রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
248

#রাজকন্যা_হূরিয়া ❤️
লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৭;

পত্র খানা হাতের মুঠোয় নিয়ে ধপ করে বসে পড়লো ওস্তাদজী। বার্ধক্যের ভারে টনটন করে উঠলো তার সমস্ত শরীর। চোখমুখ জুড়ে বিরাজমান হলো হেরে যাওয়ার অদৃশ্য ছাপ! ঐ ধূর্ত পুঁচকে কন্যা এতোদূর জেনে গেলো? তবে কি ও আয়াসকে সবটা বলে দিয়েছে? আয়াস সবটা জেনে গেছে!

কথা গুলো ভাবতেই তার শ্বাসে টান লাগলো। শ্বাসকষ্টের মতো হলো। তার এমন দশা দেখে ছুটে এলো নাজিমউদ্দীন। ওস্তাদজী হা করে দম নিতে লাগলো। নাজিমউদ্দীন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাউকে জল নিয়ে আসতে বলল।

“মিত্র কি হলো তোমার! হঠাৎ এমন দশা.. কি আছে পত্রে.. যা পড়তেই তোমার শরীরের এই গতি হলো?”

নাজিমউদ্দীনের চোখে মুখে ভয়। হাত বাড়িয়ে পত্র খানা নিতে গেলে ওস্তাদজী ওমন অবস্থায়ও সরিয়ে নেয় পত্রখানা। নাজিমউদ্দীন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় ওস্তাদজীর পানে।

“কি হলো? পত্রখানা আমায় পড়তে তো দাও?”

সন্দিহান মনেই জানতে চায় নাজিমউদ্দিন।

“ন্ না মিত্র! এই পত্র আমি তোমায় কিছুতেই পড়তে দিতে পারবোনা।”

অতিকষ্টে জবাব দেয় ওস্তাদজী। নাজিমউদ্দীন হাফ ছাড়ে। পত্র খানা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবারও ডাকে কাউকে,

“জল আনতে এতক্ষণ সময় লাগে?”

সঙ্গে সঙ্গে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে ছুটে আসে একটা ছেলে। নাজিমউদ্দীন সেই জলটা খুব সাবধানে খাওয়ায় ওস্তাদজীকে। জল খেতেই ওস্তাদজী একটু শান্ত হয়। তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নাজিমউদ্দীন।

নাজিমউদ্দীন এবং ওস্তাদজী দীর্ঘদিনের মিত্র। খুবই ভালো মিত্র তারা। আর এতোটাই ভালো মিত্র যে নাজিমউদ্দীন চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ওস্তাদজীকে। তাই ওস্তাদজী একবার বারণ করাতেই নাজিমউদ্দীন দ্বিতীয়বার আর দেখতে চাইলো না পত্র খানা।

ওস্তাদজীকে ধরে উঠালো নীচ থেকে। এগিয়ে নিয়ে গেলো শয্যার দিকে। নাজিমউদ্দীন সাবধানে বসালো ওস্তাদজীকে। বলল,

“তুমি একটু বিশ্রাম নাও মিত্র। আমি আয়াসকে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করি।”

ওস্তাদজী ছক কষে। হঠাৎ কান্নাজড়ানো গলায় বলে ওঠে,

“আয়াস যে আর ফিরে আসতে পারবেনা মিত্র! রাজকন্যা ওকে কারাবন্দী করেছে!”

নাজিমউদ্দীন চমকে ওঠে। তার চোখমুখে ভর করে আতংক।

“কি!! কেমন করে?”

“আমার পুত্রকে বন্দী করেছে ঐ কন্যা। শর্ত দিয়েছে.. যদি সিরাজ উদ্দীনকে ছেড়ে দেই তবেই ও আমার পুত্রকে ছাড়বে। এর আগে নয়!”

“অসম্ভব! সিরাজকে মুক্ত করলে আমাদের রাজপ্রাসাদ দখল করা অসম্ভব হয়ে যাবে। আমাদের এতো বর্ষের স্বাধনা…”

“সব এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।”

“কিন্তু আয়াসকে রাজকন্যা বন্দী করলো কেমন করে! রাজকন্যা আয়াসের সঙ্গে পেরে উঠেছে এটাই যে অবিশ্বাস্য!”

“আয়াসের বোকামোর জন্যই সবটা হয়েছে মিত্র। ওর প্রতি এতোটা অন্ধবিশ্বাস করা বোধহয় আমার ঠিক হয়নি।”

“তুমি এতো চিন্তা করিওনা। আয়াসকে মুক্ত করতে আমি যাবো ঐ প্রাসাদে। তবুও আমি সিরাজের মুক্তি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারবোনা। ওকে মুক্ত করা অসম্ভব মিত্র।”

“তুমি যাবে ঐ প্রাসাদে!”

“হ্যাঁ, আমি যাবো।”

বলেই উঠে দাঁড়ালো নাজিমউদ্দীন। আর এক মুহুর্ত দেরী করলো না। হনহন করে বেরিয়ে গেলো।

নাজিমউদ্দীন বেরিয়ে যেতেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলো ওস্তাদজী। শয্যায় গা এলিয়ে দিয়ে শয়/তানি হেসে বলল,

“রাজকন্যা এতোটাও বোকা নয় প্রিয় মিত্র। আর আমি তো তার থেকেও একধাপ উপরে। আমাকে মাত দেওয়া এতো সহজ হবেনা। এই কে কোথায় আছিস?”

“আজ্ঞে ওস্তাদ?”

“মেরাজকে খবর দে।”

“কিন্তু ওস্তাদজী, মেরাজজী তো চিকিৎসায় আছেন।”

ওস্তাদজী ঠোঁটের কোনে পূণরায় বাঁকা হাসি টানলেন। বললেন,

“ওর কানে কানে গিয়ে বলবি ওস্তাদজী আপনাকে স্বরন করেছেন। ব্যস তাতেই ও ছুটে আসবে। যা।”

“আজ্ঞে ওস্তাদজী।”

________

রাজকন্যা নিজের কক্ষে ক্রমাগত পায়চারি করে চলেছে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে নাজিমউদ্দীনের আগমনের অপেক্ষায়। নাজিমউদ্দীন এই প্রাসাদে ফিরে আসলেই তার অনেক অজানা প্রশ্নের জট খুলে যাবে। সেটারই অপেক্ষা কেবল।

“রাজকন্যে,এতো হতাশ হয়ো নাকো। নাজিমউদ্দীন ঠিক আসবেন।”

“জিন্নাত আমার ভয় হচ্ছে। যদি নাজিমউদ্দীন না আসেন?”

“আসবে রাজকন্যে। কেননা,তোমার টোপ উনারা গিলে নিয়েছেন। আর তাছাড়া তোমার ভাবনা যদি সঠিক হয় তাহলে নাজিমউদ্দীনকে আসতেই হবে।”

রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পায়চারি করা বন্ধ করে স্বস্তির দাঁড়াল। ভাবুক কন্ঠে বলল,

“ফুপুআম্মা কোথায় গো?”

“নিজের কক্ষেই হবেন।”

“দাসী? দাসী?”

“আজ্ঞে রাজকন্যা!”

“ফুপুআম্মাকে তৈরি করে দাও। এক্ষনি।”

“আজ্ঞে।”

রাজকন্যা উত্তেজনা পূর্বক হেসে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবারও ডাকলো প্রহরীদের।

“প্রহরী?”

“আজ্ঞে রাজকন্যা!”

“আয়াসকে এবং রেদোয়ানকে নিয়ে এসো ফুপুআম্মার কক্ষে।”

“যথাআজ্ঞা।”

“আসতে পারি?”

