#রঙতুলির_ক্যানভাস
#লেখনীতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_০৮
পরিবেশ শান্ত !তবে এখানে উপস্থিত প্রত্যেকের নীরবতা জানান দিচ্ছে আজকে রোদেলা,রোদ্দুরের ভাগ্যে অনেক কিছু আছে।
করিম আর রফিক বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছেন।নোভার থেকে সবটা শুনার পর এই আলোচনা সভা।রুবি আর কাকলি আনন্দে মাতোয়ারা!
“মামা বাদ দেও না,ওরা তো একসাথে থাকতে চায় না!”
খুশিতে বলে দিলো রুবি!ওর সাথে ওর মাও তাল মিলালো!
“হ্যাঁ ভাইজান, জোর করে তো আর সংসার করানো যায় না!”
করিম মলিন হাসলো।
“হেয়ারিং এর ডেট কবে?”
করিমের কথায় রোদেলা রোদ্দুর চমকে উঠলো! করিম ওদের চমকানো দেখে হাসলো।
“ভেবেছিলাম তোমরা থাকবে একসাথে,কিন্তু আসলেও! জোর করে সংসার করানো যায় না!এখানে লেখা সাত দিন পর ডেট!শুভ কামনা!”
বলেই উঠে দাড়ালেন!তার প্রতিটা কথায় স্পষ্ট সে কতটা আঘাত পেয়েছে!রোদেলা ওর বাবা কে কিছু বলবে তার আগেই তিনি উঠে রুমে চলে গেলেন!রোদেলা পিছু পিছু গেলো।
“বাবা!”
রফিক নির্লিপ্ত!রোদেলা আস্তে করে এসে রফিকের পায়ের কাছে বসলো।তার এক হাত নিজের মুঠোয় নিলো।
“আমি জানি আমার কারণে তুমি হার্ট হয়েছো,কিন্তু বাবা একটা পারফেক্ট লাইফ পার্টনার এর জন্য একে অপরের সাথে ভালো থাকাটা জরুরি!তুমি নিজেও দেখো আমাদের মাঝে না আছে বনি বনতা,না আছে আন্ডার স্ট্যান্ডিং!এভাবে সারাটা জীবন ম্যানেজ করে থাকা যায়!বাবা,আমারও স্বপ্ন আছে।আমার লাইফ পার্টনার কে নিয়ে।সে আমাকে অনেক অনেক আগলে রাখবে,ভালোবাসবে!রোদ্দুর আমার ভালো বন্ধু হতে পারে বাট!পার্টনার?যেখানে আমরা সারাদিন ঝগড়া করেই দিন কাটাই সেখানে অন্য কিছু কিভাবে বাবা?”
রফিক মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”তোর মা যাওয়ার পর তোকে নিজের বেস্ট টা দিয়ে বড় করেছি!ইভেন লাইফ পার্টনার টাও বেস্ট টাই দিয়েছি!কিন্তু তোরা বুঝলি না!কর যা খুশি!শুধু আফসোস করিস না পরে!”
রোদেলা বলার কিছু পেলো না।উঠে গেলো!রোদ্দুরের রুমে যেতে নিলেই নোভা আটকালো!
“তোর জিনিস পত্র তোর নিজের রুমে দিয়ে এসেছি!আলাদা যখন হবি ই এখন হ!”
বলেই চলে গেলো।রোদ কিছু না বলে নিজের রুমে গেলো।
________
পরেরদিন!বাড়ির অবস্থা ভালো না,সবাই কেমন একটা হয়ে থাকে।তাই একটু মাইন্ড ফ্রেশ করতে বাইরে আসলো রোদেলা।
“হাই রোদ!”
সানির কথায় ভ্রু কুচকে সামনে তাকালো রোদেলা।
“তুই এখানে?”
“ভেবেছিলাম তোর বাড়ি যাবো,বাট রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো।”
রোদেলা শক্ত কণ্ঠে বললো,”তোকে বলেছি না আমার সামনে আসবি না!”
