রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
236

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৪…

ভাঙা কুটিরে পদচারণ ঘটে রাজকন্যার। মাটির গৃহতলে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে নগর রাজ্যের রাজকুমার সাদ্দাত। তার ঠিক পাশেই আরহাম। আরহাম অবশ্য নিজের চেতনেই আছে। তবে জখম অবস্থায়। রেদোয়ান তার পাশে বসে খাবার তুলে দিচ্ছে মুখে। আরহাম নির্দ্বিধায় খাচ্ছে। কোনো রকম বাঁধা কিংবা নাকচ করার ভাব তার মুখে নেই।

রাজকন্যাকে দেখতেই রেদোয়ান কেমন চমকে উঠলো আকস্মিক। তার হাতে ধরে রাখা তালপাতাটা পড়তে পড়তে সামলে নিলো আরহাম। রেদোয়ান শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো একবার। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রাজকন্যাকে একবার দেখে আরহামের দিকে তাকালো। আরহামের দিকে তাকিয়ে তার ভয়টা যেন তরতর করে বেড়ে দিগুন হয়ে গেলো। -তবে কি রাজকন্যা সবটা জেনে গেছে? আরহামকে আর তাকে যে সরদার এখানে এনে রেখেছে? এবার কি হবে তার? রাজকন্যা কি পুরাদস্তুর মে/রে ফেলবে তাকে?

রেদোয়ান আর ভাবতে পারলোনা। কম্পিত আর দুর্বল দেহ খানা টেনে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। উদ্দেশ্য রাজকন্যার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া। মাফ চাইবে সে! অন্তত সরদার এখানে পৌঁছোবার পূর্বে নিজের প্রাণটুকু বাঁচাতে মাফ চাইবে। তাতে কি গলবে রাজকন্যার মন? নাকি তার পূর্বেই-

আবারও কেঁপে ওঠে রেদোয়ান। উদ্দেশ্য মাফিক তড়িঘড়ি রাজকন্যার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই সরদারকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে থমকে দাঁড়ায়। একি? সরদারই কি রাজকন্যাকে এখানে নিয়ে এলো? কিন্তু কেন?-

রাজকন্যা থমকায়। রাজকুমার আর আরহামকে পাশাপাশি দেখে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ তাকে তাড়না করতে লাগে। এই তো সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি! তার আব্বাজানের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর একমাত্র পুত্র। যার কথা শুনতে শুনতেই শৈশবের প্রায় অর্ধেকটা সময় সে অতিবাহিত করেছিলো। বড় হলে তাহার সঙ্গে বিবাহের মতো এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে দু’জনে। বাকি সারাটি জীবন একত্রে, হাত ধরেই পার করবে। সেসব ছিলো এক সহজসরল পথচলার দিবাস্বপ্ন। যা চোখ মেলে তাকাতেই কোথায় যে হারিয়ে যেতো জানা নেই তার। তবে সেই স্বপ্ন আজ কেবলই স্বপ্ন। তা যে আর কোনো কালেও বাস্তব হওয়া সম্ভব নয়। কেননা তার ভাগ্য মিলে গেছে অন্যকারোর সঙ্গে। যাকে সে কোনো দিন দুঃস্বপ্নেও আনেনি ঠিক এমনই কারোর সঙ্গে।

“দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? আসুন?”

আয়াসের মৃদুস্বর কানে এসে ঠেকতেই ভাবনায় ছেদ পড়লো রাজকন্যার। যার পরিপ্রেক্ষিত কিঞ্চিৎ চমকালো সে। অতঃপর চমকা চমকির পালা শেষ করে পাশ ফিরে দেখলো আয়াসকে। কিছু বলল না। আয়াস উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলো। রাজকন্যা আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাজকুমারকে দেখলো। খানিকটা ক্রোধযুক্ত কন্ঠে বলল,

“রাজকুমারকে ঠিক কত দিন যাবত এমন অচেতন করে রাখা হয়েছে?”

রেদোয়ান ভয়ের দরুন বারবার ঢোক গিলছিলো। রাজকন্যার হঠাৎ এখানে আগমন তার বোধগম্য হচ্ছে না। উপরন্তু তার প্রশ্ন! সবটাই তার মাথার এক হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে।

আয়াস স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেঁটে এসে রেদোয়ানের পাশে দাঁড়ালো। অতঃপর অচেতন রাজকুমারের দিকে একবার দৃষ্টি বুলালো।

“মোট ৩০দিন।”

রাজকন্যা চকিতে তাকালো।

“বলছেন কি আপনি? ত্রিশটা দিন.. মানে পুরো একটা মাস রাজকুমারকে এমন অচেতন করে রেখেছেন? আ্ আপনি কি মানুষ?” ক্রুদ্ধ স্বরে কথা গুলো বলে গেলো রাজকন্যা।

আয়াস ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে কয়েক মুহুর্ত নিশ্চুপ হয়ে রইলো। অতঃপর বলল,

“একাধারে চব্বিশ ঘন্টা তাকে অচেতন করে রাখা হয়েছে তা কিন্তু বলিনি। যে নিদ্রাবি/ষ রাজকুমারকে দেওয়া হতো তা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকতো। এই যেমন রাতের প্রথম প্রহর থেকে দ্বিপ্রহর(দিন-দুপুর) অব্দি। ওখানে রাজকুমারকে দেখার জন্য লোক ছিলো। তাকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে যেকোনো প্রয়োজন সবটাই তারা দেখতো। আমি রাজকুমারের উপর কোনো জু/লুম করিনি রাজকন্যা। নিতান্তই আমার প্রয়োজনে তাকে
নিদ্রাবি/ষ দেওয়া হতো।”

সবটা শুনে কোনো প্রত্যুত্তর করলো না রাজকন্যা। স্রেফ ছোট্ট করে বাক্য আওড়ালো,

“রাজকুমার এবং আরহামকে প্রাসাদে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

