রেইনকোট আরোহী পর্ব-১১

0
122

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে মিমির মুখটা গম্ভীর থাকলেও সকালটা আবার সুন্দর হাসিখুশিতে ভরে উঠলো। সব স্বাভাবিক। নতুন দিনের সবকিছুই নতুন। যেন, গতকাল কিছুই হয়নি। প্রিয় সম্পর্কগুলো ঠিক এমনই। নতুনত্ব নিয়ে আসে ক্ষণে ক্ষণে।
সকাল থেকেই কয়েকবার ফোন যাচ্ছে শিরিন বেগমের কাছে। তারা এখনো আসছে না কেন! আবরারের তুলে রাখা কাপড়চোপড় সম্পর্কে বিস্তারিত বলে দিয়েছে মিমি। আসার সময় যেন মনে করে নিয়ে আসে। তারপরও কেমন লাগছিলো তার, সবাই-ই কিছু না কিছু কিনলো প্রোগ্রাম উপলক্ষে। আবরারের কিছুই কেনা হলো না। যেন গতকাল আবরারের জিজ্ঞাসায় আরও বেশি অস্বস্তি করে তুলেছে তাকে! কেন সে কিনলো না কিছু আবরারের জন্য। আর তাই ফাঁকে ফাঁকে সকাল থেকে একাধিক বার আবরারকে বলেছে, “শপিংয়ে যাও। কিছু কিনে নিয়ে এসো।”
আবরার যেতে রাজি হয়নি। বাসায় নতুন পোশাক তুলে রাখা আছে, তাতেই তার হবে। কিন্তু মিমির হচ্ছে না। একটা শার্ট হলেও তাকে কিনিয়ে ছাড়বে। তাই নাস্তার পরপরই বলতে লাগলো,
“শপিংয়ে যাবো। চলো।”
“শপিং না করে এলে! আবার কেন!”
“এমনি। প্রয়োজন আছে। চলো।”
“কি প্রয়োজন, শুনি?”
“তুমি শপিং করিয়েছো আমাকে?”
“একজন করলেই তো হয়।”
“না, হবে না। চলো।”
আবরার বুঝতে পেরেছে তার তাড়ার কারণ। তাই বললো,
“মিমি, আমার লাগবে না কিছু। মা নিয়ে আসছে পোশাক।”
“আমার লাগবে। তাড়াতাড়ি চলো। এক দেড় ঘন্টার মধ্যে ফিরবো। বাসায় কাজ আছে।”
মিমির ধাক্কাধাক্কিতে আবরার যেতে বাধ্য! পিছু ছাড়লো না মারওয়া! সে যাবে তার আব্বুর গাড়িতে, আব্বুর সাথে। বেশ তো, উর্মিকেও সাথে নিলো আবরার। একটু ঘুরে আসার জন্য। রিমিকে বললেও সে যাবে না। দুপুরে পার্লারে যেতে হবে, তার বন্দোবস্ত করতে হবে তাকে। এদিকে তারা শপিং করে ও ঘুরেফিরে দুপুরের মধ্যেই ফিরে এলো। শুধুমাত্র মারওয়ার জন্য আরও এক জোড়া জুতো এবং আবরারের শার্ট, পাঞ্জাবি কিনেছে বলেই স্বল্প সময়ে ফেরা সম্ভব হয়েছে৷ হালকা খাবার খেয়েও সময় কাটিয়ে এসেছে বাইরে।
বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততায় ব্যস্ত সবাই-ই। সময়ের সাথে সাথে যেন এই ব্যস্ততা কেবল বেড়েই চলেছে। আবরার ছাড়া সব হবে, তবুও আবরারেরই কত কাজ পড়ে গেছে। তাই বলে অন্যরাও যে বসে আছে, তা নয়। তার বাবা সৈয়দ শাহ আলী ও মা শিরিন বেগমও এসে গেছেন দুপুরের পরপর। বাবা রাগ দেখায়নি আবরারের উপর। আবরার বাবামায়ের সাথে বসে কথা বললো কিছুক্ষণ। ইলহাম সম্পর্কে মাকে বললো,
“ইলহাম কোনো চাকরির জন্য ট্রাই করছে না কেন? তাকে কিছু বলছো না কেন, মা? এভাবে বসে বসে চলবে? পরে তো আফসোস করবে, বয়স পেরিয়ে যাবে।”
“করছে তো। সেদিনও না ইন্টারভিউ দিয়ে এলো ঢাকাতে। তোর সাথে না দেখাও করে এলো।”
“সে ইন্টারভিউ দিতে গেছে ঢাকায়? আমি বলার পরও তো কিছু বললো না।”
“সে বলেটা কি?”
“তোমাদের আস্কারায়ই এমন হয়েছে। কোনো বিপদ এলেও জানাবে না সে। কিসের ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে?”
