রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-০৫

0
508

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_৫
#M_Sonali

সকাল থেকেই বৌভাতের অনুষ্ঠানের বেশ ভালোভাবেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে চৌধুরী বাড়িতে। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত, কারো জন্য কারো সাথে কথা বলার সময় নেই। চৌধুরী পরিবার এর বড় ছেলের বৌভাত বলে কথা। যেখানে ঢাকা শহরের হয়তো বড় বড় সকল মানুষই উপস্থিত হবে। হায়া এবং সায়েমের জন্য ট্রেজের উপর অনেক সুন্দর করে দুটি চেয়ার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেখানে ওরা বসবে। সকাল থেকে মীর কেউ অনেক বেশি কাজে দেখা যাচ্ছে। সকাল থেকেই বাসার কাজে হাত লাগিয়ে চলেছে সে। সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনটা কিভাবে সাজাতে হবে। মীরের এই কাজ করা দেখে হায়ার মনে মনে ভীষণ ভালো লাগছে। দুদিন হল সে এ বাসায় আসার পর মীরের সাথে তেমন কথা না হলেও, আজকে ওকে কাজ করতে দেখে খুবই ভাল লাগছে। হায়ার মত সায়েমও ভীষণ খুশি। কারণ মীর সব সময় গম্ভীর এবং চুপচাপ থাকতে ভালবাসে। তবে আজকে তাকে বেশ হাসিখুশি এবং কাজে মনোযোগী দেখা যাচ্ছে। একটু গম্ভীর ভাব দেখা যাচ্ছে না তার মাঝে। মীরের এমন পরিবর্তনে বাসার সবাই মোটামুটি খুশি। এবং সবাই এই পরিবর্তনটা ভালোই লক্ষ্য করেছে আজ।

——————

সকাল থেকেই একের পর এক কাপড় চোপড় আলমারি থেকে বের করছি এবং সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে দিচ্ছি আমি। আজকে ঠিক কি পরে হায়ার বৌভাতে যাব সেটাই ঠিক করতে পারছি না। কারণ আজকে তো শুধু হায়ার বৌভাত’ই নয়, বরং মীরের সাথে ওকে ভালোবাসি সে কথা বলতে চাই আমি। তাই কোনভাবেই ঠিক করতে পারছিনা কোন ড্রেসটা পড়লে আমাকে অনেক সুন্দর লাগবে। মীর আমার ভালোবাসা গ্রহণ করে নেবে। এভাবে অনেক্ষণ হল খোঁজাখুঁজির পর শেষে একটা ড্রেস চয়েজ হলো আমার। নীল রঙের বিশাল ঘেরওয়ালা একটি জরজেট পাথরের কাজ করা লেহেঙ্গা। মনে মনে ঠিক করলাম আজকে এটা পড়েই হায়ার বৌভাতে যাব। তাই ওটার সাথে মিলিয়ে সকল রকমের জুয়েলারি এবং সাজগোজের কসমেটিকস রেডি করে রেখে দিলাম। সময় মত এগুলো পরে রেডি হবো বলে।

আজকের দিনটা এত বড় মনে হচ্ছে যে কোনভাবেই যেন সময় কাটছে না। তাই সারাদিন এটা ওটা করে করে সময় কাটাতে লাগলাম। কখন যে মীরদের বাসায় যাব সেটা ভেবেই যেন ঘুম হারাম হয়ে গেছে আমার। বিকেলে এক কাপ কফি বানিয়ে সেটাতে যখনি চুমুক দিতে যাবো আম্মু এসে বলল,

— “এই আব্রু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আমাদের সায়েমদের বাসায় যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।”

আম্মুর কথা শুনতেই যেন হৃদয়টা নেচে উঠল আমার। দ্রুত নিজের হাতের কফিটা চুপ করে ফেলে দিয়ে রুমে গিয়ে রেডি হওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। লেহেঙ্গাটা খুব যত্নের সাথে পরে নিলাম। চোখে গাঢ়ো করে কাজল, কপালে ছোট্ট করে একটি কালো টিপ, হাতভর্তি নীল রঙের চুড়ি, আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক পরে নিলাম। চুলগুলো একপাশ করে চিরুনি করে ছেড়ে রাখলাম। সাথে হালকা মেকআপ করতেও ভুললাম না। আমি রেডি হতেই আম্মুর ডাক পড়লো। আমিও একবার নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। তারপর আব্বু আম্মুর সাথে রওনা হলাম মীরদের বাসার উদ্দেশ্যে। যত বেশি ওদের বাসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তত বেশি যেন মনের মাঝে ছটফটানি বেড়ে চলেছে। মীরকে কিভাবে নিজের মনের কথাগুলো বলব ওকে, সেগুলো নিয়ে ভাবতেই যেনো রাস্তা কখন ফুরিয়ে গেছে খেয়ালই করিনি।

