জানালার কাছের কয়েকটা নিভেও গেল। পায়ে পায়ে লোকটার কাছে এল সিদ্রা। কেকের মোমবাতিগুলো এখন একেবারে নিভে গেছে। দূরের মোমবাতিগুলোর আলোয় দেখা যাচ্ছে, মৃদু বাতাসে লোকটার চুলগুলো নড়ছে। অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করল সিদ্রা, ওর খুব ইচ্ছে করছে লোকটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই এত লজ্জা লাগল ওর, ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

***
বুবুর বাসা থেকে বের হতেই মেঘ গুড়গুড় করে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে খুশিতে মনটা নেচে উঠল সিদ্রার। পুরো আকাশ ছেয়ে গেছে ঘন কালো মেঘে, বৃষ্টি হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ও অনেক ভালবাসে। কিন্তু এখানে আসার পর যখনি বৃষ্টি হয়েছে, হয় লোকটা এখানে ছিল নাহয় ওর মন ভীষণ খারাপ ছিল, বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছেই করেনি। কিন্তু আজ বৃষ্টিতে ভেজার একদম মোক্ষম সুযোগ। বুবুর সাথে গল্প করে মনটা ফ্রেশ হয়ে আছে আর লোকটাও বুবুর বাসায় যাওয়ার সময় ওদের সাথেই বেরিয়েছে, বলে গিয়েছে যে রাত হবে ফিরতে। আশেপাশে কেউ আছে কিনা চকিতে দেখে নিয়ে খালার হাতটা শক্ত করে ধরে দৌড় লাগাল সিদ্রা বাংলোর দিকে, বৃষ্টির একটা ফোটাও মিস করতে চায়না। খালা তো হতভম্ব হয়ে ওর সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে গেল। বাসায় ঢুকে ড্রয়িংরুমেই বোরকা খুলে ব্যাগ থেকে ওড়না বের করে পরতে পরতেই বাগানের দিকে ছুটলো ও।

সিদ্রাও বাগানে পৌঁছল আর বৃষ্টিও শুরু হল। দুহাত দুপাশে লম্বা করে ছড়িয়ে মুখ উপরে তুলে দুচোখ বন্ধ করে রইল সিদ্রা। মুখের ওপর টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার আনন্দ যে অনুভব করেনি, সে জীবনে অনেক বড় কিছু মিস করেছে। আস্তে আস্তে বৃষ্টির তেজ বাড়লো, খোপাটা আলগা করে দিল সিদ্রা। চোখ খুলে দেখে খালা বাগানের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

“খালা, আসেননা” ডাক দিল সিদ্রা, মাথা নাড়ল খালা।

“আরে আসেনতো, একা একা ভিজতে কোন মজা নাই” টেনে খালাকে নিচে নামাতে গেল সিদ্রা, না না করতে লাগল খালা। খালার হাত আর মাথা নেড়ে জোর প্রতিবাদ জানানো দেখে হেসে ফেলল সিদ্রা। সিদ্রার হাসিমুখ দেখে মনটা ভরে গেল খালার। আমি ওর সাথে ভিজলে যদি মেয়েটার মুখে একটু হাসি ফুটে, তবে ক্ষতি কি? হাসিমুখে যোগ দিল ওর সাথে।

***
রাইয়্যান বিরক্তমুখে ফোনটা পাশের সিটে ছুড়ে মারল। গাড়ি ড্রাইভ করছিল ও, অনেক জরুরী একটা প্রোগ্রামে যাবার কথা, যেখানে খোদ মন্ত্রীমশাই উপস্থিত থাকবেন। এখন শুনছে, মন্ত্রীমশাই নাকি প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করেছেন, কোন মানে হয়! গাড়ি ঘুরাল রাইয়্যান, ফিরে চলল বাংলোর দিকে।

গাড়ি পার্ক করতে গিয়েই মনে পড়ল, ওরা তো বুবুর বাড়ি গিয়েছে, আমিও ওখানে যাবো নাকি? নাহ! মেয়েটা বুবুর সামনে আমাকে নিয়ে বড্ড আনইজি ফিল করে, বুবুর চোখে কিছু ধরা পড়লে শেষে মিথ্যা বলতে বলতে জান যাবে, রিস্ক নিয়ে লাভ নাই।

