রাখিব তোমায় যতনে পর্ব-০৭

0
435

#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৭
-‘ আমরা ওদের বিয়ে দিয়ে কোন ভুল করছি না তো ফারুক সাহেব? আপনার কি মনে হয়?’

রাশেদ সাহেবের এমন কথায়।কিয়ৎক্ষন চুপ রইলেন তিনি।পরে আস্তেধীরে বলেন,
-‘ আপনার যদি মনে হয় আপনি আমার ছেলের কাছে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পস্তাবেন তাহলে বিয়েটা না দেওয়াই ভালো রাশেদ সাহেব।’

রাশেদ সাহেব বুঝলেন ফারুক এহসান তার কথাটার অর্থ অন্যকিছু ভেবে বসেছেন।তিনি বলেন,
-‘ না না এটা কি বলছেন আপনি?এমন কিছুই নাহ।আমি জানি নীবদ্ধ বাবা আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাসে।তা আমি এই একবছরেই বুঝতে পেরেছি।আমি তো ভয় পাচ্ছি আমার মেয়েটাকে নিয়ে।ও অনেক রাগি,জেদি।আর আমার বড় মেয়েটার মৃত্যুর পর যেন তা আরো বেশি বেড়ে গিয়েছে।মেয়েটা আমার একটা বছর ট্রমাতে ছিলো।পৃথিবীর আলো দেখেনি।নিজেকে রুমবন্ধি করে রেখেছিলো।আমাদের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় আমার মেয়েটা ভালো হয়েছে।কিন্তু আমার বড় মেয়েটার মৃত্যুর পিছনে যে কারন আছে তা আজও ভুলেনি আমার মেয়েটা।তাই তো বিয়ে,ভালোবাসা এসবে বিশ্বাস করে না।আমার ভয় হয় মেয়েটাকে নিয়ে জেদের বসে মেয়েটা না জানি আমার কখন কি করে বসে।এক মেয়েকে হারিয়েছি আমি আমার এই মেয়েটাকেও আমি হারাতে চাই না।তাহলে যে আমি মরে যাবো ফারুক সাহেব।’

রাশেদ সাহেবের কন্ঠ কাঁপছে কথাগুলো বলার সময়।তার ভীতরে যে অনেক কষ্ট সেটা একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারলেন ফারুক সাহেব।তাই তিনি নরম গলায় বলেন,
-‘ চিন্তা করবেন না রাশেদ সাহেব।ভরশা রাখুন আমার ছেলের উপর আমাদের উপর।ইনশাআল্লাহ আপনাকে আমরা নিরাশ করবো না।শুদ্ধতাকে আমরা আমাদের সবটা দিয়ে আগলে রাখবো।’

রাশেদ সাহেব সস্থির নিশ্বাস ফেললেন ফারুক এহসানের কথায়।অতঃপর আরো কিছু টুকটাক কথা বলে তারা কথপোকথনে সমাপ্তি টানলেন।
কথা শেষ হতে ফোন রাখতেই দরজার অপাশ হতে নীবদ্ধ বলল,
-‘ আসবো বাবা?’

ফারুক এহসান অনুমতি দিলেন নীবদ্ধকে।নীবদ্ধ বাবার কাছে এসে বসে।ফারুক এহসান ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘ কি হয়েছে নীবদ্ধ।তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?কি নিয়ে এতো চিন্তা করছিস?’

নীবদ্ধ’র নিজের ভীতরে কি চলছে তা কেউ নীবদ্ধ’র চেহারা দেখে বুঝতে পারবে না।নীবদ্ধ নিজের চিন্তাগুলো নিজের মনের মধ্যে খুব দক্ষতার সাথে চেপে যেতে পারে।তবে ওর বাবার সামনে এটা কখনই পারে না।তিনি কেমন যেন চট করে নীবদ্ধ’র মনের অবস্থা বুঝে ফেলেন একনিমিষেই। নীবদ্ধ হালকা হেসে বলে,
-‘ ও কিছু না বাবা।শুধু ওই বাচ্চা ছেলেটার জন্যে চিন্তা হচ্ছে আমার।না জানি ছেলেটা কেমন আছে।’