আয়াস আর জবাব আওড়ালো না। রাজকন্যার আদেশ অনুযায়ী লেগে পড়লো কাজে।

রেদোয়ান এখনও স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি সবটা না বুঝলেও প্রয়োজন অনুযায়ী বুঝে নিলো। তাই আর দাঁড়িয়ে না থেকে লেগে পড়লো আয়াসকে সাহায্য করতে।

_______

নিজের কক্ষে এসে চুপটি করে বসে পড়লো রাজকন্যা। রাতের প্রথম প্রহর। কবিরাজ মশাইকে ডাকা হয়েছে রাজকুমার এবং আরহামের চিকিৎসার জন্য। আয়াস জেদ করে বলল,-আপনাকেও চিকিৎসা নিতে হবে।”

কিন্তু রাজকন্যা দিগুণ জেদ দেখিয়ে নিজের চিকিৎসা নিলো না। কবিরাজ মশাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে চলে এসেছে নিজের কক্ষে। আজ সে বড্ড ক্লান্ত। ক্লান্ত নিজের কাছে,নিজর ভালোবাসার কাছে। ক্লান্ত এই গোটা সাম্রাজ্যের কাছে। কি করে লড়বে সে প্রিয় মানুষটার সাথে? কি করে ত/লো/য়ারঘাত করবে ঐ মানুষটাকে, যাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। সে যে এতো অন্যায়, এতো ব্যভিচার করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। ক্ষমা করে দিলেও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। কিন্তু সে কিছুতেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবেনা। এটা তার ধর্ম নয়। আয়াসকে শাস্তি পেতেই হবে-

রাজকন্যা ছটফট করতে করতে উঠে দাঁড়ালো। বড়বড় করে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে এগোলে দরজার দিকে। আয়াসকে শাস্তি দিতে হবে- বাক্যটা বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো মস্তিষ্কে। নিমিষেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো সে। নিজের দুর্বলতার কাছে।

“রাজকন্যা! কেন বন্দী করেছো তোমার চাচাজানকে? দু’দিন হলো রাজ সিংহাসনের হাওয়া গায়ে লাগলো কি, এর মাঝেই সাপের পাঁচ দেখেছো তুমি? কত বড় স্পর্ধা হয়েছে তোমার? আমি তো অবাক না হয়ে পারছিনা!”

একাধারে চাচীজানের উত্ত্যক্ত গলার স্বর কাঁপিয়ে তুললো রাজকন্যার কক্ষকে। রাজকন্যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকালো সম্মুখে। চাচীজান এবং আলিয়া দাঁড়িয়ে আছে তার কক্ষের দরজায়। চোখে মুখে ক্ষোভের রেশ ফুটে উঠেছে চাচীজানের। যেন এক্ষনি চোখ দিয়েই তিনি গিলে খাবেন রাজকন্যাকে।

“আমি তো আপনাদের আগেই বলেছিলাম আম্মাজান, হূরিয়াকে সিংহাসনে না বসিয়ে ভাইয়াজান বসানোই উত্তম পরিকল্পনা।”

“আলিয়া! আমি বড় বোন তোমার। সম্মান দিয়ে কথা বলতে শেখো!”

উচ্চস্বরে ধমক দিলো রাজকন্যা। আলিয়া নিভলো না। বরং চোখ মুখ রাঙিয়ে তাকিয়ে রইলো রাজকন্যার রাগান্বিত মুখমন্ডলে।

“ওকে তোমার সম্মান করতে না শেখালেও চলবে রাজকন্যা! আগে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। কোন অপরাধে বন্দী করেছো উনাকে? কি দোষ উনার? উপরন্তু ভোর থেকে নিখোঁজ আমার পু্ত্র! কোথায় সে? তাকে আবার কোথায় বন্দী করেছো তুমি?”

রাজকন্যা চমকায়।

“আদিম নিখোঁজ! এসব আপনি কি বলছেন?”

“এমন ভাব করছো যেন এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা ইতিপূর্বে এই প্রথম শুনলে?”

রাজকন্যা ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকালো চাচীজানের মুখপানে। চিন্তান্বিত মুখ করে তাদের উপেক্ষা করেই দ্রুত বের হতে চাইলো নিজের কক্ষ থেকে। তবে দু’পা এগোবার পূর্বেই পেছন থেকে তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন চাচীজান। রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললেন,

“তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাই আমি! আমি তোমায় একটা প্রশ্ন করেছি আর তুমি কি না তা এত সহজে উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছো?”

“আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চাইতেও আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আদিমকে খুঁজে আনা। আমি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার অহেতুক প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজের মূল্যবান সময় গুলোকে অপচয় করতে পারবোনা!”

“হুূরিয়া!”

বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন চাচীজান।

“এতো গলার জোর কেমন করে দেখাচ্ছো বলোত? কিসের ভিত্তিতে? ঐ সিংহাসনের জন্য? জানো এতকাল যাবত ঐ সিংহাসনকে আগলে রাখার জন্য কতটা করেছেন তোমার চাচাজান? তোমায় কোলেপিঠে করে কতটা কষ্ট করে মানুষ করার পাশাপাশি ঐ সিংহাসন আগলে রেখেছেন উনি! তোমাদের জন্য এতো সব করার পর এই প্রতিদান তার? এই পুরষ্কার?”

চাচীজান অনর্গল বলে গেলেন। রাজকন্যা নিজেকে শান্ত করতে হাসলো। তার ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসি দেখে জ্বলে উঠলেন চাচীজান। কিছু বলবেন,তার পূর্বেই বলে উঠলো রাজকন্যা,