নিজের ঘরে কাউচে বসে ল্যাপটপে মনযোগ দিয়ে কাজ করছে রাইয়্যান। হঠাৎ ভেজা বাতাসের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। যাব্বাবা, বৃষ্টি কখন শুরু হল, খেয়ালই তো করিনি। ইশ! কাগজগুলো ভিজে গেলোতো, জানালা বন্ধ করতে উঠল রাইয়্যান। হাসির শব্দ কানে আসতেই চোখ পড়ল বাগানের দিকে আর সেখানেই আটকে গেল।

মেয়েটা এত প্রাণ খুলে হাসতে পারে! আমার সাথে তো কোনদিনই না, খালার আর বুবুর সাথে কথা বলার সময় ওর মুখে একটু আধটু হাসির রেখা দেখেছি, কিন্তু এমন প্রাণখোলা হাসি এই প্রথম। ওর চুলগুলো এত লম্বা নাকি? হাঁটু ছুঁই ছুঁই করছে, আগে খেয়াল করিনি তো! কি আনন্দ নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে মেয়েটা।

সবুজ ড্রেসটাতে কি সুন্দর লাগছে ওকে! ড্রেসটাতো আমি নিতেই চাইছিলামনা, দোকানদার জোর করে দিয়ে দিল, বলে কিনা আপনার বউকে খুব মানাবে। বউ! শব্দটা মনে আসলে নিজের অজান্তেই ঠোঁটে একটা মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে রাইয়্যানের।

আমি তো কখনও বিয়েই করতে চাইনি, কিন্তু এই মেয়েটাকে বউ ভাবতে খারাপ লাগেনা। মেয়েটাতো বউ শব্দটা সহ্যই করতে পারেনা, যা রেগে উঠে। সিদ্রার রাগী চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মুখের হাসিটা চওড়া হল রাইয়্যানের। ধ্যান ভাঙল সিদ্রার হাসির আওয়াজেই। গাছে পানি দেওয়ার হোস পাইপটা নিয়ে খালার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে ও। খালা দুহাত দিয়ে পানি আড়াল করে পালানোর চেষ্টা করছে, সেটা দেখেই খিলখিল করে হাসছে সিদ্রা। হাসিতে তার মুক্তো ঝরে, কে যেন বলেছেন, তিনি কি এমন হাসি দেখেই লিখেছিলেন কথাটা?

বৃষ্টির তেজ একটু কমে এসেছে, এখন আরো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সিদ্রাকে। আজকে মেয়েটাকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে না? সেটা কি বৃষ্টিতে ভিজেছে বলে? হতে পারে! ও আচ্ছা, গয়না পরেছে। আমিই তো ওকে বলেছিলাম, সবসময় কিছু না কিছু পরে থাকতে, যাতে আমার বউ হিসেবে মান থাকে। কিন্তু সেই গয়না পরা অবস্থায় সিদ্রাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওর। ওইদিনের কথা মনে পড়ে গেল রাইয়্যানের। নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছিল সিদ্রা, হাত খালি দেখে ধমকে উঠেছিল রাইয়্যান।

“আমি গয়না পরে আছি, যাদের দেখানো লাগবে তাদের দেখিয়ে দিব, আপনার দেখার দরকার নেই” ধমকের জবাব এভাবেই দিয়েছিলো সিদ্রা।

“কেন?”

“কারণ আমার গয়নাপরা হাত দেখার অধিকার আপনার নেই” জামার হাতার উপর দিয়ে চেপে চুড়ির অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিল সিদ্রা, সেগুলোকে রাইয়্যানের সামনে জামার হাতার ভেতরে উপর দিকে উঠিয়ে রাখে ও। হতভম্ব রাইয়্যান সেদিন আর কিছু বলতে পারেনি ওকে।

ছোট একটা লকেটওয়ালা চেইন, হালকা ঝোলান ছোট একজোড়া দুল, আর চিকন চিকন একগাছা চুড়ি, এগুলোই সবসময় পরে থাকে সিদ্রা। আর আজ সেগুলো পরেই ওকে দেখছে রাইয়্যান। বাহ! গয়নাগুলো দারুণ মানিয়েছে তো! চয়েস কার দেখতে হবে তো? বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সোনার গয়না যেন ঝকঝক করছে। আর সাথে সিদ্রার চেহারাও, তা থেকে তো নূর বেরোচ্ছে, যে নূর রাইয়্যানকে তেড়ে বেড়ায় সবসময়, বলে যে ও নিষ্পাপ।

