রেড রোজ পর্ব-০৫

0
170

#রেড রোজ (পর্ব ৫)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস

১.
হাফিজ মনে মনে আফসোস করছে, ইশ, এই ব্যাপার তো আগে মাথায় আসেনি। ওরা এতদিন দু’জনকেই সন্দেহ করে অযথা সময় নষ্ট করেছে। রাহাত স্যার তো প্রথমেই দারুণ একটা বুদ্ধি বের করেছে। নাহ, ব্যাপারটা আগেই ভাবা উচিত ছিল।

রাহাত আজ সকাল সকাল থানায় চলে এসেছে। হাফিজের দিকে তাকাতেই ও আগ বাড়িয়ে বলে, ‘স্যার, আপনার কথাই ঠিক। ওই সাজিদ নামের ভদ্রলোক ওইদিন বাসায়ই ছিলেন। আমি সিসিটিভির ফুটেজ নিয়ে আসছি। দুপুরে অল্প সময়ের জন্য বের হয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আর বের হননি।’

রাহাত স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে, যাক, একটা দিক তাও নিশ্চিত হওয়া গেল, সাজিদ সেই অদৃশ্য আততায়ী না। তাহলে সাজিদের বলা কথাগুলো আসলেই সত্য। সেদিন ও রয়াকে পড়ে যেতে দেখেছিল। আচ্ছা, রয়া ফোন পেয়ে এত ভয় পেয়েছিল কেন? এত ভয়ই পেল যে একবারও খেয়াল করল না ও পড়ে যাচ্ছে? নাকি ও অদৃশ্য আততায়ীর গলা চিনে ফেলেছিল?

রাহাত হাফিজের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হাফিজ, তোমার কেস ফাইলে লেখা আছে রয়া যেদিন মারা যায় সেদিন কেউ ফুল পাঠিয়েছিল। ফুলের দোকানে একবার চেক করেছিলে?’

হাফিজ এবার আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, ‘স্যার, সেটা একদম ঠিকঠাক চেক করেছি। ওদের ওখানে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। অনেকেই নাকি এমন ফুল পাঠিয়ে থাকে প্রিয়জনকে। তাই ওরা এগুলো নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না।’

রাহাত জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘ফুলের দোকানটা কোথায়?’

হাফিজ একটু মনে করার চেষ্টা করে, তারপর বলে, ‘স্যার, এটা গুলশান ১ এ। আমি নিজেই তদন্ত করতে গিয়েছিলাম।’

রাহাত একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা, রায়ানের অফিসও তো গুলশানে, তাই না?’

হাফিজ মাথা নেড়ে বলে, ‘স্যার, এই ব্যাপারে আমারও একটু সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু কোনো প্রমাণ তো পাইনি যে ফুল ওই রায়ান পাঠিয়েছিল।’

রাহাত মাথা নাড়ে। এখানেই মূল সমস্যা এই কেসের। আততায়ী বুঝে শুনে এমন একটা দোকানে গেছে যেখানে সিসি ক্যামেরা নেই। রাহাতের ভীষণ অসহায় লাগে, পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এই ফোন রয়ার হাসব্যান্ড রায়ানই করত, কিন্তু শুধুমাত্র প্রমাণের অভাবে কিছুই করা যাচ্ছে না। রাহাত একটু ভাবে, তারপর মোবাইলের গুগল ম্যাপ অপশন খোলে। সার্চ দেয় গুলশান ১ থেকে ইকবাল রোড, রায়ানের বাসা, পর্যন্ত। মুহুর্তেই ম্যাপে গুলশান থেকে গাড়িতে করে ইকবাল রোড পর্যন্ত আসার রাস্তাটা ভেসে ওঠে। রাহাত এবার হাফিজকে ডাক দেয়, ‘হাফিজ, তুমি কেস ফাইলটা খোল। রয়ার কাছে যে চারটা মেসেজ আর একটা কল এসেছিল তার লোকেশন বলো তো।’