“আব্বাজান নিখোঁজ হয়েছেন ঠিক এক যুগ পেরোলো চাচীজান! কই? কোনোদিন কি একবারের জন্যও তার খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন মানুষটা? নাহ্। যাননি। অথচ তার সিংহাসনকে সযত্নে আগলে রেখেছেন তিনি। আম্মাজানকে কবিরাজ মশাই ওলট-পালট ঔষধি খাওয়াচ্ছিলেন। কই? তখন কি একবারের জন্য জানতে চেয়েছিলেন এর পেছনে কার হাত আছে? নাহ্। জানতে চাননি। বরং এক কথায় তাকে জল্লাদ ডেকে গর্দান নেওয়ার হুকুম দিলেন। আর যখন সে আমার বিবাহ ঠিক করলেন নগর রাজ্যের রাজকুমার সাদ্দাতের সঙ্গে? একবারও কি খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন রাজকুমার কোথায় আছে,কি অবস্থায় আছে,কোন পরিস্থিতিতে আছে কিংবা রাজকুমার আসলেও বেঁচে আছে কিনা? নাহ্। নেয়নি খোঁজ। বরং সে ইচ্ছে করে আমার থেকে সবটা লুকিয়ে আমাকে বিবাহ দিলো! কার সঙ্গে? একজন ডাকাত সরদারের সঙ্গে! এতসব ঘটনা ঘটনার পরও আমি কোনোদিন তাকে একটা প্রশ্নও করিনি! কেন জানেন? কারন, তাকে আমি পিতৃ সমতুল্য মানি। তাকে আমি নিজের আব্বাজানের বরাবর একজন ভাবী, চাচীজান। কিন্তু যখন দেখলাম তার অন্যায়, অবিচার দিনদিন বেড়েই চলেছে তখন আর চুপ থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলোনা। সেদিন রাজসভায় যে লোকটা বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে ছটফট করতে করতে ম/রে গেলো সেদিনই ভেবে নিয়েছিলাম এই অন্যায় এবার বন্ধ হবে। যেকোনো মূল্যে।”

“তাই বলে নিজের চাচাজানকে তুমি কারাগারে বন্দী করবে রাজকন্যা?”

“এটা আমার রাজ্য চাচীজান। এখানে কেবল আমার শাসন চলবে। আর আমার শাসন সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আমার এই রাজ্যে অন্যায়ের কোনো স্থান নেই। আগেও ছিলো না। আজও হবেনা।”

রাজকন্যার একেকটা বানীতে দমে গেলেন চাচীজান। তার মুখ থেকে আর একটা শব্দও বেরোলা না৷ নিশ্চুপ হয়ে রইলেন তিনি। রাজকন্যা আর দাঁড়ালো না। বড় বড় ধাপ ফেলে চলে গেলো দৃষ্টির অগোচরে।

#চলবে___

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
_২৫_

“আদিম সম্পূর্ণ ঠিক আছে এবং সুরক্ষিত আছে।”

তাড়াহুড়ো করে রাজপ্রাসাদ থেকে বের হতে নিলেই পেছন থেকে ভেসে আসে আয়াসের গলা। রাজকন্যা দাঁড়িয়ে পড়ে। তার চোখে মুখে মুষড়ে পড়া ভাব। হতাশায় নিমজ্জিত। পেছন মুড়ে তাকালো রাজকন্যা। আয়াসের এমন উক্তিতে শুঁকিয়ে যাওয়া গলাটা অল্প হলেও ভিজে এলো। প্রশান্ত হলো ছটফট করা মনটা। না চাইতেও বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের আনাগোনা হলো।

“কোথায় আছে আদিম?” তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চায় রাজকন্যা।

আয়াস দু’পা এগিয়ে আসে। তার নিজস্ব অভিব্যক্তি ব্যক্ত রেখে বলে,

“আপনাকে খুঁজতে প্রসাদ থেকে আমি আর আদিম একত্রেই বেরোই। তবে আপনাকে খোঁজার সেই পুরোটা সময় আমি চাইলেও আদিমকে আমার সঙ্গে রাখতে পারতাম না। তাই মাঝপথে পরিকল্পনা মাফিক ইচ্ছে করেই আমার লোক দিয়ে নিজেদের উপর হামলা করাই। ঘটনার এককালে আদিমের মাথার পেছনটাতে আঘাত লাগে। আর সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায় ও। আর তারপর ওকে একটা সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘন্টা ব্যাপী ওর জ্ঞান ফিরে আসার কথা। জ্ঞান ফিরতেই ওকে প্রাসাদে সুরক্ষিত অবস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”

সবটা শুনে পূণরায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাজকন্যা। অতিষ্ঠ স্বরে বলে ওঠে,

“কসম আল্লাহর! ঠিক যতবার ভাবী আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিবো ঠিক ততবারই আপনি আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন আপনি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যই নন। সেই এক যুগ পূর্ব থেকে আপনি কেবল আমার ক্ষতিই করে এসেছেন! প্রথমত আমার আব্বাজানকে কেঁড়ে নিয়ে অতঃপর একের পর এক আমার প্রিয়জনদের কেঁড়ে নিয়ে। আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো? আমাদের কি কোনো পূরণো শত্রুতা ছিলো.. কোনোদিন কি..

বলতে বলতে থেমে গেলো রাজকন্যা। আকস্মিক কিছু একটা মনে পড়তেই আতংকে তার চোখ মুখ ভরে উঠলো। আয়াস তাকিয়েই ছিলো তার দিকে। হঠাৎ তার মুখের এহেম পরিবর্তনে চিন্তান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,

” কি হলো? কি ভাবছেন!”

রাজকন্যা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে আয়াসের সম্মুখে দাঁড়ালো। শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে ভীত মনে প্রশ্ন করলো,

“আচ্ছা,মেরাজ আপনার কি হয়?”

আয়াসের কপাল কুঁচকে এলো। ভাবুক কন্ঠে আওড়ালো,

“কি হবে?”

“মানে, ও আপনার কিছু হয়না?”

“না। ও আমার কিছুই হয়না। আব্বাজানের হয়। আপনি যার খোঁজে গিয়েছিলেন, মানে আপনার ফুপুআম্মার স্বামী! মেরাজ নাজিমউদ্দিন এবং বেগমজির পুত্র।”

রাজকন্যা আঁতকে উঠে দু’কদম পিছিয়ে পড়লো। বড়বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে ডুব দিলো অতীতে।

তবে কি মেরাজ সেই লোকমুখে বলা মৃ/ত সন্তান? যে আসলে কোনোদিন ম/রেইনি। বরং তাকে অপহরণ করা হয়েছিলো জন্মের ঠিক কয়েক মুহুর্ত পরেই।

“আপনার কি হয়েছে বলুন তো? কি এতো ভাবছেন আকাশ-কুসুম?”

