রেড রোজ পর্ব-০৪

0
147

#রেড রোজ (পর্ব ৪)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস

১.
রাহাত আনমনে ওর রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। কিছুদিন আগেই ও এই থানায় বদলি হয়ে এসেছে। বাইরে জোর বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে ঝড়ো বাতাস। মোহাম্মদপুর থানার সামনের ছোট্ট মেহগনি গাছটা বাতাসে বার বার নুয়ে পড়ছে। শ্রাবণের এই বর্ষণমুখর সন্ধ্যা যেন সত্যিই অনেক রহস্যময়।

এই যখন ভাবছিল তখন হাফিজ একটা বড় বাটিতে মুড়ি চানাচুর মাখা নিয়ে এসে বলে, ‘স্যার, আজকের আবহাওয়া এইটা ডিমান্ড করে।’

রাহাত ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘একদম ঠিক বলেছ। সন্ধ্যার চায়ের আগে এই মুড়ি চানাচুর দারুণ হবে। বসো, তুমিও নাও।’

হাফিজ আর দেরি করে না, এক মুঠো মুড়ি মাখানো মুখে দিয়ে বলতে থাকে, ‘স্যার, আজ বহুদিন পর সেই জাদুকর চিত্রকর আহমেদ নকিবের কথা মনে পড়তেছে। সুন্দরী মেয়েদের পোট্রের্ট আঁকার সময় ওদের ছবিতে বন্দি করে ফেলত। আর মেয়েগুলো হারিয়ে যেত, কেউই খুঁজে পেত না। আপনিই সেই রহস্য ভেদ করলেন, কী রোমাঞ্চকর একটা অভিযান ছিল!’

রাহাত খেতে খেতে বলে, ‘হ্যাঁ, তা যা বলেছ। অনেক ধুরন্ধর ছিল এই আহমেদ নকিব। যদিও কেসটা অনেক ভুগিয়েছে কিন্তু এমন মেধাবী অপরাধী পেলে তদন্ত করে আনন্দ পাওয়া যায়। বহুদিন এমন কেস পাই না আর। এই থানায় তো আমি নতুন, আছে নাকি এমন অমীমাংসিত কোনো কেস?’

একজন কনস্টেবল দু’কাপ দুধ চা দিয়ে যায়। রাহাতকে এক কাপ এগিয়ে দিয়ে নিজেও নেয় হাফিজ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘জাদুকর চিত্রকরের মতো না হলেও এমন একটা রহস্যময় কেস আছে। আগের স্যার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সমাধান করতে পারেননি।’

রাহাত কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বলে, ‘সেটা কী রকম, বলো দেখি?’

হাফিজ মনে মনে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলে, ‘কয়েক মাস আগে ইকবাল রোডের বাসার ছাদ থেকে পড়ে রয়া নামে একটা মেয়ে মারা যায়। আমরা তো প্রথমে ভেবেছিলাম এটা একটা দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। কিন্তু মেয়ের পরিবারের লোকজন যখন বলল এটা হত্যা, হাসব্যান্ডের নামে ওরা মামলা দিতে চাইল। আমরা ভেবেছিলাম অন্য কেসের মতো এটাও, স্ত্রী মারা গেলেই হাসব্যান্ডের নামে মামলা। কিন্তু আমরা তদন্ত করে নিশ্চিত হলাম মেয়েটা আসলেই ছাদ থেকে পড়ে গেছে। আর এটা আরেকজন দেখেছেও। আমরা কেসের আরেকটু তদন্ত করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম। মেয়েটাকে দু’মাস আগে থেকে কেউ মৃত্যুর হুমকি দিত। একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ আসত। এমনকি মেয়েটা যখন ছাদ থেকে পড়ে যায় তার আগমুহূর্তে একটা কল এসেছিল ওই নাম্বার থেকে। আমরা আমাদের আইটি টিম দিয়ে মোবাইলের খোঁজ বের করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ফোনটা ওইদিনের পর থেকে একদম বন্ধ। তাই আর ট্র‍্যাক করতে পারিনি। হাসব্যান্ড, রায়ানকে সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে একটা জিনিস পেয়েছিলাম, যে লোকটা মেয়েটাকে পড়ে যেতে দেখেছিল সেই লোকটা মেয়েটার হাসব্যান্ডের বন্ধু, নাম সাজিদ। এই সাজিদের সাথে মেয়েটার রোজ কথা হতো। মনে হয় বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। দুইজনকেই ভালোমতো ট্র‍্যাক করে দেখেছিলাম, কিছুই পাওয়া যায়নি। আর মেয়েটার মৃত্যু তো ছাদ থেকে পড়ে হয়েছে, দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। তাই কেসটা নিয়ে খুব একটা ঘাটাঘাটি হয়নি। কেউ হয়ত ভয় দেখাতেই মেসেজ দিত, তার জন্য অতটা খুঁজে দেখা হয়নি। আর তাকে ধরতে পারলেও খুব একটা শাস্তি হতো না, কারণ সে তো আর মেয়েটাকে মেরে ফেলেনি।’