প্রহরী বেরিয়ে যেতেই ভেসে এলো কারোর গলা। রাজকন্যা নিজের প্রফুল্লতা চেপে পেছন মুড়ে তাকালো। ততক্ষণে অদৃশ্য হয়েছে জিন্নাত। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার সাদ্দাত। তাকে দেখতেই রাজকন্যার হাসিখুশি মুখখানা চুপসে গেলো।

“রাজকুমার! আসুন?”

রাজকুমার অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

“কবিরাজ মশাই বললেন আপনার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে। চিন্তার আর কোনো কারন নেই।”

“আজ্ঞে। আগের চেয়ে বেশ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?”

রাজকন্যা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,

“জী ভালো আছি। বসুন না দয়াকরে।”

রাজকুমার বসতে বসতে চারপাশে একবার দৃষ্টি বুলালো। অতঃপর কি ভেবে বলে উঠলো,

“ও কি আপনাকে ছুঁয়েছে রাজকন্যা?”

রাজকন্যার ভ্রু কুঞ্চিত হলো।

“ও মানে! কে? কে আমাকে ছোঁবে?”

“আয়াস!”

রাজকন্যার কপালের ভাজ অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবার তাকে একগাদা বিরক্তি আর অস্বস্তি চেপে বসলো। গলা কঠিন করে বলল,

“এর মানে কি রাজকুমার? আপনি এসব কি প্রশ্ন করছেন আমায়?”

রাজকুমার একটু ভড়কে গেলো। আমতাআমতা করে বলল,

“ন্ না আসলে, আমার কথার মানে অন্যকিছু রাজকন্যা। আপনি ভুল বুঝবেন না।”

“অন্যকিছু? কি সেটা?”

“ওরা আসলে মানুষ হিসেবে খুবই জঘন্য হয় রাজকন্যা। ওদের উদ্দেশ্য থাকে নারীদেহ্। আর আপনি যেমন ভয়ংকর সুন্দর তেমন..”

“সে মানুষ হিসেবে যেমনই হোক না কেন প্রথমত সে আমার স্বামী..”

রাজকন্যা প্রতিবাদী কন্ঠে জবাব দিতেই তাকে থামিয়ে দিলো রাজকুমার। বলে উঠলো,

“থাকবে না! হু। আর থাকবে না। আমি আপনাদের আলাদা হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো রাজকন্যা।”

রাজকন্যা ধপ করে জ্বলে উঠলো। কিন্তু তাতে বিশেষ ভাবান্তর হলো না রাজকুমারের। সে নিজের মতো করে হাসলো। বলল,

“ছোটবেলা থেকে নিজের প্রত্যেকটা জিনিসে অন্যকাউকে ভাগ বসাতে দেখেছি। নিজের অধিকারেও আব্বাজান ভাগ বসিয়ে দিয়েছেন তার বড় সন্তান যদি আজ বেঁচে থাকতো তাহলে এটা তার হতো এই বলে। সব মুখ বুঁজে মেনে এসেছি। কিন্তু আর নয়। যে জিনিসটা আমার সেটা কেবলই আমারই রাজকন্যা। আমি তাতে আমি কারোর ভাগ বসাতে দেবোনা।”

“আমি কোনো পন্য নই রাজকুমার। যে যার যখন ইচ্ছে হলো সে আমায় নিয়ে গেলো। আমার বিবাহ হয়ে গিয়েছে। আর এই অবস্থায় আপনি এসব নিয়ে না ভাবলেই আমি খুশি হবো।”

“না রাজকন্যা। আপনি আমার। আর আপনাকে আমি নিজের করেই ছাড়ব! যে-কোনো মূল্যে।”

“রাজকুমার..”

—“রাজকন্যা, নাজিমউদ্দীন এসেছেন!”

কক্ষের বাইরে থেকে ভেসে এলো এক প্রহরীর গলা। রাজকন্যা থেমে গেলো। রাজকুমারের নামটা উচ্চারণ করতে নিয়েও আর কিছু বলতে পারলো না। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

“এই কক্ষে তোমার সঙ্গে আমার রঙ্গিন দুনিয়া সাজাতে কেউ আটকাতে পারবেনা রাজকন্যা। তোমাকে তো আমার হতেই হবে। আমি একটা ডাকাতের সামনে কিছুতেই হার মানবোনা। অসম্ভব!”

_____

নাজিমউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে রাজসভায়। উপস্থিত মহলে তিনি আর কয়েকজন প্রহরী ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি চোখ বুলিয়ে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। তার সম্মুখেই বিশাল সিংহাসন। তার স্বপ্নের সিংহাসন। একদিন ঐ সিংহাসনে তার রাজ চলবে। এই গোটা সাম্রাজ্যে কেবলই তার রাজ চলবে। সবাই তাকে রাজার মতো সম্মান করবে। তার আদেশ পালনে সর্বদা নিয়োজিত থাকবে শতশত প্রহরী।

“ধ্যান করছেন বুঝি?”

নাটকীয় সুরে বলে উঠলো রাজকন্যা। নাজিমউদ্দীন আকস্মিক চমকে উঠলো। সম্মুখে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো তার স্বপ্নের সিংহাসন আগলে বসে আছে রাজকন্যা হূরিয়া। মুখে বিসদৃশ হাসি।

“দ্বী-প্রহরের স্বপ্নকে কি বলে জানেন? দিবাস্বপ্ন! যা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়।”

নাজিমউদ্দীন ধাতস্থ করলেন নিজেকে। রাজকন্যা হূরিয়ার অনেক গল্প তিনি শুনেছেন। আজ সামনাসামনি দেখে সত্যি বড় অবাক না হয়ে পারছেন না। এই টুকুনি পুঁচকে মেয়ের কথা বলার ধরণই যেন ভিন্ম। এমন কথায় যেকোনো মানুষই ভড়কাবো। ভয় পাবে। চিন্তায় পড়বে। তারও তেমনই হচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ভয়ও করছে কিঞ্চিৎ।

নাজিমউদ্দীনকে নিশ্চুপ দেখে ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসির রেখা টানলো রাজকন্যা। আকস্মিক দাঁড়িয়ে পড়ে বজ্রকন্ঠে হুকুম দিলো,

“কে কোথায় আছো? বন্দী করো নাজিমউদ্দীনকে।”

রাজকন্যার বজ্রকন্ঠ কানে আসতেই হকচকিয়ে তাকালো নাজিমউদ্দীন। মুখ খুললো কিছু বলবে বলে তার পূর্বেই বন্দী হলো। রাজকন্যা রাজকীয় ভঙ্গিতে নেমে এলো সিংহাসন থেকে। ছটফট করা নাজিমউদ্দীনের নিকটে এসে পূর্বের ন্যায় হাসলো। অতঃপর আস্তে করে বলল,

“স্বাগতম আপনাকে,আমার রাজ্যে। নিয়ে চলো উনাকে।”

বলেই হাঁটা ধরলো রাজকন্যা। রাজকন্যাকে অনুসরণ করে চারজন প্রহরী নাজিমউদ্দীনকে নিয়ে এগোলো তার পেছন পেছন। রাজকন্যা হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো ফুপুআম্মার কক্ষের সামনে। বেগমজির কক্ষ চেনে নাজিমউদ্দীন। ভুলেনি কিছুই। আচমকা বেগমজির কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে থমকে গেলো সে। অকস্মাৎ তার মনে পড়লো পুরণো সব অতীত। -‘এক যে ছিলো সোনার কন্যা,মেঘ বরন কেশ;’

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া❤️🌸
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৮;

