রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
261

#রাজকন্যা_হূরিয়া
লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৩০;

অম্বরের বক্ষজুড়ে নিশাকান্তের দম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেখা হলো না রাজকন্যার। তার দৃষ্টি শূন্যে কোথাও ভাসছে। এক ঝাঁক মন খারাপ নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সে। তার সাজানো উদ্যান তখন বেলীফুলের সতেজ সুবাসে মুখরিত। রাজকন্যার হাতে লাগানো নতুন গাছ। ফুল এসেছে সবে সবে। মিষ্টি সুঘ্রাণ। নির্মল বাতাসে ভেসে চলেছে সর্বত্র। এমন সময় একজোড়া উষ্ণ হাতের সংস্পর্শে নিজেকে আকস্মিক জড়িয়ে পড়তে দেখে চমকে উঠলো রাজকন্যা। হাতজোড়া ততক্ষণে তাকে সম্পূর্ণ নিজের দখলে করে নিয়েছে। আগন্তুকের শরীরের মিষ্টি গন্ধ পরিচিত রাজকন্যার। তাই পেছন মুড়ে তাকে না দেখেও বুঝে নিলো তার প্রিয় মানুষটা ব্যতীত অন্যকেউ নয়।

“আমার মনোহরিণীর মনটা এত্তো খারাপ কেন? এই অধম পূণরায় কি করলো?”

রাজকন্যার বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের আনাগোনা মিলল। আয়াস ততক্ষণে রাজকন্যার কাঁধের উপর থুঁতনি রেখে আরেকটু কাছে টেনে নিলো রাজকন্যাকে। রাজকন্যা প্রায় অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। ফের জবাব দিলো,

“আপনাকে যেতে হবে যে!”

“খুব শীঘ্রই ফিরবো যে। তারপর ঠিক এই ভাবেই পার করে ফেলবো জনম জনম।”

“আপনি খুশি হতো রাজকুমার?”

“না চাইতেও আপনি আমায় এই ধরণীর সমস্ত সুখ একত্র করে দিয়েছেন মনোহরিণী। এরপরও আমি খুশি হবোনা?”

“ওস্তাদজী আপনার কোনো ক্ষতি করে দেবেন নাতো?”

“ম/রে যেতে ভয় নেই। কিন্তু মরবার পূর্বে এই মিষ্টি মুখ খানা দেখবার আবদার নিশ্চিয় করবো! তারা নিশ্চয়ই আমার শেষ ইচ্ছে অপূর্ণ রাখবে না!”

রাজকন্যা ক্রোধে ফেটে পড়লো। একই সঙ্গে একঝাঁক মন খারাপ হানা দিলো মনে। এক ঝাটকায় নিজের থেকে সরিয়ে দিলো আয়াসকে। রাগে কিঞ্চিৎ কম্পন হলো তার ওষ্ঠযুগলে। তা নাড়িয়েই রাগান্বিত হয়ে বলল,

“আপনি কখনও শুধরাবেন না তাই না!”

রাজকন্যার রাগ দেখলেও মনেমনে ঠিকই বুঝে নিলো তার অপ্রকাশিত মন খারাপের ভাব। অমনি হুট করে তার মনটাও খারাপ হয়ে গেলো। ভেতরে মুচড়ে উঠলো মন খারাপ। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো রাজকন্যার সম্মুখে। দু্ই কানে হাত দিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

“ক্ষমা করবেন রাজকন্যা! আ- আমি আপনাকে আঘাত করতে চায়নি!”

আয়াসের কার্যকলাপে আকস্মিক রাজকন্যার মনের সব রাগ,মন খারাপ একই সঙ্গে পালালো। তাছাড়া ভীষণ মায়াও হলো আয়াসকে এমন করে কান ধরতে দেখে। না চাইতেও মনে মনে ভীষণ হাসলো রাজকন্যা। মুখে কিছু না বলে চুপটি করে বসলো আয়াসের সম্মুখে। ঠিক তার মতোই হাঁটু মুড়ে। হাত বাড়িয়ে আয়াসের ধরে রাখা কান থেকে হাত ছাড়িয়ে দিলো। কিঞ্চিৎ বকার সুরে বলল,

“আপনি সত্যি শোধরাবার নয়। ভীষণ নাটুকেও হয়েছেন বটে।”

আয়াস কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো রাজকন্যার পানে। যেন সে ভীষণ অবাক হয়েছে। রাজকন্যাও তাকিয়ে রইলো আয়াসের পানে। তারপর হঠাৎই দু’জন হেঁসে উঠলো একত্রে। আয়াস হাসি থামিয়ে বলল,

“আমি শুধরাতে চাইনা। এমনই নির্লজ্জ, ঠোঁট কাটা পুরুষ থাকতে চাই। যাতে আপনাকে যখন তখন লজ্জায় ফেলে বুকে জড়িয়ে রাখতে পারি৷”

“উফফ!”

“সত্যি!”

“আমি মোটেও আপনার ওসব কথায় লজ্জা পাইনা।”

“তাই?”

“একদম।”

“চেষ্টা করবো একবার?”

“রাজকন্যাকে ভয় দেখাচ্ছেন? বন্দী করবো কারাগারে।”

“আমি তো সেই কবে থেকেই বন্দী। আপনার মনের কারাগারে।”

“ধ্যাৎ!”

“এখনই লজ্জা পেয়েছেন।”

“এখন যেতে হবে। উঠুন।”

“ইচ্ছে হচ্ছে না এখন। আরেকটু থাকিনা।”

আকুল কন্ঠে আবেদন জানালো আয়াস। কথাটা বলতে বলতে রাজকন্যার হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। রাজকন্যা স্মিত হাসলো। একহাত বাড়িয়ে আয়াসের মুখবিবর ছুঁয়ে দিয়ে ক্ষনকাল ঠিক এমনই পলকহীন চেয়ে রইলো। অতঃপর বলল,

“আর মোটে ক’টা দিন। তারপরই তো আমরা আবারও একত্রে হতে পারবো। তখন আর কোনো দুঃখ থাকবেনা। সত্যি।”

আয়াসও হাসলো। মলিন হাসি। হাত উঠিয়ে রাজকন্যার নরম হাতটা চেপে ধরলো নিজের গালে। চোখ বুঁজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিলো। ফের আনমনেই বলে উঠলো,

“আমাদের আর কখনও দেখা হবে তো মনোহরিণী? নাকি এটাই আমাদের শেষ দেখা..”