রাহাত মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। হাফিজের কথা শেষ হতেই ও বলে, ‘যতটুকু শুনলাম তাতে তো মনে হচ্ছে ওই হাসব্যান্ডই মেসেজ দিত। হয়ত রয়ার সাথে সাজিদের সম্পর্ক টের পেয়ে গিয়েছিল। এটা তো খুব সহজ কেস ছিল। ভালোমতো জিজ্ঞাসাবাদ করলে নিশ্চয়ই বের হয়ে আসত।’

কথাটা গায়ে লাগে হাফিজের। একটু উষ্ণ গলায় বলে, ‘স্যার, কেসটা দেখে যত সহজ মনে হয় অতটা সহজ না। আমরাও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু একটা জায়গায় এসে ধন্দে পড়ে গেলাম। একটা মেসেজ এসেছিল ওই রায়ান আর রয়া যখন গাড়িতে ছিল। ভ্যালেন্টাইন ডে তে ওরা একটা রিসোর্টে যাচ্ছিল। তখন নাকি মেসেজ এসেছিল। আমরা ওদের দু’জনের মোবাইল লোকেশন আর টাইম মিলিয়ে দেখেছিলাম। একসাথেই ছিল। আর এটা ওই সাজিদও বলেছিল। রয়া ওর সাথেও কথাটা শেয়ার করেছিল। রয়াও ভাবত যে হয়ত রায়ান মেসেজ দেয়। কিন্তু সেদিন নাকি রায়ান ওর পাশে বসেই ড্রাইভ করছিল। তখনই মেসেজ আসে। তার মানে রায়ান সেই অচেনা নাম্বার থেকে আসা মেসেজ দেওয়া লোকটা না। এরপর সন্দেহের তীরটা সাজিদের দিকে ঘুরে যায়। আমরা এখনও কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাইনি। তাই, কেসটা যত সহজ মনে হচ্ছে ততটা না।’

রাহাত মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘যে নাম্বার থেকে ফোন আসত সেটা ট্র‍্যাক ডাউন করে দেখেছ সিমটা আসলে কার ছিল?’

হাফিজ আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে, ‘স্যার, সেসব করা হয়েছে। এটা একটা চোরাই ফোন ছিল। যে ভদ্রলোক ব্যবহার করতেন উনি সম্প্রতি মারা গেছেন। বাসায় ওনার স্ত্রী শুধু। ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকে। তাই কেউ আর ফোন হারানো নিয়ে কমপ্লেইন করেনি।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘কেসটা আমি তদন্ত করব। ভেবেছিলাম সহজ কেস, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অপরাধী ভীষণ ধূর্ত। নিজেকে একদম আড়ালে রেখে কাজটা হাসিল করেছে। রয়ার মৃত্যু আপাত দৃষ্টিতে দূর্ঘটনা মনে হলেও আমার কেন জানি মনে হয়েছে এটা ঘটানো হয়েছে। তুমি আমাকে কেস ফাইলটা দাও তো, দেখি অদৃশ্য এই আততায়ীকে খুঁজে বার করতে পারি কি না।’

হাফিজ হাসে, অনেক দিন পর রাহাত স্যারকে এমন করে কথা বলতে শুনল। স্যার যেহেতু কেসটা নিলেন, তখন এই অদৃশ্য আততায়ী দৃশ্যমান হবেই। হাফিজ নিজেও একটা উত্তেজনা বোধ করে।