ফুপুআম্মা বেহুঁশ হয়ে গেছেন নাজিমউদ্দীনকে দেখে। হওয়ারই কথা। গত পঁচিশটা বর্ষ অব্দি যাকে মৃত বলে জেনে এসেছেন আজ হঠাৎ সেই মানুষ টাকে চোখের সামনে জীবিত দেখলে যে কেউই জ্ঞান হারাবেন। ফুপুআম্মার ব্যাপারেও বিকল্প ভাবতে পারেনি রাজকন্যা। প্রায় অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে ফুপুআম্মা বেহুঁশ। আয়াস,রাজকন্যা এবং রেদোয়ান তিনজনেই কাঠপুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে এক কোনে। যেন তাদের হাত পা অচল। তারা অন্যের দ্বারা চলাচল করতে পারে। অন্যথায় নয়।

এদিকে নাজিমউদ্দীন সেই তখন থেকেই পাগলের মতো করছেন ফুপুআম্মার হুঁশ ফেরানোর তাগাদায়। এই মুহুর্তে এই মানুষটাকে দেখলে কেউ বলতে পারবেনা এক কালে কতটা নির্দয়,নিষ্ঠুর ছিলেন। কতটা অত্যাচার করে ফুপুআম্মার জীবনটা নরকে পরিনত করে দিয়েছেন! আচ্ছা এমনটাও তো হতে পারে তিনি তখন কারোর ইশারার কাঠ পুতুল ছিলেন! কারোর ইশারায়, কারোর প্ররোচনায় তিনি ফুপুআম্মাকে নির্দয়ের মতো প্র’হার করেছেন,অ’ত্যা’চার। হতেই পারে! কিন্তু কার প্ররোচনায়-

“বেগম! বেগম চোখে খোলো? কি হলো তোমার? বেগম!”

নাজিমউদ্দীনের তৃষ্ণার্ত গলাটা ভেসে আসতেই রাজকন্যার ভাবনার ঘোর কেটে যায়। সে আর ভাবতে পারেনা। স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকায়। ফুপুআম্মা অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন শয্যায়। নাজিমউদ্দীন তার মাথার কাছে। হাতের কৌটোতে জল নিয়ে বসে আছেন। কতক্ষন পরপরই জলের ছিটে দিচ্ছেন ফুপুআম্মার মুখে। কক্ষে তারা চারজন ব্যতীত আর কেউ। নাজিমউদ্দীন কে বন্দী করে আনা প্রহরীরা এবং কক্ষের বাইরে পাহারারত প্রহরীরা সবাইকেই বিদায় করেছে রাজকন্যা। কেননা, সে চায়না এই কক্ষের কোনো কথাই যেন চার দেয়ালের ওপাশে যায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ডাকতে হবে। কবিরাজ মশাইকে একবার খবর দিতেই হবে।

ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। একবার কক্ষের দরজার দিকে তাকালো। দু’জন দাসী দাঁড়িয়ে আছে। রাজকন্যা তৈরি হলো তাদের ডাকবে কিন্তু এমন মুহূর্তে আয়াস তাকে আটকালো।

“কবিরাজ মশাইকে ডাকার প্রয়োজন নেই রাজকন্যা। আমার মনে হয় তাদের দু’জনকে আরও কিছুক্ষন এমন একাই রাখা উচিৎ। বেগমজির হুঁশ যদি ফেরে তবে নাজিমউদ্দীনের ডাকেই ফিরবে। আমি নিশ্চিত।”

রাজকন্যা আয়াসের বারন শোনে। ঠোঁটের কোনে ছোট্ট করে হাসির রেখা টেনে নিজের জায়গায় নিশ্চুপ দাঁড়ায়। ক্ষনকাল পেরোতে আয়াসের বানী ফলে যায়। ফুপুআম্মা যেমন আকস্মিক জ্ঞান হারিয়েছেন ঠিক তেমনই আকস্মিক সজ্ঞান ফিরেছেন। চোখ মেলে কয়েক মুহূর্ত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন নাজিমউদ্দীনের পানে। তবে সেটাও দীর্ঘব্যাপী হলো না।আচমকা আতংকে ছিটকে পড়লেন খানিকটা দূরে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠছেন বারেবারে। তার এমন করে ছিটকে পড়াতে চমকে উঠলেন নাজিমউদ্দীনও। ভড়কানো দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি।

ফুপুআম্মা হঠাৎ চেঁচালেন।

“আ- আ- আপনি! আপনি! আপনি?”

‘আপনি’ ব্যতীত ফুপুআম্মার গলার আওয়াজ শোনা গেলো না। রাজকন্যা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ফুপুআম্মার নিকটে।

“ফুপুআম্মা.. ফুপুআম্মা শান্ত হোন। উনি আপনার স্বামী। নাজিমউদ্দীন। উনাকে চিনতে পারছেন না আপনি?”

রাজকন্যার স্পর্শ আর গলার আওয়াজ পেতেই তাকে ঝাপটে ধরে ফুপুআম্মা। মনে হচ্ছে তিনি প্রচন্ড ভয় পাচ্ছেন। দরদর করে ঘামছেনও।

“ন- ন- নাজিমউদ্দীন! না- নাজিমউদ্দীন!”

ফুপুআম্মা আবারও একাধারে নাম জপ করলো নাজিমউদ্দীনের। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। মনে হচ্ছে আবারও অচেতন হবেন। রাজকন্যা আয়াসের দিকে তাকালো। বিহ্বল কন্ঠে বলল,

“ফুপুআম্মাকে জল দিন দয়াকরে।”

আয়াস কেমন ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো ফুপুআম্মার পানে। রাজকন্যার গলা পেয়ে তার ঘোর কাটলো। দ্রুত এগিয়ে গেলো জল দিতে। রেদোয়ানও এলো তার পিছুপিছু।

“বেগম! আমি তোমার স্বামী। আমাকে দেখে ভয় পেয়ো না। আমি নাজিম।”

ফুপুআম্মা শান্ত হলো না। বরং আরও ছটফট করতে লাগলো। আয়াস জল নিয়ে ছুট্টে এলো রাজকন্যার কাছে। রাজকন্যা তড়িঘড়ি করে জলটা খাইয়ে দিলো ফুপুআম্মাকে। খালি পাত্রটা আয়াসের হাতে তুলে দিতে দিতে করুন দৃষ্টিতে তাকালো রাজকন্যা। আয়াস রাজকন্যার অসহায় ঘেরা মুখটা দেখে তার দৃষ্টিখানা শান্ত করে নিলো। যার দরুন রাজকন্যাও কিছুটা প্রশান্তি অনুভব করলো। আয়াস চোখের পলক ঝাপটে বলল,

“সবটা ভালো হবে।”

রাজকন্যা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপরনিচ মাথা নাড়লো। অতঃপর ফুপুআম্মার সম্মুখে বসলো। ফুপুআম্মা ভয়ে কাঁপছেন। তার দৃষ্টি নীচের দিকে স্থির হয়ে আছে। যেন উপরের দিকে তাকালেই ভয়ংকর কিছু দর্শন হয়ে যেতে পারে।

“ফুপুআম্মা। ও ফুপুআম্মা। একবার দেখবেন না আমায়? আমি আপনার স্নেহের রাজকন্যা। দেখুন একবার আমায়? আমি ডাকছি তো আপনাকে।”

ফুপুআম্মা চোখ পিটপিট করে একবার তাকায় রাজকন্যার পানে। ফের দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। রাজকন্যা আবারও ডাকে।

“ফুপুআম্মা? দেখুন আমি কাকে নিয়ে এসেছি।”

