যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-৭+৮

0
370

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৭.
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? কি করতে চাইছেন আপনি?” বারংবার জানতে চাইল সিদ্রা।

কোন কথা বলছেনা লোকটা, এগিয়েই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শিকলে এমন টান দিচ্ছে, কোনমতে পড়তে পড়তে বেঁচে যাচ্ছে ও। মনে হচ্ছে যেন ইচ্ছে করে করছে কাজটা। প্রায় পাঁচ মিনিট হাঁটার পর থামল লোকটা। জংগল আগের থেকে ঘন হল না পাতলা, বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। ওকে একটা মোটা গাছের সাথে দুইহাত পিছমোড়া করে শিকল দিয়ে আটকাল লোকটা। বলল, “নে, এবার যত খুশি চিৎকার দে আর বনের পশুপাখিদের শুনা। দেখি, কাউকে পটাতে পারিস কিনা! কপালে থাকলে বাঘ-ভাল্লুক কিছুও তোর প্রেমে পড়ে যেতে পারে”

“কি-ক্কি বলছেন আপনি….. ব ব্বাঘ- ভাল্লুক মানে? আমাকে এখানে আ-আটকে রেখে যাচ্ছেন ক্কেন?” ভয়ের চোটে তোতলাতে লাগল সিদ্রা।

লোকটা আর কোন কথা না বলে যেপথ দিয়ে ওরা এসেছে, সেদিকে হাঁটতে লাগল।

“শুনেন, শুনেন, এই যে……… আপনি একটা পাগল, শুনছেন আপনি, আস্ত একটা সাইকো আপনি” এতবার ডাকল সিদ্রা, পরের কথাগুলো চিৎকার দিয়ে বলল। কোন ডাকই কানে তুললনা লোকটা। একটু পরেই গাছের আড়াল হয়ে গেল।

ঢোক গিলল সিদ্রা, যেদিকে তাকাচ্ছে, সেদিকেই শুধু গাছ আর গাছ। উপরে পাতার ফাঁক দিয়ে বিন্দু বিন্দু আকাশ দেখা যাচ্ছে। ডাক দিয়ে দেখি, কেউ তো শুনতেও পারে। উচ্চকণ্ঠে ডাকতে লাগল সিদ্রা,
“হেলো……. কেউ শুনতে পাচ্ছেন……. আমাকে বাঁচান…… হেলো……. কেউ আছেন…… শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা…… একটা পাগল মাথা খারাপ লোক আমাকে কিডন্যাপ করে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে……… আমাকে বাঁচান প্লি………জ…..”

ডাকতে ডাকতে গলা ব্যাথা হয়ে গেল সিদ্রার। কিন্তু কোন মানুষ তো দূরের কথা, কোন জন্তুজানোয়ারও উঁকি দিলনা। অবশ্য কোন জন্তুজানোয়ার আসুক, সেটাও চাইছেনা। কি করবে বুঝতে না পেরে আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করতে শুরু করল, চোখে পানিও চলে এল মুহূর্ত পরেই।

হঠাৎ করেই মনে পড়ল কথাটা। লোকটা আমাকে হাফেজ সাহেবা বলেছে, মানে আমার সম্পর্কে সবটাই জানে। তাহলে এসব অপবাদ দেয়ার মানে কি! মানছি, কিছু কিছু মাদ্রাসায় পড়া মেয়ে এমনকি কিছুসংখ্যক হাফেজারাও শয়তানের ধোঁকায় আর দুনিয়াবি মোহে ভুল পথে চলে যাচ্ছে বা গেছে, আল্লাহ্‌ তাদের হেদায়াত দান করুন। কিন্তু আমি কেমন মেয়ে সেটাতো আমার আশেপাশের সবাই জানে। তাহলে লোকটা এসব ফালতু কথা কেন বলছে? আমার ছবিও নাকি ফেসবুকে দেখেছে! আমি কোনদিন মেসেজেও নিজের পিক শেয়ার করিনা, ফেবুতে তো দূরের কথা!! তাহলে? ধূর! মাথা কাজ করছেনা আমার। আকাশের দিকে তাকাল সিদ্রা,
“আল্লাহ্‌! এসব কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে? তুমি আমাকে এমন পরীক্ষায় কেন ফেললে আল্লাহ? অন্তত আমি এসব কেন সহ্য করছি, সেটা তো বলে দাও। আমাকে সাহায্য করো, এসব থেকে মুক্ত কর মাবুদ, আমাকে মুক্ত কর।“ অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে ডেকে চলল সিদ্রা।

আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে দুপুর হল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কারো কোন দেখা নেই। সেই রাত থেকে পেটে ওই এক চুমুক বিষ চা ছাড়া আর কোন দানাপানি পড়েনি। পেটের ভেতরে ছুঁচো-ইঁদুর সব একসাথে যুদ্ধ করা শুরু করেছে। এরমধ্যে গাছ থেকে একটা মাকড়শা নেমে এসেছিল সিদ্রার গায়ে।

“আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া………. আল্লাহ্‌ বাঁচাও, আল্লাহ্‌ বাঁচাও” করে এমন চিৎকার দিয়েছিলো যে, আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে কোন মানুষ থাকলে শোনার কথা। কিন্তু কেউ আসেনি। মাকড়শাটা অবশ্য কিছু করেনি, ওর গা বেয়ে শুধু নেমে গেছে।

এখন যত রাত ঘনিয়ে আসছে, সিদ্রার ভয় তত বাড়ছে। লোকটা কি আমাকে সারারাত এখানে আটকে রাখবে নাকি! যেই পাগল লোক, রাখতেও পারে, ভাবল ও। কিন্তু আমি কি করব, ভয়েই তো মরে যাব মনে হচ্ছে। আল্লাহ্‌, তুমি আমাকে সাহস দাও, ধৈর্য দাও আর ওই লোকটাকে সুমতি দাও।

অন্ধকার ঘন হতেই হঠাৎ মেঘ গুড়গুড় করে উঠল, সাথে বাতাসও বইতে শুরু করল। ও আল্লাহ্‌! এর মধ্যে আবার বৃষ্টি হবে নাকি!!

একটু পরেই ঝপ করে যেন রাত নেমে এল বনের মাঝে। আসলেই সন্ধ্যা হল, না মেঘের জন্য, ঠিক বুঝতে পারলনা সিদ্রা। কিন্তু অন্ধকারে ভয়ে এতটুকু হয়ে গেল ও। মেঘের ডাকও বাড়ছে আস্তে আস্তে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটু পর পর। তার আলোয় দেখা যাচ্ছে আশেপাশের গাছগুলো পাগলের মত নৃত্য করছে। দোয়াদরুদ পড়া শুরু করল সিদ্রা। এরকম একটা দিন ওর জীবনে আসবে, ও কি স্বপ্নেও ভেবেছিল! হায়রে নিয়তি, এর খেলা বোঝা দায়!!

যা ভেবেছিল তাই, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। আর কি গর্জন গাছপালা আর মেঘের। মটমট করে ডাল ভাঙারও শব্দ পাচ্ছে সিদ্রা। মাথার উপরে একটা পড়লেই সোজা আল্লাহ্‌র কাছে। আব্বু-আম্মু আর বোনকে আর দেখতে পাবোনা আমি, এভাবেই মৃত্যু লেখা আছে আমার কপালে। জোরেশোরে আল্লাহ্‌ কে ডাকতে লাগল সিদ্রা। বিপদের ষোলকলা পূর্ণ করতেই যেন মনে হল পায়ের উপর দিয়ে সড়সড় করে কি একটা যাচ্ছে।

“আল্লাহ্‌ গো….. সাপ! সাপ!” ভয়ে চিৎকার দিল সিদ্রা। এসময় বিদ্যুৎ চমকাল। তার আবছা আলোয় দেখল সিদ্রা, লোকটা দৌড়ে আসছে।

রাগে দুঃখে কি করবে বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। ওর মনে চাচ্ছে, একটা পাথর টাথর কিছু মেরে লোকটাকে খুন করে দেয়। লোকটা কাছে এসে ওর পায়ের ওপর টর্চ এর আলো ফেলল, “কোথায় সাপ?”