একটু পর হাফিজ হাতে করে একটা ধূসর রঙের ফাইল নিয়ে আসে, রাহাতকে দেয়। ফাইলটার দিকে একটু তাকিয়ে থাকে, একটা গোলাপের ছবি আঁকা ফাইলের উপর, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘রেড রোজ’।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই হাফিজ গলা খাকার দিয়ে বলে, ‘আগের স্যার একটু কাব্যিক ছিলেন। সময় পেলেই কবিতা পড়তেন। উনি এই কেসের নাম দিয়েছেন রেড রোজ। পড়লেই বুঝতে পারবেন স্যার।’

রাহাত মুগ্ধ গলায় বলে, ‘বাহ, দারুণ নাম দিয়েছেন তো ভদ্র‍লোক। তুমি আমাকে আরেক কাপ চা দিতে বলো, আমি পড়া শুরু করি।’

হাফিজ হাসে, স্যার এবার ডুবে যাবে কেসটায়। ইতোমধ্যেই হাতে লাল, নীল কলম দেখা যাচ্ছে। এবার পুরো ফাইল জুড়ে লাল নীল কালির অসংখ্য নোট দেখা যাবে। হাফিজ মাথা নেড়ে বের হয়ে যায়।

রাহাত যখন পুরো ফাইলটা পড়া শেষ করে ততক্ষণে রাত এগারোটা বেজে গেছে। মোবাইলে আঁন্দ্রে রিউয়ের দ্য লাস্ট রোজ অর্কেস্ট্রা বাজছে। একটু আগেই ও ইউটিউবে সার্চ দিয়ে বের করেছে। রয়ার মোবাইলের শেষ মেসেজে এই লিরিকটা ছিল। রাহাত চোখ বন্ধ করে অর্কেস্ট্রার সুরে ডুবে যায়। এত সুন্দর সুরটা!

রাহাতের হঠাৎ করেই মনে হয়, এই অদৃশ্য আততায়ী একজন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার খুনি। না হলে এমন সুন্দর একটা গান যে শোনে সে কি করে সেই গানের লিরিক থেকে মেসেজ করে!

পুরো কেসটায় রেড রোজের একটা ব্যাপার আছে, এর পেছনের কারণটা জানতে হবে। আর একটা ব্যাপার, এমন মেসেজ আসার পরেও রয়া পুলিশের কাছে যেতে চায়নি কেন? এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ। হয়ত সাজিদের সাথে প্রেমটা নিয়ে ভয় ছিল। পুলিশের কাছে গেলে তো পুরো কল লিস্ট নিয়ে টান দিত। তখন এই অজানা সম্পর্কটা সামনে চলে আসত। ইশ, রয়া একবার যদি পুলিশকে সব খুলে বলত তাহলে এই অদৃশ্য আততায়ীকে ধরে ফেলা যেত। রয়ার ব্যাপার গোপন রেখেই তদন্ত করা যেত।

পুরো কেস পড়ে একটা জিনিস অন্তত পরিস্কার। রয়াকে মানসিক চাপের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল এই অদৃশ্য আততায়ী। শেষে আর নিতে পারেনি। শেষ ফোন কলে এমন কি বলেছিল আততায়ী যেটা নিতে পারেনি ও?

রয়া বেঁচে থাকলে ওর কথাগুলো জানা যেত। তার উপায় নেই এখন। ওর কথাগুলো হয়ত সাজিদ আর রায়ানের কাছে জানা যাবে। যদি ওরা সত্য বলে, তবেই।

আরও অনেকগুলো ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে, কিছু জিনিস একটু তদন্ত করেও দেখতে হবে। নাহ আজ থাকুক, বাসায় যেতে হবে। করবি ফোন করেছিল, ধরেনি। মেসেজ করে জানিয়েছিল দেরি হবে, খেয়ে ফেলে যেন। কিন্তু বাসায় যেয়ে দেখা যাবে করবি ঠিক না খেয়ে বসে আছে। একটা মায়া টের পায় রাহাত।

২.
রাহাত বসার ঘর থেকে শুনতে পায় ছোট ছোট বাচ্চারা কচিকণ্ঠে গাইছে,

‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি,
নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।’

গানের তালে তালে ও মাথা দোলায়। কতদিন পর গানটা শুনল। বাচ্চারা গান গাইছে। সাজিদ যে গান শেখায় এটা তো কেস ফাইল পড়েই ও জেনেছিল। রাহাতের কেন জানি মনে হয় রয়া সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানবে সাজিদই। যে কথা রায়ানের সাথে শেয়ার করা যায় না সে কথা সাজিদকে অনায়াসে বলার কথা। এটা জানতেই আজ হাফিজকে নিয়ে আজ আসা। হাফিজকে নিচের নিরাপত্তা রক্ষীর সাথে কথা বলতে বলেছে, যদি কিছু জানা যায়।

