রাখিব তোমায় যতনে পর্ব-০৫

0
454

#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৫

শা শা আওয়াজে গাড়ি চলছে।অস্থিরতায় ঘিরে আছে শুদ্ধতা।নীবদ্ধদের বাড়ি যাচ্ছে ও।মনটা কেমন যেন করছে।যার ছেলেকে বিয়ে করবে না, বিয়ে করবে না করছে তাদের বাড়িতেই এইভাবে যেতে কেমন যেন লাগছে। সামনের সিটে বসেছে নীবদ্ধ আর ড্রাইভার।
পিছনের সিটে সানাম আর শুদ্ধতা।সানাম শুদ্ধতার আরেকটু কাছে ঘেসে বসতেই সম্ভিত ফিরে পায় শুদ্ধতা।ভ্রু-কুচকে তাকালো সানামের দিকে।সানাম বোকা হাসলো।এতে বিন্দুমাত্র মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হলো না শুদ্ধতার।সানাম শুদ্ধতার কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
-‘ শুদ্ধতা আজ ভাইয়া তোকে তুমি করে বলেছে সেটা খেয়াল করেছিস?’

শুদ্ধতা কথাটা শুনলো।আনমনা হয়ে গেলো নিমিষেই।কিছু একটা ভাবলো।বেখায়ালি ভাবে বলল,
-‘ উনি কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত থাকলে মাঝে মাঝে আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেন।’

-‘ তা এখনও কি টেন্সনে আছেন?আর থাকলেও তার কারনটা কি শুদ্ধতা?’

সানামের প্রশ্ন ধ্যানভঙ্গ হয় শুদ্ধতার।বলল,
-‘ তা তো জানি না। উনি তো আমায় কিছু বলেননি।’

সানাম হাসলো।উপহাস করে বলে,
-‘ ভাইয়া বলেন নাই এটা বলে ফেললি কি সহজে তাই নাহ?অথচ তুই নিজে থেকে একবারও ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিস যে ভাইয়া কি নিয়ে এতো চিন্তায় থাকে?’

শুদ্ধতা চুপ হয়ে গেলো।মন খারাপের প্রজাপতিরা ডানা মেলে উড়তে লাগলো এদিক সেদিক।মাথা নত করে নিলো।আসলেই তো ও তো কখনো জিজ্ঞেস করেনি কিছু নীবদ্ধকে।কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি ‘ আপনি ভালো আছেন?’ এই সামান্য কথাটা।অথচ ওর মন খারাপ থাকলে শতো ব্যস্ততার মাঝেও লোকটা পাগলের মতো ছুটে চলে আসে।আর একটা কথাও শুদ্ধতার মুখ থেকে বের হলো না।চুপচাপ রইলো পুরোটা রাস্তা।গাড়ি ‘ এহসান মঞ্জিল ‘ এর সামনে থামতেই সবাই নেমে দাড়ালো গাড়ি থেকে।বাড়ির ভীতরে প্রবেশ করতেই মায়ের কান্নাকাটির আওয়াজ পেতেই বুকটা ধরাস করে উঠলো নীবদ্ধ’র।হঠাৎ ওর মা কাঁদছে কেন?কান্নার সুরটা ঈশানের ঘর থেকে আসছে।নীবদ্ধ ছুট লাগালো দোতলায় ঈশানের রুমের দিকে।পিছন পিছন শুদ্ধতা আর সানামও গেলো।নীবদ্ধ ঘরে প্রবেশ করতেই দেখে ফারুক এহসান,ঐক্য রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, ওর মা বিছানায় ঈশানের পাশে বসে কাঁদছেন।ঈশানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই নীবদ্ধ’র চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো।ভয়ংকরভাবে গর্জে উঠলো,
-‘ এসব কি ঈশান?তোমার এই অবস্থা কেন?’