“তোর তেজ এখনও আগের মতই!কিন্তু সেটা স্বল্প ক্ষণের।”
বলেই হাতে থাকা বোতল খুললো,রোদেলা কিছু বলার আগেই বোতলের এসিড ছুড়ে মারলো ওর দিকে।ওদিকে কেও হেচকা টেনে রোদেলাকে সরিয়ে আনলো।এসিড সব পড়লো রাস্তায়!রোদেলার হতে একটু ছিটা পড়তেই জ্বলে উঠলো।ব্যাপারটা এতটাই জলদি হলো রোদেলা কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না।সানি রোদ্দুর কে দেখা মাত্রই দৌড়ে পালালো।রোদ্দুর পিছু যেতে নিয়েও গেলো না।রোদেলা চুপ হয়ে রাস্তায় ফেনা ওঠা এসিডের দিকে তাকিয়ে আছে।
“রোদ?”
রোদেলা নিশ্চুপ!রোদ্দুর আস্তে করে ওকে বুকে টেনে নিল।রোদেলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে ওকে! অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হুট করে ঘটে গেলে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক!ওদিকে রোদ্দুর রোদেলা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ছাদে ছিল।সানিকে লক্ষ করেই এখানে এসেছিল। ও না আসলে এতক্ষণে কি হতো ভাবতেই ওর বুক ধড়ফড় করছে।রোদেলা এত স্ট্রেস না নিতে পারে জ্ঞান হারালো।রোদ্দুর ওকে কোলে নিয়ে বাড়ি গেলো।সবাইকে সবটা বলার পর রহিমা বেশ কান্না কাটি করলো।রোদ্দুর নোভাকে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে রোদ কে নিয়ে গেলো। হাতে মলম দিয়ে গায়ে কাঁথা টেনে দিল।
রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো ওর।রোদ্দুর সারারাত ওর পাশে বসে জল পট্টি দিয়েছে।রুবি এ দেখে জ্বলে উঠে বলেছিলো,”তুমি ওর জন্য এত কষ্ট কেনো করছো?আর সবাই আছে তো!”
রোদ্দুর কড়া গলায় বলেছে,”ও আমার স্ত্রী!ওর জন্য কি করবো না করবো সেটা আমার দায়িত্ব!তোকে কেও বলতে বলে নী!”
কাকলি তখন বললো,”আর কয়েকদিন পর তো তোমরা আলাদা হয়ে যাবে বাবা!এখন এসবের কি দরকার!”
“হবো, হই নি এখনো!এখন তোমরা যেতে পারো!”
রুবি আর কিছু বলার আগে রোদ্দুর কঠোর গলায় বললো,”যাও!”
ওরা রেগে বেরিয়ে গেলো।রোদ্দুর রোদেলার হাত ধরে বসে আছে।
“এখনও ওকে ছেড়ে দিতে চাইবি?”
নোভার কথায় চমকে উঠলো রোদ্দুর।
“ও এখনও আমার দায়িত্ব আপু!”
“এটা কি শুধু দায়িত্ব রোদ্দুর?”
রোদ্দুর চুপ করে রইলো।
“তোর চোখে ওর জন্য ভালোবাসা দেখেছি আমি রোদ্দুর!”
রোদ্দুর নির্লিপ্ত!
“ছোট থেকে তোরা দুইটা ঝগড়া করলেও একে অপরকে যথেষ্ট ভালো বুঝিস!তোরা নিজেদের অজান্তেই অনুভূতির সাগরে হারিয়েছিস!রোদেলা কে হারাস না রোদ্দুর।আমি জানি তুই ওকে ভালোবাসিস!তুই হয়তো বুঝছিস না,কিন্তু এখনও সময় আছে রোদ্দুর!অনেক সময়!পাঁচটা দিন আছে তোর কাছে।”
“ঘুমাবে না আপু?”
নোভা আহত হলো।
“হুমম!থাক ওর কাছে।”
নোভা উঠে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,”রোদের সাথে তুই সানিকে সহ্য করতে পারতিস না, ঋদ্ধ কেও না!ডিভোর্সের পর ওর যখন আবার বিয়ে হবে সহ্য করতে পারবি তো?থাকতে পারবি তো ওকে ছাড়া?”