একটু পর বাচ্চারা একে একে বের হয়ে যায়। আজকের মতো গান শেখা শেষ ওদের। রাহাত সস্নেহে ওদের চলে যাওয়া দেখে। সবাই বের হয়ে যেতেই সাজিদ বের হয়ে আসে, যেমনটা ভেবেছিল লোকটা তেমনই। লম্বা একহারা গড়ণ, উজ্জ্বল গায়ের রঙ, মাথার চুল এলোমেলো। এক ধরনের মানুষ আছে যাদের চোখেমুখে একটা দীপ্তি থাকে, সাজিদ সে ধরনেরই মানুষ। রাহাত অবশ্য এতে বিভ্রান্ত হয় না। এমন অনেক মানুষ দেখেছে যাদের চেহারা সুফী দরবেশের মতো, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখতেই ঘৃণ্য নরপশুর সন্ধান পেয়েছে।

সাজিদ সালাম দিয়ে বলে, ‘আপনিই তো পুলিশ অফিসার রাহাত? আমাকে ডাকলেই হতো, চলে যেতাম। আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে এসেছেন।’

রাহাত মাথা নেড়ে ওকে বসতে বলে। তারপর আলতো গলায় বলে, ‘আপনি কি শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতই শেখান? ইংরেজি গান শেখান না?’

সাজিদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘নাহ। কেন বলুন তো?’

রাহাত একটু ভেবে বলে, ‘না, আপনার এত সুন্দর গানের গলা। আমার প্রিয় একটা ইংরেজি গান শুনতাম তাহলে।’

সাজিদ আগ্রহের সাথে বলে, ‘কোন গানটা বলুন তো?’

রাহাত ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আঁন্দ্রে রিউয়ের দ্য লাস্ট রোজ গানটা।’

সাজিদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ‘এটা তো অনেক সুন্দর একটা গান। অর্কেস্ট্রার জন্য মূলত। আপনি আসলেই শুনবেন?’

রাহাত তীক্ষ্ণ চোখে সাজিদের মুখে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে। একটুও অপ্রস্তুত মনে হলো না সাজিদকে। নাকি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস?

রাহাত মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই সাজিদ খালি গলাতেই ধরে। রাহাত মুগ্ধ হয়ে গান শুনতে থাকে। এই ছেলের প্রেমে তো পড়বেই মেয়েরা, বিশেষ করে যারা গান পছন্দ করে। আর রয়া গান পছন্দ করত। কথাটা মনে হতেই রাহাতের মন খারাপ হয়ে যায়, সেই সাথে মুখের পেশি শক্ত হয়ে যায়। খুনিকে ও খুঁজে বের করবেই।

সাজিদের গান শেষ হতেই রাহাত প্রশংসা করে বলে, ‘আপনার গলার সুর দারুণ। রয়া বুঝি খুব পছন্দ করত?’

সাজিদ থতমত খেয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুখে একটা বিষণ্ণতা নেমে আসে। একটু উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। এবার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ধরা পড়ে রাহাতের চোখে। এমনটাই তো হবার কথা। সাজিদ যে রয়াকে ভালোবাসত তা ওর চোখেমুখেই ফুটে ওঠে।

সাজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘হ্যাঁ, গান খুব ভালোবাসত। বাচ্চা হয় না বলে একটা শুন্যতা ছিল, আর সেজন্য গানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল।’

রাহাত মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘সাজিদ, আপনার কাছে এসেছি রয়ার কথা জানতে। একমাত্র আপনিই ওর অজানা কথাগুলো বলতে পারবেন। তাতে আমার তদন্তে খুব উপকার হয়। আপনি তো পুলিশকে এর আগে সবই বলেছেন, তারপরও যদি কিছু থাকে যেটা বলেননি কাউকে। আছে এমন কিছু?’

