রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-০৭

0
525

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_৭
#M_Sonali

বেনারসি শাড়ি আর একগাদা গয়না পরে বউয়ের সাজে বসে আছি আমি মীরের রুমে। রুমটাকেও অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। শুধু তাজা গোলাম ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে রুমটা। এককথায় অসম্ভব সুন্দর লাগছে। চারিপাশে যেনো ফুলের সুবাসে একদম ম ম করছে।

এত অল্প সময়ের মাঝে যে, এভাবে আমাদের দুজনের বিয়ে হয়ে যাবে, সেটা কল্পনাও করতে পারিনি আমি। কাল আমি অজ্ঞান হওয়ার পর শায়লা আন্টি আর মীর গিয়েছিলেন আমাদের বাসায়। আর তখনি শায়লা আন্টি আমার আর মীরের বিয়ের কথা বলেন! মীরের ভালবাসায় আমি এতটাই পাগল ছিলাম যে, তখন একবারের জন্যেও প্রশ্ন করিনি বা কোনো রকম কিছু বলেনি আন্টিকে। বরং আন্টির কথা শুনে এক কথায় রাজি হয়ে যাই আমি মীরকে বিয়ে করতে। মীরের সাথে কথা বলারও প্রয়োজন মনে করিনি। কারণ মীরও চেয়ে ছিলো আমায় বিয়ে করতে। নইলে তারা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কখনো যেত না। আমি জানিনা এতকিছু কিভাবে হলো। শুধু জানি আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি আমার মীরের বউ হয়ে আসতে পেরেছি তার কাছে।

এই অল্প সময়ের মাঝে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হলেও, বিয়েতে কোনরকম ত্রুটি রাখেনি আঙ্কেল আর আমার বাবা। দুজনে মিলে বেশ ভালোই আয়োজন করে ফেলেছেন। আমার বিয়ের গহনা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই একদম বিয়ের সাজ পরিপূর্ণ রয়েছে। কোন কিছুতে কোন কমতি রাখেনি তারা। শুধু ধুমধাম করে অনুষ্ঠান টাই করা হয়নি। তবে সেটাও হয়ে যাবে এক সপ্তাহের মধ্যে। এটা আঙ্কেল আগেই বলে দিয়েছেন আমাদের। যতই হোক চৌধুরী পরিবারের ছোট ছেলের বিয়ে বলে কথা। আর আমিও খান পরিবারের ছোট মেয়ে। তাই আমার বাবাও কিছুতে কমতি রাখেন নাই।

হঠাৎ দরজা লাগানোর শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার। দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলাম মীর রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে। তাকে দেখেই কেমন যেনো এক অজানা ভয় গ্রাস করলো আমায়। উনি দরজা লাগিয়ে গুটিগুটি পায়ে আমার কাছে এগিয়ে আসতে লাগলেন। ভয়কে জয় করে তাকে সালাম দিলাম আমি। আমাকে সালাম দিতে দেখে সালামের উত্তর নিয়ে আমার কিছুটা দূরে এসে দাড়ালো তিনি। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,

–“তোমাকে কিছু জরুরী কথা বলার আছে আব্রু”

গম্ভীর গলায় ওনার এমন কথা বলতে শুনে কিছুটা অবাক হলাম আমি। তবে সেটা বুঝতে না দিয়ে, মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

–” জি বলুন কি বলবেন, আমি শুনছি! আর ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন। এখানে এসে বসুন!”

উনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ নিরাবতা পালন করে ঝাঁঝালো গলায় বলতে শুরু করলেন,

–” দেখো আব্রু, আমি তোমাকে বিয়ে করেছি ঠিকই, কিন্তু এই বিয়েতে একটুও আমার মত ছিল না। বাসার আর কেউ না জানলেও তুমি বেশ ভালোভাবেই জানো আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। এমন কি তুমি সেটা ছাদের উপর উঠে নিজের চোখে দেখেছো। তার পরেও আমার তোমাকে বিয়ে করতে হয়েছে বাদ্ধ হয়ে। তবে মন থেকে তোমাকে আমি নিজের স্ত্রী হিসাবে কখনোই মানতে পারব না। তাই এটাই ভাল হবে যে, আমরা সবার সামনে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকলেও, ঘরের মধ্যে দুজন আলাদা বিছানায় ঘুমাবো। আর আলাদা থাকবো। আমাদের মাঝে কোন প্রকার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। আশা করি তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছ!”