বলেই বেরিয়ে গেলো।
রোদ্দুর রোদের হাত মুঠোয় নিয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এ কেমন পরিস্থিতি?কোন দিকে যাবে ও?মন কি চায়?
____
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো রোদের।পাশে নিশাত কে দেখে একটু হাসলো।
“দেখি জ্বর গেছে কিনা!”
বলেই ওর মাথায় হাত দিল।
“জ্বর নেই!”
“তুই এত সকালে?”
“এগারোটা সকাল?”
রোদ হাসলো!
“সারারাত তোর সেবা করলো রোদ্দুর।”
“ওই ই তো করে সবসময়!”
“যখন তোরা আলাদা হবি তখন কি করতে পারবে?”
রোদেলা নিশ্চুপ!
“তোরা কেনো বুঝিস না,তোরা একে অপরের জন্য!কেন এই আলাদা হওয়ার কাজ করছিস!পড়ে আফসোস করবি।চরম আফসোস!”
রোদেলা নিশ্চুপ!
“নিজের মন কে প্রশ্ন কর রোদ,তুই বাসিস না ভালো ভাইয়া কে?”
“একা থাকতে চাই!”
নিশাত কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো।
রোদ নিজের মাথা চেপে ধরলো, এ কেমন পরিস্থিতি!
উঠে গিয়ে নিজের ক্যানভাস আর রং তুলি বের করলো।জানে কি করবে।তাই মনের মত শুধু একেই গেলো। সারা ফ্লোরে রং ছিটানো এমনকি ওর ড্রেসেও!কিন্তু ওর সেদিকে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই।নিজের আকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো ও!কি রকম খাপ ছাড়া।একটা হার্ট ,তার মাঝে একটা ছেলে একটা মেয়ে ।তবে দুজনের মাঝে বেশ দূরত্ব!বিছানার সাথে ঘেঁষে হাঁটুতে মুখ গুজে বসে পড়লো রোদ।
ভাবতে পারছে না কিছু।
বিকেলে রোদ্দুর ওর রুমে এলো দেখতে।সারাদিন সেও রোদেলার মত নির্বোধ ছিল।ঘরের অবস্থা দেখে চমকে উঠলো।রোদেলাকে ডাকতে গিয়েও না ডেকে ওই ক্যানভাস এর কাছে গেলো।রোদেলা সব টুকুই টের পেলো।কিন্তু কিছু করলো না।ওভাবেই বসে রইলো।
রোদ্দুর তুলি নিয়ে হার্টের মাঝে দাগ টেনে দিল,যেটা হার্ট ব্রেক বুঝায়!কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো ও।আকাশের অবস্থা ভালো না।হয়তো বৃষ্টি আসবে কিছুক্ষণ পর!
রোদ ও যেতেই মাথা তুললো।হুমম!এবার ছবিটা সুন্দর।কিন্তু ছবিটা দেখে রোদের মাঝে অস্থিরতা তৈরি হলো।অর্ধেক হার্ট এ মেয়ে ,আর অর্ধেক হার্ট এ ছেলে।দুইজন আলাদা!সম্পূর্ণ আলাদা!উঠে গিয়ে ক্যানভাস ছুড়ে ফেলে দিল।কান্না পাচ্ছে ওর।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বুঝতে পেরে ছাদে চলে গেলো।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অদূর আকাশে মুখ করে আনমনে বির বির করলো,”আমি কেনো বুঝতে পারছি না কিছু।কি করবো আমি খোদা!প্লিজ পথ দেখাও!আমার লক্ষ্য কি?আমার ভবিষ্যৎ কি?কেনো এতো অসহায় আমি,কেনো?বলো না কি করবো!”
“রোদ”
রোদ্দুরের ডাকে চোখ মেলে তাকালো ও!আনমনেই মুচকি হেসে বলল,”আমার উত্তর!”
ঢলে পড়লো রোদ্দুরের বুকে ও। জ্বর আবারও এসেছে।তবে এবার মাত্রা অনেক!
#চলবে!