রাজকন্যা আঁতকে উঠে মুখ চাপলো আয়াসের।

“উফফ! কেন এসব কথা বলেন?”

অভিযোগের সুরে বলে রাজকন্যা। আয়াস নেত্র মেলে তাকায়। ততক্ষণে রাজকন্যার ন্যায় তার নেত্রকোনও ভিজে উঠেছে। কাঁপা কাঁপা হস্তে নিজের মুখ থেকে রাজকন্যার হাত টা নামিয়ে এনে ঢিপঢিপ করে আওয়াজ করে যাওয়া বক্ষস্থলে চেপে ধরলো। অসহায় কন্ঠে আওড়ালো,

“আমি পারবো না ঐ মানুষটাকে আঘাত করতে! শতহোক তাকে আমি নিজের প্রিয় আব্বাজানের পবিত্র স্থানে বসিয়ে ছিলাম।”

“আপনাকে পারতেই হবে। আমার জন্য..”

“আমাকে কি ক্ষমা করবেন আপনি? যদি আমি হেরেই ফিরে আসি! কিংবা না আসি?”

রাজকন্যা ক্লান্ত দৃষ্টিতে দেখে আয়াসকে। আয়াস ভেতর থেকে ভেঙে যাচ্ছে। তার সাধারণ জ্ঞান শক্তি যেন ক্রমশ লোপ পাচ্ছে! সত্যিই তো কি করে
ত/লোয়ার চালাবে ঐ মানুষটার উপর? যাই হোক না কেন, তাকে তো সে আব্বাজান ডেকেছে!

রাজকন্যা জবাব দিলো না। আর কিছু না বলে আয়াসের বুকে মাথা রাখলো। কতক্ষণ ঠিক এমন সময় পেরোলো জানেনা সে। এক পর্যায়ে আহত কন্ঠে আওড়ালো,

“আমার আব্বাজানকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন রাজকুমার। দয়াকরে;’

আয়াস থমকালো। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগলো হঠাৎ। এক যুগ! এক যুগ এই মানুষ টা তার আব্বাজানের স্নেহ থেকে বঞ্চিত! কেবল তার আব্বাজানের জন্য! না। সে ভুল। ঐ মানুষটাকে তার আব্বাজান নয়। একজন ডাকাত। যে কিনা দিনের পর দিন কেবল তার পাপের চূড়া উঁচু করে গেছে। কখনও কারোর ভালো চায়নি এমনকি ভালো করেওনি! কোনোদিনও না। তাকে মারতে কিসের আপত্তি? কোনো আপত্তি নেই। একজন বাবাকে তার সন্তান এবং স্ত্রীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া তার কর্তব্য। একজন রাজকুমার হিসেবে,একজন সন্তান হিসেবে আর সবশেষে একজন মানুষ হিসেবে। হ্যাঁ। সে পারবে।

ভাবতে ভাবতে আয়াস দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো রাজকন্যাকে। রাজকন্যার ললাটে অধর ছুঁয়ে ভালোবাসার পরশ একে কোমল স্বরে বলল,

” চিন্তা করবেন না। রাজামশাই অতি শীঘ্রই ফিরে আসবেন তার আদরের রাজকন্যার কাছে। এবং তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে। পরিশেষে তার গোটা সাম্রাজ্যের কাছে। ফিরে আসবেন। আমি কথা দিচ্ছি।”

আয়াসের কথাগুলোয় আনন্দে নেত্রকোন গলিয়ে টসটসে কয়েকোটা জলে অক্ষিকাচ ভিজে উঠলো রাজকন্যার। সে আর কিছু বলতে পারলো না। আয়াসে বক্ষস্থলে পরম স্নেহে মাথা রেখে নিশ্চুপ রইলো।

–“আম্মাজাননননন!(বিকট শব্দে)”

আকস্মিক রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল থেকে কারোর কন্ঠে এমন বিকট আওয়াজ ভেসে আসতেই চমকে উঠলো তারা দু’জনেই। রাজকন্যা এবং আয়াস দু’জনেই আতংকিত দৃষ্টিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

“আবার কোন বিপদ হলো?”

আতংকিত কন্ঠে প্রশ্ন করে রাজকন্যা। আয়াস অন্দরমহলে দৃষ্টি রেখে বলে,

“জানিনা। চলুন দেখতে হবে।”

রাজকন্যাকে হাত ধরে উঠালো আয়াস। অতঃপর দু’জনেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো।

___

কাউকে কোত্থাও না পেয়ে রাজকন্যা এবং আয়াস ছুট্টে গেলো নিজেদের কক্ষে। শোরগোলের আওয়াজটা ওখান থেকেই ভেসে আসছে। নিজেদের কক্ষের সামনে এসে অবাক হলো দু’জনেই। কি হয়েছে তাদের কক্ষে?

“কি হয়েছে এখানে?”

রাজকন্যার গলা ভেসে আসতেই সবাই পাশে সরে গেলো। তাদের ভেতরে যাওয়ার পথ করে দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়ালো সব প্রহরী এবং দাসীরা। রাজকন্যা তাদের থেকে উত্তরের আশায় বসে রইলো না। দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আলিয়া কাঁদছে! আদিমকেও দেখা যাচ্ছে। সে কখন ফিরে এলো? দেখা করলো না যে! আরহাম রেদোয়ান দু’জনেই আছে। চাচীজানও আছেন যে। ফুপুআম্মা, নাজিমউদ্দীন, রাজকুমার সাদ্দাত সবাই উপস্থিত। রাজকন্যা নিজের বিস্ময় চেপে রাখতে পারলোনা। এগিয়ে গেলো আলিয়ার কাছে। আলিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তার মুখবিবর ধরে নিজের দিকে ফেরালো। স্নেহ মিশ্রিত গলায় আওড়ালো,

“কি হয়েছে আলিয়া? কাঁদছো কেন?”

