রাগে অনুরাগে পর্ব-০৪

0
356

#রাগে_অনুরাগে💚✨

#পর্ব_০৪

#লেখক_ঈশান_আহমেদ

মিহিরের খাওয়া শেষ হতেই তার মোবাইলে একটা কল আসলো।সে কলটা রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে নিলয় বললো,

“স্যার কয়েকজন ক্লাইন্ড এসেছেন।আপনি যদি একটু আসতেন ভালো হতো।”

“মানে?আমি তো বলেছিলাম আজ সব কাজ বন্ধ রাখতে।এর মধ্যে ক্লাইন্ড আসলো কোথা থেকে?”

“স্যার মিটিংটা আগেই ঠিক করা ছিলো।কিন্তু আমি আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।”

মিহির চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করলো।তারপরে খুব শান্ত গলায় বললো,

“আচ্ছা আমি আসতেছি।”

মিহির মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো।মুহিত পাশে থেকে বললো,

“কোথায় যাবি রে ভাইয়া?”

“আর বলিস নাহ্।আজকে নাকি কোন মিটিং ফিক্সড করে রেখেছে।কিন্তু আমাকেই জানায়নি।এরা যে একেক জন কি কাজ করে!”

“আচ্ছা ভাইয়া তুই যা।”

“হুম।”

মিহির রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় সে দেখলো আরাধ্যা একটা লোকের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।আরাধ্যার কথা বলার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে সে লোকটার সাথে ঝগড়া করতেছে।মিহির গাড়ির ব্রেক কষলো।গাড়ি থেকে নেমে আরাধ্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

“চাশমিশ কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?”

পরিচিত পুরুষ কণ্ঠস্বর শুনে আরাধ্যা তার বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকালো।মিহিরকে দেখে আরাধ্যা একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,

“আর বলবেন নাহ্ মিহির বাবু।এই লোক আমার ব্যাগ নিয়ে পালাচ্ছিলো।”

মিহির আরাধ্যার কথা শুনে লোকটার দিকে তাকালো।মিহির লোকটার দিকে তাকাতেই লোকটা হাত জোর করে বললো,

“স্যার আমাকে মারবেন নাহ্ দয়া করে।আমার বাচ্চাটা অসুস্থ।তাই এমন কাজ করতে বাধ্য হয়ে ছিলাম।”

আরাধ্যা লোকটার কথা শুনে বললো,

“আরে এটা আপনি আগে বলবেন তো।আমি আপনার সাথে কত বাজে ব্যবহার করলাম।”

মিহির তার মানিব্যাগ থেকে কতগুলো টাকা বের করে লোকটার হাতে দিয়ে বললো,

“হাত-পা সব ঠিক থাকতে অসৎ পথে উপার্জন করার মানে কি!নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে কিছু করেন।এইসব চুরি করে তো আর সারাজীবন চলবে নাহ্।আমার জানা মতে আপনি খুব ভালো ম্যাকানিকের কাজ পারেন।কারণ আপনি একদিন আমার গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিলাম।সেটাকেই কাজে লাগিয়ে কিছু করেন।”

“সাহেব আপনার আমারে মনে আছে!আমি তো ভাবছিলাম ভুলে গেছেন।কিন্তু সাহেব আমাগো তো কেউ কাজ দেয় নাহ্।এই কারণেই এইসব অসৎ কাজ শুরু করছি।”

“দেখুন কাজ দেয় নাহ্ এটা কোনো কথা নাহ্।নিজের আগ্রহ থাকতে হবে কাজের প্রতি।আপনি যদি ভালো কাজ করে দেখাতে পারেন তাহলে আপনাকে কাজে নিতে বাধ্য থাকবে।আমি চাইলে আপনাকে একটা কাজ দিতে পারি।কিন্তু সেটা আপনার জন্য ভালো হবে নাহ্।আপনার নিজেকেই কাজ খুঁজতে হবে।তাহলে বুঝবেন সৎ কাজ করার আনন্দ কত বেশি!”