ওনার প্রতিটি কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলাম আমি। কিন্তু উনি কথা শেষ করে চুপ করে গেলেও, আমি কোন প্রকার উত্তর দিলাম না। বা মাথা নাড়িয়ে ও কিছু বললাম না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি আবার বলে উঠলেন,

–“আমি জানি আমার কথায় হয়তো তুমি কষ্ট পেলে। রাগও হচ্ছে হয়তো তোমার। কিন্তু এতে আমার কিছু করার নাই। কারণ আমি আরেকজনকে ভালবাসি। তোমাকে মেনে নেওয়া আমার সম্ভব নয়। রাত অনেক হয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পরো। আমি সোফায় শুয়ে পরছি।”

কথাগুলো একনাগাড়ে বলেই সোফার দিকে পা বাড়ালেন উনি। তখনই আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,

–“কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে আপনার বাসার সবাই যখন বিয়ের কথা বলছিল তখন আপনি মানা করলেন না কেন? কেন বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন? আমিতো কাউকে কিছু বলিনি! তাহলে আপনাদের বাসা থেকে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ই বা কেন গেল আন্টি? আপনি ছাড়া তো আর কেউ জানতো না যে আমি আপনাকে পছন্দ করি।”

–” তুমি ছাদে আমাকে আর ওকে একসাথে দেখার পর হায়াকে কিছু একটা বলে বাসায় চলে গিয়েছিলে। আর বাসায় গিয়ে শাওয়ারের নিচে বসে থেকে অসুস্থও হয়ে গেছিলে। তাই সবাই ভয় পেয়েছিলো যে, তুমি হয়তো আমায় না পেলে সুইসাইড করবে। তখন হায়া সায়েম ভাইয়ের কাছে সবকিছু বলে দিয়েছে। যে কারণে ভাই বাসার সবাই কে বলেছে তোমার কথা। আর সবাই সঠিকটা না জেনেই আমাকে বকাবকি দিয়ে তোমার সাথে বিয়ের কথা বলেছে। তাই আমি মানা করতে পারিনি। সবার মুখ রাখার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি। একপ্রকার জোর করেই তোমাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো।”

কথাগুলো বলেই উনি দ্রুত গিয়ে সোফার ওপরে শুয়ে পড়লেন। তারপর ঘুমের ভান ধরলেন। আমি বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছি যে আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যই এমনটা করলেন উনি। আমি চুপ করে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে কিছু একটা ভাবলাম। তারপর জোরে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। নিজেকে রিল্যাক্স করে ব্যাগের মধ্যে কে একটি থ্রিপিচ বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম চেঞ্জ করতে। একটু পর জামা কাপড় চেঞ্জ করে এসে বিয়ের পোষাকটা গুছিয়ে রেছে বাকা হাসি দিলাম। তারপর সোজা গিয়ে মীরের গায়ের ওপর ওকে জাপটে ধরে শুয়ে পরলাম। আমার এমন কান্ডে যেন কারেন্টে 440 ভোল্টের ঝটকা খাওয়ার মত ঝটকা খেলো মীর। ও আমাকে টেনে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার থেকে কিছুটা দূরে সরে গেল। তারপর রাগী গলায় বলে উঠল,

— “এটা কোন ধরনের অসভ্যতা হচ্ছে আব্রু?”

