রেইনকোট আরোহী পর্ব-১২

0
117

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
রোহান ও ইলহাম রেডি হওয়ার জন্য ছাদ থেকে সিড়ি দিয়ে দোতলায় নামতেই মারওয়া ছুটে এলো,
“বাবাই! তুমি কখন এসেছো?”
“আরে! এটা কে? কে তুমি?”
“আমি, আমি।”
“আমিটা কে?”
“আমি মারওয়া। তুমি আমাকে চেনো না?”
“না তো। তুমি তো মারওয়া না। আমার মারওয়া তো অন্যরকম। কিউট বেবি আমার। মারওয়া, মারওয়া কোথায় তুমি?”
“আরে! আমি, আমি মারওয়া।”
“নাহ! তুমি মারওয়া হতেই পারো না। মারওয়া তো এভাবে সাজে না।”
“আমি পার্লার থেকে সেজে এসেছি মামনির সাথে।”
“উহুম, আমি তোমাকে চিনি না।”
“ধ্যাৎ!”
ইলহামের দুষ্টুমিতে মুখটাকে কাচুমাচু বানিয়ে মারওয়া ফিরে রোহানের রুমে চলে যেতে লাগলো আবার। লেহেঙ্গা পরে পার্লার থেকে সেজে এসেছে সে। তার রাগের উপর হেসে ইলহাম পিছু পিছু রুমে গিয়ে তাকে পাজা কোলে তুলে নিলো।
“ছাড়ো আমাকে। তুমি পঁচা বাবাই।”
“বাবাই তো সমসময়ই পঁচা!”
ইলহাম গালে চেপে গভীর চুমু খেলো আদুরীকে।
“আমার পরী মা টা।”
“ওফ্ফ, বাবাই! এতো জোরে আদর দেয় কেউ!”
“কেন, এতো জোরে আদর দিলে কি হয়?”
“আমার মেকাপ উঠে যাবে না তবে!”
“সর্বনাশ! এখনই এই অবস্থা! রোহান, এইটুকু বাচ্চার মাথা পুরো গুলিয়ে দিয়েছে তোমার বোনেরা।”
“ছাড়ো, নামাও। আমার আব্বুই সুন্দর আদর দিয়েছে আমাকে। একদম মেকাপ উঠে না।”
“তাই? কিভাবে আদর দিয়েছে আব্বু?”
ইলহামের মাথা টেনে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
“এভাবে।”
ইলহাম দুষ্টুমি করে আবার কপাল নামিয়ে দিয়ে বললো,
“কিভাবে?”
“ওফ্ফ! এই ভাবে।”
মারওয়া আবারও আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। রোহান তাকে আরেকটু ভরকে দিতে বললো,
“আম্মু, তোমার লিপস্টিক উঠে যাচ্ছে তো!”
“আ…! সত্যি! বাবাই, ছাড়ো ছাড়ো! আমার সব সাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো তুমি!”
“না, আরেকটু আদর দিবো বাবাইকে।”
“না…!”
মারওয়া রেগে যাচ্ছে তাই হেসে ছেড়ে দিলো ইলহাম। সে ছুটে গেলো ওপাশের রুমে, মায়ের কাছে। মিমি পার্লার থেকে এসেই আবরারের পোশাক বের করে সামনে দিচ্ছে তৈরি হওয়ার জন্য।
“কত দিনের ছুটি নিয়েছো?”
“কাল রিমিকে বিদায় দিয়েই চলে যাই। কি বলো? আমার তো কাজ নেই এখানে।”
“কাল কেন আর? আজই যাও। রিমিকে আমরাই বিদায় দিতে পারবো।”
“দেখো, কান্না করো না কিন্তু আবার।”
“কান্না কেন করবো। দ্বিতীয় বার তোমার কিশোরগঞ্জ আসাটা শুধু বন্ধ হবে।”
এরইমধ্যে মারওয়া এসে বললো,
“আম্মু, আমাকে আবার পার্লারে নিয়ে চলো।”
“কেন?”
“আমার সব সাজ নষ্ট করে দিয়েছে বাবাই।”
“কোথায় সব সাজ নষ্ট করে দিয়েছে?”
“গালের মেকাপ নিয়ে গেছে বাবাই আদর দিয়ে, লিপস্টিকও মুছে গেছে মামা বলেছে।”
“কিছুই হয়নি। দুষ্টুমি করেছে মামা।”
“না, নিয়ে চলো তুমি।”
“মারওয়া, জেদ করবে না এসময়। সব সাজ ঠিক আছে।”
“আব্বু, তুমিই আমাকে নিয়ে চলো তো।”
আবরার তাকে কোলে তুলে বললো,
“কোথায় নিয়ে যাবো তোমাকে?”