ভয়ে কেঁপে উঠলো ঈশান।মা’কে ঝাপ্টে ধরলো।শুদ্ধতা ছুটে গেলো ঈশানের কাছে।ঈশানের অপরপাশে বসতেই ঈশান এইবার শুদ্ধতাকে জড়িয়ে ধরলো।তারপর কাঁদতে লাগলো।শুদ্ধতা ঈশানের ব্যান্ডেজে মোড়ানো পায়ের দিক তাকিয়ে বলে ওঠে,
-‘ এসব কিভাবে হলো ঈশান?কাঁদে না আগে আমাদের বলো?’

নীবদ্ধ রাগে কিছু বলতে যাবে শুদ্ধতা চোখের ইশারা দিয়ে থামিয়ে দিলো।ঈশান চুপচাপ শুদ্ধতার বুকের সাথে লেগে কাঁদছে।নীবদ্ধ শক্ত কন্ঠে ঐক্যকে জিজ্ঞেস করে,
-‘ ডোন্ট টেল মি তুই ও কিছু জানিস নাহ।’

ঐক্য অসহায় গলায় বলে,
-‘ আসলে সত্যিই আমরা কেউ কিছু জানি না।আজ আমি অফিসে ছিলাম।এমন টাইমে আমার কাছে ফোন আসে। রিসিভ করে জানতে পারি ঈশান এক্সিডেন্ট করেছে।আর ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।আমি কাজ ফেলে সেখানে যাই।ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারি ওর পায়ের হাড্ডি সামান্য ফেটে গেছে।আমি বহুবার জিজ্ঞেস করেছি কিভাবে কি হলো?কিন্তু ও কিছুই বলছে না।বাসায় আসার জন্যে কান্নাকাটি করছিলো।বাসায় নিয়ে আসলাম।বাবা আর মা এতো জিজ্ঞেস করলো তাও কিছু বললো না।আমরা যে তোকে ফোন করে জানাবো সেটাও করতে দিলো না।উলটো তোকে ভাবিকে নিয়ে আসতে বললো।ভাবির কাছে নাকি সব বলবে।’

রাগি চোখে তাকালো নীবদ্ধ ঈশানের দিকে।ঈশান ভয় পেয়ে আরো চেপে ধরলো শুদ্ধতাকে।বলল,
-‘ ভাবি ভাইয়া কিভাবে তাকাচ্ছে।’

শুদ্ধতা রাগি গলায় বলে,
-‘ এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?ও বাচ্চা মানুষ ভয় পাচ্ছে!’

-‘ আপনি একদম লাই দেবেন না ওকে শুদ্ধতা।বাদরামি করে পা ভেঙ্গে এসেছে।আবার মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে কাউকে কিছু বলছে না।থাপড়িয়ে আজ ওর গাল লাল করে দিবো।’

শুদ্ধতা বিরক্ত হলো নীবদ্ধ’র কথায় বলে,
-‘ উফ, আপনি থামবেন? ওকে তো এইবার বলতে দিন।বলবে আস্তে ধীরে।এইভাবে ধমকালে হবে?’

আয়েশা রহমান কান্নারত গলায় বলেন,
-‘ মা তুমি একটু ভালোভাবে জিজ্ঞেস করো না। ছেলেটা আমার কতো ব্যাথা পেয়েছে।’

-‘ আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না।আমি জিজ্ঞেস করছি।’

স্ত্রীর কান্নাকাটিতে বিরক্ত ফারুক এহসান।অসহ্য কন্ঠে বলে,
-‘ আল্লাহ্’র ওয়াস্তে একটু চুপ করো আয়েশা। এমন মরা কান্না করার কোন মানে আছে? শুদ্ধতা তোমার শাশুড়িকে বলো কান্না থামাতে আমার মাথা ব্যাথা করছে।’

-‘ আংকেল আমি……!’

শুদ্ধতা কথা পূর্ণ করার আগেই আয়েশা রহমান তেতে উঠে বলে,
-‘ আপনার জন্যে কি এখন আমি আমার ছেলের জন্যে কাঁদতেও পারবো নাহ?যত্তোসব রাজনীতির জাত এরা।মনটা পাথরের তৈরি।বড় ছেলেটাকেও বানিয়েছে এমন।ছেলেটা আমার পা ভেঙে বসে।আর বাপ ওর পাষাণ মনের। একটু কাঁদলও না।’

-‘ আমার ওতো আজাইরা কান্না আসে না তোমার মতো।’

নীবদ্ধ বিরক্ত হয়ে গেলো বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে। চেঁচিয়ে উঠলো,
-‘ উফ এখন তোমরা কি শুরু করলে?বাচ্চাদের মতো ঝগড়া শুরু করে দিলে।’

আয়েশা রহমান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন যেন,
-‘ তোর বাপকে থামা।আমাকে শুধু খোঁচাতে আসে কেন?’