রাজকন্যা আয়াসের স্থীর দৃষ্টি খানার দিকে তাকালো। সন্দিহান মনে জানতে চাইলো,

“আপনি কি জানেন সেই ইতিহাস?”

“কোন ইতিহাস?”

“কেন মেরাজের জন্মের পরমুহূর্তেই তাকে অপহরণ করা হয়েছিলো? কেন ফুপুআম্মার কোলে একটা মৃ/ত সন্তান তুলে দেওয়া হয়েছিলো? আর কেন নাজিমউদ্দিন নিজেকে মৃ/ত বলে ঘোষণা দিয়েছিলো?”

আয়াস স্থবির হয়ে গেলো আচমকা। যেন এমন আশ্চর্যজনক কথা সে ইতিপূর্বে কোনোদিন শোনেনি। উদ্বিগ্ন কন্ঠে আওড়ালো,

“এসব আপনি কি বলছেন রাজকন্যা? ঘটনা তো এরকম কখনো ঘটেইনি। বরং বেগমজি এবং রাজামশাই পরিকল্পনা করেই নাজিমউদ্দিনকে এই প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করেছিলো। এমনকি তাদের সদ্যোজাত সন্তানও এই ব্যভিচার থেকে ছাড় পায়নি। উনারা ওকেও বিতাড়িত করেছিলো তার আব্বাজানের সঙ্গে।”

রাজকন্যা মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“মানে! এসব আপনাকে কে বলেছে?”

“কে আবার! আমার আব্বাজান বলেছেন।”

রাজকন্যা থমকালো। আর কিছু বলতে আকস্মিক বাঁধা দিলো তার মস্তিষ্ক। যেন এখানে নিরব থাকাই বাঞ্ছনীয়।

ভাবনায় ডুব দিলো রাজকন্যা। ডাকাত কুঠুরিতে এই মিথ্যে রটালো কে? আয়াস নিজেই যেহেতু সবটা ভুল জানে এর মানে তার আব্বাজানও ভুলটাই জানে। কিন্তু নাজিমুদ্দিন তো সবটা সঠিক জানে। এবং যতদূর ধারণা এই সব কিছুর মুলে নাজিমউদ্দিনেরই হাত আছে। তবে তার নিজেরই লোকদের এতো বড় সত্যিটা না বলে লাভটা কি হলো উনার? ঐ ডেরায় এই সত্যি আর কে কে জানে? নাকি কেউই জানেনা? আচ্ছা,মেরাজ কি জানে?

“মেরাজ জানে এই প্রাসাদে তার আম্মাজান থাকেন?”

রাজকন্যা উৎসুক নয়নে শুধালো। আয়াস কপাল কুঁচকে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। অর্থাৎ জানে।

“জেনেও কখনও নিজের মাকে একবারও দেখতে চাইলো না?”

“এমন মাকে কোন পুত্রই দেখতে চাইবে,যে মা জন্মের পরমুহূর্তেই নিজের সন্তানকে নিজের থেকে আলাদা করে দেয়!”

“তবুও! আক্ষেপ হলোনা কোনোদিন?”

আয়াস অদ্ভুত হাসলো। একরাশ অসহায়ত্বতা ঢেলে পড়লো তার বাজপাখির ন্যায় ঐ দৃষ্টিতে। নিমিষেই কেমন বিষাদে ভরে উঠলো তা।

“জানিনা। কিন্তু আমার বরাবরই ভীষণ আক্ষেপ ছিলো নিজের আম্মাজানকে এক নজর দেখবার। কিন্তু কি করেই বা দেখতাম! সে যে আমায় জন্ম দিতে গিয়েই..”

কথাটা শেষ করার পূর্বেই আয়াসের স্বর মিইয়ে এলো। নিজের মায়ের মৃ/ত্যুর কথাটা সে নিজ মুখে কোনোদিনই উচ্চারণ করতে পারেনি। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বড়বড় করে বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এখন যে তাকে ফিরতে হবে। তার ফেরার সময় হয়ে এসেছে।

“কোথায় যাচ্ছেন?”

উদগ্রীব কন্ঠে ডেকে উঠলো রাজকন্যা। আয়াস দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন মুড়ে চমৎকার হাসলো।

“আমায় এবার ফিরতে হবে!”

“কোথায়?”

“নিজের বেশে। নিজের ডেরায়।”

রাজকন্যার কন্ঠনালি থেমে যায়। এই মুহুর্তে মানুষটাকে কি বলে আটকানো উচিৎ জানা নেই তার। ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত রকমের তাড়না হচ্ছে। যেন তাকে আটকাতে না পারলে সে ম/রে যাবে। দম বন্ধ হয়ে ম/রে যাবে।

“আ্ আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আমার প্রত্যেকটা প্রশ্নের জবাব নেওয়া এখনও বাকি!”

আয়াস দুর্বোধ্য হাসলো। কপালের কোন চুলকে বলল,

“আপনি প্রশ্ন করুন,আমি জবাব দেবো।”

“আমার আব্বাজান কোথায়?”

“রাজামশাইকে এতোদিন যাবত ডেরাতেই বন্দী রাখা হয়েছে। গত কয়েক দিন পূর্বে হঠাৎই তাকে কোথাও একটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোথায় পাঠানো হয় জানিনা আমি। আব্বাজানকে জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন, তিনি সুরক্ষিত আছেন। এতো সহজে তাকে মা/রবেনা।”

সাবলীল গলায় বলে গেলো আয়াস। রাজকন্যা ফোঁস করে উঠলো,

“এতো সহজে তাকে মা/রবেনা মানে! আমি আপনাকে বলে রাখছি আয়াস, আমার আব্বাজানের উপর যদি এতোটুকু আচ আসে তবে আমি লণ্ডভণ্ড করে দেবো আপনাদের ঐ কালো দুনিয়া।”

“হু মা/রবেনা। আর মা/রবেনা ঠিক দিন অব্দি, যতদিন অব্দি আব্বাজান এবং নাজিমউদ্দীন এই রাজ্যের সিংহাসনে বসতে না পারে। এই রাজ্য নিজেদের দখলে করতে না পারে।”

“ঠাট্টা করছেন আপনি?”