আলিয়া রাজকন্যাকে দেখতেই ঝাপটে ধরলো। আর ওমনি তার কান্নার বেগ দিগুন হলো। রাজকন্যা ভড়কে গেলো। ইতিহাসে এই প্রথম ঘটলো, তার বোন তাকে পেয়ে এমন করে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে!

“আলিয়া.. আলিয়া?”

আলিয়া কাঁদতে কাঁদতে জবার আওড়াতে পারলোনা। রাজকন্যা আবারও ডাকলো। এবারও কেবল কেঁদেই গেলো আলিয়া। রাজকন্যা ওকে আর কোনো প্রশ্ন না করে চাচীজানকে প্রশ্ন করলো,

“চাচীজান.. কি হয়েছে ওর? কাঁদছে কেন এমন করে?”

চাচীজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিন্তিত গলায় বললেন,

“আমি জানিনা রাজকন্যা। ও যে কিছুই বলছেনা।”

রাজকন্যা এক এক করে বাকিদেরও জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু সবার জবাবের ভান্ডারই শূন্য। রাজকন্যা না পেরে রাজকুমার সাদ্দাতকে প্রশ্ন করলো,

“আপনি কি কিছু জানেন রাজকুমার?”

রাজকুমার সাদ্দাত নিশ্চুপ! সে না কিংবা হ্যাঁ কোনো জবাবই দিলো না। রাজকন্যা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাজকুমার সাদ্দাতের পানে। যেন এর মাঝেই কোনো ঘাপলা আছে। হঠাৎই রেদোয়ান কিছু বলতে চাইলো,

“আমি হয়তো বুঝতে পারছি এখানে কি ঘটেছে!”

সবাই উৎসুক নয়নে তাকালো রেদোয়ানের পানে। রাজকন্যা হুকুম করলো,

“বলো?”

রাজকুমার সাদ্দাত কেমন অস্বস্তিতে পড়লো। যেন তার পর্দা ফাঁস হতে যাচ্ছে। সে যাওয়ার তাগাদায় বলে উঠলো,

“আমার একটু কাজ আছে!”

রাজকন্যা পাশ ফিরে তাকালো রাজকুমার সাদ্দাতের পানে। রাজকন্যার সন্দেহ যেন ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। রাজকুমার সাদ্দাত রাজকন্যার পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই রাজকন্যা কঠোর গলায় বলে উঠলো,

“দাঁড়ান!”

রাজকুমার সাদ্দাত থমকে দাঁড়ায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায়। রাজকন্যা আলিয়াকে সোজা করে দাঁড় করায়। পূর্বের ন্যায় কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করে,

“আলিয়া, কি হয়েছে?”

আলিয়া ফুঁপিয়ে ওঠে। ঘৃণিত দৃষ্টিতে একবার তাকায় রাজকুমার সাদ্দাতের পানে। অতঃপর আকস্মিক ক্ষেপে যায়। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বলে,

“আপা, রাজকুমার সাদ্দাত আমায় জোর করে.. আ- আমায় কলঙ্ক.. কলঙ্কিত করতে চেয়েছে!”

আলিয়ার মুখে এমন কথা শুনে স্থবির হয়ে যায় রাজকন্যা। একই সঙ্গে উপস্থিত সকলে। রাজকন্যা বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় রাজকুমার সাদ্দাতের পানে। আলিয়া আবারও বলে ওঠে,

“তোমার কক্ষে উনি এই বাজে মতলব নিয়েই আসে আপা। উনি আমায় নয় তোমায় কলঙ্কিত করতে চেয়েছে! আমি উনাকে লক্ষ করেছি সেই প্রভাত থেকে। উনি কেবল একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সুযোগ পেলেই উনি তোমার সঙ্গে এমন বাজে আচরণ করবেন। কিন্তু উনার এই কাজে আমি বাঁধা দিতে যাওয়ায় উনি আমার সঙ্গে..”

“প্রহরী!”

বজ্রকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো রাজকন্যা। রাজকুমার সাদ্দাত চমকে উঠলো। এবার বুঝি তারও কারাবাস ঘটার পালা!

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸💙
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৩১.

“বন্দী করো রাজকুমার সাদ্দাত কে!”

বজ্রকন্ঠে হুকুম করলো রাজকন্যা। রাজকন্যার রাগান্বীত মুখ দেখে ঘাবড়ে গেলো উপস্থিত সকলে। দু’জন প্রহরী ছুটে এলো রাজকুমার সাদ্দাতকে বন্দী করতে। রাজকুমার সাদ্দাত ভড়কানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এখনও। সে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু আলিয়ার অদ্ভুত চাহনি যেন বাঁধা দিচ্ছে তাকে।

“নিয়ে যাও!”

রাজকন্যা আবারও হুকুম করে। প্রহরী আজ্ঞা পালনে নতশির করে রাজকুমার সাদ্দাতকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়ার আগেই পুনরায় মুখ খুলে রেদোয়ান।

“রাজকন্যা, আলিয়া পুরোপুরি সত্যিটা বলেনি আপনাকে! রাজকুমার সাদ্দাত এমন কোনো কিছুই করেনি তার সঙ্গে! সে মিথ্যে বলছে আপনাকে!”

রাজকন্যার ললাট কুঞ্চিত হয়! সে রেদোয়ানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আলিয়ার পানে নিক্ষেপ করে। অবাক স্বরে জানতে চায়,

“মানে!”