মিহিরের কথায় লোকটার মুখে হাসি ফুটলো।লোকটা মিহিরের হাত ধরে বললো,

“সাহেব আপনে আমার চোখ খুলে দিছেন।আজ দিয়ে আমি কাম খুজমু।তারপরে সৎ পথে রোজগার করমু!”

লোকটার কথায় মিহির প্রশান্তির হাসি দিলো।লোকটা চলে যেতে যাবে এমন সময় মিহির তার পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে তার হাতে দিয়ে বললো,

“এই নাম্বারে যোগাযোগ করলে আমাকে পাবেন।কোনো প্রয়োজন হলে অবশ্যই কল করতে পারেন।আর হ্যাঁ কাজ কিন্তু আপনার নিজেরই খুঁজতে হবে।

লোকটা কার্ডটা নিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।লোকটা চলে যেতে মিহির আরাধ্যার দিকে তাকালো।

আরাধ্যা মুচকি হেসে মিহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।সে এতোক্ষণ মিহিরের বলা কথাগুলো শুনতেছিলো।একটা মানুষ কি সুন্দর করে আরেকটা মানুষকে সৎ কাজ করে উপার্জন করার পরামর্শ দিতে পারে!

আরাধ্যাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিহির হালকা কেশে বললো,

“কি ব্যাপার চাশমিশ প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি?”

মিহিরের কথায় আরাধ্যা খানিকটা লজ্জা পেলো।তাও সে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

“আরাধ্যা রহমান এতো সহজে কারো প্রেমে পড়ে নাহ্ বুঝলেন মিহির বাবু!”

আরাধ্যার কথায় মিহির মুচকি হেসে বললো,

“পড়তেও পারেন বলা তো যায় নাহ্।”

“হয়েছে এতো কথা না বলে এখন বাড়ি যান।আমারও বাড়ি যেতে হবে।”

“আরে চাশমিশ শুনেন নাহ্!”

“বলেন।”

“চলুন দুজনে টং দোকানে বসে চা খাই।আমার অনেক দিনের ইচ্ছা আমার প্রিয় মানুষকে নিয়ে টং দোকানে বসে চা খাবো।”

আরাধ্যা ভ্রু কুচকে বললো,

“আমি আপনার প্রিয় মানুষ?”

“অবিয়াসলি!নাহলে আমি আপনার সাথে এতো কথা বলতাম নাহ্।কারণ আমি আবার মেয়েদের সাথে এক-দুইটা কথা বলার পরে কি বললো তা খুঁজে পাই নাহ্।যার কারণেই বয়স বাড়ছে তবে বিয়ে হচ্ছে নাহ্!”

মিহিরের কথা শুনে আরাধ্যা খিলখিল করে হেসে দিলো।মিহিরও মিটমিট করে হাসছে।আরাধ্যা হাসি থামিয়ে বললো,

“আপনি কিন্তু অনেক মজার কথা বলতে পারেন।তাহলে চলুন দুজনে একসাথে টং দোকানে বসে চা খাই।”

“আপনি হাঁটা শুরু করুন আমি পিছনে আছি।”

আরাধ্যা মুচকি হেসে হাঁটা শুরু করলো।মিহির তাকে অনুসরণ করে হাঁটতেছে।হঠাৎ করে একটা মেয়ে এসে মিহিরকে জড়িয়ে ধরলো।মিহির তো অবাক হয়ে গেছে।

আরাধ্যা ততক্ষণে টং দোকানে পৌঁছে গেছে।মিহিরের দিকে তাকাতে সে দেখলো মিহিরকে একটা মেয়ে জড়িয়ে ধরে আছে।

মিহির মেয়েটাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সামনে দাঁড়া করালো।মেয়েটাকে সে চিনে।কারণ মেয়েটা তার সাথে এক ভার্সিটিতে পড়তো।মেয়েটার নাম টিনা।তবে মিহির তাকে একদম পছন্দ করে নাহ্।কারণ মেয়েটা মিহিরকে অনেক বিরক্ত করতো।কিন্তু মিহিরের এইসব কাজকর্ম একদম পছন্দ নাহ্।তাই সে বরাবরের মতো টিনার থেকে দূরত্ব বজায় চলতো।

মিহির কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,

“টিনা তোর এখনো এমন হুটহাট জড়িয়ে ধরার অভ্যাস গেলো নাহ্?”