“সত্যি বলছি।”

“এতোদিন পর হঠাৎ এই পরিকল্পনা কেন? এই এক যুগে কেন বসলো না সিংহাসনে। তখন তো আটকাবারও কেউ ছিলো না।”

“ছিলো!”

“ছিলো?” উদ্বিগ্ন মনে শুধালো রাজকন্যা।

“জি। ছিলো। আর সে হলো সেনাপতি আতাউল এর পিতা, শহীদ সেনাপতি মির্জা আবদুল্লাহ। তিনিই এই এক যুগ আপনার গোটা সাম্রাজ্যটাকে রক্ষা করেছেন। একা। নিজ হস্তে। এক ফোটা আচ আসতে দেয়নি কোনো দিন।”

‘শহীদ সেনাপতি মির্জা আবদুল্লাহ’ নামটা শুনতেই বুকের ভেতর শূন্য জায়গাটা কেমন হাহাকার করে উঠলো রাজকন্যার। গতবার ঠিক এমনই একটা সময়ে তাকে কারা যেন নৃশংস ভাবে হ/ত্যা করে দি/খন্ডিত মাথাটা ঝুলিয়ে রেখে দিয়ে যায় নিজেরই কক্ষে। তার এমন ভয়াবহ দশা দেখে জ্ঞান হারিয়েছিলো রাজকন্যা। তারপর থেকে ঠিক কত রাত যে নির্ঘুম কেটেছে তার,হিসেব নেই।

“তার এমন বিভৎস হত্যাকাণ্ডের পেছনে অবশ্য মেরাজের ক্ষোভ ছিলো প্রচন্ড। আব্বাজান ওকে বলেছিলো মির্জা আবদুল্লাহকে মেরে ফেলতে। কিন্তু তাকে এমন বিভৎস ভাবে মারার হুকুম দেওয়া হয়নি। উনার একটা কন্যা ছিলো। আর ঐ কন্যাকে প্রথমবার দেখতেই মেরাজের মাথা খারাপ হয়ে যায়। অনেকবার প্রচেষ্টা চালায় ওকে তোলার। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয় মির্জা আবদুল্লাহ-র জন্য। যে কিনা গোটা একটা রাজ্যকে রক্ষা করে আসছে তার কাছে নিজের ছোট্ট মেয়েটাকে রক্ষা করা দুধভাত ছিলো। আর তখন থেকে মেরজের ক্ষোভ রয়ে যায় উনার উপর। আর যখন সুযোগ এলো তখন তো..”

“সায়েরা বুবুকে ওমন পশুর মতো ধর্ষণ করে নিজের পিতার পায়ের কাছে বিবস্ত্র করে ফেলে রাখা মানুষটা মেরাজই ছিলো?”

“হু!” (উপর-নীচ করে মাথা নেড়ে)

রাজকন্যার শরীর ভেঙে আসতে চাইলো। তাড়নায় বুঁজে আসতে চাইলো নেত্রজোড়া। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো চাপাকান্নাগুলো। দু’হাতে কপাল চেপে ধরলো। রাগে,দুঃখে ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে সব কিছু। একদম সব কিছু।

রাজকন্যার এমন দশা দেখে ছুটে এলো আয়াস। তার বাহু আগলে সামলে নিতে নিতে বলল,

“কি হলো আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?”

রাজকন্যার চোখ ফেটে কান্না এলো। কিন্তু কাঁদতে পারছেনা। আয়াসের ছোঁয়ায় এক বিষ যেন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গে। আয়াসকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,

“আপনিও ওদেরই একজন! প/শু,জা/নোয়ার ঠিক ওদেরই মতো। আপনারা ভালোবাসতে পারেন না। কেবল হিংস্র দানবের মতো ধ্বংস লীলা করতে পারেন। হ্যাঁ, আ্ আপনারা ভালোবাসতে পারেন না।”

“পারি! পারি.. আমরাও ভালোবাসতে পারি। এবং আমি ভালোবেসেছি। হু। ভালোবেসেছি আমি। আপনাকে। আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। আর ভালোবেসেই নিজের হিংস্র দানবী খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। হ্যাঁ মনোহরীণি! আপনাকে ভীষণ ভালোবেসে নিঃশ্ব করেছি নিজেকে।”

দৃঢ় কন্ঠে বলে গেলো আয়াস। রাজকন্যা কয়েক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে বজ্রকন্ঠে জবাব দিলো,

“হ্যাঁ, ভালোবেসেছেন আপনি। আর ভালোবেসেই সর্বপ্রথম মে/রে ফেলতে চেয়েছেন আমার আম্মাজানকে। আমার সবচেয়ে কাছে মানুষটাকে। গোপনে,নৃশংস ভাবে! আর তার জন্য কাকে হাত করলেন? আমাদের সবচেয়ে বিশ্বাস যোগ্য মানুষটাকে। কবিরাজ মশাইকে! যেন কিছু ঘটে গেলেও আমরা বুঝতে না পারি এটা একটা হ/ত্যার পরিকল্পনা ছিলো। যখন কবিরাজ মশাই বন্দী হলো, এতো প্রহারের পরেও মানুষটা মুখ খোলেনি। কারণ তার একমাত্র কন্যাকে একদল হায়না তুলে নিয়ে আঁটকে রেখেছে। তারা প্রয়োজন পড়তেই ষোড়শীর নরম শরীরটাকে ক্ষুধার্ত কু/কুরের ন্যায় খাবলে খাবলে খেয়েছে। হ্যাঁ, ভালোবেসেছেন আমায়। আর ভালোবেসেই, রাজকন্যাকে দুর্বল রাখতে কবিরাজ মশাইকে ভয়ানক মৃত্যু উপহার দিয়েছেন। হু,ভালোবেসেন আমায়। আর ভালোবেসেই আরোভিকে নিজ হাতে হ/ত্যা করে নিজেই গায়েব হয়ে গিয়েছেন। যেন রাজকন্যা ভুল করেও আপনাকে সন্দেহ করতে না পারে। মূর্খ আপনি। আপনি নিজেও জানেন এই বোকা রাজকন্যা ঠিক কতটা ভালোবেসেছিলো আপনাকে। অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে আপনাকে। আপনি যদি আরোভিকে হ/ত্যা করে র/ক্ত মাখা ছুরি নিয়েও আমায় বলতেন, আমি তবুও কোনোদিন বিশ্বাস করতাম না আরোভিকে সত্যিই আপনি হ/ত্যা করেছেন। ঠিক এতোটাই বিশ্বাস করেছিলাম আপনায়। ঠিক এতোটাই ভালোবেসেছিলাম আপনাকে।”