“আমি বলছি; রাজকুমার সাদ্দাত আপনাকে যেকোনো ভাবে পেতে চায় একথা সম্পূর্ণ সত্যি। তবে সেই কাজে আলিয়া বাঁধা হওয়াতে যে সে আলিয়াকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছে এ কথা সম্পূর্ণ ভুল। রাজকুমার সাদ্দাত খারাপ মতলবেই এই রাতের মধ্য প্রহরে আপনার কক্ষে এসেছিলো। সে মনেপ্রাণে চেয়েছিলো একটা বাজে পরিস্থিতি তৈরি করে আপনার আর রাজকুমার আয়াসের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে। কিন্তু এখানে এসে দেখলো আপনারা কেউই কক্ষে নেই। তাই অন্ধকার কক্ষে আপনার অপেক্ষা করতে লাগলো। আর তার সুযোগ নিলো আলিয়া। তার মনেও একই ক্ষোভ ছিলো রাজকুমার আয়াসকে নিয়ে। তবে সেটা যে আর কোনো কালেই সম্ভব না তা বুঝেই সে নিজেকে আপনার রূপ দিতে চাইলো। যেন কোনো মতে রাজকুমার সাদ্দাতের সঙ্গে তার বিয়েটা হয়ে যায়। এই ভাবনা নিয়েই সে রাজকুমার সাদ্দাতের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চায়। রাজকুমার সাদ্দাত প্রথমে তাকে আপনি ভেবেই ভুল করেন। আর যখন বুঝলেন সে আপনি নন আলিয়া, তখনই শুরু হয় নিজেকে এই মুহুর্ত থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যায়। তারা দু’জনেই অন্যায় করেছেন আর একই সঙ্গে দু’জনেই নিজেদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন।”

আয়াস এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। রেদোয়ানের মুখে এহেম কথা গুলো শুনে আর দূরে সরে থাকা সম্ভব হলোনা। এদিকে আলিয়া এবং রাজকুমার সাদ্দাতের মুখ খানা চুপসে গেলো ভয়ে। আলিয়া ভয় পাচ্ছে নিজের ভুলের জন্য! রাজকুমার সাদ্দাতের মতো তাকেও কি রাজকন্যা কারাবন্দী করবে?

রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে পাশ ফিরে তাকালো আয়াসের পানে। আয়াস ছোট্ট করে হাসলো। ভরসা দিলো তার প্রনয়ণীকে। চোখের পলক ফেলে শান্ত হতে বললো। যেন যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে ভেবে চিন্তে নেয়।

“রাজকুমার সাদ্দাত এবং আলিয়ার বিবাহের ব্যবস্থা করো। এবং বিবাহের পর-মুহুর্তেই তাদের নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার কঠোর আদেশ রইলো। যদি এই আদেশ তারা দু’জনের কেউ অমান্য করে তবে একত্রেই দু’জনকে পাতালঘরের কারাগারে বন্দী করার হুকুম রইলো।”

রাজকন্যার আদেশ শিরোধার্য করলো প্রত্যেকে। অনেকে বেজায় খুশি হলেও অনেকই রইলো মুখ ভার করে। আয়াস স্মিত হেসে দু’পা এগিয়ে এসে রাজকন্যার কাঁধে হাত রাখলো। রাজকন্যা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাম্ভিক হাসলো।

_____

“ওস্তাদজী; আমরা নিজেদের কুঠুরি ছেড়ে এই ঘন জঙ্গল দিয়ে কোথায় যাচ্ছি বলুন তো? সঙ্গে একটা লোককেও নিলেন না। এখন এই বুড়োকে নিয়ে কি করবো আমরা?”

অন্ধকার জঙ্গলে হাতে একটা অগ্নি কুপ নিয়ে হেঁটে চলেছে ওস্তাদজী, মেরাজ এবং রাজা সিরাজ উদ্দীন। রাজা সিরাজ উদ্দীন নিজের চেতনে নেই। তাকে নানাবিধ ওলটপালট ওষধি সেবন করানো হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সে হাঁটছে, সবকিছু দেখছে ঠিকই তবে নিজের মস্তিষ্ক খাঁটিয়ে কিছু করতে পারছেনা। এমনকি সামনের কয়েক প্রহরেও করতে পারবেনা।

মেরাজের অধৈর্য্য দেখে কিঞ্চিৎ রেগে গেলেন ওস্তাদজী। কিন্তু আপাতত কিচ্ছুটি বললেন না। মুখে কুলুপ এঁটে রাখলেন।

আরও অনেকখানী পথ পারি দেওয়ার পরে তারা পৌঁছালো একটা বাড়ির সামনে। ইটপাথরে গড়া ছোট্ট একটা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে শ’খানেক লোক পাহারায় রয়েছে। তাদের দেখতেই মেরাজের কৌতুহল আরও বেড়ে গেলো। সে আবারও প্রশ্ন করল,

“ওস্তাদজী? ওরা কি আমাদের লোক? আমাদের হয়ে কাজ করে? আর এই বাড়িটা.. এই বাড়িটা কার?”

ওস্তাদজী বিরক্তি সূচক নিঃশ্বাস ফেলে। গম্ভীর স্বরে বলে,

“হ্যাঁ ওরা আমার লোক। আমার পোষা। এত কথা বলিস কেন রে তুই? যা হবে দেখতে পাবি। এখন যা, এই বুড়োকে কক্ষে দিয়ে আয়। শোন, বাইরেটা ভালো করে বন্ধ করবি। যা। আয়াস আসলো বলে!”

মেরাজ ওস্তাদজীর আদেশ পালনে লেগে পড়লো। এর মাঝে আয়াসের নাম শুনে মনে মনে হিংস্র পশুর মতো কয়েক মুহুর্ত গোঙালো ঠিকই। তবে প্রকাশ করলো না।

“আজ্ঞে ওস্তাদজী।”

ওস্তাদজীর ভাবনা মোতাবেক কয়েক মুহুর্ত বাদে সত্যি সত্যি ফিরলো আয়াস। সঙ্গে ফিরলো রেদোয়ানও। আয়াসকে দেখতেই তার মুখ জুড়ে বিচরণ করলো আত্মতৃপ্তির মৃদু হাসি। চালাকি করে নাজিমউদ্দীনকে পাঠিয়ে ভুল কিছু করেননি তিনি। সিরাজ উদ্দীনের নাম করে তাকে না পাঠালে যুদ্ধের শেষ মুহুর্তে এসে নিজের এতো কালের সাধনার প্রাসাদ যে তার হাতেই তুলে দিতে হতো। এখন আর সেই ভয় নেই।

“আব্বাজান? আমার আব্বাজান.. তুমি ফিরেছো?”