“কি করবো বল!তুই তো জানিস আমি আমেরিকায় ছিলাম।তোকে প্রায় দুই বছর পরে দেখলাম।তাই নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনি।যতই হোক আমি তোকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।”

“তুই কতজনকে এমন নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসিস সেটা একটু ক্লিয়ার করে বলতে পারবি?জানি পারবি নাহ্।কারণ ভালোবাসা কি সেটাই তুই জানিস না্হ্!তাই জনে জনে ভালোবাসা বিলিয়ে বেড়াস।বাই দ্যা ওয়ে তোর সাথে এতো কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছা নেই।আমার জরুরি কাজ আছে।সো বাই।”

মিহির কথাটা বলে আরাধ্যার দিকে তাকালো।সে দেখলো আরাধ্যা কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলছে।মিহির আরাধ্যার দিকে এগিয়ে গেলো।আরাধ্যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।আরাধ্যা মোবাইলে কথা বলা শেষ করে মিহিরের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিলো নাকি?”

“গার্লফ্রেন্ড থাকলে এতোদিনে বিয়ে হয়ে যেতো।ভার্সিটিতে একসাথে পড়তাম।”

“ওহ্ আচ্ছা।আপনি তাহলে উনাকে রেখে আমার এখানে কেনো আসলেন?আমি না হয় চলে যেতাম।”

“ওর থেকে আপনি আমার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট।বেশি স্পেশাল!”

আরাধ্যা কিছু বলতে যাবে তার আগে মিহির বললো,

“আর কোনো কথা নাহ্।এখন চা খেতে হবে।”

মিহির গিয়ে দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিলো।আরাধ্যা গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলো।চায়ের অর্ডার দিয়ে মিহির আরাধ্যার পাশে বসলো।বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে।

টিনা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে।টিনা ভ্রু কুচকে বললো,

“এই মেয়েটা আবার কে?এই মেয়ের সাথে মিহিরের কি সম্পর্ক?ও কি এই মেয়ের কারণে আমার সাথে এমন ব্যবহার করলো?এমন একটা অন্ধ মেয়ের জন্য আমাকে কাজ দেখিয়ে চলে গেলো!না মিহির তোকে আমারই হতে হবে।”

টিনা কথাটা বলে চোখ রাঙিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলো।



মিহির চা এনে আরাধ্যার হাতে দিলো।আরাধ্যা মিহিরের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে বললো,

“উনার নাম কি?”

মিহির চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেলো।নিরব দৃষ্টিতে আরাধ্যার দিকে তাকালো।আরাধ্যা আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে হয়তো উত্তরের আশায়।মিহির কিছু একটা ভেবে বললো,

“আপনি কার কথা বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি নাহ্।”

“আপনাকে যেই মেয়েটা জড়িয়ে ধরেছিলো উনার কথা?”

মিহির এতোক্ষণে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।তারপরে শান্ত গলায় বললো,

“টিনা।”

আরাধ্যা মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুজাতে গুজাতে বললো,

“মেইবি উনি আপনাকে ভালোবাসে।আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে অনেকটা রেগেই চলে গেলেন।”

মিহির আরাধ্যার কথায় হেসে দিলো।আরাধ্যার দিকে তাকিয়ে বললো,

“ও ভালোবাসার মানেই বুঝে নাহ্।ও এমন অনেককে’ই ভালোবাসে।ওর ভালোবাসা শুধু আমার জন্য সীমাবদ্ধ নয়।”

মিহিরের কথার কোনো উত্তর দিলো নাহ্ আরাধ্যা।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

“আমাদের সাথে চা খেতে তো ডাকতে পারতেন!”