ফুপুআম্মা চমকে ওঠে। ভয়ে আরও গুটিয়ে যায়। কিছু বলতে পারেনা।

“ফুপুআম্মা.. নাজিমউদ্দীন জীবিতই ছিলেন। উনার কোনোদিনই কিছু হয়নি। সত্যি বলছি। উনি একদম সুস্থ ছিলেন, স্বাভাবিক ছিলেন। উনার মৃত্যু সংবাদটা মিথ্যে ছিলো। কেউ ইচ্ছে করে উনার মৃত্যু সংবাদটা রটিয়েছে এই রাজ্যে। উনি মারা যাননি।”

ফুপুআম্মা সবটাই শুনছেন। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করছেন না। তিনি একটু একটু শান্ত হচ্ছেন। তা দেখে রাজকন্যা আবারও বলতে আরম্ভ করে,

“হ্যাঁ ফুপুআম্মা। আপনার স্বামী একদম ঠিকাছেন। উনি একদম সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। আর দেখুন না, এতো বর্ষ বাদে আজ উনি নিজে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আপনার খোঁজ নিতে এসেছেন। আপনি কেমন আছেন তাকে ছাড়া উনি জানতে চান ফুপুআম্মা। উনাকে কি একবার বলবেন আপনি উনাকে ছাড়া একদম ভালো নেই? আপনি উনাকে ছাড়া ভীষণ একা! আপনি উনাকে ছাড়া একদম নিঃশ্ব! একবার কি বলতে চান উনাকে ফুপুআম্মা?”

ফুপুআম্মা ব্যতীত বাকি তিনজনের দৃষ্টিতেই নেমে এলো এক আকাশসম বিস্ময়! কি বলছে রাজকন্যা? বেগমজি নাজিমউদ্দীনকে ছাড়া ভালো নেই? নাজিমউদ্দীন যেন হোঁচট খেলেন রাজকন্যার কথা গুলোয়! এটা কেমন করে সম্ভব? তিনি যা অ’বিচার করেছেন বেগমজির প্রতি.. তাতে করে সারাজীবন ধরে কেবল অ’ভিশাপই দেওয়ার কথা ছিলো তাকে। কিন্তু না। বেগমজি তাকে অভিশাপ দেওয়া তো দূর বরং আরও বেশি ভালোবেসেছেন তাকে! এও কি বিশ্বাসযোগ্য?

“এ আপনি কি বলছেন রাজকন্যা?”

আয়াস বিস্মিত কন্ঠে শুধালো। রাজকন্যা তার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো,

“হ্যাঁ। আমি ঠিক বলছি।”

বলতে বলতে রাজকন্যা নাজিমউদ্দীনের দিকে তাকালো। নাজিমউদ্দীন তাকিয়েই ছিলো রাজকন্যার দিকে। এ কথা শুনে তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তার কান্নার শব্দে চমকে উঠলো উপস্থিত সকলে। এমনকি বেগমজিও। বেগমজি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো নাজিমউদ্দীনের পানে। তার চোখে ভাসতে থাকা জল দেখে তার কি হলো সে নিজেও জানেনা। ছুট্টে গেলো তার সম্মুখে।

“ক- ক- কি হলো! ক- কি হলো? আ-আপনি কাঁদছেন কেন? ক-কি হলো?”

ফুপুআম্মার এহেম কান্ড দেখে অবাক না হয়ে পারলোনা বাকিরা। আয়াস এবার বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো কতটা ভালোবাসেন বেগমজি নাজিমউদ্দীনকে।

রাজকন্যা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আয়াসের সম্মুখে গিয়ে ফুপুআম্মা এবং নাজিমউদ্দীনকে ইশারা করে বলল,

“এখন বলুন? আপনার কি মনে হয় এই মানুষটা কোনোদিন তার স্বামীকে নিজের থেকে আলাদা করতে পারে? কোনোদিন নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে?”

আয়াস নিজের অজান্তেই বলে উঠলো,

“অসম্ভব!”

“হু অসম্ভব তো বটেই। কিন্তু আপনি যে সত্যিটা জেনেছেন সেই সত্যিটারও তো নিবারণ করতে হবে। তাই না?”

“মানে?”

“অপেক্ষা করুন।”

বলে রাজকন্যা স্থীর দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে ফুপুআম্মাও কাঁদছেন। নাজিমউদ্দীন কাঁদতে কাঁদতে হাত জোর করে মাফ চাইছেন ফুপুআম্মার কাছে। এসব দেখে শান্তি লাগছে রাজকন্যার। তবে এবার রহস্য খোলার পালা।

“ফুপুআম্মা?”

ডাকলো রাজকন্যা। ফুপুআম্মা পেছন মুড়ে তাকালেন।

“আপনার কি মনে আছে সেই ক্ষনের কথা, যে ক্ষনে আপনি আপনার সদ্যোজাত পুত্রের কান্নার আওয়াজ শুনেছিলেন?”

ফুপুআম্মা স্তবির হয়ে গেলেন। তার একটু একটু করে মনে পড়তে লাগলো সেই কাল রাতের কথা। এক নিমিষে ভয়ার্ত উঠলো তার দৃষ্টি। একরাশ অসহায়ত্বতা এসে ভর করলো তার মন পুকুরে। আবারও কেঁদে উঠলেন তিনি। নাজিমউদ্দীনের পানে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন,

“আমি পারিনি আমাদের সন্তানকে বাঁচাতে! আপনি চলে যাবার পরপর সেও আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।”

“ম- মানে! বাঁচাতে পারোনি মানে! সে তো বেঁচে আছে৷ আর আমার সঙ্গেই আছে।”

নাজিমউদ্দীনের গলায় এমন কথা শুনে স্তব্দ হয়ে গেলো ফুপুআম্মা। তার কান্না থেমে গেলো। বোবা চোখে তাকিয়ে রইলো নাজিমুদ্দিনের পানে। যেন এমন অবাক বিস্ময় বাণী তিনি ইতিপূর্বে কোনোদিন শোনেন নি।

“ব- ব- বেঁচে আছে! আ- আ- আমার পুত্র বেঁচে আছে?”

“হ্যাঁ বেঁচে আছে সে। তাকে তুমি মৃত কেন বলছো বেগম? তুমিই তো তাকে জন্মের পরে এই রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেছো। কেননা সে আমার পুত্র ছিলো বলে।”

“কি বলছেন? কি বলছেন আপনি এসব?”

“এটা কি সত্যি নয়?”

“না না না। এ- এটা সত্যি নয়। আমার পুত্রকে আমি কেন বহিষ্কার করবো? আমি যে হতভাগিনী মা! জন্মের পর তার মুখখানাও দেখতে পারিনি। একটা মৃত্যু সন্তানের মুখ দেখেছিলাম আমি!”

নাজিমউদ্দীন অবাক হন।

“এটা কি করে সম্ভব? মিত্র তো বলেছিলো তুমি আমার চলে যাওয়ার পর নিজের সন্তানকেও বহিষ্কার করেছো। এবং সে আমাদের পুত্রের প্রায় ৪ বর্ষ অব্দি দেখভাল করে। যখন তার বয়স ৪ বর্ষ তখনই সে আমার কাছে তাকে ফিরিয়ে দেয়।”

“মিত্র?”

“মিত্র?”