আবেগি ভাব করে পুত্রকে বুকে টেনে নিলেন ওস্তাদজী। রেদোয়ান তার কান্ড দেখে পেছন দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলো। কিন্তু প্রকাশ করার মতো বোকামি করলো না। আয়াস প্রথম থেকেই দুর্বোধ্য হেসে চলেছে। ওস্তাদজী আর ঠিক কত নাটক করতে পারে সেসবই দেখে চলেছে।

“তুমি ঠিকাছো তো আব্বাজান? ঐ ধূর্ত কন্যা তোমার কোনো ক্ষতি করেনি তো?”

আয়াস ঠোঁটের কোনে দুর্বোধ্য হাসির রেখাটা বজায় রেখেই বলে উঠলো,

“ক্ষতি করেনি কি বলছেন আব্বাজান? আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা সেই করেছে আব্বাজান!”

আয়াসের নাটকীয় সুরে বলা কথাটায় কিঞ্চিৎ চমকে উঠলেন ওস্তাদজী। মনের মাঝে ভয়ের দানা বাঁধলো! আয়াস কি সবটা জেনে গেছে? জেনে গেলে কি একা ফিরতো? না; তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষনা করে নিশ্চয়ই শ’খানেক প্রজা নিয়ে তবেই আসতো।

“আ-আমার ক্ষতি!”

ওস্তাদজীর গলাটা খানিক কাঁপলো। তা দেখে মনে মনে হাসলো আয়াস। মুখে বলল,

“তা নয়তো কি আব্বাজান? ভেবে দেখুন? ওই মায়াবিনী কন্যা তার আগুনের মতো সুন্দর রূপ দিয়ে আপনার পুত্রকে আপনার থেকে কেঁড়ে নেয়নি?”

ওস্তাদজী হো হো করে হেঁসে উঠলেন। আয়াসের দুই কাঁধে হাত রেখে বললেন,

“কখনও কখনও কিছু ভুল থেকেই আসল লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় আব্বাজান। এই যে দেখো তুমি ঐ ধূর্ত কন্যাকে বিবাহ করেছো বলেই আজ আমরা আমাদের লক্ষ্যের এতো নিকটে। তাই নয় কি?”

আয়াস হাসলো। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,

“খারাপ থেকেই আমার জীবনের ভালোটা আমি খুঁজে পেয়েছি আব্বাজান। আব.. আমাদের; আমাদের জীবনের ভালোটা।”

“একদম।”

“আব্বাজান,আপনি আমাকে মুক্ত করতে নাজিমউদ্দীনকে কেন পাঠালেন! আমি তো চাইলে একাই ফিরে আসতে পারতাম আব্বাজান। খামোখা উনাকে…”

“তোমার বন্দী হওয়ার কথা শুনে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেছিলাম আব্বাজান। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করে ফিরিয়ে আনবো তোমায়। আর এমন মুহুর্তে রাজকন্যার পত্র পেয়ে যা মাথায় আসলো সেটাই যে করলাম আব্বাজান।”

“আব্বাজান.. আপনার মিত্রকে তো ফিরিয়ে আনতে হবে! তাই না? আমাদের ছাড়া উনি তো ঐ মহলে সুরক্ষিত না! রাজকন্যা তার আব্বাজানকে ফিরে পেতে উনার যেকোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে!”

কথাটা বলতে বলতে আয়াস ওস্তাদজীর হাতটা ধরলো। তার কন্ঠের আকুতি হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে ওস্তাদজী। তাই পূর্বের ভয়টা পুনরায় জাঁতা দিয়ে বসলো মনে।

“হ্- হ্যাঁ আব্বাজান। মিত্রকে তো অবশ্যই ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবো। মেরাজকে আমি সবটা জানিয়েছি। ও প্রস্তুত প্রাসাদে যাওয়ার জন্য!”

জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে পুত্রের মন রাখার জন্য কথাটা বললেন ওস্তাদজী। আয়াস ওস্তাদজীর দৃষ্টির অগোচরে বাঁকা হাসলো। এর মাঝে দেখা মিলল মেরাজের। হাতে সিরাজ উদ্দীনের কক্ষের চাবি গুচ্ছ। আয়াসকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন হঠাৎ তার চক্ষুদ্বয়ের পীড়া জেগে উঠলো। টানটান করে উঠলো চোখের ভেতর। মনে হলো পূনরায় আঘাত করেছে আয়াস। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের রাগটা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো। তবে পূর্বের ন্যায়ই সবটা ভেতরে চেপে রাখলো। প্রকাশ করলো না বাইরে।

“ওস্তাদজী,আপনার জন্য পত্র পাঠিয়েছেন রাজকন্যা!”

পেছন থেকে রেদোয়ানের গলা পাওয়া গেলো। তার কথায় আয়াস,ওস্তাদজী এবং মেরাজ তিনজনেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। ওস্তাদজী শুঁকনো ঢোক গিললেন। আবার কি চাই ঐ ধূর্ত কন্যার!

#চলবে___

#রাজকন্যা_হূরিয়া 💙🌸
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
পর্ব_৩২;

“আমি শুধু আমার আব্বাজানকে ফিরে পেতে চাই! তার পরিবর্তে আপনাকে রাজ্য সমর্পিত করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”

রাজকন্যার পাঠানো প্রত্রে এমন লেখা দেখে বিমূঢ় হয়ে গেলেন ওস্তাদজী। যেন নিজের কানকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। ঠিক শুনেছে তো সে? নাকি ঘোরের মাঝে ভুল শুনলো?

“আব্বাজান, রাজকন্যা এতো শীঘ্রই মেনে যাবে আমি তো ভাবতেও পারিনি!”

