রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-০৬

0
494

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_৬
#M_Sonali

মীরদের বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলেই, শুধু হায়াকে একবার বলেই দৌড়ে বেরিয়ে এসেছি। তারপর নিজের বাসায় চলে এসে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে তার নিচে বসে আছি। কোনমতেই যেন মনটাকে শান্ত করতে পারছি না। সকাল থেকে এতটা খুশি এবং উত্তেজনা নিয়ে ওখানে যাওয়ার পর, আমার সাথে এমনটা হবে সেটা কল্পনাও করতে পারিনি আমি। মীর কিভাবে পারলো আমার সাথে এমন টা করতে? ওর কি একবারও কষ্ট হলো না আমার সাথে এমন আচরন করতে? আমি সহ্য করতে পারছিনা। বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করলাম বাথরুমের মাঝে। ইচ্ছে করছে নিজেকে নিজেই শেষ করে দেই চিরদিনের মত। মীর তো পারত আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে। এভাবে অপমান করার কি দরকার ছিল ওর? আমিতো শুধু ভালবেসে ছিলাম ওকে, আর কিছু তো নয়। কথাগুলো ভাবছি আর চিৎকার করে কান্না করছি আমি। এভাবে প্রায় অনেকটা সময় কেটে গেলো।
হঠাৎ করে শরীরটা কেমন ভার হয়ে আসলো। মাথা ঘুরতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে আমি জ্ঞান হারাবো। কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করে ধরে রাখতে পারলাম না। বাথরুমটা যেন ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে, আসলে আমি অন্ধকার দেখছি সবকিছু তাই এমনটা মনে হচ্ছে। মাথা ঘুরতে ঘুরতে চোখ বন্ধ করে ঢলে পড়লাম ফ্লোরে। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।

———————-

আব্রুর হঠাৎ করে এভাবে চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না হায়া। কি হলো তার ছোট বোনটার, যে এভাবে চলে গেলো সে? মনের মাঝে যেন বারবার কু ডাকছে হায়ার। এদিকে অনুষ্ঠানের মাঝে সবাই এতটাই মগ্ন যে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। সবাই চিন্তা করবে ভেবে। আবার মানুষ কি বলবে তারও একটা ব্যপার আছে। তবে হ্যাঁ হায়া কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে, যে আব্রুর অবশ্যই মীরের সাথে কিছু একটা হয়েছে। কারণ সে বেশ ভালো করেই জানে আব্রু মীরের জন্য কতটা পাগল।

হায়াকে মন খারাপ করে এমন ছটফট করতে দেখে পাশ থেকে সায়েম ওর দিকে কিছুটা ঝুকে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

–” কি ব্যাপার হায়া, তুমি এমন করছ কেন? তোমার কি কিছুতে অস্বস্তি হচ্ছে? শরীর খারাপ লাগছে তোমার? এখানে সমস্যা হলে বলো তোমায় রুমে নিয়ে যাচ্ছি?”

সায়েমের প্রশ্নে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা হায়া। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বলে উঠলো,

— “না সায়েম আমার কোথাও খারাপ লাগছে না। কিন্তু অনুষ্ঠানটা দ্রুত শেষ করতে বলো প্লিজ। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় যেতে হবে।”

–” ওহ বুঝেছি! তারমানে তোমার বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য মন আকুপাকু করছে তাই তো? তার মানে তুমি এখনো আমাদের বাসার কাউকে আপন করে নিতে পারোনি! তাই বাবার বাসায় যাওয়ার এতো তাড়াহুড়া তোমার!”

কথাটি বলেই গোমরা মুখ করে অন্য দিকে ফিরে তাকাল সায়েম। ওর কথা শুনে এবার বেশ বিরক্ত হলো হায়া। তারপর আবারও ফিসফিস করে বললো,

–” দেখো সায়েম আমি এখন একটুও মজা করার মুডে নেই। তুমি বুঝতে পারছো না কি হতে পারে!”

কথাগুলো বলার সময় প্রায় কান্না করে ফেলতে নিল হায়া। ওকে এমন হতে দেখে এবার সিরিয়াস হয়ে সায়েম জিজ্ঞেস করল,

–” কি হয়েছে হায়া? আমাকে সব কিছু খুলে বলোতো! তুমি হঠাৎ এমন করছ কেন?”

–” আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা সায়েম। কিভাবে কি বলবো তোমায়! আব্রু আমার কাছে এসেছিল। কিছু না বলে শুধু বাসায় যাওয়ার কথা বলে দৌড়ে বাসায় চলে গেল। কাউকে কিছু বলতেও নিষেধ করেছে। এমন অবস্থায় কি করবো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না আমি। এখন এখানকার সবাইকে জানালে সবাই দুশ্চিন্তা করবে। কেউ কেউ হয়তো আবার উল্টাপাল্টা ভাবতেও পারে। আমার বোনটা যেমন দুষ্টু তেমনি রাগি। রাগের বসে কোনো কিছু করে ফেলতে পারে ও। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় পৌঁছাতে হবে। জানিনা এভাবে কেন চলে গেল আব্রু বাসায়!”

হায়ার কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠলো সায়েম। ও দ্রুত বলে উঠল,

–” তুমি এই কথা এতক্ষণে বলছ আমায় হায়া। বুঝতে পারছ কি হতে পারে আব্রুর কিছু হলে? ও একা একটা মেয়ে মানুষ এভাবে বাসায় চলে গেল অথচ তুমি চুপ করে বসে আছো? অন্তত আমাকে তো বলতে পারতে। তুমি বসো আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।”

কথাগুলো বলেই হায়ার পাশ থেকে দ্রুত উঠে গেল সায়েম। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে সবাইকে নিয়ে বাসার জন্য রওনা হল। সে আত্বিয় সজন আর গেস্টদেরকে কিছু বুঝতে দিলো না। শুধু বললো বাসায় জরুরী কাজ আছে তাই তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে। বাকিটা আশরাফ চৌধুরী আর শায়লা বেগম সামলে নিলেন।

গাড়ি বাসার সামনে এসে থামতেই দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সবাই। তারপর সবাই পাগলের মত ছুটে গেল বাসার ভেতর। গিয়ে দেখল বাসার দরজা জানালা সব কিছু খোলা। সবাই এদিক ওদিক আব্রুকে খুঁজতে লাগলো। ওর নাম ধরে ডাকতে লাগল সবাই। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পেল না। শেষে হায়া ওকে খুঁজতে খুঁজতে বাথরুমের মাঝে গিয়ে দেখল আব্রু অজ্ঞান অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে।

আব্রুকে এমন অবস্থায় দেখে চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করল হায়া। ওর চিৎকার শুনে সবাই ছুটে আসলো সেখানে। এসে দেখল আব্রু অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে ফ্লোরে। ওর জামা কাপড় সব ভিজে একাকার। কিন্তু শরীর আর চুল একদম শুকিয়ে গেছে। আব্রুর বাবা আর দেরি না করে ওকে কোলে তুলে নিল। তারপর রুমে এসে শুইয়ে দিয়ে হায়াকে বললো ওর কাপড় চেঞ্জ করে দিতে। আর উনি দ্রুত ডাক্তারকে কল করলেন বাসায় আসার জন্যে।

হায়া আব্রুর গাঁয়ের পোষাক চেঞ্জ করে দিয়ে ওকে পাগলের মত ডাকতে লাগল। মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে লাগলো ওর আম্মুও। কিন্তু কোনভাবেই ওর জ্ঞান ফিরবে না। কিছুক্ষণের মাঝেই ডাক্তার চলে এলেন। ডাক্তার এসে ওকে ভালো কোরে চেকআপ করে একটি ইনজেকশন পুশ করলেন। তারপর সবাইকে বাইরে আসতে বললেন।

বাইরে আসতেই উত্তেজিত কণ্ঠে আব্রুর বাবা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল,

–” ডাক্তার কী হয়েছে আমার আব্রুর? ও এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো কিভাবে? আর জ্ঞান’ই বা হারিয়েছে কেন?”

