রাখিব তোমায় যতনে পর্ব-০৬

0
451

#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৬
‘লোক দেখানো আদর্শ, বাতাসে ভাসমান দূর্গের মত। যার বাস্তবতা ও মূল্য কোনোটাই নেই। ‘
-ক্লাইড ম্যাকি

তবে নীবদ্ধ তো লোক দেখাতে আদর্শ ব্যাক্তি হতে আসেনি।ও আসলেই একজন আদর্শবান ব্যাক্তি হতে চায়।মানুষের পাশে দাড়াতে চায়।সাধারন মানুষদের একজন আদর্শবান নেতা হতে চায়।তবে সেটা যে নেতা হওয়ার আগে করতে পারবে না এমনটা না। মানুষের সাহায্য করতে হলে যে নেতার ট্যাগ নিতে হবে এমন না।নেতা হওয়ার আগে নীবদ্ধ’র সামর্থ্যে যতোটুকু আছে সবটা দিয়ে জনসাধারনদের সেবা করে যাবে আজীবন। নিজের দু চারজন লোক নিয়ে পুলিশ স্টেশনে এসেছে নীবদ্ধ।আরো দুজন লোক পাঠিয়ে দিয়েছে ওই ছেলেটার বাড়ি।যাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুলিশ স্টেশনে প্রবেশ করতেই সবাই সালাম জানালো নীবদ্ধকে।নীবদ্ধও হাসিমুখে উত্তর দিলো।তারপর সোজা চলে গেলো ইন্সপেক্টর এর কাছে। তার কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি নীবদ্ধকে বসার জন্যে বললেন।নীবদ্ধ বসে পরলো। ইন্সপেক্টর হাসি মুখে বলেন,
-‘ মিঃএহসান। হঠাৎ আমার এখানে আসার কারন?’

নীবদ্ধ স্থিরতা বজায় রেখে বলে,
-‘ নিশ্চয়ই কাজেই এসেছি।অহেতুক এখানে আসার আমার কোন শখ নেই।’

ইন্সপেক্টর হেসে বলেন,
-‘ তা কি কাজ শুনতে পারি?’

নীবদ্ধ সরাসরি বলে ফেলল,
-‘একটা কেইস ফাইল করাবো স্যার।’

ইন্সেক্টর পান চাবানো লাল দাঁতগুলো দেখিয়ে দিয়ে বলেন,
-‘ কিসের কেস মিঃএহসান?’
-‘ একটা বাচ্চার মিসিং কেইস ফাইল করবো।’
-‘ কখন হারিয়েছে?’
-‘ এইতো আজ দুপুর দুটো কি আড়াইটার সময়।’

ইন্সপেক্টর ভ্রু-কুচকে ফেললেন।বিরক্ত হয়ে বলেন,
-‘ মিঃ এহসান আপনাকে কি নতুন করে এসব নিয়ম সম্পর্কে অবগত করানো লাগবে নাকি?আপনি জানেন না যে চব্বিশ ঘন্টার আগে মিসিং কেইস ফাইল করা হয় না!’

রাগ ফুটে উঠলো নীবদ্ধ’র মুখশ্রীতে। তাও নিজেকে যথাম্ভব সামলে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে ও।
-‘ আমি জানি স্যার।তবে এটা সরাসরি একটা কিডন্যাপিং কেইস।আমার ছোট ভাইয়ের ফ্রেন্ডকে ওরই সামনে থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছে।এখানে তো আমি হাত গুটিয়ে চব্বিশ ঘন্টা বসে থাকতে পারবো না।আপনি কেইস ফাইল করুন!’

ইন্সপেক্টর নাকচ করলেন,
-‘ আমি পারবো না।রুল্স রুল্সই।’

নীবদ্ধ বাঁকা হাসলো।বলল,
-‘ আপনার রুল্স আর সবার জন্যে হলেও আমার জন্যে না।জয়?’

মীবদ্ধ’র ডাকে সারা দিলো জয়।তড়িঘড়ি করে বলে,
-‘ জি বস!’
-‘ ফোন লাগাও!’