আয়াসের সন্তোষজনক কন্ঠটি কানে বাজতেই হো হো করে হেসে উঠলেন ওস্তাদজী। নিজের খুশিতে উল্লাস করে বললেন,

“কন্যা কেবল ধূর্তই নয় আব্বাজান, বুদ্ধিমতীও বটে। সে ঠিক ঠাওরে নিয়েছে আমাদের কি চাই?”

আয়াস হঠাৎ মলিন মুখে তাকালো পত্রখানার দিকে। মন খারাপের সুরে বলল,

“নাজিমজী থাকলে বেশ ভালো হতো। তাই না আব্বাজান?”

আয়াসের এমন কথায় ভেতরে ভেতরে ক্রোধে ফেটে পড়লেন ওস্তাদজী। অসহ্য! এই পুত্রের হঠাৎ এতো দরদ হচ্ছে কেন নাজিমউদ্দীনের জন্য?

“আব্বাজান? চিন্তা করিওনা। খুব শীঘ্রই মিত্রকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবো।”

“ওস্তাদজী, রাজকন্যা কি এখানে আসবে? আমাদের ডেরায়?”

পত্রের লেখা গুলো মেরাজের কানেও পৌঁছেছে। সে হঠাৎ নিজের পৈশাচিক আনন্দগুলো ধরে রাখতে পারেনি। তাই ভুল করেই যমের সম্মুখী দাঁড়িয়ে ভুল কথা বলে ফেলেছে।

আয়াস তীক্ষ্ণ নজরে মেরাজের পানে তাকাতেই মেরাজ শুঁকনো ঢোক গিললো। নিজের অন্য চোখ টা রক্ষা করতে কথার মানে পাল্টানোর চেষ্টায় ব্রত হলো,

“ম- মানে নিজের আব্বাজানকে ফিরিয়ে নিতে নিশ্চয়ই এখানে আসবে।”

“আসবে বৈ কি? দেখগে আমায় রাজ্য দিয়ে নিজেরাই এই ডেরায় বাস শুরু করে!”

মেরাজের কথার পৃষ্ঠে বলে উঠলেন ওস্তাদজী। সঙ্গে তাচ্ছিল্য করে হাসলেনও। আয়াস তাদের কথায় আর ভ্রুক্ষেপ করলো না। ছোট্ট করে হেসে ঘরের ভেতর চলে গেলো। তার পেছন পেছন রেদোয়ানও গেলো। ওস্তাদজী তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে শয়তানি হাসলো। মনেমনে ভাবলো, আর কিছু ক্ষন আব্বাজান! আর তারপরই সব খালাস!”

“এই কে আছিস? রাজকন্যার জন্য পত্র লিখে পাঠা। তার শর্তে ওস্তাদজী রাজি।”

মেরাজ বাঁকা হাসলো। বাঁ হাতটা তুলে জখমে ঘেরা চোখটায় হাত বুলালো। রাজপ্রাসাদে যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই একবার শরীরের জ্বালা মেটাবে সে। আর ঠিক ঐ আয়াসের সামনে বসেই।

দু’জন চেলা এসে হাজির হলো। একজন বলল,

“ওস্তাদজী, আমরা তো লেখতো জানিনা। সরদারের হাতেই লেখাতে হবে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ যা করার জলদি কর। যা।”

“আজ্ঞে ওস্তাদজী।”

চেলা দু’জন যেভাবে এসেছিলো আবার সেভাবেই ফিরে গেলো আয়াসের কাছে। আয়াস ততক্ষণে নিজের কক্ষে গিয়ে গা এলিয়ে দিলো শয্যায়। রেদোয়ানও বসলো তার সম্মুখে। রেদোয়ান সেই তখন থেকেই হাসফাস করছে। কিছু বলতে চায় সে। কিন্তু সাহস সঞ্চার করে বলতে পারছেনা। সময় গড়াতে হঠাৎ আয়াস নিজেই বলে উঠলো,

“কি বলতে চাও বলে ফেলো? এতো ভাবনার প্রয়োজন নেই।”

রেদোয়ান প্রথম দফায় চমকায়। ফের নিজেকে সামলে নেয়। কথাটা এতক্ষণ বলার জন্য মরিয়া হয়ে থাকলেও এখন যেন সাহসে কুলোচ্ছে না। আমতাআমতা করছে। আয়াস ওর মুখ দেখে হাসল। শোয়া থেকে উঠে বসে রেদোয়ানের কাঁধে হাত রাখলো। ভরসা দিয়ে বলল,

“এতো ভেবে ভেবে কূল-কিনারা না হারিয়ে বলে ফেলোতো ঝটপট?”

“আ-আ আসলে সরদার.. আমার একজন মনে ধরে গেছে!”

প্রথমে ভয় পেলেও পরক্ষণে যেন ফট করে বলে বসলো কথাটা। আয়াস নেত্র জোড়া বড় বড় করে তাকালো। অবাক স্বরে বলল,

“তাই? কাকে?”

রেদোয়ানের কম্পিত হৃদয় খানা কেঁপে উঠলো হঠাৎ। তার নাম নিতে গিয়েও কম্পন হলো বক্ষজুড়ে।

“কি হলো? বলো কাকে? কার মায়ায় জড়ালে তুমি?”

“প- পরীর!”

নিঃশ্বাস আঁটকে বলে ফেললো রেদোয়ান। আয়াসের নেত্রকোন উপচে এখন বিস্ময় গড়াতে লাগলো। পূর্বের ন্যায় বলে উঠলো,

“পরী? মানে রাজকন্যার জিন্নাত?”

“হ- হ্যাঁ সরদার!”

আয়াস হেসে উঠলো। বলল,

“শেষ পর্যন্ত একটা পরীর প্রেমে পড়লে? এটা কি সম্ভব রেদোয়ান?”

শেষোক্ত প্রশ্নটা আয়াস বেশ নরম গলাতেই জিজ্ঞেস করলো। কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে পূনরায় বলল,

“আমরা বিনা কারনে ওর সঙ্গে যে অ/বিচার
অ/ত্যাচার করেছি.. তারপর কি কখনও ও তোমায় মেনে নিবে?”