হাফিজ ফাইল খুলে লোকেশনগুলো বলতে থাকে, ‘স্যার প্রথম মেসেজ আসে ফেব্রুয়ারি মাসের এক তারিখ, সময় বিকাল ৫.৩১ মিনিট, লোকেশন চন্দ্রিমা উদ্যানের আশেপাশে। দ্বিতীয় মেসেজ আসে ফেব্রুয়ারির সাত তারিখ, সময় রাত ৯.৪৩ মিনিট, লোকেশন সামরিক জাদুঘর। তৃতীয় মেসেজ আসে ফেব্রুয়ারি ১৪ তারিখ, দুপুর ১১.৪৭ মিনিট, লোকেশন ইকবাল রোড। এইদিন ওরা রিসোর্টে যাচ্ছিল। আর শেষ মেসেজটা আসে এপ্রিলের ১৩ তারিখ, বিকেল ৫.২৩ মিনিট, লোকেশন হাতিরঝিল। আর কলটাও তখনই, একই লোকেশন।’

রাহাত ওর মোবাইলে গুগল ম্যাপের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। একটু পর মুখ তুলে বলে, ‘চারটা মেসেজের তিনটা আর ফোন কলের লোকেশন রায়ানের বাসা থেকে অফিস ফেরার পথে। এবং প্রতিটা সময় রায়ান বাইরে ছিল, শুধুমাত্র ১৪ তারিখে ওরা যখন রিসোর্টে যায় সেদিন মেসেজটা যখন আসে তখন ও পাশেই ছিল। এটা খুব অদ্ভুত। আর মেসেজটা এসেছেও ইকবাল রোড থেকে। সেক্ষেত্রে জোর সম্ভাবনা যে মেসেজটা সাজিদ করেছে। কারণ সেদিন সকালে ও ওদের বেরিয়ে যেতে দেখেছিল। ঈর্ষাকাতর হয়ে মেসেজ দিতেই পারে। কিন্তু সাজিদ তো অদৃশ্য আততায়ী না? তাহলে রিসোর্টে যাবার সময় রায়ান কি অন্য কাউকে দিয়ে মেসেজটা দিয়েছে যাতে ওকে কেউ সন্দেহ না করে?’

হাফিজ মাথা নেড়ে বলে, ‘স্যার আমার মনে হয় এই মেসেজটা রায়ান দেয় নাই। কারণ রিসোর্টের জন্য এত টাকা খরচ করে বুকিং দেওয়ার পরে কেউ কি আর এমন মেসেজ দেয়? কারণ এমন মেসেজ পাওয়ার পরে রয়া যে রায়ানের সাথে যাবে না এটা তো জানা কথা। সে ক্ষেত্রে এতগুলা টাকা শুধু শুধু নষ্ট করার কথা না। তাই রায়ান ওইদিন মেসেজটা দেবার কথা না স্যার।’

রাহাত সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল চোখে বলে, ‘তুমি একদম ঠিক বলেছ, এই পয়েন্টটা আমি ভেবে দেখিনি। রায়ান জেনে শুনে এতগুলো টাকা নষ্ট করার কথা না। আচ্ছা ওরা যেন কোন রিসোর্টে উঠার কথা ছিল? ওটা কি চেক করেছিলে যে রায়ান আসলেই রিসোর্টের বুকিং দিয়েছিল কি না?’

হাফিজ নিজেকে মনে মনে কষে একটা চড় মারে, ইশ! আসলেই তো এটা খোঁজ নেওয়া হয়নি। ও আমতা আমতা করে বলে, ‘স্যার এটা অবশ্য আমরা খোঁজ নেই নাই। ওদের বয়ানেই তো বলেছিল ওরা রিসোর্টে যায়নি, তাই আর খোঁজ নেইনি। আমরা মেসেজ নিয়েই পড়েছিলাম। আচ্ছা স্যার, এখনই খোঁজ নিচ্ছি।’