জয় তাড়াতাড়ি কাকে যেন ফোন লাগালো।তারপর নীবদ্ধকে দিলো।নীবদ্ধ হাসিমুখে বলে,
-‘ আসসালামু আলাইকুম ডিআইজি স্যার।ভালো আছেন?জি আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি।জি একটু দরকার।আমি এসেছিলাম থানায় একটা মিসিং কেইস ফাইল করতে।কিন্তু আপনাদের পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে অনেক রুল্স এর কথা বলছেন স্যার।কি করবো বলুন?আচ্ছা দিচ্ছি।’

নীবদ্ধ হাসি হাসি মুখে ইন্সপেক্টরের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলো।ইন্সপেক্টর কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে কানে লাগায়।অতঃপর কথা শেষ করে খুব দ্রুত ফোনটা এগিয়ে দেয় নীবদ্ধ’র দিকে।ভয়ে ভয়ে বলে,
-‘ স্যার আপনি ডিটেইলসগুলো বলেন।আমি কেইস ফাইল করছি।’

নীবদ্ধ অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।হাসতে হাসতে বলে,
-‘ বাহ এতো চেঞ্জ।আই লাইক ইট।জয় বাচ্চাটার বাবা মাকে নিয়ে আসো।’

জয় গিয়ে বাচ্চাটার বাবা মাকে নিয়ে আসলো।বাচ্চাটার বাবা মা কাঁদছেন নীবদ্ধ তাদের শান্তনা দিলেন অতি দ্রুত তাদের সন্তান তাদের কোলে ফিরিয়ে দিবে ও। বাচ্চাটার বাবা মাকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করা হলো।বাচ্চাটার ছবি দেওয়া হলো।তারপর বাড়িতে ফোন করে ঈশানের থেকে কি কি হয়েছিলো তা ডিটেইলসে আবার জেনে নেওয়া হলো।
কাজ শেষ করে থানা হতে বেড়িয়ে আসলো নীবদ্ধ। তারপর নিজের সিক্রেট অফিস রুমে চলে গেলো।সেখানে যেতেই তার আন্ডারে থাকা সব লোকদের এক জায়গায় জড়ো হতে বললো নীবদ্ধ।পাঁচ মিনিটের মাঝে সবাই হাজির হতেই।নীবদ্ধ বেশ রুক্ষ কন্ঠে বলতে শুরু করলো,
-‘ আমি যে একটা বাচ্চার মিসিং কেস ফাইল করে এসেছি সেটা তোমরা জানো।তবে আমি সবটা পুরোপুরি পুলিশের হাতে ছেড়ে দিতে চাচ্ছি না। এখান থেকে দশজন যাবে বাচ্চাটাকে খোজার মিশনে।আরও দশজন যাবে ‘ ********’ ভার্সিটিতে খোঁজ লাগাতে সেখানে নাকি অবৈধ আর বেআইনি কাজ চলে তার পুরো ডিটেইলস এনে আমাকে দিবা।আর বাকি রইলো আরো সতেরোজন তোমরা সজীবের পিছনে লেগে পরো।ও কোথায় যায়? কি করে?ওর লোকেরা কি করে?আমার এভ্রি সেকেন্ডের খোঁজ চাই।এখন আমার কথা মতো লেগে পরো কাজে।বাকিটা হৃদয় বুঝিয়ে দিবে। আর টিমটাও ওই তৈরি করে দিবে।জাস্ট ফলো হিস ইন্সট্রাকশন।’

সবাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে নিজের অফিস হতে বেড়িয়ে আসলো নীবদ্ধ।রাত হয়ে গিয়েছে।বড্ড দৌড়ঝাপ করেছে আজ।বাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন।ঈশানটাও অসুস্থ।একটু আদরও করেনি।ধমকে এসেছে ছেলেটাকে। জয়কে বললো বাড়ির পথে গাড়ি ঘোরাতে।
_________
ঈশান জেগে উঠার পর সেইযে শুদ্ধতাকে জড়িয়ে ধরে আছে আর ছাড়েনি।শুদ্ধতা চিন্তিত স্বরে বলে,
-‘ ঈশান! এইভাবে ধরে রাখলে হবে?ভাবি আবার আসবো তো।অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে আটটা বাজে তো।’