রাজকন্যা এবং ফুপুআম্মা একত্রেই নামটি উচ্চারণ করে। নাজিমউদ্দীন জবাব দেয়,

“হ্যাঁ আমার মিত্র। মানে আয়াসের আব্বাজান। আয়াস এবং আমাদের পুত্র মেরাজ একই ক্ষনে জন্মায়। মেরাজকে তুমি এই রাজ্য থেকে বিতাড়িত করলে ওকে নিয়ে যায় মিত্র। আয়াস এবং মেরাজকে একত্রেই দেখভাল করতে আরম্ভ করে। আমি সেই ৪বর্ষ এই রাজ্য এবং আমাদের কুঠুরি ছেড়ে ভিন্ন দেশে চলে যাই। কেননা তখন সিরাজ আমাকে বন্দী করিবার জন্য শতশত প্রহরী নিয়োজিত করে। আমার চলে যওয়ার পেছনে অবশ্য মিত্ররই সহযোগিতা বেশি ছিল। আমার জীবনের নিশ্চয়তা দিতেই সে আমাকে ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়। আমিও চলে যাই। এমনকি আমি এটাও জানতাম না বেগম এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে।”

“আপনার কখনও জানতে ইচ্ছে হয়নি কেন ফুপুআম্মা আপনাদের পুত্রকে এই রাজ্য থেকে বিতাড়িত করলো? শতহোক সে তো একজন মা! কোনো মা’ই কি পারে তার সন্তানকে নিজের থেকে আলাদা করতে?”

রাজকন্যা শুধালো। তার কন্ঠে আকুলতা। নাজিমউদ্দীন মুখ উঁচিয়ে তাকায় রাজকন্যার পানে। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

“জানতে চেয়েছি বৈ কি! অবশ্যই চেয়েছিলাম। চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু ওমন একটা মুহুর্তে বেগমের সামনে আসাটা প্রায় দুঃসাধ্য ছিলো। আর মিত্রের মুখে সবটা শুনে মেনেও নিয়েছিলাম। কেননা, মিত্র যখন নিজে বলেছে তখন মিথ্যে নিশ্চিয়ই বলবেনা।”

“আ- আ- আমার পুত্র কোথায়? কোথায় সে? তাকে নিয়ে এলেন না কেন? কোথায় আমার পুত্র?”

ফুপুআম্মা অস্থির হয়ে উঠলেন। উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন তার পুত্রের কথা। রাজকন্যা পাশ ফিরে একবার আয়াসের দিকে তাকালো। আয়াসও তাকালো রাজকন্যার পানে। ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দৃষ্টি মাটিতে বিদ্ধ করলো আয়াস। অপরাধী গলায় বলল,

“ক্ষমা করবেন ফুপুআম্মা! মেরাজ এখন ঠিক নেই। ওর চিকিৎসা চলছে!”

আঁতকে উঠলেন ফুপুআম্মা!

“ক- ক- কি বলছো? কেন! কি হয়েছে আমার পুত্রের!”

“ফুপুআম্মা আমি বলছি।” বলল রাজকন্যা।

ফুপুআম্মা তাকালো রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা স্মিত হাসলো। একবার আয়াসের দিকে তাকিয়ে ফের নাজিমউদ্দীনের দিকে তাকালো। কিছু না বলে এগিয়ে গেলো ফুপুআম্মা শয্যার পাশে। নীচের দিকে ঝুঁকে ছোট্ট একটা বাক্স তুললো। বাক্সটা উঠিয়ে ফুপুআম্মার সামনে রাখলো। বলল,

“ফুপুআম্মা, এর মাঝে নাজিমউদ্দীনের যুবক কালের একখানা চিত্র আছে। দয়াকরে বের করবেন?”

ফুপুআম্মা তুমুল গতিতে মাথা নেড়ে চটজলদি বাক্সটা খুলল। বাক্যটা খুলতেই দৃশ্যমান হয় নাজিমউদ্দীনের যুবক কালের একখানা চিত্র। কিন্তু সেটা দেখতে মোটেও পুরনো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আজই এই চিত্র আকা হয়েছে।

ফুপুআম্মা চিত্রখানা বের করে নাজিমউদ্দীনকে দেখালেন। নাজিমউদ্দীন যেন অবাক বনে গেলেন। বিস্মিত নয়নে তিনি আয়াসের পানে একবার তাকালেন। আয়াস উদগ্রীব নয়নে তাকিয়ে ছিলো। নাজিমউদ্দীন তাকাতেই সে প্রস্তুত হলো কিছু বলবে বলে। তবে তার পূর্বেই বলে উঠলো রাজকন্যা,

“মেরাজ আপনার এবং ফুপুআম্মার পুত্র নয় নাজিমউদ্দীন। আপনাদের একমাত্র পুত্র হলো আয়াস।”

রাজকন্যার এহেম বাণীতে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো পুরো কক্ষ। সবাই আকস্মিক যেন হোঁচট খেয়ে পড়লো। এক বিশাল আকাশ সমগ্র বিস্ময় নিয়ে হা সূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সবাই!

“এটা কি ধরণের ঠাট্টা করছেন, রাজকন্যা?

ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো আয়াস।

“আমি কোনো ঠাট্টা করছি না, রাজকুমার আয়াস!”

আয়াসের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তস্রোতে বয়ে গেলো! অদ্ভুত তাড়না মিশ্রিত দম বন্ধ করা এক অনুভূতি হলো। রাজকন্যা এসব কি ধরনের ঠাট্টা করছে তার সঙ্গে! এসব নিয়েও কি কেউ ঠাট্টা করে?

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৯;

“এ-এটা অসম্ভব!”

আয়াসের গলা কাঁপে! বক্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক যন্ত্রণাময় বিষাদ।

“এটাই বাস্তব আর এটাই সত্যি, রাজকুমার।”

“না!(কঠিন গলায়) আ- আমি কোনো রাজকুমার নই। আমায় ঐ নামে ডাকবেন না দয়াকরে!”

দম নিতে কষ্ট হয় আয়াসের। সে মানতে পারছেনা সে কোনো রাজকুমার হতে পারে! কেননা তার প্রিয় আব্বাজান, তার চোখের মনি তাকে এত বড় ধোঁকা দিতেই পারেনা। এ অসম্ভব!

রাজকন্যা এক দৃষ্টে চেয়েই রইলো আয়াসের মুখবিবরে। অস্থিরতায় কেমন হাসফাস করছে মানুষটা! বাস্তবতা বড়ই কঠিন! আর এর চেয়েও কঠিন বাস্তবতার মোকাবিলা তাকে আজ করতে হবে। করতেই হবে।

“এ- এ- এসব তুমি কি বলছো, আম্মাজান!”

ফুপুআম্মার কাতর কন্ঠ ভেসে আসে। রাজকন্যার টনক নড়ে। আয়াসের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফুপুআম্মার দিকে তাকাতেই দৃশ্যমান হয় ফুপুআম্মার অশ্রুসিক্ত নয়ন। রাজকন্যা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

“হ্যাঁ ফুপুআম্মা। আমি সত্যি বলছি। আপনি কি একবার ঐ চিত্রখানা এই মুখটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন?”

ফুপুআম্মার কোনো জবাব আসেনা। তিনি তার কম্পিত হস্তে নাজিমউদ্দীনের হাত থেকে কেড়ে নিলেন আয়াসের চিত্র খানা। অতঃপর রাজকন্যার কথা মতোই গভীর দৃষ্টি মেলে মিলালো। -হ্যাঁ, হুবহু সেই চেহারা। যেন এ আরেক নাজিমউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে! সেই চোখ,সেই মুখ,সেই হাসি!”