সাজিদ একটু ভাবে, তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘নাহ, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। শুধু এটুকু মনে আছে, ও যেদিন মারা যায় তার আগের দিন বিকেলে আমি জোর করেই ওর ওখানে গিয়েছিলাম। আমাকে কেন এড়িয়ে যাচ্ছে সেটা জানতে। সেদিন ও সব খুলে বলেছিল, কেউ ওকে ভয় দেখাত। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ও খুব চিন্তিত ছিল। ওকে ভীষণ ভয় পেতে দেখেছি।’

রাহাত মাথা নাড়ে। এগুলো ও জানে আগেই। একটু ভেবে বলে, ‘আচ্ছা, রয়া লাল গোলাপ পছন্দ করত?’

সাজিদ মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমি তো তাই জানতাম। কিন্তু শেষ দিকে লাল গোলাপ দেখলেই ভয় পেত।’

রাহাত ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা রয়া আর কি কি পছন্দ করত, বলতে পারেন?’

সাজিদ একটু ভেবে বলে, ‘গান, লাল গোলাপের পরে যদি বলি সেটা হলো ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর কবিতা আবৃত্তি করতে খুব পছন্দ করত। ও তো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিল, তাই প্রায়ই কবিতা রিসাইট করে আমাকে পাঠাত।’

রাহাত মথা নাড়ে। হাতঘড়ির দিকে তাকায়, তারপর বলে, ‘আজ একটু তাড়া আছে। আরেকদিন আসব। আর আমি যে এসেছিলাম এটা কাউক না বললেই ভালো।’

সাজিদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। রাহাত উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যাবার আগমুহূর্তে হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, বলে, ‘আচ্ছা, আপনার না একটা বাইনোকুলার আছে, দেখি একটু।’

সাজিদ ইতস্তত করে একটু। তারপর ভেতরের রুমে চলে যেয়ে বাইনোকুলার নিয়ে আসে। রাহাত হাতে নিয়ে দেখে, শক্তিশালী যন্ত্র। জানালার কাছে এসে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে বলে, ‘রয়ার বাসার ছাদটা একটু দেখিয়ে দিন তো।’

সাজিদের কেমন এলোমেলো লাগছে। এই লোকটা কী চায় ওর কাছে? ও জানালার কাছে এসে সামনের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দেয়। রাহাত এবার সোজা রয়ার বাসার ছাদের দিকে বাইনোকুলার তাক করে। আলো জ্বলছে ছাদে। জুম করতেই দেখতে পায় ছাদের রেলিঙ। মন খারাপ হয়ে যায় রাহাতের। সাজিদের তাহলে কেমন লেগেছিল দৃশ্যটা দেখে?

রাহাত চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘রয়া পড়ে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে ফোনটা আসে। আচ্ছা, রয়া যখন কথা বলছিল তখন কি ও খুব বেশি উত্তেজিত ছিল?’

সাজিদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি ওকে জুম করে দেখছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ভীষণ ভয় পেয়েছে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কী হচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যেই ও পড়ে গেল, আর আমি এপাশ থেকে অসহাতের মতো চেয়ে চেয়ে দেখলাম।’

কথাটা বলেই সাজিদ মুখ চেপে ধরে, কান্নাটা সামলায়।

রাহাত ওকে সান্ত্বনা দিতে যেয়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে হয়। রয়া পড়ে যাবার ঠিক আগ মুহুর্তে ওর মোবাইলে সেই আততায়ীর কল এসেছিল। তারমানে সাজিদ যদি সত্যিই সেদিন বাসায় থেকে থাকে তাহলে সে অদৃশ্য আততায়ী না। কারণ সে সময় মোবাইলের কল লোকেশন ছিল হাতিরঝিলের আশেপাশে, ইকবাল রোডে না। রাহাত উত্তেজনা বোধ করে। কোনোভাবে যদি জানা যায় সাজিদ ওইদিন আসলেই বাসায় ছিল বাইনোকুলার হাতে তাহলে কেসটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

রাহাত ওর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়, তারপর বিদায় নেয়। গেট দিয়ে নামার সময় সিসি ক্যামেরা নজরে পড়ে। রাহাত ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তারপর হাফিজকে ডেকে বলে, ‘হাফিজ, এই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নাও। বিশেষ করে রয়া যেদিন ছাদ থেকে পড়ে গেল সেদিনের।’

ফেরার পথে রাহাত চিন্তিত মুখে ভাবতে থাকে, যদি দেখা যায় সেদিন সত্যিই সাজিদ বাসায় ছিল না, তাহলে?

(চলবে)