রাগ, ভয়, আতঙ্ক, ঘৃণা সব দলা পাকাল সিদ্রার মাঝে। কথা বলতে পারছেনা সিদ্রা। সারা শরীর কাঁপছে ওর। লোকটা ওর মুখের ওপর আলো ফেলে দেখল ঠোঁট মুখ তিরতির করে কাঁপছে আর দুচোখে এমন এক দৃষ্টি, যা এর মধ্যে ওর চোখে দেখেনি। লোকটা মনে হয় বুঝতে পারল ওর অবস্থা। পেছনে গিয়ে শিকল খুলে দিল।

তারপর প্রথমবারের মত আলতো করে সিদ্রার থরথর কম্পমান হাতটা ধরল লোকটা, যেন অভয় দিতে চাইছে। রাগে ঘৃণায় রি রি করে উঠল সিদ্রার সারা শরীর। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল ও। লোকটা এবার হাতটা শক্ত করে ধরল আর হাঁটার জন্য টানল ওকে। কিন্তু সিদ্রার যেন ওখানে শিকড় গজিয়ে গেছে, এক চুলও নড়লনা ও। এতক্ষণ ও একা একা ভয়ে মরছিল, কিন্তু এখন এই জঘন্য লোকটার ওপর এত ঘৃণা হচ্ছে যে, তার সাথে আর যেতে ইচ্ছে করছেনা ওর। মনে হচ্ছে, এখানে গাছের ডাল মাথায় পড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অসুখ করে মরে যাওয়াও ভাল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনর্গল। বৃষ্টির ফোটার সাথে চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ও এগোচ্ছেনা দেখে লোকটা আবার টর্চের আলো ফেলল ওর মুখে। এবার বুঝতে পারল যে কাঁদছে ও। ও কিছুতেই এগুচ্ছেনা দেখে লোকটা ওকে ধরে বস্তার মত কাঁধে তুলে ফেলল। সাথে সাথে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল সিদ্রা। হাতপা ছুড়তে লাগল সমানে, “ছাড়েন আমাকে…….ছাড়েন বলছি………নামান আমাকে…….হাঁটছি আমি……..নামান বলছি……. ছাড়েন প্লি……জ………..”।

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৮.
কে শুনে কার কথা? সিদ্রার চিল্লাচিল্লি আর অজস্র কিলঘুষি খেয়েও লোকটা ওকে কাঁধ থেকে নামালোনা। দ্রুত পা চালিয়ে চালাঘরের বারান্দায় এসে থামল। তখনও কিন্তু সিদ্রার পা থেকে শিকল ঝুলছে। ঘরের ভেতর ঢুকে ধপাস করে ওকে মেঝেতে ফেলল লোকটা। অন্ধকার ঘরে ভয়ে দম আটকে গেল সিদ্রার। তবে লোকটা আর কিছু করলনা, শুধু নিচু হয়ে পা থেকে শিকলটা খুলে নিল। বের হওয়ার আগে বলল,
“ফারদার কোন চালাকি করার আগে আশা করি আজকের কথাটা মনে থাকবে”।

“মনে থাকবে, কিন্তু আমার সাথে এমন আচরণ করার জন্য আপনি একদিন পস্তাবেন, ক্ষমা চাইবেন আমার কাছে, মিলিয়ে নিয়েন কথাটা” স্বর উঁচু করে বলল সিদ্রা, কারণ লোকটা ততক্ষণে বের হয়ে গেছে।

প্রায় সাথে সাথেই ওই মহিলাটা একটা তেলের বাতি আর কয়েকটা কাপড় নিয়ে ঘরে ঢুকল। বাতিটা ট্রাংক এর ওপর আর কাপড়গুলো বিছানায় রেখে ইশারা করল। ওকে কাপড় চেঞ্জ করতে বলছে, এটা বুঝল সিদ্রা। দরজা লাগিয়ে মহিলা চলে গেলেও সিদ্রা সাথে সাথে উঠতে পারলনা। সারাদিনের ধকলে শরীর মন এত ক্লান্ত যে ওর নড়তেও ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু সারাদিনের কাজা নামাজের কথা চিন্তা করে কষ্ট করে উঠল সিদ্রা। উঠে দেখল, এক সেট শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট আর সাথে একটা গামছা। শাড়িটা অনেক পুরনো, এই বাতির আলোতেও সেটা বোঝা যাচ্ছে, এমনকি জায়গায় জায়গায় ছেঁড়াও। মনে হচ্ছে ওই মহিলারই পুরনো শাড়ি হবে।

মনটা খারাপ হয়ে গেল সিদ্রার। ওই লোকটা যখন তখন চলে আসছে, আমি কিভাবে এই ছেঁড়া শাড়ি পরে থাকব, ভাবল ও। লোকটা যখন ওকে তুলে আনছিল, তখন স্কার্ফটাও বনের ভেতরে কোথাও পড়ে গেছে। কিন্তু এখন পোশাকও তো পাল্টাতে হবে, কি করি? আইডিয়া! পেয়েছি বুদ্ধি।