রেদোয়ান আহত নয়নে তাকালো। আহত স্বরেই বলল,

“আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইবো!”

“তাতে ও মেনে যাবে?”

“দরকার হয় আমার সর্বস্ব ত্যাগ করবো সরদার! তবুও আপনি ওকে আমার জন্য নিয়ে আসুন।”

“পাগলামি করো না রেদোয়ান..”

“দয়াকরুন সরদার! ওকে আমার চাই!”

অসহায় কন্ঠে আওড়ালো রেদোয়ান। না পেরে হাত জোর করলো আয়াসের সম্মুখে। আয়াস ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে রেদোয়ানের হাতের উপর হাত রাখলো। আস্থা দিয়ে বলল,

“চিন্তা করো না। তুমি আমার ভাইয়ের চেয়ে কিছু কম নও। তোমার খুশির জন্য আমি এটুকু নিশ্চয়ই করবো।”

রেদোয়ান অতি আনন্দে জড়িয়ে ধরলো আয়াসকে। অশ্রুসিক্ত নয়নে আবেগি স্বরে বারবার শুকরিয়া জানালো তার। আয়াস বড় ভাইয়ের ন্যায় স্নেহের সহিত হাসলো।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলো দু’জন চেলা। রেদোয়ান চোখ মুছে আয়াসের সঙ্গে একত্রেই তাকালো পেছন মুড়ে। আয়াস দু’জনকে দেখে অনুমতি দিলো ভেতরে আসার। দু’জন ভেতরে প্রবেশ করে নতশির করলো। অতঃপর একজন বলে উঠলো,

“রাজকন্যা হূরিয়াকে পত্র লেখার জন্য বলেছেন ওস্তাদজী।”

চেলার মুখে এমন কথা শুনে আয়াস এবং রেদোয়ান মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। ফের দু’জনেই রহস্য মণ্ডিত হাসলো।

___

“রাজকন্যে, পত্র এসেছে ডাকাতদের ডেরা থেকে।”

রাজকন্যা বসা থেকে একপ্রকার ছিটকে দাঁড়াল। জিন্নাতের হাতে ধরে রাখা পত্রটা নিয়ে নিলো নিজের হাতে। তাতে লেখা,

“আমি রাজি।”

এই ছোট্ট কথাটায় যেন এক জনমের সুখের নিঃশ্বাস একত্রে ফেললো রাজকন্যা। আনন্দে তার নেত্রকোণ ভিজে উঠলো। জিন্নাতও আনন্দে হাসতে লাগলো। রাজকন্যার চোখে জল দেখে বলল,

“এখন কাঁদার সময় নয় গো রাজকন্যে। এতোকাল বাদে রাজামশাইয়ের সন্ধান পেয়েছি এখন কি কাঁদলে চলবে। তাকে ফিরিয়ে আনতে যেতে হবেনা?”

রাজকন্যা কাঁদতে কাঁদতে হাসলো। হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে বলল,

“এক যুগ.. এক যুগ পেরিয়ে গেলো জিন্নাত! ঐ মানুষটাকে দেখি,ছুঁই না। এক যুগ.. এক যুগ আমার আম্মাজান হাসেনা। কাঁদে না। এক যুগ!”

“অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে রাজকন্যে। রাজামশাইয়ের অভাবে হাহাকার করা এই রাজপ্রাসাদ পূনরায় হাসবে। প্রাণবন্ত হবে। দেখো তুমি।”

“নিশ্চয়ই। তুমি তৈরি তো? আমরা এখনই বের হতে পারি।”

“রাজকন্যে তুমি কি নিশ্চিত এই যুদ্ধে তুমি একাই যাবে? কোনো প্রজা,সৈন্য ব্যতীত!”

“একা কোথায় হলাম? তুমি আছো,সুফি থাকবে সেনাপতি আতাউল থাকবেন।”

“কিন্তু রাজকন্যে…”

“না জিন্নাত। এই যুদ্ধ আমাদের। আমাদের ব্যক্তিগত। আমি চাইনা সেখানে আমার একটা প্রজাও ক্ষতির সম্মুখীন হোক।”

জিন্নাত চমৎকার হাসলো। সন্তর্পণে এগিয়ে এসে রাজকন্যার ললাটে ছোট্ট একটা চুমু খেলো। আহ্লাদী হয়ে বলল,

“রাজকন্যা হূরিয়া.. সিরাজদী রাজ্যের প্রাণভোমরা। আমাদের সবার গর্ব,আশা,ভরসা। আমাদের প্রাণ। আমি যতদিন বাঁচবো কেবল এই দোয়াই করবো যেন প্রত্যেকটা ইতিহাসের পাতায় আমি তোমায় খুঁজে পাই। তোমায় এই স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষটাকে আমার রাজকন্যে হিসেবে ফিরে পাই। এটাই আমার আক্ষেপ থাকবে সারাজীবন। যতদিন বাঁচব। আমার সালাম তুমি সর্বদা স্বরণে রেখো রাজকন্যে। তোমায় আমি সারাজীবন এভাবেই পেতে চাই।”

রাজকন্যা মৃদু হাসলো। জিন্নাতের নরম তুলতুলে হাত দুটো স্পর্শ করে বলল,

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম জিন্নাত। আমিও আমার গোটা জীবনটাতে প্রত্যেকটা যুদ্ধে আমার জিন্নাতকে যেন সঙ্গে পাই। ঠিক এভাবেই। আমার বোন তুমি। আমার আদ্ধেক জীবন তুমি। তোমায় আমি ভীষণ ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে আগলে রেখেছি এতোকাল। জীবনের শেষ দিন অব্দি ঠিক এমন করেই আগলে রাখতে চাই।”

জিন্নাত জড়িয়ে ধরলো রাজকন্যাকে। রাজকন্যা স্মিত হেসে মাথায় হাত রাখলো জিন্নাতের। ফের বলল,

“এবার কিন্তু যেতে হবে। দেরী হচ্ছে।”

জিন্নাত মাথা জাগিয়ে চমৎকার হাসলো। বলল,

“চলো যাই।”