গাড়ি থেকে নেমে মীরদের গেট দিয়ে বাসার মধ্যে ঢুকতেই চারিপাশের ডেকোরেশন দেখে যেন মনটা জুড়িয়ে গেল আমার। অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ওদের বাসা। সত্যি ওদের চয়েজ আছে বলতে হয়। আমি আব্বু আম্মুকে পিছে ফেলে আগে আগে হাটতে লাগলাম। ওদের বাসার মধ্যে ঢুকতেই দেখলাম সামনেই ট্রেজের উপর পাাশাপাশি বসে আছে হায়া আর সায়েম ভাই। মুচকি হেসে সেখানে এগিয়ে গেলাম। হায়াকে আলতো করে আলিঙ্গন করে বললাম,

–” ইস হায়া তোকে কি সুন্দর লাগছে রে। একদম বউ বউ। আর দুলাভাইকে তোর পাশে দারুন মানিয়েছে। কেমন আছিস তুই?”

আমার কথায় হায়া মুচকি হেসে বললো,

–” তোকেও কিন্তু অনেক সুন্দর লাগছে রে আব্রু। ঠিক যেনো নীল পরীর মতো। আমি অনেক ভালো আছি তুই কেমন আছিস রে? তোকে অনেক বেশি মিস করেছি আমি এই দুদিন।”

ওর কথায় আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে উঠলাম,

–” হ্যাঁ হ্যাঁ জানিতো, তুই আমাকে কেমন মিস করেছিস! সে জন্যই তো একটিবারের জন্যও ফোন করলিনা আমার কাছে! তুই জানিস আমি রাতে একা ঘুমাতে পারিনি বারবার তোর কথা মনে হয়েছে। কিন্তু তুই তো সায়েম ভাইকে পেয়ে আমাকে ভুলেই গেছিস রে হায়া।”

আমার কথায় হায়া কিছু বলার আগেই সায়েম ভাই পাশ থেকে বলে উঠলো,

–” শালিকা দেখি অনেক অভিমান করেছে। কিন্তু আব্রু তোমার বোন কিন্তু তোমাকে সত্যিই অনেক মিস করেছে। সারাদিন শুধু তোমার কথাই বলেছে আমার কাছে।”

এভাবে আরো কিছুক্ষন টুকটাক কথা বললাম ওদের সাথে। ওদের সাথে কথা বলতে থাকলেও আমার মন আর চোখ দুটো বারবার শুধু মীরকে খুঁজে চলেছে। এদিক-সেদিক সব জায়গায় চোখ বুলিয়ে খুজেও কোথাও ওকে দেখতে পেলাম না। তাই ধীরে ধীরে হায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম,

–” এই হায়া তোর দেবর কোথায় বলতো? তাকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না!”

আমার কথায় বাঁকা চোখে তাকাল হায়া। তারপর গম্ভীর গলায় ফিসফিস করে বললো,

–” ওওও তার মানে এখানে তুই আমার জন্য আসিসনি তাইনা আব্রু। তুই তো এসেছিস মীর ভাইয়ের জন্য।”

ওর কথায় বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। এখন কি বলব বুঝতে পারছি না। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

— “আরে ধুর এমনি বলছিলাম! আসলে এখানে আসার পর থেকে তাকে দেখি নাই তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

–” আমি জানিনা রে আব্রু কোথায় মীর ভাইয়া। তবে সকাল থেকে বাড়ির যত কাজ তো সে’ই করেছে। এই যে সবকিছু এত সুন্দর করে ডেকোরেশন করা, সব তো তিনি দাঁড়িয়ে থেকেই করেছে। তবে বেশ অনেকক্ষণ সময় হলো তাকে দেখতে পাচ্ছিনা। আছে হয়তো কোথাও। এদিক ওদিক খুঁজে দেখ পেয়ে যাবি।”

হায়ার কথা শুনে আর সেখানে দাঁড়ালাম না আমি। ট্রেজ থেকে নেমে এদিক-সেদিক খুঁজতে শুরু করলাম। মনে মনে বললাম,”মীর ডেকোরেশন করেছে বলেই তো এসব দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। সত্যিই ওর চয়েজ আছে। তারপর সারা বাসার সব জায়গায় ওকে খুঁজতে লাগলাম। এভাবে প্রায় সারা বাড়ি খোঁজা হয়ে গেছে আমার। কিন্তু এখন অব্দি তাকে কোথাও দেখলাম না।

আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই যেন কেমন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে চারিদিকে ঘুরঘুর করতে দেখে হয়তো সবাই এভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নিজেকে সবার কাছে কেমন জোকার জোকার মনে হতে লাগল আমার। সাথে মীর এর উপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো। কি দরকার ছিল বাসায় না থাকার, আমি যে তাকে খুজে খুজে মরছি, সে কি সেটা বুঝতে পারছে না। কথাগুলো ভেবে বাসার মধ্যে ঢোকার জন্য পা বাড়ালাম। তখনই হঠাৎ চোখ আটকে গেল ছাদের দিকে। ছাদের ওপর মীর দাড়িয়ে আছে। আর কার সাথে যেন খুব হেসে হেসে কথা বলছে। ওকে এতটা হাসিখুশি কখনো দেখিনি আমি। যার সাথে কথা বলছে তাকে দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলাম মীর অনেক আনন্দে আছে। ওর হাসি মুখটা দেখে কেন জানিনা আমার মনটাও খুশিতে ভরে উঠল। আমি আর দেরি না করে দ্রুত ছাদের দিকে ছুটলাম। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। তাই চারিদিকে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে।

একপা দুপা করে ধীরে ধীরে ছাদের দরজার কাছে পৌঁছাতেই মীরের কন্ঠে কিছু কথা ভেসে আসলো আমার কানে। সে যেন হাসতে হাসতে কাকে বলছে,

–” তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি খুব শীঘ্রই তোমাকে বিয়ে করে আমার ঘরের বউ করে আনবো। তুমি জানো না আমি তোমাকে কত ভালবাসি। তোমাকে দেখলেই যে সারা পৃথিবী আনন্দে ভরে যায় আমার।”

এতোটুকু শুনেই সেখানে থমকে দাঁড়ালাম আমি। কেন জানি না বুকের মাঝে ধুকপুকানি প্রবলভাবে বেড়ে চলেছে। বারবার মনে হচ্ছে যেটা আমি শুনলাম সেটা আমার শোনার ভুল। এটা হতে পারে না, মীর অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে না। আমি মেনে নিতে পারব না এটা। হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো আমার। আমার সব আশা কি তাহলে এখানেই শেষ হয়ে যাবে? চুপচাপ কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত করে নিলাম। তারপর মনে সাহস জুগিয়ে পা বাড়ালাম ছাদে ওঠার জন্যে। ছাদের দরজা দিয়ে ঢুকতেই মীর আর একজন কালো বোরখা পরিহিত মেয়েকে দেখতে পেলাম আমি। মেয়েটার সারা শরীর কালো বোরখা দিয়ে ঢাকা থাকলেও চোখ এবং হাত দেখে বুঝতে পারলাম, মেয়েটা একদম ধবধবে সাদা ফর্সা। এবং অনেক সুন্দর দেখতে হবে হয়তো। যেমন উচা লম্বা তেমনি তার সৌন্দর্য। চোখ দুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ টানা টানা হরিণী চোখ তার। তাকে দেখে ক্যান যেনো ভিষণ হিংসা হতে লাগলো আমার।

হঠাৎ মেয়েটির কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার। মেয়েটি মীরকে উদ্যেশ্য করে প্রশ্ন করলো,

— “মীর, কে ইনি? আর এসময় এখানে কি করছে?”

মেয়েটির কথার উত্তরে বিরক্তির চোখে মীর আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি ভরা গলায় রাগি ভাবে বললো,

–“এটা সায়েম ভাইয়ার বউ এর ছোটবোন আব্রু।জানিনা এখন এখানে কেন এসেছে। এই মেয়ে তোমার কি কোন বিবেক বুদ্ধি নেই? এভাবে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে কারো মাঝে আসতে হয়না জানো না সেটা?”

মীরার কথা শুনে অসম্ভব কান্না পেতে লাগল আমার। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কান্না করতে। এতটা অপমানিত কোনদিনও হইনি আমি। যার জন্য এত সুন্দর করে সেজেগুজে আসলাম অথচ সে’ই আমার সাথে এমন আচরণ করবে ভাবতেও পারিনি। আমি কিছু বলার আগেই পাশে থাকা মেয়েটি বলে উঠলো,

–” থাক না মীর এভাবে বলছ কেন? ও হয়তো বুঝতে পারেনি।”

–” বুঝতে পারেনি মানে? ওকি কোনো ছোট মানুষ নাকি যে বুঝতে পারেনি?”

এতটুকু বলে রাগি নজরে তাকালো মীর আমার দিকে। তখনি মেয়েটি আমার কাছে এগিয়ে আসতে নিলো। কিন্তু আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। কান্না করতে করতে দ্রুতো ছাদ থেকে নিচে নেমে এলাম।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,