“তুমি অন্যায় করছো!” ভেতর থেকে কেউ একজন ধমকে উঠল রাইয়্যানকে। “ওই যে হাসি তুমি দেখছো, সে হাসি তুমিই কেড়ে নিয়েছো ওর থেকে। ও হাসছে, কারণ ও জানে তুমি এখানে নেই। ও যদি জানতো তুমি এখানে আছো, এমন হাসি ও কখনোই হাসতোনা। তাই এ হাসি দেখার কোন অধিকার নেই তোমার” কেঁপে উঠলো রাইয়্যান।

আরেকটা কথাও মনে হল ওর, যে মেয়ে আমার সামনে পর্দা করার প্রাণপণ চেষ্টা করে, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখছি, এটা ঠিক হচ্ছেনা, সত্যিই ভীষণ অন্যায় হচ্ছে। ও জানতে পারলে হয়তো আমার সামনে আসাই বন্ধ করে দিবে। সাথে সাথে জানালাটা বন্ধ করে দিল রাইয়্যান।

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৩০.
পরদিন ভোরে দরজায় ক্রমাগত ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙল রাইয়্যানের। আমার দরজায় ধাক্কা! নিশ্চয় গুরুতর কিছু হয়েছে, জলদি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলল রাইয়্যান। কান্নাভেজা চোখ নিয়ে সিদ্রা দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখেই দুহাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। ভয় পেয়ে গেল রাইয়্যান।

“এই, কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছিস কেন?”

কিছু বলতে গিয়েও কান্নার চোটে বলতে পারলনা সিদ্রা। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে ওর দু’কাঁধে হাত রাখল রাইয়্যান।

“শান্ত হয়ে বল আগে কি হয়েছে, নাহলে বুঝব কি করে?”

“খালার অনেক জ্বর….কিছুতেই কমছেনা… সব আমার জন্য হয়েছে… আমি ভিজতে না বললে এসব কিছুই হতনা… সব আমার দোষ…. প্লিজ আপনি কিছু করেন…. খালাকে বাঁচান” সিদ্রার কান্নার মাঝে থেকে এই কথাগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হল রাইয়্যান।

“আরে পাগলী! সেজন্য তুই এভাবে কাঁদছিস? জ্বর হলে কি মানুষ মরে যায় নাকি! কান্না থামা। চল দেখি কি হয়েছে”

রাইয়্যানের প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হল সিদ্রা, ব্যাপারটা উনি এত হালকাভাবে নিচ্ছেন কিভাবে? আসলে ও প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছে। জঙ্গলেও খালার জ্বর হয়েছিল ওর জন্য। আর এখন আবার, সেটাও ওরই পাগলামির জন্য, এটাই ও মানতে পারছেনা। তাও একটু আধটু হলে হয়। কি প্রচণ্ড তাপ! সারারাত ধরে জলপট্টি দিয়ে, মাথায় পানি ঢেলেও কমছেনা। ভয় পাবেনা?

রাইয়্যান ঘরে ঢুকে দেখল খালার কপালে জলপট্টির কাপড়। সেটা সরিয়ে হাত দিতেই চমকে উঠলো, পুরো আগুন! মেয়েটা অহেতুক ভয় পায়নি। চুল ভেজা খালার, নিচে বালতিও দেখা যাচ্ছে। মাথায় পানিও ঢেলেছে দেখছি।

“তুই থাক এখানে, আমি বুবুকে ফোন করে দেখি” মাথা নেড়ে সায় দিল সিদ্রা।

ফোন হাতে নিয়ে ফিরে আসল রাইয়্যান, দেখল সিদ্রা খালার হাতপা মুছে দিচ্ছে। চেয়ারে বসে বলল, “বুবু আসছে এখনি, কখন থেকে এ অবস্থা?”

“মাঝরাত থেকে”

“কি? এখন তো ছয়টা বাজে! কিন্তু…… তুই তো শুয়ে পড়েছিলি, কিভাবে বুঝলি?” হতভম্ব দেখাচ্ছে রাইয়্যানকে।

“শুয়ে পড়ার পর হঠাৎ আমার আগেরবারের কথা মনে পড়ে, সেদিন ওইটুক ভেজাতেই খালার এত জ্বর এসেছিল, আর আজ তো এতক্ষণ ধরে ভিজেছে, তাই দেখতে এসেছিলাম আমি”

“তারপর থেকে একা একা এসব করছিস! আমাকে ডাকিসনি কেন?”