ফুপুআম্মার ভেতর থেকে হাঁকডাক পেড়ে জানান দেয় কথাগুলো। ফুপুআম্মা মুখে আঁচল চাপলেন কান্নার বেগ চাপতে। এপাশ থেকে রাজকন্যা আবারও বলে ওঠে,

“ঐ চিত্র খানা নাজিমউদ্দীনের নয় ফুপুআম্মা। ঐ চিত্র আপনার এবং নাজিমউদ্দীনের এক মাত্র পুত্র রাজকুমার আয়াসের। চিত্রকার আজই আমায় এই চিত্র তৈরী করে দিয়েছেন।”

হুহু করে কেঁদে ওঠেন ফুপুআম্মা। তার কান্নার শব্দ ভেবে আসতেই হা করে আঁটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দেয় আয়াস। ঢোক গেলে। তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে! তার আব্বাজান তাকে মিথ্যে বলতে পারেনা! কোনোদিনও পারেনা।

রেদোয়ান এগিয়ে এসে আয়াসের পাশে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে বলে,

“সরদার! আপনি রাজকুমার হলে অসুবিধাই বা কি? আপনি কি রাজকুমার হতে পারেন না?”

“রেদোয়ান তুমিও! তুমিও একথা বলবে? আর কেউ না জানলেও তুমি তো জানো আমি আমার আব্বাজানকে ঠিক কতটা বিশ্বাস করি। কতটা ভালোবাসি! আ- আমার আব্বাজান আমার সঙ্গে এতো বড় প্রতারনা করতে পারেন না!”

“আর যদি পারেন সরদার?”

“রেদোয়ান!”(রাগান্বিত স্বরে)

“হ্যাঁ সরদার! এ কথা আপনিও খুব ভালো করে জানেন যে ওস্তাদজী কতটা স্বার্থপর মানুষ! নিজের স্বার্থের জন্য আপনাকে দিয়ে কি না করিয়েছে!”

“কিন্তু রেদোয়ান.. তাই বলে বলে মিত্র আমাকে তো ধোঁকা দিতে পারেনা! আমি তার বাল্যকালের মিত্র! আমাদের শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ একই সঙ্গে! সে আমায় অনন্ত ধোঁকা দিতে পারেনা!”

দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠেন নাজিমউদ্দীন। রাজকন্যা আকস্মিক হেসে ওঠে। তার হাসি দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় সকলে। তখনও রাজকন্যার ঠোঁটের কোনে লেগে থাকে তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসি। রাজকন্যা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বুলি আওড়ায়,

“বিশ্বাস! ভরসা! ভালোবাসা! এই প্রত্যেকটা শব্দের ব্যবহার যদি আপনারা যথার্থ করতে পারতেন তবে সত্যিই আমার কোনো আক্ষেপ থাকতো না রাজকুমার। কিন্তু না, আপনারা দু’জনেই এই একই ভুল করে এসেছেন গত পঁচিশ বর্ষ অব্দি। একজন মানুষের উপর অন্ধবিশ্বাস, অন্ধভরসা এবং অন্ধ ভালোবেসে! (নাজিমউদ্দীনের দিকে তাকিয়ে) কেবল পঁচিশ বর্ষই নয়! না জানি আরও কত যুগ!”

নাজিমউদ্দীন ক্ষনকালের জন্য থমকালেন! স্থবির চিত্তে ডুব দিলেন অতীতের পাতায়। তার নিজের ভ্রাতা সমান মিত্র তাকে ঠিকিয়েছে? যে মিত্রকে এই গোটা জীবনটাই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, ভালোবেসে এসেছে সেই মিত্রই তাকে সবচেয়ে বড় ধোঁকা দিয়েছে? প্রতারণা করেছে নিজেরই পুত্রকে বদলে! হে রব!

“আয়াস যদি আমার পুত্র হয় তবে রুবা এবং মিত্রের পুত্র কে? মেরাজ? যদি মেরাজ ওদের পুত্র হয় তবে কেন সে এই অদলবদল ঘটালো? এর পেছনে মিত্রের উদ্দেশ্য কি?”

নাজিমউদ্দীন উদগ্রীব কন্ঠে জানতে চাইলেন। রাজকন্যার ওষ্ঠদ্বয়ের তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসি এবার অদৃশ্য হলো। মলিন হলো মুখবিবর। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলো,

“কি আবার? এই সাম্রাজ্য!”

“ন- না না! মিত্র এই রাজ্য দখল করতে চেয়েছিলো কেবল আমার জন্য! যেন এই সিংহাসনে আমার রাজ চলে! এই গোটা সাম্রাজ্য যেন আমার হয়। মিত্র এই সমস্ত কিছু কেবল আমার জন্য করেছে।”

“তাই? তবে আপনি এখানে আসার পূর্বে আপনার মিত্রর কাছে কেন জানতে চাননি রাজকুমার আয়াসের মুক্তির বদলে আপনাকে বন্দী করে কেন পাঠাচ্ছে? সে নিজের পুত্রকে মুক্ত করতে নিজেই কেন বন্দী হলো না? কেন নিজের পুত্রকে মুক্ত করতে গোটা ডাকাতের দলটা নিয়ে এলো না এই ভেবে যে, যুদ্ধ করে হলেও পাতালঘরের ঐ কারাগার থেকে মুক্ত করবে নিজের পুত্রকে। কেন করলো না? জবাব আছে কোনো?”

নাজিমউদ্দীন যেন হোঁচট খেয়ে পড়লেন! তার ললাটে ফুটে উঠলো দুশ্চিন্তার অগুনিত ছাপ। আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বললেন,

“ঐ পত্রে তুমি আমাকে বন্দী করে পাঠাতে বলেছিলে?”

“জি। আপনাকে বন্দী করার কথা আমি গোটাগোটা অক্ষরে লিখে পাঠিয়েছি। কেন? আপনার মিত্র আপনাকে পড়ে শোনাননি?”

নাজিমউদ্দীন আহত নয়নে তাকালেন আয়াসের পানে। বললেন,

“সে বলেছে ঐ পত্রে তুমি তোমার আব্বাজানের মুক্তি দাবী করেছো। যদি আমরা সিরাজকে মুক্ত করে দেই তাহলেই আয়াস মুক্তি পাবে! যা এই মুহুর্তে অসম্ভব ছিলো। এই রাজসিংহাসনে বসিবার একমাত্র হাতিয়ার হলো বন্দী রাজা সিরাজ উদ্দীন! তাকে মুক্ত করলে আমরা সবই খোয়াবো! এই বলে আমি নিজেই চলে আসি এখানে! আয়াসকে মুক্ত করতে!”

“এখানেও আপনি ঠকে গেলেন নাজিমউদ্দীন। নিজের বিশ্বাসঘাতক মিত্রের কাছে।”

বলতে বলতে পাশ ফিরে তাকালো আয়াসের অসহায় মুখটার দিকে। এতকিছু শুনে আয়াস এখনও স্থীর দাঁড়িয়ে আছে সেটাই যেন অনেক কিছু। রাজকন্যা তাকাতে আয়াসও মুখ তুলে তাকালো। তার অক্ষিকাচ গলিয়ে টসটসে দু’ফোটা জল গড়াতেই হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিলো সেই জল। রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আয়াসের দিকে স্থীর দৃষ্টি রেখেই পূণরায় বলতে আরম্ভ করলো,

“মেরাজ ওস্তাদজীর এবং রুবার অবৈধ সন্তান। ওস্তাদজী পুত্রের পিতা তো হয়েছিলেন বটে তবে কোনো কালেই তার মতো একজন পাপিষ্ঠ ব্যাক্তি বিয়ের মতো এমন একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি।”

“কিন্তু সে তো আমাকে জানিয়েছিল সে রুবাকে বিবাহ করেছে!”