শাড়িটার তুওলনামূলক ভাল একটা পাশ ওড়নার সাইজ করে ছিড়ে ফেলল সিদ্রা। পুরনো শাড়ি, একটানেই ছিড়ে গেল। বাতিটা ফু দিয়ে নিভিয়ে দিল, কারণ জানালাগুলো খোলা আছে, লোকটা আশেপাশে থাকতে পারে। গামছা দিয়ে শরীর মুছে বাকি শাড়ির অংশটুকু ব্লাউজ পেটিকোট এর সাথে গুঁজে কোনমতে পরে নিল। তারপর ছিড়ে নেয়া অংশটা দিয়ে ওড়না পরে নিল। কি বুদ্ধি বের করেছি! নামাজ পড়ে নিয়ে বোরকাটাও পরে ফেলব। এর আগে যেন লোকটা না আসে আল্লাহ, মনে মনে প্রার্থনা করল সিদ্রা।

এসময় মহিলাটা আবার আসল। খাটের ওপর কিছু একটা রেখে নিভে যাওয়া বাতিটা নিয়ে গেল। আবার বাতিটা দিয়ে যেতেই সিদ্রা তাকিয়ে দেখল থালা ভর্তি মুড়ি আর এক টুকরা গুড়। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা, সারাদিন উপবাসের পর গুড়মুড়ি! আর কি কি আছে আমার কপালে?

ক্ষুধা তো লেগেছেই কিন্তু খাবার দেখে সেটা আরো প্রকট ভাবে অনুভূত হল। এদিকে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে গোসল তো হয়েই গেছে। সেক্ষেত্রে আগে নামাজটা পড়ে ফেলা দরকার। কারণ অজু ভেঙে গেলে এই বৃষ্টির মধ্যে অজু করতে বের হতে কাহিনী করতে হবে, মহিলা দরজা না খোলার চান্স আছে। আজ ভোররাতে অনেক ডাকাডাকি করেও দরজা খোলাতে পারেনি সিদ্রা। বাধ্য হয়ে খাওয়ার পানি দিয়ে অজু করেছে। কিন্তু এতগুলো নামাজ পড়ার জন্য শক্তিও তো লাগবে। তাড়াতাড়ি করে কয়েক মুঠো মুড়ি পানি দিয়ে গিলে নিয়ে নামাজে দাঁড়াল সিদ্রা।

হাতটা বেঁধেছে কি বাঁধেনি, এমন সময় “হ্যাঁচ্চো!” এরপর পুরো নামাজে হাঁচি দিতে দিতে নাজেহাল হয়ে গেল সিদ্রা। বাতিটা বাতাসে প্রায়ই নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছিল, অবশেষে এক দমকা বাতাস পুরোপুরি নিভিয়েই দিল। ইবাদত যত আঁধারে করা যায়, ততই আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করা যায়। আজকের ঘটনায় আরো দুর্বল হয়ে গেছে সিদ্রার মন। নামাজের ভেতরেই তাই ভেতরের দলাপাকা কষ্টগুলো চোখ বেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। নামাজ শেষে জোরে জোরে কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করতে লাগল সিদ্রা। মোনাজাত যখন শেষ হল বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে, শুধু বাতাস বইছে। একটু শীত শীত লাগছিল সিদ্রার, উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে মনে হল, কেউ একজন সরে গেল জানালার সামনে থেকে। হায় হায়, লোকটা নাকি? শুনে ফেলল নাতো আমার কথাগুলো, কেমন বিব্রত লাগল সিদ্রার। কিন্তু একি? জানালার পাল্লা আছে, কিন্তু আটকানোর মত কিছু নেই। এখন কি হবে? অনেক শীত করছে তো, তার ওপর ঠাণ্ডাও লেগে গেছে!!

ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে, তাই শীতের চিন্তা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি করে খেতে বসল সিদ্রা। গতকাল রাতেও ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল ওর। তখনি মনে পড়ে ঘরের আলমারিটার কথা, ওখানে কিছু থাকতে পারে। অন্ধকারে আন্দাজে হাতড়ে একটা চাদর পেয়েছিল। ওটা দিয়েই কাল রাতে ঠাণ্ডা আর মশার কামড় থেকে রেহাই পেয়েছিল।

এখন ওটাই ডাবল করে গায়ে পেঁচাল, একটু আরাম লাগল। বিছানায় বসে আবার মুড়ি খেতে শুরু করল। কিন্তু ততক্ষণে ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সিদ্রা, মুড়ি চিবানোর মত শক্তি আর ওর শরীরে অবশিষ্ট নেই। থালা ফাঁকা করার আগেই ঘুমে ঢলে পড়ল সিদ্রা।