ঈশানের একরোখা জেদ,
-‘ নাহ! তুমি কোথাও যাবে না। আজ আমার সাথেই থাকবে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুদ্ধতা এই ছেলেকে বুঝিয়ে লাভ নেই। শুদ্ধতা অসহায় চোখে সানামের দিকে তাকালো।অপরাধী কন্ঠে বলে,
-‘ সরি রে আমার জন্যে তুই ফেসে গেলি।’

সানাম হালকা হেসে বলে,
-‘ আরে দূর বোকা।আমি তো এমনিতেই হোস্টেলে থাকি। আজ নাহয় ঈশানের সাথেই রাতটা কাটিয়ে দিবো গল্পগুজব করে।কি বলো ঈশান?’

ঈশান খুশি হলো বেশ।দাঁত বের করে হাসি দিয়ে সানামের দিকে তাকালো।এমন সময় খাবার নিয়ে রুমে আসলো নীবদ্ধ।শুদ্ধতা একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। নীবদ্ধ গম্ভীর গলায় বলে,
-‘ খাসনি কেন? তুই যে অসুস্থ তার খেয়াল আছে?’

ঈশান ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
-‘ আমি তোমার হাতে খাবো তাই খাইনি।’

-‘ কেন আমার হাতে খাবি কেন?তোর ভাবি আছে নাহ? আমাকে দিয়ে কি করবি?’

ঈশান কান্নামাখা চোখে তাকালো নীবদ্ধ’র দিকে।হেসে দিলো নীবদ্ধ।বলল,
-‘ হয়েছে আর কাঁদতে হবে না।খাইয়ে দিচ্ছি আমি।’

নীবদ্ধ ঈশানকে খাবার খাইয়ে দিলো।শুদ্ধতা এইবার মেডিসিনগুলোও খাইয়ে দিলো।একটা ঘুমের মেডিসিনও দিয়েছে।এটা না দিলে রাতভর ঘুমাতে পারবে না ছেলেটা।ব্যাথায় ছটফট করবে।নীবদ্ধ ঈশানকে ভালোভাবে সুইয়ে দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।মেডিসিনের ইফেক্টে ঈশান আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পরলো।ঈশান ঘুমাতেই শুদ্ধতা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো।নীবদ্ধকে বলে,
-‘ নয়টা বাজে।আমাকে আর সানামকে আমাদের বাড়ি দিয়ে আসলে ভালো হয়।এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে।সানামের আজ আর হোস্টেলে যাওয়া লাগবে না।ও আজ আমাদের বাড়িতে থাকবে।’

নীবদ্ধ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলো শুদ্ধতার দিকে।তবে কিছু বললো না।চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।শুদ্ধতা আর সামাম একে-অপরের দিকে তাকিয়ে ওরাও নীবদ্ধ’র পিছন পিছন নিচে নামলো।ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখা গেলো আয়েশা রহমান টেবিলে খাবার দিচ্ছেন।শুদ্ধতাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,
-‘ এসো মা ডিনার করে নেও।দুপুরেও তো কিছু খেলে না।’

নীবদ্ধ রাগি গলায় বলে,
-‘ হ্যা তা খাবে কেন?শুধু পারে বারুদের মতো ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠতে।’

শুদ্ধতা নীবদ্ধ’র কথা দাঁতেদাঁত চিপে রইলো।চাইলেও কিছু বলতে পারলো না।এখন নিহাতই এই বাড়িতে আছে তাই কিছু বললো না। নাহলে একদম ধুয়ে দিতো। অসভ্য লোক একটা।শুদ্ধতা দৃষ্টি ঘুরিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
-‘ নাহ আন্টি আসলে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।আমাদের এইবার বাড়ি ফিরা দরকার।’

-‘ সে কি মা এ কেমন কথা না খেয়ে কোথায় যাবে?আর আজকে তোমাদের কোথাও যাওয়া হবে না।চুপচাপ এখানে এসে বসো।তোমার আব্বু আম্মুর কাছে আমি ফোন করে বলে দেবো।চিন্তা করো না।আসো মা।’

আয়েশা রহমানের কথায় সায় দিলেন ফারুক এহসান বলেন,
-‘ হ্যা শুদ্ধতা আম্মু।এখানে আসো একসাথে ডিনার করি।আজ কতোদিন পর এলে তুমি।আজ কোথাও যেতে দিবো না।’