“এইসব টং দোকানে ও খেতে পারবে নাহ্।আচ্ছা ওর কথা বাদ দেন।আপনি আপনার কথা বলুন।”

আরাধ্যা চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে বললো,

“আমাকে নিয়ে কি বলবো?”

“এই যে আপনার কোনো ভালোবাসার মানুষ মানে লাভার আছে নাকি!”

মিহিরের কথায় আরাধ্যা নিঃশব্দে হাসলো।মিহির আড়চোখে আরাধ্যার হাসি দেখতে ব্যস্ত।আরাধ্যা মিহিরের দিকে তাকিয়ে দেখলো মিহির তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে।আরাধ্যা বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে’ই নিলো।চায়ের কাপে লাস্ট চুমুক দিয়ে আরাধ্যা বললো,

“আমার কোনো ভালোবাসার মানুষ নেই।একটা জিনিস কি জানেন চশমা পড়া মানুষদেরও কিন্তু অনেক কথা শুনতে হয়।যেমন ধরুন-অন্ধ,ডাবল ব্যাটারি,কানা ইত্যাদি!কোনো মানুষ যদি মজার ছলে এইসব নাম ধরে ডাকে সেটা মানা যায়।কিন্তু সিরিয়াসলি কেউ যদি এইসব বলে তাহলে সেটা অপমানে লাগে।কিছুদিন আগে একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।কাল সেই ছেলেটা আমার বান্ধবীকে বিয়ে করে আমাকে ডাবল ব্যাটারি নাম দিয়েছে।আচ্ছা চশমা পড়া কি কোনো অপরাধ?নাকি চোখে সমস্যা থাকা কোনো অপরাধ?পৃথিবীর সব মানুষই কি পারফেক্ট হয়?”

আরাধ্যার কথাগুলো শুনে মিহির চুপ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আরাধ্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“অনেক কথা’ই আপনাকে বলে ফেললাম।কিছু মনে করবেন নাহ্।আসলে আমি একবার কথা বলা শুরু করলে আর থামতে পারিনা।তাই সব বলে দিলাম।আচ্ছা আজকের মতো আসি।পরে কোনোদিন দেখা হবে!”

আরাধ্যা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চলে যেতে যাবে এমন সময় মিহির আরাধ্যার ব্যাগের ফিতা টেনে ধরলো।মিহিরের এমন কাজে আরাধ্যা পিছনে ফিরে তাকালো।আরাধ্যা পিছনে ফিরতেই মিহির তার ব্যাগের ফিতা ছেড়ে দিলো।মিহির মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,

“আসলে আপনাকে থামানোর জন্য এমনটা করেছি।আপনাকে কিছু বলা উচিত।এই যে একজন আপনাকে ডাবল ব্যাটারি বলেছে বলে আপনি কষ্ট পেয়েছেন।কিন্তু চোখে সমস্যা থাকাটা কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপার।এটা তেমন বড় কোনো ইস্যু নাহ্।আর যে এই চোখে সমস্যা নিয়ে কথা বলে সে কখনো ভালো মানুষ হতে পারে নাহ্।বিকজ এতো ছোট ব্যাপার নিয়ে খুঁত ধরার কোনো মানেই হয় নাহ্।তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো উচিত বুঝলেন।সো এইসব বিষয় নিয়ে ভেবে আর কষ্ট পাবেন চাশমিশ।আর হ্যাঁ চশমা পড়ার কারণেই আপনাকে বেশি কিউট লাগে।”

মিহিরের কথায় মুচকি হাসলো আরাধ্যা।তারপরে সে মিহিরকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।

#চলবে……………..