এরপরের দুটো দিন ঘরেই বন্দী থাকতে হল সিদ্রাকে। লোকটা আর কেন যেন আসেনি। দিনে দুবার খাবার দিয়ে গেছে মহিলা, কখনো শুকনো রুটি আবার কখনো গুড় মুড়ি। এক বেলাও ভাত খেতে দেয়নি।

মহিলাটাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছে সিদ্রা, কথা নাহয় বলতে পারেনা, ইশারায়ও তো উত্তর দিতে পারে। না, পাথর মুখ করে থাকে সবসময় আর মাঝেমাঝে ঠাণ্ডা চোখে তাকায়। ওই চোখ দেখলে মনে হয়, মহিলা জাদুটোনা করে। কি করে আল্লাহ জানে, কিন্তু ওই লোকের কথা যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এতে কোন সন্দেহ নেই। অনেকবার বাথরুমে যাওয়ার উসিলায় পালানোর চিন্তা করেছে সিদ্রা, কিন্তু মহিলা এত শক্ত করে ওকে ধরে রাখে, ও কেন ওর বাপেরও সাধ্য নেই ওই হাত ছুটিয়ে পালায়।

সেদিন রাতে আরেক ঝামেলা হল। ডায়রিয়া হয়ে গেল সিদ্রার। হবেনা কেন? উল্টাপাল্টা খাবার, তারও আবার কোন নিয়মনীতি নেই। শরীরটাও দিনকে দিন দুর্বল হয়ে গেছে দুবেলা করে খাবার খেয়ে। সন্ধ্যার পর থেকে ঝম ঝম করে বৃষ্টিও নামল। আর এই বৃষ্টির মধ্যে বারবার করে বাথরুম যেতে হচ্ছে ওকে। আর মহিলাও একটা ছাতা নিয়ে বারবার ওকে বাথরুমে আনা নেওয়া করছে। সিদ্রাতো বাথরুমে ঢুকে যাচ্ছে, আর সে মহিলা দরজার বাইরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিচ্ছে ওকে। এতে করে ভিজেও যাচ্ছে বারবার। সিদ্রা অনেকবার উনাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল যে, এই বৃষ্টির মধ্যে ও পালাবে না, পালাতে পারবেনা। উনাকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা। কিন্তু উনি মানলে তো!

যে ওকে বন্দী করে রাখছে, খেতে দিচ্ছেনা, তার প্রতি কোন সহানুভূতি আসার কথা না, কিন্তু মহিলাটা বোবা বলেই হয়ত ওর একটু মায়া লাগছে। তাছাড়া উনি যে শুধু ওই লোকের হুকুম তামিল করছেন, সেটা তো পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে। আর মালিক যা বলবে উনি তাই বিশ্বাস করবেন ওর সম্পর্কে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই উনার ওপর তেমন রাগ হচ্ছেনা সিদ্রার।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল সিদ্রার। শরীরে এক ফোটাও শক্তি নেই। ট্রাংক এর ওপর কয়েক প্যাকেট ওরস্যালাইন আর একটা থালায় ভাত তরকারি চোখে পড়ল সিদ্রার। নিশ্চয় ওই মহিলা রেখে গেছে। হাত দিয়ে দেখে তখনো হালকা গরম আছে ভাতটা। তাড়াতাড়ি করে আগে গ্লাসে স্যালাইন গুলিয়ে খেয়ে ভাত খেতে বসল সিদ্রা। কয়দিন পর এই সামান্য তরকারী দিয়ে ভাত খেতে যেন অমৃতের মত লাগল সিদ্রার। যেন কতকাল ভাত খেতে পায়নি, এমন মনে হচ্ছে ওর। বুঝল, ওর পেটের অবস্থা দেখেই ভাত রান্না করেছে মহিলা। উনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসল সিদ্রার।

খাওয়া শেষ করে “খালা, খালা” করে ডাক দিল সিদ্রা, ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু খালা আসলনা। কোথাও গেছে মনে হয়, ভাবল সিদ্রা। কিছুক্ষণ পর আবার ডাকল, তাও আসলনা। তখন জানালার কাছে গিয়ে জোরে জোরে ডাকল, তাও কোন সাড়া নেই। অদ্ভুত তো, এমন তো কখনো হয়নি, ভাবল সিদ্রা।

চলবে।