“কি জানি! সেটা আমাকে বলেনি। যাওয়ার সময় জানালো মাত্র ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। জানতে চাইলে বললো, চাকরি হলে তো দেখবোই!”
আবরার আর কিছু বললো না তার ব্যাপারে। এই একটা দিক থেকে ইলহামের উপর খুব বিরক্ত হয় সে। কোনো ব্যাপারেই ইলহামটা স্পষ্ট জবাব দেয় না পরিবারকে। একে একে মেহমানে বাড়িতে সমাগম বেড়ে যাচ্ছে। মিমির ননদ, অরিনও এসে গেছে হাসব্যান্ড এর সাথে। ভাইদের একমাত্র আদরের ছোট বোন অরিন। তবে ইলহাম আর অরিন পিঠাপিঠি। বছরখানেক পার্থক্য তাদের বয়স। সবাইকে একত্রে পেয়ে মারওয়ার খুশি যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। এতো লোকের ভীড়ে এই বাড়িতে সবচেয়ে খুশি ও আনন্দিত বোধহয় আপাতত সে-ই। এতো লোকের এতো ব্যস্ততার মাঝে এই এক ইলহামকেই পাওয়া যাচ্ছে না সময়মত। অথচ তারই আগে থাকার কথা! মিমি কল করেছে কতবার, একটা কলও রিসিভ করেনি। বিকেলে সোজা এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। মিমি দেখেই মেজাজী গলায় বললো,
“কার সাথে দেখা করতে গেছো? হ্যাঁ? বউ আমরা খুঁজে দিতে পারবো না সময়মতো? নাকি একা একাই বিয়ে করে নিয়ে আসবে?”
ইলহাম জবাব না দিয়ে হাসলো শুধু। তার চোখমুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, সারাদিন ঘুমিয়েছে! মিমি তার হাসি দেখে বললো,
“আবার হাসো! একদম ভাইটার মতো হয়েছে! কাজের সময় তাদের পাওয়া যাবে না। ফোন ধরোনি কেন?”
“এলে তো বকা দিবেই, আবার ফোনে দেওয়ার কি প্রয়োজন? ফোনের ব্যালেন্স আর তোমার এনার্জি দুটোই লস হবে ভেবে ধরলাম না ফোন।”
রাগের মধ্যেই হাসলো মিমি। ইলহামের কথার ধরণই এমন হাস্যকর।
“ছাদে যাও। রোহান আর হালিম সব গোছাচ্ছে। আরও কে কে যেনো আছে।”
“হালিমটা কে?”
“আমার ফুপাতো ভাই। ওইতো, ছোট ফুপির ছেলেটা যে।”
“ও আচ্ছা।”
“তোমার ভাইও গেছে উপরে। দেখো গিয়ে কি করে। তার চোখ তো আবার রহস্যে ঘেরা। রোমান্টিক স্টেজকে না আবার রহস্যময় বাড়ি বানিয়ে ফেলে।”
কথার সাথে মিমি মৃদু হাসলে ইলহামও হেসে বললো,
“ভাইয়াকে এতো তাড়াতাড়ি ক্ষমা করে দিলে?”
“হ্যাঁ, দিলাম।”
“তোমার সতীন কিন্তু আমি দেখে এসেছিলাম ঢাকায়।”
“বেশ করেছো। যাও।”
“ফ্রিজে পানি আছে?”
“হুম। খাবে?”
“দাও এক গ্লাস।”
“রুমে বসো। নিয়ে আসছি আমি। মিষ্টি দিবো?”
“উহুম, শুধু ঠান্ডা পানি দাও।”
“দুপুরে খেয়েছো তো কিছু? মা রান্না করে রেখে এসেছিলো?”
“হুম, হুম। খেয়েছি।”
মিমি ঠান্ডা পানি আর দই নিয়ে এলো।
“এই নাও। মিষ্টি খাবে না যখন, দই খাও।”
“আবার এটা কেন! কিছুই খাবো না আমি।”
“ঝটপট শেষ করো। ভারি কিছু সাধলাম না এখন। একটু পর বিরিয়ানি খেয়ো।”
ইলহাম হাতে প্লেট নিয়ে বললো,
“বিয়ে বাড়ি, অথচ বাড়িটা এতো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন? তোমার বোন টোন সব কোথায়? এতো এতো বোন তোমার!”
“বোনেরা তাদের কাজে গেছে।”
“কোথায়? পার্লারে?”
“জ্বি।”
“ওফ্ফ! এজন্যই তো বলি, বাড়ি এমন ফাঁকা কেন!”
“ফাঁকা কোথায়? বাকিদের কি চোখে পড়ছে না নাকি তোমার?”
“উনারা তো মুরব্বি। মুরব্বিদের জন্য আজকের প্রোগ্রাম নাকি? বাবাই কোথায়?”
“তোমার বাবাইও গেছে পার্লারে।”
“বাপরে! মাসুম বাচ্চাটারও মাথা খেয়ে দিচ্ছে তোমার বোনেরা!”