“হ্যাঁ, আয়াস ভালোবেসেছিল তোমায় রাজকন্যে। আর ঠিক এতোটাই ভালোবেসেছিলো যে আমায় অগ্নিশিখার কারাগারে বন্দী করে ক্রমাগত নি/পীড়ন, নি/র্যাতন করতে করতে মৃ/ত্যুর দুয়ার অব্দি দাঁড় করিয়ে দিতেও তাহার হাত কাঁপলো না। ঠিক এতোটাই ভালোবেসেছিলো তোমায়।”

রাজকন্যার কথার পৃষ্ঠে জিন্নাতের মোহিত কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই চমকে উঠলো রাজকন্যা। একই সঙ্গে আয়াসও। জিন্নাতকে পূর্বের ন্যায় সুস্থ সবল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক মুহুর্তের জন্য রাজকন্যার চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো আনন্দে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার কন্ঠে এমন উক্তি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। বুকের ভেতরটায় যেন কেউ হাহাকার করে উঠলো। দম আঁটকে এলো তার। আয়াসের মুখ পানে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো তার তাড়নায় ভরা মুখশ্রী! সে কি ঠিক শুনেছে? তার জিন্নাতের ওমন মরন দশা করার পেছনে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটারই হাত ছিলো?

#চলবে__

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৬;

“শেষ পর্যন্ত জিন্নাতকেও আপনি ছাড়লেন না!” রাজকন্যার কম্পিত কণ্ঠ ভেসে এলো। আয়াস বিমূঢ় হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলো। অক্ষিপট বন্ধ করলো। বুক ফুলিয়ে বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর মুখ উঁচিয়ে তাকালো রাজকন্যার পানে। ভেতরটা ছারখার হচ্ছে তার। তার জীবনটা এমন কেনো হলো? কেন সে ডাকাতই হলো? কেন জন্মের পর এই প্রাসাদটাই হলো না তার আসল ঠিকানা। যদি কোনো দাসীর গর্ভেও তার জন্ম হতো তবেও তো থাকতে পারতো এই প্রাসাদে। থাকতে পারতো রাজকন্যার আশেপাশে। দেখতে পারতো তাকে তৃপ্তি ভরে। তখন নিশ্চয়ই তার নামের সাথে জুটতো না কোনো কালিমা। নিজের উদ্দেশ্য,নিজের নাম বাঁচাতে নিশ্চয়ই করতে হতো না এতো
অ/ন্যায়,অ/বিচার,নি/পীড়ন! কেন তার জন্মটাই
পা/প হলো? কেন!

“রাজকন্যা! আমি আপনাকে সবটা খুলে বলতে…”

“খামোশ!”

রাজকন্যার ত/লোয়ার বিঁধল গিয়ে আয়াসের বক্ষস্থলে। ফ্যাচ করে কে/টে গেলো এক দলা চা/মড়া। ওমনি গল গল করে র/ক্ত পড়তে আরম্ভ করলো। আয়াস থমকে গেলো! তার পদতল অচল হয়ে পড়লো সেখানেই। এক চিনচিনে ব্যথায় আকস্মিক তার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। গলার কাছে রগ গুলো ফুলেফেঁপে উঠলো। অক্ষগোলকোর চারিকোণ কেমন র/ক্ত মুখো হয়ে উঠলো। আকস্মিক আক্রমণ তার বোধগম্য হতে নেহাতই অনেকটা সময় লেগে গেলো।

রাজকন্যার বজ্রকন্ঠ এখনও যেন ঝংকার তুলে চলেছে উপস্থিত মহলে। চারপাশের প্রহরীরা ভয়ে কাবু হয়ে গেলো। রাজকন্যা তাদের তথাকথিত রাজকুমারকে এমন করে আঘাত করলো? কিন্তু কেন?

আয়াস হা করে দম ছেড়ে দিলো। আর ঠিক তার পরপরই ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে আরম্ভ করলো। মুখ উঁচিয়ে রাজকন্যার অগ্নিমূর্তির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চমৎকার হাসলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বুলি আওড়ালো,

“আমি আপনাকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি রাজকন্যা। তাই আপনার প্রত্যেকটা আঘাত আমার শিরোধার্য প্রনয়ণী। ভালোবাসি। ভীষণ।” বলতে বলতে বক্ষস্থলে হাত চাপলো আয়াস।

“প্রহরী!”

আবারও রাজকন্যার বজ্রকন্ঠ প্রতিধ্বনি তুললো উপস্থিত মহলে। পাঁচ ছ’জন প্রহরী ছুট্টে এলো রাজকন্যার সম্মুখপানে। মাথা নত করে ‘আদেশ করুন,রাজকন্যা’ বলে নিশ্চুপ দাঁড়ালো।

“বন্দী করো এই অর্বাচীনকে। এক্ষনি।”

আয়াসের সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠলো। র/ক্ত পড়লো জোয়াল দিয়ে। রাজকন্যা অগ্নিমূর্তির ন্যায় স্থীর দাঁড়িয়ে আছে। জিন্নাত সমস্তটা দেখে রাজকন্যার পাশে এসে দাঁড়ালো।

“রাজকন্যে,শান্ত হও। এখন তুমি ক্রোধে। ক্রোধান্বিত অবস্থায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিওনা যেন পরে পস্তাতে হয়।”

রাজকন্যা কানে নিলো না জিন্নাতের কথা। আবারও গর্জে উঠলো,

“কি হলো? কথা কানে গেলো না?”