ফারুক এহসান ছেলের কাঁধে ভরসার হাত রাখেন।তারপর বলেন,
-‘ তুই তোর সবটা দিয়ে মানুষের সেবা করার চেষ্টা করবি।যাতে তোর মনে এতোটুকুও অনুশোচনা না থাকে যে তুই কোন চেষ্টার কমতি রেখেছিস।অথবা মানুষ তোর দিকে আঙ্গুল তুলতে পারে এমন বিন্দুমাত্র পথ খোলা রাখবি না।বাকিটা উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিবি।কারন ভাগ্যের উপরে আমাদের কারো হাত নেই।’

নীবদ্ধ মুগ্ধ হয়ে বাবার প্রতিটা কথা শুনলো।এই এক চমৎকার ব্যাক্তি।যার মুখগহ্বর হতে নিস্কৃত প্রতিটা বাক্য নীবদ্ধ’কে নতুন করে অনুপ্রেরণা দেয়।ফারুক সাহেব আবারও বলেন,
-‘ তা কি জন্যে এসেছো?কোন দরকার?’

নীবদ্ধ মাথা দুলালো যার অর্থ ‘ হ্যা!’। অতঃপর আস্তে ধীরে বলা শুরু করল,
-‘ বাবা তুমি যখন এমপি ছিলে এই জেলার। তখন এমন একটা কেইস উঠেছিলো।একাধিক পরিমানে শিশু,আর মেয়ে গায়েব হয়ে যাওয়ার নিয়ে আন্দোলন উঠেছিলো।সময়টা তখন বোধহয় ২০১৭। তখন আমাদের জেলা থেকেই প্রায় পঞ্চাশটা শিশু, আর মেয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিলো।গায়েব হলে ভুল হবে তাদের কিডন্যাপ করা হয়েছিলো। তুমি নিজে এই কেসটার সমাধানে লেগেছিলো।সন্ত্রাসীদের ধরেছিলেও।বাবা তোমার কি মনে হয়?২০১৭ সালের ঘটনাটি কি আবারো ঘটতে চলেছে? বাবা এই নিয়ে কিন্তু প্রায় এগারোজন শিশু গায়েব হয়ে গিয়েছে।কিন্তু তোমরা তো সন্ত্রাসীদের পাকরাও করেছিলে। তবে আবার কারা এসব করছে?কোন আইডিয়া আছে বাবা?’

ফারুক এহসান বেশ চিন্তিত হয়ে পরলেন নীবদ্ধ’র কথা শুনে।চিন্তার রেশ কন্ঠে রেখেই তিনি বলতে লাগলেন,
-‘ কেসটাকে আমরা দি এন্ড ঘোষনা করলেও কিন্তু তা পুরোপুরি সত্যি ছিলো না।আমরা দুশোজন বাচ্চার মধ্যে একশো পঁচাত্তর জন উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাও কতো কাঠখোঁড় পোড়াতে যে হয়েছিলো।সন্ত্রসী পাকরাও করেছিলাম তবে এর মধ্যে আবার পাঁচজন পালিয়ে গিয়েছিলো।আমার মনে হচ্ছে তারা ফিরে এসেছে।এবং আবারও সে জঘন্য কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছে।’

-‘ এক্সেক্টলি।আমি এইটাই ভাবছিলাম। তোমরা বলেছিলে তো সবাইকে ধরে গ্রেফতার করা হয়েছে।তবে আমার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছিলো। অবশেষে দেখো আমার সন্দেহটাই ঠিক।তা বাবা তুমি কি ওদের চেহারা দেখেছিলে?মানে অনেক বছর আগের কথা।আমি জানি মনে নাও থাকতে পারে তাও একবার জিজ্ঞেস করলাম।’

নীবদ্ধ’র কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফারুক এহসান।ব্যর্থ কন্ঠে বলে,
-‘ বাবা আমার বয়স হয়েছে আমার কি আর ওতোসব কিছু মনে থাকে।আর এটা তো আরো কতোবছর আগের কথা।তারপরেও ওই লোকগুলোকে দেখেছিলাম শুধু একপলক।একপলকের দেখায় কি কাউকে মনে থাকে?’