ফারুক এহসান কিছু বলবে তার আগে ঐক্য তাকে থামিয়ে দিলো।পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হতেই শুদ্ধতা এইবার আদুরে কন্ঠে ঈশানকে জিজ্ঞেস করে,
-‘ ঈশান লক্ষি ভাই আমার।কি হয়েছে তোমার সাথে?কিভাবে পায়ের অবস্থা এমন হলো? বলো আমাদের?ভাবির কাছে বলবে না?’

শুদ্ধতার আদুরে স্বরে বলা কথায় গলে গেলো ঈশান।চোখ মুছে বলতে লাগলো,
-‘ স্কুলে টিফিন টাইম চলছিলো।আমি আর আমার একটা বন্ধু স্কুলের বাহিরে একটা আইস্ক্রিম পার্লার আছে দারোয়ান চাচাকে অনেক রিকুয়েস্ট করে সেখান গিয়ে আইস্ক্রিম কিনলাম।তারপর আইস্ক্রিম খেতে খেতে অনেকদূর হেটে একটা একটা গাছের নিচে বসলাম।কথা বলতে বলতে কখন যে টিফিন টাইম শেষ হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না।ঘড়িতে চোখ যেতেই দুজন স্কুলের দিকে দৌড় দিলাম। দুপুর বেলা রাস্তা পুরো ফাঁকা ধরতে গেলে শুধু দু একটা গাড়ি চলছে। মানুষ নেই কোন।এমন দৌড়ানোর কারনে আমি মাটিতে উপুর হয়ে পরে গেলাম।আমার বন্ধু আমাকে সাহায্যে কর‍তে আসবে ঠিক তার আগেই একটা কালো মাইক্রো এসে ওকে এক ঝটকায় ওকে মাইক্রোতে তুলে নিয়ে চলে গেলো।আমি মাটিতে পরে যাওয়া আমার পা’টা ভেঙে গেলো।তাই আমি চাইলেও ওর পিছন পিছন যেতে পারলাম না।চিল্লাতে লাগলাম পরে আমার চিল্লানো শুনে অনেক লোক আসলো কিন্তু ব্যাথায় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।চোখ খুলতেই ঐক্য ভাইয়াকে দেখলাম এর পরেরগুলো তো তোমরা জানো।প্লিজ বড় ভাইয়া।যে করেই হোক আমার বন্ধুকে বাচাও।ওকে নিশ্চয়ই ছেলে ধরারা নিয়ে গেছে।আম্মু আগে আমাকে গল্প শোনাতো না এটা নিয়ে।আজ দেখলাম তা সত্যি।বড় ভাইয়া তোমার তো অনেক পাওয়ার।প্লিজ ভাইয়া ওকে বাচাও।’

সবটা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলো।ঈশান কেঁদে যাচ্ছে আবারও শুদ্ধতাকে ধরে।ওর সারা গা কাঁপছে।বুঝাই যাচ্ছে ছেলেটা বেশ ভয় পেয়েছে।নীবদ্ধ চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস ফেললো।অতঃপর ফোন বের করে কাউকে কল দিতে দিতে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।চিন্তিত শুদ্ধতা ঈশানকে সুইয়ে দিলো ঠিকঠাক তারপর ঈশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।একসময় ঈশান ঘুমিয়ে গেলে। সবাইকে নিয়ে ঈশানের রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো।ওই বাচ্চাটার মা বাবার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।না জানি ওই বাচ্চাটার ফ্যামিলির কি অবস্থা এখন?নীবদ্ধও কোথায় জানি চলে গেলো।
চিন্তায় শুদ্ধতার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো।

#চলবে___________
ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।