উনার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে সোফার ওপর আরাম করে বসলাম আমি। তারপর ওনার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললাম,

–” এখানে অসভ্যতার কি দেখলেন আপনি স্বামী! আপনি আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র স্বামী। আমি কি করে আমার স্বামীকে ফেলে আলাদা বিছানায় ঘুমাবো বলুন। তাও আবার এই ফুলে ফুলে সাজানো বাসর ঘরে। তাই আপনি যেখানে আমিও সেখানে। আপনি যেহেতু সোফায় শুয়েছেন, তাই ভাবলাম আমিও এখানে শুবো। কিন্তু সোফার উপরে একজন ছাড়া দুজন শোয়া সম্ভব নয়। তাই আমি আপনার গায়ের উপর শুয়ে পরেছি। ভালো করিনি বলেন? আমি তো আপনারই বউ!”

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে দুষ্টু হেসে চোখ পিটপিট করে তাকালাম আমি ওনার দিকে। উনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে আমাকে এমন রিয়েক্ট করতে দেখে। উনি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে বিরক্তমাখা কন্ঠে বললেন,

–” আব্রু তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আমি একটু আগে তোমাকে কি বললাম, সে কথাগুলো কি তুমি শুনতে পাওনি? এসব কি হচ্ছে কি? আমি বললাম না আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মানি না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। তাই ভুল করেও আমার কাছে স্ত্রীর অধিকার চাইতে আসবে না। যাও এখান থেকে, গিয়ে বিছানায় ঘুমাও। আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো। আর যদি সোফায় ঘুমানোর ইচ্ছা থাকে তাহলে তুমি এখানে শুয়ে পড়ো। আমি বিছানায় শুয়ে পরছি।”

–” না স্বামী, সেটা বললে তো চলবে না। আমি তো বললাম আপনি যেখানে আমিও সেখানে। বিয়ের আগে আপনি কাকে ভালবাসতেন না বাসতেন, কার সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল! সেটা দিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। এখন আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। আপনি আমার স্বামী আর আমি আপনার বউ। তাই আপনি যেখানে আমিও সেখানে। আমার থেকে এভাবে পালিয়ে বাঁচতে পারবেন না আপনি। আমাকে কোন সাধারণ মেয়ে ভাববেন না। যে কি না আপনি যেটা বললেন আমি মুখ বুঝে সেটাই মেনে নিবো। বিয়ে যখন করেছেন তখন ঘাড়ের বোঝা হয়ে থাকলেও আমাকে বোঝা’ই করে রাখতে হবে। আপনি যেখানে শোবেন আমিও সেখানে শোবো। এটা আমার অধিকার। এখন বাকিটা আপনার ইচ্ছা।”

আমার কথা শুনে কোন উত্তর দিলেন না উনি। শুধু জোরে করে হাতে থাকা কিছু একটা ছুড়ে ফেলে বললেন,

–” ধুউউউউরর।”

কথাটি বলেই গিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। আমিও আর দেরি না করে দ্রুত ওনার পাশে শুয়ে পরলাম। তারপর উনার উপর দিয়ে হাত তুলে দিলাম। সাথে সাথে উনি আমার হাতটা ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দিয়ে বললেন,

–“দেখো আব্রু একই বিছানায় শুয়েছো বলে ভেবোনা যে আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি। না তোমাকে স্ত্রীর অধিকার দেবো। আমি যখন বলেছি আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মানি না। তখন সেটাই হবে। তুমি আমার থেকে যতটা দুরত্ব বজায় রাখবে তোমার জন্য ততই ভালো। নিজের ভাল চাও তো আমার থেকে দূরে থাকো।”

কথাগুলো বলে অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। আমিও আর তোকে বিরক্ত করলাম না। অন্য পাশে ফিরে চোখের জল ফেলতে লাগলাম। মুখে যতই হাসি আর বড় বড় কথা বলিনা কেন, মনের মাঝে তো আমারও রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিটি কথা যেন তীরের মত আঘাত করেছে আমার বুকে। কিন্তু আমিও হার মানার পাত্রী নই। বিয়ে যখন একবার করেছেন তখন স্ত্রী হিসেবে আমাকে মানতেই হবে। তার জন্য যা করতে হয় করব আমি।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

রি-চেক করা হয়নি। বানানে ভুল হলে কষ্ট করে পড়ে নিয়েন সবাই। কেমন হচ্ছে গল্পটা জানাবেন। ধন্যবাদ