“পার্লারে। এই দেখো না, সব নষ্ট করে দিয়েছে! আমাকে আবার সাজতে হবে।”
“উম্মম… সবই তো ঠিক আছে দেখছি। কিছু নষ্ট হয়নি।”
“আমার লিপস্টিক ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে তো।”
“এই গালের মেকাপটাও কি ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, মেকাপও ঠিক আছে।”
“ওফ্ফ! বাবাইটা শুধুশুধু আমাকে ভয় দেখায়। তুমি বকে দিয়ো তো।”
“ওকে, দিবো।”
“মামাকেও দিয়ো। মামাও দুষ্টুমি করে।”
“ওকে, মামাকেও দিবো।”
মিমি বললো,
“মারওয়া, নামো কোল থেকে। আব্বুকে রেডি হতে দাও। বারবার কোলে উঠলে তো আব্বুকেও বকে দিতে হবে। নিউ ড্রেস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না, বারবার কোলে উঠছো যে।”
“ও, তাইতো।”
মারওয়া নেমে চলে গেলো দাদুনের সাথে সাক্ষাৎ করতে। আবরার রেডি হয়ে গেলে দুজনেই ছাদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। মিমি আবার বললো,
“বললে না, কত দিনের ছুটিতে এসেছো?”
“এক সপ্তাহের হলে খুশি?”
মিমি খুশি মনোভাব ব্যক্ত করে বললো,
“কম যেন না হয় আবার।”
সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় এক লোককে থামিয়ে আবরার বললো,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
“কাজ। কাজ করতে আসছি।”
মিমি বললো,
“ডেকোরেশনের লোক।”
“ডেকোরেশনের লোক বুঝলাম, কিন্তু ঘরে উনার কি কাজ? ঘরে কিংবা ছাদে তো কোনো কাজ নেই।”
“আরে, কাজ থাকতে পারে না? আসবাবপত্র রাখছে, নিচ্ছে।”
মিমি পরবর্তী জবাব দিতে দিতে লোকটা চলে গেছে তার পথে। আবরার তাকিয়েই রইলো তার যাওয়ার দিকে। মিমি তার সন্দেহের দৃষ্টি দেখে বিড়বিড় করলো,
“চলো, সবসময় বেশি বেশি।”
ইলহাম সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হয়তো লক্ষ্য করেছে, তাই এরই মধ্যে মিমির কথায় সুর টানলো,
“আইনের লোক তো। বুঝতে হবে, ভাবি। ভাতেও সন্দেহ, ঘা’তেও সন্দেহ।”
ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি রেখে পাশ দিয়ে নেমে গেলো ইলহাম। তার কথা শুনে মিমি মুখ চেপে হাসলেও আবরার বিনা প্রতিক্রিয়ায় পা বাড়িয়েছে। ইলহাম চলে গেছে একটু রিমির সাথে দেখা করতে। রিমি আর সে প্রায় সমবয়সী। তবে দুজন দুজনকে আপা, ভাইয়া সম্বোধনই করে। এদিকে রিমির রুমে মোটামুটি ভীড়। ইলহাম দরজার সামনে থেকেই হাক ছেড়েছে, “রিমি আপা কোনদিকে?”
রিমি সাড়া দিতেই সে “সাইড, সাইড” বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করলো। রিমিকে দেখে বললো,
“যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই! আপনার বিয়ে, আপনার সাজ কোথায়? বাকিরা দেখি এক একজন ডানাকাটা পরী!”
উপস্থিত সবাই-ই হেসে উঠলো। রিমি বললো,
“কি বলেন, ইলহাম ভাই! এই যে, সেজেছি না!”
“এইটুকু সাজ!”
পাশে উর্মি ছিলো, তাকে ইশারায় তাক করে বললো,
“দেখো তো, উর্মিকে চেনাই যাচ্ছে না মেকাপের ভারে। আর তুমি সেই পুরনো রিমি আপাই!”
“বেশ তো। বদলে গেলে হাসব্যান্ডের চিনতে অসুবিধা হবে না আবার! আগে কি দেখে পছন্দ করলো, পরে কি হলো!”
“তা-ও তো কথা। কিন্তু ক্যামেরাম্যানের কনেকে খুঁজে পেতে জটিল সমস্যা হয়ে যাবে আজ!”
তার দুষ্টুমির বিপরীতে রিমি আফসোসের সুর টেনে বললো,
“তাই, না? আসলে হয়েছে কি, সবাইকে মেকাপ করতে করতে আমার বেলায় শর্ট পড়ে গেছে। কি আর করার বলুন তো!”
“ভারি চিন্তার বিষয়। রিমির পরিবর্তে না আবার উর্মিকে তুলে নিয়ে যায় বরপক্ষ। আমিই তো কনফিউজড, বিয়ে রিমির নাকি উর্মির!”
“ইশ! বেচারা ইলহাম ভাই আর বেচারা ক্যামেরাম্যান। কিছু করার নেই। এভাবেই খুঁজে নিতে হবে।”
এদিকে উর্মি আবারও তার বিদ্রুপে চেহারা কাচুমাচু করে বললো,
“ভাইয়া!”