–” রিলাক্স মিস্টার খান। আপনি একদম চিন্তা করবেন না আমি আব্রুকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। যখন ও ঘুম থেকে উঠবে, তখন সুস্থ হয়ে যাবে। আমার মনে হয় ও কোন বিষয়ে ভীষণ ডিপ্রেশনে রয়েছে। সেইজন্য ওর এমন অবস্থা। আপনি চিন্তা করবেন না ঘুম থেকে উঠে সুস্থ হলে তখন ওর থেকে জেনে নেবেন। আচ্ছা আমি এবার আসি।”

কথাগুলো বলে আব্রুর বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন ডাক্তার।সবাই অনেকটাই চিন্তা মুক্ত হলো। তবে সবার মনে একটাই প্রশ্ন, আর সেটা হলো কি নিয়ে ডিপ্রেশনে আছে আব্রু? যদিও হায়া অনেকটাই আন্দাজ করতে পেরেছে।

—————–

মাথায় হালকা ব্যথা নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম আমি। তাকাতেই খেয়াল করলাম নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে আছি। আর আমার ঠিক পাশেই বসে থেকে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে হায়া। কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম কি হয়েছে আমার সাথে। তখনই একে একে সবকিছু মনে পড়ে গেলো আমার। মনে পড়তেই দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না আমি। মনে পড়ে গেল মীরের আমার সাথে করা ব্যবহারগুলোর কথা।

আমার কান্নার শব্দ হায়ার কানে যেতেই ও ম্যাগাজিন ফেলে আমার দিকে তাকালো। তারপর দ্রুত আমার কাছে ছুটে আসলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে উত্তেজিত গলায় বলল,

–” কি হয়েছে আব্রু? তুই এভাবে কাঁদছিস কেন? আমার এমন হাসিখুশি বোনটা এতটা ভেঙে পড়েছে কেন? বল আমায় কি হয়েছে তোর? প্লিজ বল আব্রু!”

হায়ার কথার কোন উত্তর দিলানা আব্রু। বরং হায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হু হু করে ছোট বাচ্চাদের মত কান্না করতে শুরু করল। ওকে এভাবে কান্না করতে দেখে অনেকটাই ঘাবড়ে গেল হায়া। বুঝতে পারছেনা আদরের ছোট বোন টার কি হল। সে এমন বাচ্চাদের মতো বিহেভ করছে কেন। যখনই হায়া কিছু বলবে, তখনই হঠাৎ বাইরে থেকে আব্রুর মা ছুটে এসে বলল,

–” আব্রু তোমার জ্ঞান ফিরেছে মামনি? কি হয়েছিল তোমার? তুমি এভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে কেন?”

মায়ের কথায় হায়াকে ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো আব্রু। কিন্তু কারো কোন প্রশ্নের উত্তর দিল না। তখনই আবারো ওর আম্মু বলে উঠল,

— “এভাবে কাদছো কেন তুমি মামুনি? দেখো তোমার সাথে কারা দেখা করতে এসেছে!”

কথাটা বলে ওর সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। তখনি আব্রু সামনে তাকিয়ে দেখল মীর আর শায়লা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। মীরের মুখে গম্ভিরতার ছাপ। মীরকে দেখামাত্রই কান্না থেমে গেল আব্রুর। সে হা করে মীরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। যেন ভূত দেখছে সে। মীরকে যেনো এই মুহূর্তে এখানে কোনভাবেই আশা করেনি সে। ওকে চুপ থাকতে দেখে শায়লা বেগম ওর কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,

–” আব্রু মামনি, আমি তোমাকে হায়ার মত আমার বাড়ির বউ করে নিতে এসেছি। হবেনা আমার মীরের বউ?”

শায়লা বেগমের কথায় যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল আব্রুর। সে অবাক চোখে একবার মীরের দিকে আরেক বার শায়লা বেগমের দিকে তাকাতে লাগলো। কোন কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না তার। সবার চেহারায়’ই মুচকি হাঁসি। রুমের মাঝের সবাই মিটিমিটি হাসছে। শুধু হাসি নেই মীর এবং আব্রুর মুখে। ওর মাথায় কিছু ঢুকছে না। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে সবই যেন তার কল্পনার বাইরে। মনে হচ্ছে যেন সব কিছুই তাঁর স্বপ্ন।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,