“শুধু আমার বোনেরা না, আপনার বোনও গেছেরে ভাই।”
“তুমি আর একা একা বাসায় কি করছো? তুমিও চলে যাও।”
“জ্বি, আমিও যাবো। আমার তো আবার দায়িত্ব বেশি, তাই সিরিয়াল সবার পরে। একটু পরপরই একএকজন মিমি, মিমি, মিমি বলতেই থাকে। আরেকজন তো আছেই! আপনার ভাইয়ের পিছু ঘুরতে ঘুরতেই আমার অর্ধেক বেলা শেষ!”
“আহারে! যাও, যাও। আর কাজ করতে হবে না। তোমাদের রুটিনই তো প্রতি প্রোগ্রামে দিন লাগিয়ে সাজগোজ করা। আর আমরা ছেলেরা অসহায়, কোমড়ে গামছা বাঁধা কামলা!”
“তো আপনারাও যান। পার্লার তো ছেলেদেরও আছে।”
“থাক, আমাদের আর প্রয়োজন নেই ওসব আটা ময়দার!”
“আল্লাহ জানে, এই ছেলের ঘরে কোন কপালি আসে! যদি কোনো মডার্ন মেয়েই আসে, তোমার কপালে যে কি আছে রে ইলহাম!”
মুখে ঠান্ডা পানি ও চাপা হাসি নিয়ে ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চলে গেলো ইলহাম। হলুদের স্টেজটা ছাদেই করা হচ্ছে। পরিকল্পনা মোতাবেক তারাই সবটা করবে এবং সেভাবেই নিজেরা কেনাকাটাও করেছে।
সন্ধ্যার পরপরই বাড়িটা আরো জমে উঠলো। আঁধারকে চমকে দিতে লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। বাড়ির পরিবেশটাই বদলে গেছে সাজসজ্জায়। প্রত্যেকের মনেও এক অন্যরকম আমেজ। এদিকে তাদের স্টেজ সাজানোও শেষ। কোত্থেকে যেনো হঠাৎ একঝাঁক সুন্দরী উঠে এলো ছাদে। স্টেজের দিকে অগ্রসর হতেই ইলহাম রোহানের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“এরা কারা, রোহান? আমার দিকে কেন আসছে? বাঁচাও আমাকে!”
রোহান ফিক করে হেসে উঠলো শুধু। আর সুন্দরীরা একএকজন স্টেজের প্রশংসা করছে, আবার কেউ কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একজন তার মধ্যে কোনোটাই না করে এগিয়ে এলো ঘনঘন পা ফেলে।
“ওয়াও, স্টেজ কমপ্লিট!”
রোহান জবাব দিলো,
“হ্যাঁ, তোদের শুটিং শুরু কর এবার।”
“আমাদের শুটিং মানে!”
“ওইযে, এক একজন ঢংয়ে ঢংয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত যে!”
“তো ছবি তুলবে না! আযব!”
“হ্যাঁ, তোল তোল। এখন বাসায় জায়গা পাবো না মনে হচ্ছে, একটু পরে ফেসবুকে ছবি আপলোড দিতে দিতে সেখানেও জ্যাম সৃষ্টি করবি একএকজন!”
“তুমি ফেসবুকে এক্টিভ না হলেই তো হয়।”
“এক্টিভ হবো না? সবগুলোকে ঘাড় ধরে ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে বের করবো।”
“ওকে, ফাইন।”
রোহানকে ইগনোর করে ইলহামকে বললো,
“ভালো আছেন, ভাইয়া? কখন এসেছেন?”
ইলহাম রোহানের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে বললো,
“এটা কে রোহান? আমি ঠিক চিনে উঠতে পারছি না কেন?”
রোহান এবং উর্মি দুজনেই হেসে উঠলো। রোহান ইলহামের সাথে তাল মিলিয়ে বিদ্রুপের সাথে আর উর্মি লজ্জায়। সে লজ্জা পেয়ে চলেই যাচ্ছে এখান থেকে। ওদিকে রোহান হাসি থামিয়ে বললো,
“এটা আমাদের উর্মি ম্যাডাম।”
“আরে, এটা উর্মি! কি বলে! এই উর্মি, শুনে যাও।”
“ধুর!”
উর্মি চলেই গেলো ছাদ থেকে। তারা যে ইচ্ছাকৃত বিদ্রুপ করবে তার সাজসজ্জা নিয়ে, বুঝতেই পারছে সে। রোহান বললো,
“ইলহাম ভাই, নিচে চলো। এবার আমরাও একটু নিজেদের দেখি আয়নায়। কেমন ক্ষেত ক্ষেত লাগছে পরীদের সামনে।”
“চলো, একটা গামছা আর একটা লুঙ্গি দাও দেখি। তাদের মতো তো আর আটাময়দার ভার সামলাতে পারবো না!”

চলবে।