ইলহাম এক গাল হেসে বললো,
“উহুম, এটা ঠিক হয়নি। উর্মির বিয়েটাই আগে দেওয়া উচিত ছিলো। নাহয় দুজন একসাথে বিদায় হলেই চলতো।”
উর্মি একদমই বিরক্ত হলো না। লজ্জা পেয়ে মুখ চেপে হেসে বেরিয়েই যাচ্ছে। তারপর ইলহাম তাড়া দিতে লাগলো তাড়াতাড়ি ছাদে যাওয়ার। প্রোগ্রাম কোন রাতে শুরু হবে নয়তো! বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। মূলত সে এখানে এসেছেই এজন্য। এরপর শুরু হলো ক্যামেরাম্যানের ব্যস্ততা। প্রোগ্রামের এক পর্যায়ে বাড়িতে হৈচৈ শুরু হলো। একেবারে আবরারের সন্দেহটাই প্রস্ফুটিত হয়েছে! রোহান প্রোগ্রামের এক পর্যায়ে ছাদ থেকে দোতলায় নেমে এসেছিলো ক্যাবল নিয়ে যেতে। দরজা ঠেলে রুমে পা রাখতেই দেখতে পেলো একটা লোক তার আলমারি খোলার চেষ্টা করছে হাতে চাবির মতোই ছোট একটা যন্ত্র দিয়ে। লোকটা পালাতে চাইলেও হাতেনাতে ধরা খেয়েছে। হৈচৈ শুনে অনেকেই ছুটে এসেছে। মিমি, আবরার এসে দেখলো এটা সেই লোকটাই! চুরি করার উদ্দেশ্যেই ঘরে ঘোরাফেরা করছিলো। মিমির বিস্মিত চেহারায় তাকিয়ে আবরার মন্তব্য করলো,
“বেশি বেশিটাই ঠিক হলো তো এবার?”
মিমি সাথে সাথেই ইলহামের দিকে তাকালো। সে-ও তো বিদ্রুপ করেছিলো তখন! ইলহাম হালকা কেশে কেটে পড়লো তাদের পাশ থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এটা ডেকোরেশনের লোক নয়। ডেকোরেশন পার্টির যারা এসেছে, তারা তাকে চেনেই না। এদিকে চোর লোকটির যত আকুতি মিনতি! সে গরীব, ঘরে বউ বাচ্চা আছে, পেটের দায়ে চুরি করতে নেমেছে, আর জীবনেও চুরি করবে না বলে বলে ক্ষমা চাওয়া। কে জানে, কতটুকু সত্য! তবে খুব একটা ঝামেলায় যাওয়া হলো না এই সুন্দর মুহুর্তে। লোকটাকে দেখতে আসলেই গরীব মনে হচ্ছে। অতঃপর হালকা ধাওয়া দিয়ে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
বিয়ের কার্যক্রম শেষ করে তিনদিন পর আবরার নিজ বাড়িতে ফিরেছে বউ বাচ্চাকে নিয়ে৷ বাকিরা আগেই এসে পড়েছে। আর ইলহাম? শুধু হলুদের প্রোগ্রামের বিশেষ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলো বলে সেই সন্ধ্যায়ই একটু বেশি সময় কাটিয়েছিলো। পরদিন দুপুরে খেয়েই উধাও! তাকে আর দেখাই যায়নি! বৌভাতেও উপস্থিত হয়নি। কোথায় নাকি ঘুরতে চলে গেছে বন্ধুবান্ধবদের সাথে! আবরার একসপ্তাহেরও দুদিন বেশি সময় পরিবারের সাথে কাটিয়ে তারপর আবার ফিরেছে কর্মজীবনে। কেউই এবার অভিমান নিয়ে বসে নেই। মিমি তো খুব আনন্দের সাথেই চলাচল করছিলো। মনেই হয়নি আবরারের উপর সে অভিমান করেছিলো কখনো। চলে যাওয়ার সময় খারাপ লাগলেও তা ঢেকে রেখে হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছে পরিবার। অপেক্ষা বুনতে শুরু করেছে পরবর্তী সময়ে ফেরার। একমাত্র মেয়েটাই হাসিমুখে বিদায় দেয়নি বাবাকে। কখনোই দেয় না। সে একদমই ছাড়তে চায় না তার বাবাকে। এক মুহুর্তের জন্যও না। মুখের উপর হালনাগাদ প্রকাশ করে দেয় তার মনের অবস্থা। মেয়েকে কত আদর দিয়ে বুঝিয়ে তারপর বাড়ির সীমানা ছেড়েছে আবরার। অপেক্ষা তারও, পরিবারে ফেরার। আবার অপেক্ষা তারও, কর্মক্ষেত্রে পরিকল্পিত কাজ সম্পন্ন করার!

চলবে।