“ওইদিন তো শুধু জলপট্টি দিয়ে আর গা মুছিয়েই কমে গিয়েছিল জ্বর, আজ তো মাথায় পানিও ঢেলেছি। আমি ভেবেছিলাম কমে যাবে”

“ঔষধ খাইয়েছিস?” উপর নিচে মাথা ঝাঁকাল সিদ্রা।

“চিন্তা করিসনা। খালার বৃষ্টির জল কোনকালেই সহ্য হয়না। কিচ্ছু হবেনা, ভাল হয়ে যাবে। এর আগেও হয়েছে এমন” যদিও আজকেরটা যে সামান্য না, ভালভাবেই বুঝতে পারছে রাইয়্যান। কিন্তু সেটা এখন এই মেয়েকে বলা যাবেনা, এমনিতেই তো কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
কথার ফাঁকে ফাঁকে আবার জলপট্টি দেয়া শুরু করেছে সিদ্রা। আবার ওকে চোখ মুছতে দেখল রাইয়্যান। ওর মন এত নরম যে ওর জন্য খালার সামান্য জ্বর হয়েছে, সেটাই ও মানতে পারছেনা। অথচ একটা ছেলে ওর জন্য মারা গেছে, সেটা তাহলে কিভাবে এত সহজে মেনে নিচ্ছে!? এই পরিস্থিতিতেও আরেকটা অদ্ভুত চিন্তা আসলো ওর মাথায়। আচ্ছা, যদি আমি কোন কারণে অসুস্থ হই, সিদ্রা কি আমারও এভাবে সেবা করবে?

কলিংবেলের আওয়াজে চিন্তার জাল ছিন্ন হল রাইয়্যানের। দরজা খুলতে গেল ও, ফিরে এল বুবুকে নিয়ে।

“জ্বর মেপেছিস?” ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল বুবু।

“না, থার্মোমিটার খুঁজে পাইনি” উত্তর দিল সিদ্রা।

আর কিছু না বলে বুবু থার্মোমিটার বের করে খালার মুখে ঢুকাল।

চোখ কপালে উঠলো বুবুর, “১০৪! শিগগির গাড়ি বের কর ভাইটু, হসপিটালে নিতে হবে” খালার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাইয়্যান বের হয়ে গেছে ঘর থেকে।

খালাকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলল রাইয়্যান। সিদ্রাকে তো লক করে যেতে পারবেনা বুবুর সামনে, তাহলে এখন কি করবে, সেটা ভাবতে গিয়েই ও দরজায় দাঁড়ানো সিদ্রার দিকে তাকালো। আগে বুঝতে পারেনি, কিন্তু এখন বাইরের আলোয় সিদ্রার মুখটা একটু অস্বাভাবিক লাগল ওর কাছে। কি মনে করে এগিয়ে এসে ওর কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলো রাইয়্যান। বুবুকে ডাক দিল, “বুবু, ওরওতো জ্বর এসেছে, যদিও খালার মত এত বেশি না। কি করি বলোতো?”

“না না, আমার কিচ্ছু হয়নি, আমি ঠিক আছি, আপনারা খালাকে নিয়ে যান” প্রতিবাদ করল সিদ্রা।

“নারে, জ্বর অবস্থায় তোকে একা রেখে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা, শেষে আরেকটা বিপদ বাঁধবে। ভাইটু, আমিই খালাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি। আর দরকার পড়লে আমি ফোন করে নিব, তুই সিদ্রার খেয়াল রাখ” কথাগুলো বলে চাবি নিয়ে ড্রাইভারের সিটে উঠে বসল বুবু।

“সাবধানে চালিও বুবু” চিৎকার করে বলল রাইয়্যান।

সিদ্রাকে কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিতে বলল রাইয়্যান কিন্তু কথা কানে তুললনা সিদ্রা, সোফায় গিয়ে বসে রইল। বাধ্য হয়ে রাইয়্যান নিজেই ঢুকল রান্নাঘরে। দেখল ইন্ডাকশনের উপর একটা সসপ্যানে স্যুপ। খালার জন্য করেছিল সিদ্রা, বুঝল ও। সেটাকেই গরম করে নিয়ে গেল সিদ্রার কাছে।

সিদ্রা সোফায় হেলান দিয়ে আছে, চোখ বোজা। ঘুমিয়ে গেল নাকি! আবার কপালে হাত দিল রাইয়্যান। চোখ খুলল সিদ্রা, দুর্বল কন্ঠে বলল, “আমার কিছু হয়নি, আপনি খালার কাছে যান প্লিজ”

কোন উত্তর দিলনা রাইয়্যান। তাপ আগের থেকে বেশি মনে হচ্ছে, জ্বর বাড়ছে নাকি? তাড়াতাড়ি করে খালার ঘরে গেল ও থার্মোমিটার আনতে। থার্মোমিটার এর সাথে প্যারাসিটামলের পাতাটাও নিয়ে এল।