__

সুফির পিঠে রাজকন্যা আর জিন্নাত। সেনাপতি আতাউল তার ঘোড়ায়। তারা পৌঁছে গেছে গহীন জঙ্গলে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। ধোঁয়া কুয়াশার মতো অন্ধকার বিরাজ করছে চারপাশে। সুফি খুব সাবধানে হাঁটছে। আর তাকে অনুসরণ করছে সেনাপতি আতাউলের ঘোড়া। অবশেষে পৌঁছাল তারা। রাজকন্যা সুফির পিঠ থেকে নেমে পড়লো। একবার জিন্নাতকে দেখে ফের সেনাপতি আতাউলকে দেখলো। চোখের ইশারায় কিছু একটা বলে তাদের রেখেই রাজকন্যা প্রবেশ করলো ডাকাতদের ডেরায়। ওস্তাদজী এবং মেরাজ সেখানেই ছিলো। আকস্মিক রাজকন্যার আগমনে কিঞ্চিত ভড়কালেন তারা দু’জনে। ফের সামলে নিলেন নিজেদের। ওস্তাদজী রাজকন্যাকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে দেখতে অদ্ভুত রকমের হাসলো। মুখে বলল,

“এসো রাজকন্যা, এসো। আমার ছোট্ট সাম্রাজ্যে তোমায় সুস্বাগত।”

মেরাজ পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে দেখতে লাগলো রাজকন্যাকে। রাজকন্যার আগমনে সবার মাঝেই এক অদ্ভুত ভয় দানা বাঁধলো যেন। কেবল ওস্তাদজীই নয়৷ বাকি সবাই অদ্ভুত ভাবে ভয় পাচ্ছে রাজকন্যা হূরিয়াকে। হয়তো এর জন্য; ‘পাপের চূড়ায় এক ফালাক পূন্যতার ছোঁয়া পড়লো বলে।’

“ভাবিজী? সালাম ভাবিজী!”

সুর টেনে বলল মেরাজ। রাজকন্যা পাশ ফিরে দেখলো না তাকে। সে স্থীর দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে ওস্তাদজীর পানে। তার চোখমুখ একদম স্বাভাবিক। ক্ষণকাল এভাবে পেরিয়ে গেলে রাজকন্যাই আগে মুখ খুলে,

“উত্তরে সিরাজদী রাজ্য আপনার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন ওস্তাদজী। আপনি চাইলে এক্ষনি চলে যেতে পারেন। আপনার সিংহাসন আপনাকে সাদরে গ্রহণ করবে বলে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।”

ওস্তাদজীর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেলো যেন। তার এতোকালের স্বপ্ন.. আজ পূরণ হতে যাচ্ছে। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা।

আনন্দে ওস্তাদজী উল্লাস করছে মনেমনে। কিন্তু বাইরেটা রেখেছে একদম সাদামাটা। যেন এ কথায় বিশেষ কিছু নেই। খুবই স্বাভাবিক কথা।

“তুমি একা কেন? তোমার পরিবারের বাকি সদস্যরা কোথায়?”

ওস্তাদজী জিজ্ঞেস করে। রাজকন্যা জবাবে বলে,

“তারা সবাই আমার সঙ্গেই আছেন। এখানে আসেন নি অবশ্য। আব্বাজানের অপেক্ষায় জঙ্গলের বাইরে খোলা প্রান্তরে অপেক্ষা করছে সবাই। আব্বাজান কে নিয়ে আমরা অনেক দূরে চলে যাবো। আর কোনোদিন এই রাজ্যে ফিরবো না।”

“আর আমার মিত্র?”

“আপনার মিত্র নাজিমউদ্দীন রাজপ্রাসাদে আপনার অপেক্ষায় আছেন।”

ওস্তাদজীর আনন্দটা কিঞ্চিৎ খসে পড়লো। নাজিমউদ্দীন থাকা মানেই তাকে সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া।

“আমার আব্বাজান কোথায়? ঠিক আছেন তো উনি?”

রাজকন্যা আবারও প্রশ্ন করে। ওস্তাদজী নিজের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলে,

“একদম ঠিকাছেন। ঘুমচ্ছিলেন এতক্ষণ। এখন ঘুম ভেঙেছে।”

“ডাকুন তাকে।”

“হ্যাঁ- এই কে আছিস? রাজামশাইকে নিয়ে আয়।”

“এক মিনিট!”

ওস্তাদজী হুকুম করতেই রাজকন্যা বাঁধা স্বরূপ বলে ওঠে।

“কি হলো?” জানতে চায় ওস্তাদজী।

“ওরা কেন নিয়ে আসবে আমার আব্বাজানকে? আপনি কি করছেন? আপনি নিজে আমার আব্বাজানকে তার সাজে সজ্জিত করে নিতে আসবেন।”

ওস্তাদজী ক্ষেপা গলায় বলে ওঠে,

“আমি তাকে নিজর হাতে তৈরী করবো? অসম্ভব!”

“অসম্ভব কেন? আমি আপনাকে আমার গোটা রাজ্য দিয়ে দিচ্ছি আর আপনি আমার জন্য সামান্য এটুকুও করতে পারছেন না?”

“না পারছে না। ওস্তাদজী এই কাজ করতে পারবেন না। দরকার পড়ে আমি…”

মেরাজ কথাটা বলতে বলতে মাঝপথেই থামিয়ে দেয়। রাজকন্যার শীতল চাহনিতে ভড়কায় সে। মনে হলো ঐ দৃষ্টি দিয়ে বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করছে রাজকন্যা।

“আমি কোনো সংহার চাই না ওস্তাদজী। আমার সামান্য ইচ্ছে আপনি অবশ্যই পূরণ করতে পারেন।”

ওস্তাদজী ক্ষেপা দৃষ্টিতে তাকায় মেরাজের দিকে। কি দরকার রাজকন্যাকে রাগানোর। ভালোয় ভালোয় এসেছে আবার ভালোয় ভালোয় ফিরে যাবে। তা না!

“আমি পারবো। তুমি অপেক্ষা করো।”

#চলবে___