প্রহরীরা ভয়ে কেঁপে ওঠে। নিজেদের প্রান রক্ষার্থে আয়াসকে বন্দী করে নিয়ে যায় কারাগারের দিকে। আয়াস সবটা হাসিমুখে বরন করে নেয়। তার মুখে বিন্দুমাত্র রাগ,কিংবা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নেই। সে হাসিমুখে চলে গেলো। যা দেখে রাজকন্যা আর শক্ত থাকতে পারলোনা। তার ইচ্ছে করলো চিৎকার করে কাঁদতে। সে পারছেনা আয়াসকে এতো কষ্ট দিতে। মরে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু আর যে কোনো উপায় নেই। ওস্তাদজী এবং নাজিমউদ্দীনকে মাত দিতে হলে আয়াসকে বন্দী করতেই হতো।

“কে কোথায় আছো? পন্ডিত মশাইকে ডেকে পাঠাও।”

কথাটা বলতে বলতে রাজকন্যা এগিয়ে গেলো রাজসভার দিকে। দু’জন প্রহরী তার আদেশ শোনা মাত্র ছুটলো পন্ডিত মশাইকে খবর দিতে। কিছু সময় পেরোতো পন্ডিত মশাই এসে হাজির হলো। রাজকন্যাকে সিংহাসনে বসে থাকতে দেখে কোমল হাসলো।

“স্বরন করেছেন রাজকন্যা?”

“হ্যাঁ পন্ডিত মশাই। আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।”

“আজ্ঞা করুন।”

“এখখানা পত্র লিখতে হবে।”

“যথাআজ্ঞা।”

পন্ডিত মশাই পত্র এবং কালী নিয়ে বসে পড়লেন। রাজকন্যা ধীরে ধীরে প্রত্যকটা কথা উপস্থাপন করলেন পন্ডিত মশাইয়ের সামনে। পন্ডিত মশাই নির্ভুল লিখে গেলেন সমস্তটা। লেখা শেষ হতেই পত্র খানা এগিয়ে দিলেন পন্ডিত মশাই। রাজকন্যা সবটা প্রথম থেকে পড়ল। নির্ভুল লেখা গুলো চোখে লাগার মতো। এই পত্র লেখা দিয়েই তবে শুরু হোক ডাকাত দল এবং রাজকন্যার যুদ্ধ।

রাজকন্যা প্রহরী ডাকলো। পত্র খানা এগিয়ে দিলো তাদের পানে। আদেশ করলো এই পত্র নিরাপদে যেন ডাকাতদের ডেরায় পৌঁছে যায়। এমনকি সরাসরি ওস্তাদজীর হাতে পড়তে হবে। এটুকু নিশ্চয়তা নিয়ে তবেই ফিরবে তারা। প্রহরী দু’জন পত্র খানা নিয়ে চলল ডাকাতদের ডেরায়। রাজকন্যা এবার একটু নিশ্চিন্ত হলো।

_____

কারাগারে বন্দী আয়াসের কাছে হাজির হলো প্রহরীরা৷ হাতে কাটাঘায়ে লাগানোর জন্য ঔষধী। তারা রাজকন্যার হুকুমে এসেছে এখানে। এই হুকুম পালন করতে আয়াসের হাতে নিজের জীবনও দিতে রাজি। অবশ্য ঘটনা কিঞ্চিৎ তেমনটাই হয়েছে। আয়াস রক্তিম চাহনিতে যেমন করে দেখেছিলো ওদের। মনে হয়েছে এই চাহনিতেই ওদের মৃত্যু অনিবার্য।

“রাজকুমার! আপনি দয়াকরে ঔষধী লাগাতে দিন। নয়তো রাজকন্যা আমাদের গর্দান নিবেন।”

অসহায় কন্ঠে বলল একজন প্রহরী। বাকিরা তার সঙ্গে সায় দিয়ে তুমুল গতিতে মাথা নাড়লো। কিন্তু আয়াস ভ্রুক্ষেপহীন। তার দৃষ্টি ঐ প্রবেশ পথের দিকে। আশা ছিলো রাজকন্যা নিজেই আসবে। হয়তো অনেক কথা শোনাবে,কিন্তু আসবে। আসবেই। কিন্তু এলো না রাজকন্যা। পাঠালো কেবল এই অধমদের।

“আমি ওসব ঔষধি লাগাবো। দয়াকরে রাজকন্যাকে গিয়ে জানিয়ে দাও।”

সেই এক কথা। অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে প্রহরীরা। তার কোনো মতেই রাজকন্যার আজ্ঞা অমান্য করতে পারবে না। এতোবড় দুঃসাহস হয়নি কারোর।

“রাজকুমার! দয়াকরে এরূপ করবেন না। আমাদের কথাটা একবার শুনুন। সামান্য ঔষধি! আপনার জখম স্থানে না লাগাতে পারলে অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি হইতে পারে।”

“হোক। কবুল সেই সমস্যার। আমি কোনোরূপ ঔষধি লাগাবো না জানিয়ে দাও তোমাদের রাজকন্যাকে। আমি এই জখম নিয়েই মরতে চাই।”

জেদ ধরা গলায় বলে গেলো আয়াস। প্রহরীরা পড়লো মহা ফ্যাসাদে। একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

রাজকন্যা কারাগারের বাইরে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে আয়াসকে টের পেতে দেয়নি তার আগমন! কিন্তু তার জেদ ধরা গলায় এবার সে নিজেও চরম বিরক্ত হয়ে উঠলো। কিসের এতো জেদ ঔষধি লাগাতে। খানিকটা লাগালেই জখম স্থানটা ভরতো। তা না! পাপ করে করে ভান্ডার ভরবে অথচ শাস্তি পাওয়ার পর যত নাটক। এটা তো শাস্তি! যেটা রাজকন্যা তাকে ক্রোধে পড়ে দিয়েছে ভালোবেসে নয়।

আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা রাজকন্যা। বিরক্তির স্তুপ আরেকটু বাড়িয়ে নিয়েই এগিয়ে গেলো কারাগারের দিকে। কারাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে হুকুম করলো প্রহরীদের,

“তোমরা বাইরে এসো। আমি দেখছি।”

রাজকন্যার আকস্মিক আগমন কাম্য ছিলো না কারোরই। রাজকন্যাকে দেখতেই আনন্দে চকচক করে উঠলো আয়াসের চোখ। মুখের পীড়াদায়ক ভাবটা কেটে গেলো এক নিমিষে। ফুটে উঠলো প্রাণোচ্ছল ভাব।

প্রহরীরা দ্রুত বেরিয়ে পড়লো কারাগার থেকে। রাজকন্যা হাত বাড়িয়ে ঔষধির বাটিটা নিজের হাতে তুলে নিলো। অতঃপর আবারও হুকুম করলো,

“উনার জন্য পরিষ্কার কিছু পোষাকের ব্যবস্থা করো।”

“আজ্ঞে রাজকন্যা।”

সবাই নতশির করে ছুটে গেলো আয়াসের জন্য পরিষ্কার পোষাক নিয়ে আসতে। রাজকন্যা একটু নীচু হয়ে কারাগারের ভেতর প্রবেশ করল। আয়াস সেই প্রথম থেকেই হাসি-হাসি মুখ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার মনোহারিণীর পানে। রাজকন্যা ললাট কুঞ্চিত রেখে বিরক্তি সূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেলো। ওমনি সুযোগ বুঝে চোখ টিপল আয়াস। ঠোঁটের কোনে খেলে গেলো বাঁকা হাসি। রাজকন্যা চকিতে তাকালো। কুঞ্চিত ললাট আরও কুঞ্চিত হলো। তেঁতে উঠে আঙ্গুল উঁচিয়ে কয়েক কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হলেও বলতে পারলো কিছু। আয়াস মুখ খানা বাচ্চাসুলভ করে নিলো। ঠোঁট উল্টে অক্ষিপট কুটিকুটি করে তাকালো। রাজকন্যা দৃষ্টি সরালো। ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের ভারী পোশাকটা ধরে কোনো মতে বসলো আয়াসের সম্মুখে। আয়াস তখন মিটমিটে হাসছিলো।হাতে ভর দিয়ে সে নিজেও একটু কাছে এগিয়ে এলো রাজকন্যার। রাজকন্যা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। ওমনি তার হাসি মুখখানা পূনরায় বাচ্চাসুলভ আকার নিলো। যার দরুন এবারও রাজকন্যা নিশ্চুপ রইলো। কোনোরূপ কথা না বলে ঔষধির বাটিটা মেঝেতে রেখে হাত বাড়ালো আয়াসের বক্ষস্থলে। আয়াস এক ধ্যানে দেখে চলল তার প্রনয়নীকে। তার গৌরীকে। রাজকন্যা গৌরী। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। গোলগোল আঁখিদুটি অনেকটা রসগোল্লার মতো। কেউ হঠাৎ দেখলে বলতেই পারবেন না এই দৃষ্টি মুহুর্তেই কতটা ভয়ংকর হতে পারে। পাতলা মসৃণ ঠোঁট দুটো আরও বেশি সুন্দর। ভুলবশত একবার দৃষ্টি পড়লে ফেরানো দায়। ইচ্ছে করে ভুল করে একটু হায়া শরম খুইয়ে ছুঁয়ে দিতে। এরপর রাজকন্যার যে আক্রমণ হবে তার জন্য অবশ্যই পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। ভাবতে ভাবতে মনে মনে নিজেকে পাগলের উপাখ্যান দিয়ে হেসে উঠলো আয়াস।

আয়াসের রক্তভেজা পোশাকটা খুলতে হাত কাঁপছিলো রাজকন্যার। রক্ত শুঁকিয়ে কটকট করছিলো। বক্ষস্থল থেকে তা অনাবৃত হতেই উদাম দেহখানা প্রকাশ্যে ভাসলো। একই সঙ্গে বক্ষস্থলের লম্বা করে কে/টে যাওয়া জায়গাটা। র/ক্ত ঝড়া বন্ধ হয়েছে বেশ খানিকটা পূর্বেই। তবে আরও বেশি দেরী করে ঔষধি দিতে গেলে সংক্রমণ ঘটতে পারে।

রাজকন্যার বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। হাতের মধ্যে ঔষধি নিয়ে আয়াসের বক্ষস্থলে লাগাতে গিয়েও হাত কাঁপল তার। যেকোনো মানুষই তার প্রিয় মানুষটার সামনে এসে দুর্বল হয়ে যায়। সেও এই নিয়মের ব্যতিক্রমে যায়নি। সত্যি সত্যি দুর্বল হয়ে পড়লো মানুষটার সামনে। এখন উপলব্ধি হচ্ছে, কি করে তার দেওয়া জখম মুখ বুঁজে গ্রহন করেছিলো মানুষটা!

“ভয় পাচ্ছেন?”

আয়াসের কন্ঠে চমকে উঠলো রাজকন্যা। ভীত দৃষ্টিতে একবার তাকালো আয়াসের হাস্যজ্জ্বল মুখখানে। ফের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সত্যিই সে ভয় পাচ্ছে।

“আমার ব্যাথা লাগবেনা। আপনি নিশ্চিন্তে ঔষধি লাগাতে পারেন। আর আপনি তো জানেন না, আপনার হাতে জাদু আছে। তখন যেভাবে আঘাত করেছেন.. সত্যি বলতে ব্যাথা আমার মোটেও লাগেনি।”

বলতে বলতে দুর্বোধ্য হাসলো আয়াস।

“চুপ করুনতো। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।”

ধমকি সুরে বলে উঠলো রাজকন্যা। আয়াস খামোশ হলো। মুখে আঙ্গুল চেপে শান্ত হয়ে গেলো। রাজকন্যা তার কান্ড দেখে পূণরায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মানুষটা ক্লান্ত হয়না কোনো কিছুতে। অদ্ভুত।

#চলবে