নীবদ্ধ চাপা শ্বাস ফেললো।ও আগেই জানতো তার বাবা এতো আগের ঘটে যাওয়া ঘটনায় জড়িত লোকদের চেহারা মনে করতে পারবে না।নীবদ্ধ নিরাশ হয়ে চলে যাবার কথাটা বলার আগেই ফারুক এহসান বলেন,
-‘ তবে এই কেসটা যেই পুলিশের আন্ডারে আমি দিয়েছিলাম তুই তার সাথে কথা বলতে পারিস।।ছেলেটা অনেক সৎ একজন পুলিশ অফিসার। আমি তোকে তার বাসার ঠিকানা দিচ্ছি।তুই একবার তার খোঁজ নিয়ে দেখিস। ছেলেটা তখন তাগড়া একজন যুবক।তাই ওর মনে থাকার কথা।এখনো তো বয়স আর কতোটুকুই বা হয়েছে।তুই তার কাছে গিয়ে দেখ।’

নীবদ্ধ’র ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো।এই একটু বুঝি আশার আলো ফুটলো।ফারুক এহসান অনেক খোঁজাখুজি করে অবশেষে সেই পুলিশের নাম ঠিকানা জোগাঢ় করতে সক্ষম হলেন। বহু পুরোনো কাগজের নিচে চাপা পরেছিলো যে।নীবদ্ধ’কে কাগজটা এগিয়ে দিতেই হাতে নেয় নীবদ্ধ।লেখাটা পড়ে একবার।ফের বিরবিরিয়ে আওড়ায়,
-‘ জুনায়িদ শেখ।’
______________
বাবার সাথে দীর্ঘক্ষন আলাপ চারিতা করতে করতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছে এখন বাজে রাত বারোটা।চোখের পাতায় অল্পসল্প ঘুম।নীবদ্ধ ভাবলো একবার ছোট ভাইটাকে দেখে আসা দরকার।ভাইটার পায়ে চোট পেয়েছে।কি জানি ঠিকঠাক ঘুমিয়েছে কিনা।
যেই ভাবা সেই কাজ।নীবদ্ধ চলে গেলো ঈশানকে দেখার জন্যে সচরাচর ঈশানের রুমের দরজা লক থাকে না।তবে আজ লক থাকায় বেশ আশ্চর্য হলো নীবদ্ধ।আবারও ফিরে নিজের রুমে গিয়ে ঈশানের রুমের চাবি এনে দরজার লক খুললো।
রুমের ভীতরে প্রবেশ করে ঈশানের বেডের কাছে যেতেই অবাক হলো নীবদ্ধ।কারন এখানে ঈশান একা না সাথে শুদ্ধতাও আছে।ঈশান ঝাপ্টে ধরে আছে শুদ্ধতাকে।আর খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুদ্ধতা ঈশানের মাথায় একটা হাত আর ওর পেটের একটা হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে।শুদ্ধতা আর সানামকে তো একটা রুম দেওয়া হয়েছিলো।অথচ দেখো মেয়েটা এখানে ঈশানের কাছে এসে ঘুমাচ্ছে।হালকা হাসলো নীবদ্ধ।ড্রিম লাইটের আলোতে শুদ্ধতার মুখশ্রীটা বড্ড মায়াবী লাগছে।এই মেয়েটার মাঝে যে কি এমন জাদু আছে নীবদ্ধ জানে না।প্রতিনিয়ত নতুন করে প্রেমে পরে মেয়েটার উপর।কবে যে মেয়েটা ওকে একটু ভালোবাসবে।নীবদ্ধ কি আদৌ পারবে শুদ্ধতার মনের ভয় কাটাতে।পৃথিবীতে সব পুরুষ যে এক হয়না এটা কিভাবে বুঝাবে ওকে? সত্যিকারের ভালোবাসা এখনো আছে পৃথিবীতে সেটে কিভাবে উপলব্ধি করাবে? জানে না নীবদ্ধ কিছু জানে না।তপ্ত শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় নীবদ্ধ শুদ্ধতার কাছে।অতি সাবধানে শুদ্ধতাকে সোজা করে সুইয়ে দিলো।তারপর ঈশানের কঁপালে চুমু দিয়ে উঠে চলে যেতে নিতেও কি মনে মরে যেন আবার ফিরে আসলো।একধ্যানে শুদ্ধতার দিকে তাকিয়ে দেখে শুদ্ধতার এলোমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলো।অতঃপর আদুরেভাবে শুদ্ধতার ললাটে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে দিলো।একটু কেঁপে উঠলো শুদ্ধতা।পরক্ষনে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।হাসলো নীবদ্ধ। তারপর চলে গেলো।কিন্তু যাওয়ার আগে বিরবির করে শুদ্ধতার কানে কিছু বলে গেলো।কিন্তু আদৌ কি শুদ্ধতা তা শুনতে পেয়েছে? একটুও কি বুঝতে পেরেছে নীবদ্ধ’র অস্তিত্ব ছিলো এখানে।

#চলবে____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।