বলে ওঠেন নাজিমউদ্দীন। রাজকন্যা না সূচক মাথা নাড়ে।

“না। সে কোনোদিনই এই পূন্য করেননি। রুবা আমাদের রাজ্যের কর্মরত এক দাসী ছিলেন। (আয়াসের দিকে তাকিয়ে) নাজিমউদ্দীন এবং ফুপুআম্মার বিবাহের পরে ওস্তাদজী প্রায়শই এই রাজ্যের গুপ্ত দরজা থেকে নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। আর তাদের সাক্ষাৎের নিখুঁত ব্যবস্থা করতেন রুবা। রুবাকে অবশ্য ঠিক করে দেন চাচাজান..”

“ছোট ভাইজন!”

ফুপুআম্মার আহত কন্ঠস্বরটা ভেসে আসে। রাজকন্যা মলিন মুখে তাকায় ফুপুআম্মার পানে।

“হ্যাঁ ফুপুআম্মা! চাচাজান করেছিলেন এই পাপ। অবশ্য তারও উদ্দেশ্য ছিলো এই সিংহাসনে রাজ করিবার। তবে রাজা সিরাজ উদ্দীন যতদিন এই সিংহাসনে থাকবেন ততদিন তো সে কোনো ভাবেই ঐ সিংহাসনে বসতে পারবেন না। তাই বাকিদের মতো তারও লক্ষ্য হয়ে ওঠে আব্বাজানকে আসনচ্যুত করার। আর তাই তিনি হাত মেলালেন ওস্তাদজীর সঙ্গে।

ওস্তাদজী ছিলো নারীলিপ্সুক এক পাপিষ্ঠ! রুবা ছিলো সুন্দরী রমণী। রুবাকে দেখতেই তার মাথা ঘুরে যায়। সে তার ভেতরের পশুটাকে ধরে রাখতে পারেনা। ধীরে ধীরে রুবাকে করে তোলে নিজের ভোগ্যসামগ্রী। তিনি এই প্রাসাদে যতবার এসেছেন ততবারই রুবার সঙ্গে তার একান্তে সময় কেটেছে এক বেলা। রুবা ভাবতো ওস্তাদজী তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে। আর বিয়েও করবে। কিন্তু সে তো জানতো না সে ওস্তাদজীর কেবল এক বেলার পৈশাচিক আনন্দের কারণ ছিলো মাত্র। আর কিছুই নয়।”

“হ্যাঁ মিত্র বরাবরই নারী পিপাসু ছিলো। কিন্তু রুবাকে সে সত্যি ভালোবেসেছিলো রাজকন্যা। আমার নিজের চোখে দেখা রুবাকে ভালোবাসার পর মিত্র আর কোনো নারীকে কু/নজরে দেখেনি!”

দৃঢ় কন্ঠে বলেন নাজিমউদ্দীন। আয়াস উৎসুক নয়নে তাকায় তার পানে। আব্বাজানের নামে খানিকটা হলেও ভালো কথা শুনে ভেতরটা কিঞ্চিৎ শান্তি লাগছে। তবে তা বেশিক্ষণ টিকলো না। অবশ্য টিকতে দিলোনা রাজকন্যা। তার শান্তিকে অশান্তিতে রূপান্তর করে বলে উঠলো,

“অসম্ভব! আপনি জানেন আপনারই প্রানপ্রিয় মিত্র আপনার সুন্দরী পত্নীকেও নিজের নোংরা দৃষ্টি থেকে বাইরে রাখেন নি! তিনি তো পুরো পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলো, যে করেই হোক বেগমজিকে সে একবার হলেও ভোগ করবে! নিজের সজ্জিত শয্যায় তুলবে।”

“রাজকন্যা.. এসব আপনি কি বলছেন?”

বজ্রকন্ঠে হুংকার ছাড়ে আয়াস। তবে সেটা নিজের কথিত আব্বাজানের নামে এহেম কথা শুনে নয়, বরং বেগমজিকে নিয়ে তার আব্বাজানের এমন নোংরা মানসিকতার বর্ননা শুনে। নাজিমউদ্দীনও আর স্থির থাকতে পারেন না। মাথার র’ক্ত টগবগ করে উঠতেই ছিটকে ওঠেন তিনি!

“এসব তুমি কি বলছো কোনো ধারণা আছে তোমার?” বলেন নাজিমউদ্দীন।

“আমি সবটা নিখুঁত জেনেই বলছি। রাজকন্যা জবাব দেয়।

” চাচাজান হয়তো জীবনের প্রথম ভালো কাজ টা তখনই করেছিলেন যখন তিনি ওস্তাদজীর এই নোংরা পরিকল্পনা সম্মন্ধে অবগত হন। তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েন। ওস্তাদজীকে হুমকি দেন, যদি সে ভুল করেও তার ভগিনীকে বাজে নজরে দেখে তবে সে নির্ঘাত তাকে রাজা সিরাজ উদ্দীনের হাতে তুলে দিবেন। ওস্তাদজী শান্ত হন। তিনি ভাবেন বেশি লোভে সে সব হারাতে পারে। তাই তিনি এই ব্যাপারে ক্ষমা চান চাচাজানের কাছে। তিনি আর কোনোদিন তার ভগিনীকে খারাপ নজরে দেখবেনা। কথা রাখতে তিনি ফুপুআম্মার থেকে কু’দৃষ্টি সরালেও তার অনাগত সন্তানের থেকে নিজের কু’দৃষ্টি সরালেন না। যদি তাকে কোনো কারনে চাচাজানের সঙ্গ ছাড়তেও হয় তবে যেন চাচাজানের চেয়েও বড় অস্ত্র সে নিজের কাছে রাখতে পারে। আর সেটা হলো ফুপুআম্মার অনাগত সন্তান! কে বলতে পারে হয়তো কোনোদিন এই সন্তানই তার সবচেয়ে বড় মোক্ষম হাতিয়ার হবে? হলোও যে তাই(আয়াসের পানে তাকিয়ে)! ফুপুআম্মার অনগত সন্তানকে নিয়ে ওস্তাদজী ছক কষে ফেললেন। কিন্তু সেই পথে বাঁধা হলেন রুবা! ওস্তাদজী জানতে পারলো রুবাও মা হতে চলেছে। আর তার অনাগত সন্তানের পিতা সে নিজেই। শুরু হলো বাড়তি ঝামেলা! রুবা মেরাজকে পেটে নিয়ে বুঝেছিলো নরক য’ন্ত্রণা কাকে বলে? এমন একটা দিন ছিলো না যে ওস্তাদজী রুবাকে এক দন্ড শান্তি দিয়েছে! এতোটা মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রণা সে সহ্য করেছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইতিহাস আজও কাঁদে! তবে এতকিছুর পরও রুবা হার মানেনি! একজন দায়িত্ব বান মায়ের মতো সে তার সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখাতে পেরেছিলো। আর তার পরই ছাড়লো এই বি/ষাক্ত দুনিয়া! হয়তো ওটাই ছিলো রুবার প্রথম নেওয়া শান্তির নিঃশ্বাস!

ওস্তাদজী মেরাজকে নিজের কাছে রাখতে চাইলেন না। ফেলে দেওয়ার কথা প্রায় ভেবেই নিয়েছিলেন কিন্তু তখনই তার মনে হয় সে ভুল করছে। এই সন্তানকে ফেলে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলে আখেরে তারই লাভ!