মুরুব্বি মানুষেরা এভাবে বলায় আর না করতে পারলো না শুদ্ধতা।সানামকে ফিসফিস করে বলে,
-‘ সরি দোস্ত।আমার জন্যে তুই ও ফেঁসে গেলি।’

-‘ ইট্স ওকে।বন্ধুর পাশে যদি বিপদের সময় দাঁড়াতে না পারি তাহলে কিসের বন্ধু আমি।’

সানামের কথায় হালকা হাসলো শুদ্ধতা।তারপর একসাথে সবাই বসলো ডিনার করতে।নীবদ্ধ বসেছে শুদ্ধতার মুখোমুখি।নিজে যা নিচ্ছে শুদ্ধতার দিকেও সেটা ঠেলে দিয়ে ইশারা করছে খাওয়ার জন্যে।রাগে কটমট দৃষ্টি ছুড়ে দিচ্ছে শুদ্ধতা।এতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই নীবদ্ধ’র।ও নির্বিকারে খেয়ে যাচ্ছে।শুদ্ধতা কিছু নিচ্ছে না দেখে এইবার ভ্রু-কুচকে তাকায় নীবদ্ধ।গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-‘ কি সমস্যা আপনার? খাচ্ছেন না কেন?’

নীবদ্ধ’র এমন কথায় সবার দৃষ্টি এইবার শুদ্ধতার দিকে গিয়ে পরে।শুদ্ধতা অসস্থিতে নড়েচড়ে বসে।মিনমিন করে বলে,
-‘ খাচ্ছি তো।আপনি অযথা এসব বলছেন।’

-‘ মা তুমি নিজেই দেখো উনার প্লেটে কতোটুকু খাবার।আমি আর কিছু বলবো না।আমার খাওয়া শেষ।রুমে যাচ্ছি কাজ আছে।’

এই বলে নীবদ্ধ চলে গেলো।আর শুদ্ধতাকে ফাসিয়ে দিয়ে গেলো।আয়েশা রহমান প্লেট ভরে খাবার দিলেন শুদ্ধতাকে। অতি কষ্টে ঠেলেঠুলে খাচ্ছে শুদ্ধতা।তা দেখে মুখ টিপে হাসছে সানাম।হাসতে হাসতে পানির গ্লাসটা নিয়ে খেতে যাবে।শুদ্ধতা রেগে সানামের পায়ে একটা জোড়েসোড়ে খোঁচা মেরে দেয়।ব্যাথায় কেঁপে উঠে সানাম হাতের পানিগুলো পাশে বসা ঐক্য’র গায়ে গিয়ে পরে। ভয়ে মুখে হাত চলে যায় সানামের।এমনিতেই ঐক্য পাশে বসায় অসস্থিতে ঠিকঠাক খেতে পারছিলো না বেচারি আর এখন এই কান্ড।ঐক্য লাফিয়ে উঠে টি-শার্ট ঝারতে লাগলো।সানাম কাঁদো ফেস বানিয়ে বলে,
-‘সরি ভাইয়া।আসলে আমি ইচ্ছে করে করিনি। অনেক সরি ভাইয়া।’

ঐক্য তাকালো সানামের দিকে।মেয়েটার চোখ টলমল করছে।আর একটু হলে এই বুঝি কেঁদে ফেলবে।ঐক্য হালকা হেসে বলে,
-‘ইট্স ওকে সানাম।আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে করোনি।মন খারাপ করার মতো কিছু হয়নি।খাবার শেষ করো।’

সস্থির শ্বাস ফেললো সানাম।আবারো সরি বলে খাবারে মনোযোগ দিলো। শুদ্ধতা শয়তানি হাসি দিয়ে চোখ টিপে দিলো সানামকে।ঐক্য খাওয়া শেষই ও উঠতে নিবে ঠিক তখনি ওর গায়ে পানিগুলো পরে।তাই হাত ধুয়ে সোজা উপরে চলে গেলো।যাবার আগে আর একবার সানামকে একপলক দেখতে ভুলে নি।

#চলবে_____________

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।