জ্বর মেপে দেখল, একশোর একটু বেশি। যাক, এত বেশি না, হাঁফ ছাড়ল রাইয়্যান। স্যুপ খাওয়ার জন্য উঠে বসতে বলল সিদ্রাকে। “আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা, নরমাল জ্বর, এমনিই কমে যাবে, আমার জন্য এত ব্যস্ত নাইবা হলেন! আপনি বুবুকে ফোন দিয়ে দেখুন খালার কি খবর”

“বুবু ওখানে আছে, খালাকে নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবেনা। আচ্ছা বেশ, তুই স্যুপ খেয়ে ঔষধ খেলে আমি বুবুকে ফোন দিব”

একথায় চট করে সোজা হয়ে বসল সিদ্রা। রাইয়্যান খাইয়ে দিতে যাচ্ছিল ওকে, বাধা দিল সিদ্রা। নিজেই বাটি নিয়ে আস্তে আস্তে খেয়ে নিল স্যুপটুকু। তারপর ঔষধ খেয়েই বলল, “এবার ফোন করেন”

হাসল রাইয়্যান, ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করল। কথা বলার পর সিদ্রাকে বলল, “টেনশনের কিছু নাই, ওরা এডমিট করে নিয়েছে। জ্বর কমার জন্য সাপোজিটরি দিয়েছে আর টেস্ট করার জন্য ব্লাড নিয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর, ইন শা আল্লাহ্‌ টেস্ট রিপোর্ট ভালই আসবে” সিদ্রার দিকে এগিয়ে আসল রাইয়্যান, “সারারাত ঘুমাসনি, এখন ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নে কিছুক্ষণ। দেখবি, ঘুম থেকে উঠে শুনবি যে খালার জ্বর ভাল হয়ে গেছে”

“ইন শা আল্লাহ্‌” বলে উঠে পড়ল সিদ্রা। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে যেন টলে উঠলো একটু, রাইয়্যান ছুটল ওকে ধরার জন্য। কিন্তু সিদ্রা হাতের ইশারায় নিষেধ করলো ওকে, নিজেই রেলিঙ ধরে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেলো। আর মনে মনে বলল, বললেই হল নিশ্চিন্তে ঘুমা, গোটা বাড়িতে আপনি আর আমি একা, জীবনেও ঘুম আসবেনা আমার। কিন্তু ওই বলা পর্যন্তই, শরীর এত ক্লান্ত হয়ে ছিল, বিছানায় শুয়ে চোখ বুজতেই সিদ্রা হারিয়ে গেল ঘুমের জগতে।

***
এক ঘুমে দুপুর পার করে দিল সিদ্রা। রাইয়্যান মাঝে মাঝে এসে চেক করে গিয়েছে। ঔষধ খাওয়ার পর জ্বর ছেড়ে গিয়েছে, আর আসেনি।

ঘুম ভেঙে সিদ্রা বুঝলো যে ওর জ্বর নেই, সকালের ভারী মাথাটা এখন অনেক হালকা লাগছে। জানালার দিকে চোখ পড়তেই বুঝলো যোহরের ওয়াক্ত যাই যাই করছে। তড়াক করে উঠে বসলো ও। এদিকে জ্বর ছাড়ার সময় ঘামে ভিজে জামা টামা সব চ্যাটচেটে হয়ে আছে। শুধু অজু করে নামাজ পড়া সম্ভব না। যত দ্রুত সম্ভব ফ্রেশ হয়ে শরীর মুছে ড্রেস চেঞ্জ করে নিল, গোসল করার ঝুঁকি আর নিলনা। বের হয়েই দেখল, লোকটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়াতেই সকালবেলার অস্বস্তিটা আবার ফিরে এল। বাসায় আর কেউ নেই, ভাবতেই ভয় লাগছে সিদ্রার। লোকটা মানুষের সামনে তো খালি বউ বউ করে, এখন ফাঁকা বাড়িতে যদি কিছু করে বসে, কি করব আমি? নাহ! আল্লাহ্‌ আছেন, তিনিই রক্ষা করবেন, মনে মনে ভরসা পেল সিদ্রা।

“খালা কেমন আছে?” সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করল সিদ্রা।

“জ্বর কমেছে, ডাক্তাররা বলেছে, চিন্তার কিছু নাই” হাসিমুখে উত্তর দিল রাইয়্যান।

লোকটা অকারণে হাসছে কেন? কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেইতো? একি, আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন?

চলবে।