মেরাজ এবং রাজকুমার আয়াসের জন্মক্ষণ একই মুহুর্তে ছিলো। রাজকুমার আয়াসের জন্মের পূর্বক্ষণে ওস্তাদজী নাজিমউদ্দীনকে এমন ভাবে প্র’রোচনায় ফেলে যে নাজিমউদ্দীন সেদিন প’শুর মতো প্র’হার করে ফুপুআম্মাকে। আর যার পরেই ফুপুআম্মার প্রসব বেদনা শুরু হয়! এমন ভাবে প্র’হার করার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই সবাই ভেবে নেয় তাদের সন্তান আর বাঁচবে না! এসব কিছু করার পেছনে ওস্তাদজীর দুটো কারন ছিলো,

এক, নিজের ভগিনীর সাথে ঘটা এই অন্যায়ের বিচার করতে রাজা সিরাজ উদ্দীন নির্ঘাত নাজিমউদ্দীনকে বন্দী করে ককারাবাসে রাখবেন।

এবং দুই, ফুপুআম্মার সন্তান জন্মাবার পূর্ব থেকেই যেন সবাই নিশ্চিত থাকে যে ফুপুআম্মার সন্তান মৃত জন্মেছে!

ওস্তাদজী সমস্ত পরিকল্পনা একে একে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। তার উদ্দেশ্য সফল হলো। রাজকুমার আয়াসের জন্মাবার ঠিক পরমুহুর্তেই চাচাজান তাকে সরিয়ে ওস্তাদজীর হাতে তুলে দেয়। এবং রাজকুমারের ফাঁকা জায়গায় রেখে দেয় এক মৃত সন্তান। যেন ফুপুআম্মার চোখ মেলেই দেখতে পায় সে একজন মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।”

এটুকু বলে রাজকন্যা থামে। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। আয়াস ততক্ষণে চোখ বুঁজে নেয়! বক্ষজুড়ে বি’ষাক্ত ব্যাথাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দম আঁটকে যাচ্ছে! আপন জন! আপন জন বলতে ঐ একটা মানুষই তো ছিলো। তার আব্বাজান। যে কি তার জীবনের গোটা পঁচিশ টা বর্ষ অব্দি কেবল ধোঁকাই দিয়ে এসেছে। তার সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবনটাকে শুরু হওয়ার পূর্বেই শেষ করে দিয়েছে! কেন? কেন করলো সে এমন?

নাজিমউদ্দীন হা করে নিঃশ্বাস নিলেন। তার একজন ভ্রাতা ছিলেন। ছোট। সে সব সময় বলতো তাদের কুঁড়েঘরটা ভেঙে যাওয়ার পেছনে তার মিত্রেরই হাত আছে। একদিন মিলবে তার কথা! ঠিক! আজ মিলে গেলো তার কথা! তার জীবনের প্রথম ক্ষতিটা তার মিত্রই করেছিলো! সে ভুলে গেলো কেমন করে? তার ভ্রাতা,মাতা পিতা সবাইকে সে এক এক করে কেঁড়ে নিলো। আর শেষ অব্দি তার পুত্রকেও! টানা একুশ টা বর্ষ! হ্যাঁ, ঠিক একুশ বর্ষ! তার ছেলেটা তো তার সম্মুখেই বড় হয়েছে। সারাক্ষণ খেলেছে,হেসেছে! কিন্তু সে হতভাগার মতো সবটা দেখে গেছে! কোনোদিন একবারের জন্য ভাবতে পারেনি এই ছোকরা তার পুত্র হতে পারে। এর জন্যই হয়তো নিজের সন্তানের চেয়েও এই ছোকরার প্রতি তার টান, তার দুর্বলতা বরাবর বেশি ছিলো!-

“ওস্তাদজী বুদ্ধি করে নাজিমউদ্দীনকে ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়। আর এদিকে ৪বর্ষ অব্দি রাজকুমার আয়াসকে নিজের মতো করে বড় করতে আরম্ভ করে। রাজকুমার আয়াসের মাঝে নিজের সব বিদ্যা ঢেলে দেয় ওস্তাদজী। যেন নাজিমউদ্দীক তাকে দেখা মাত্রই বলে দিতে পারে এই পুত্র ওস্তাদজীর ছাড়া আর কারোর হতে পারেনা। অন্যদিকে মেরাজকে সমস্ত রাজকীয় সুখ, ভোগবিলাস দিতে শুরু করে। যেন ওকে দেখতেই নাজিমউদ্দীন চিনে নেয় এটাই তার এবং বেগমজির সন্তান। নাজিমউদ্দীন পূনরায় ভুল করেন। নিজের পুত্রকে চিনতে পারেননা। ওস্তাদজীর পাতা ফাঁদে আবারও পা দেয় সে। ওস্তাদজী জানায়, সে চলে যাওয়ার পরই ফুপুআম্মার কোল আলো করে জন্মায় মেরাজ। কিন্তু সে মেরাজকে নিজের মাতৃপিরচয় দেওয়ার পূর্বেই বিতাড়িত করে রাজ্য থেকে। দাসীদের দিয়ে ফেলে আসতে বলে কোনো এক জঙ্গলে। সে খবর পেয়ে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নিজের সন্তানের আদর দিয়ে, স্নেহ দিয়ে বড় করে। নাজিমউদ্দীন তার কথাই মেনে নেয়। সে ভাবে বেগমজি হয়তো সত্যি সত্যি তাদের পুত্রকে বিতাড়িত করে রাজ্য থেকে।”

আয়াস ধপ করে বসে পড়ে মেঝেতে! তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসে। থরথর করে কাঁপতে লাগে সর্বাঙ্গ। আর কিছু শোনার বিন্দু মাত্র শক্তি তার মাঝে অবশিষ্ট নেই। দম ফুরিয়ে এসেছে যেন! বুকের পা পাশে শক্ত করে চেপে ধরলো ডান হাতটা! মনে হচ্ছে যেন মরে যাচ্ছে সে!

“সরদার! সরদার কি হলো আপনার?”

আঁতকে উঠলো উপস্থিত সকলে। রেদোয়ান অস্থিরতা নিয়ে বসে পড়লো তার পাশে। কাঁধে, পিঠে হা বুলাতে বুলাতে আওড়ালো কথাগুলো। ওদিক থেকে ছুটে এলেন নাজিমউদ্দীন! আয়াসের সম্মুখে বসে অসহায় কন্ঠে আওড়ালেন,

“রাজকুমার.. আব্বাজান? কি হলো তোমার!”

নাজিমউদ্দীন এর কন্ঠে ‘আব্বাজান’ ডাকে মন জুড়ালো যেন আয়াসের। তার সমস্ত খারাপ লাগা যেন এক নিমিষে উধাও হয়ে গেলো।

ছুট্টে এলেন ফুপুআম্মাও। ঠিক আয়াসের সম্মুখে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন। কিছু না বলেই বুকে জড়িয়ে নিলেন পুত্রকে। অমনি কান্নার ঢল পড়লো যেন।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। কাঁদলেন নাজিমউদ্দীনও,কাঁদল আয়াস এবং রেদোয়ানও। কাঁদল রাজকন্যাও। কাঁদতে কাঁদতেই আবার হাসলো রাজকন্যা। ঠিক নেই কত গুলো যুগ পেরিয়েছে ফুপুআম্মা এমন ভয়ানক ভাবে কাঁদেন না। আজ কাঁদছেন। নিজেকে উজাড় করে কাঁদছেন। দুঃখে নয়। সুখের কান্না কাঁদছেন। সে পেরেছে ফুপুআম্মার সর্বস্ব ফিরিয়ে দিতে। এবার কেবল প্রতীক্ষা নিজের আম্মাজানের এমন আনন্দের কান্না দেখার। আব্বাজান ফিরে এলে আম্মাজানও ঠিক এমন করেই কাঁদবেন।

#চলবে___