রাহাত মাথা নাড়ে। হাফিজ খুব ভালো একটা পয়েন্ট ধরেছে। দেখা যাক কী বের হয়। এর মধ্যে হাতের কাজ গুছিয়ে নেওয়া যাক।

বিকেল নাগাদ হাফিজ ওর রুমে ঢোকে, চোখেমুখে উত্তেজনা টগবগ করছে। উত্তেজিত গলায় বলে, ‘স্যার এই রায়ান তো সত্যি সেদিন রিসোর্টের বুকিং দেয়নি, আপনার কথাই ঠিক। রায়ান সাহেবের ফোন নাম্বার দিলাম, ওদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনের নাম পর্যন্ত দিলাম। কিন্তু ওরা জানাল এই নামে কোনো বুকিং ছিল না অথবা বুকিং ক্যানসেল হয়েছে এমন তথ্যও ওদের কাছে নেই। তার মানে পুরো ধাপ্পা মেরেছে লোকটা!’

রাহাত চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘এত আয়োজন করে রয়াকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিল, অথচ রিসোর্ট বুকিং না দিয়েই! এ ধরনের রিসোর্টে সাধারণত অনেক আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। অথচ রায়ান বুকিং না দিয়েই রয়াকে নিয়ে যাচ্ছিল! ও কি জানত যে মেসেজটা আসবে? আর এই মেসেজ আসার পরে রয়া যে ওর সাথে যাবে না সেটাও ও নিশ্চিত ছিল? নাহ, এখন আর কোন সন্দেহ নেই যে মেসেজগুলো রায়ানই করত। কিন্তু একটা খটকা রয়েই গেল, সেদিন রিসোর্টে যাবার সময় মেসেজটা রায়ান করেনি, অন্য কেউ রায়ানকে সাহায্য করেছিল, সেটা কে?’

হাফিজের কাছেও ব্যাপারটা এখন একদম পরিস্কার। ও উত্তেজিত গলায় বলে, ‘স্যার ওই রায়ান বেটারে ধইরা আইনা ভালো কইরা একটা ডলা দেই, তাইলেই সব খুইলা বলব।’

রাহাত হাসে, তারপর বলে, ‘নাহ, সেটা করলে লাভ নেই। ও যদি রিসোর্ট বুকিং নাও দেয় তাতে তো আর এটা প্রমাণ হয় না যে মেসেজ ওই দিত। আমরা সন্দেহ করতে পারি। আদালত অকাট্য প্রমাণ চাবে। সেটা দরকার আমাদের। রায়ানকে আপাতত কিছু জিজ্ঞেস করা বোকামি হবে তাতে ও আরও সাবধান হয়ে যাবে। এখন একটা কাজ খুব জরুরি দরকার। ট্রাফিক বিভাগের সাহায্য লাগবে, কয়েকটা সিসিটিভি ফুটেজ দরকার।’

হাফিজের এবার বুঝতে দেরি হয় না, চকচকে চোখে বলে, ‘আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি স্যার কোন ভিডিও ফুটেজ চাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি এক, সাত, আর এপ্রিল মাসের তের তারিখের, ঠিক না স্যার?’

রাহাত হাসে, বলে, ‘একদম ঠিক ধরেছ। এই তিনটে মেসেজ যে স্পট থেকে এসেছে তার আশেপাশে রায়ানের গাড়ি অথবা রায়ানকে দেখা যাওয়ার কথা। আমার কেন জানি মনে হয় কাজটা ও গাড়িতে বসেই করেছে। আর সেক্ষেত্রে প্রথম মেসেজ দুটো যেখান থেকে এসেছিল, চন্দ্রিমা উদ্যান আর সামরিক জাদুঘর, সেটা রায়ানের বাসায় ফেরার রুট। আর শেষের মেসেজ হাতিরঝিল, সেটাও ওর রুটের পাশেই পড়ে। একটু ঘোরা হয়। এই সব জায়গাতেই মূল রাস্তায় ট্রাফিকের সিসি ক্যামেরা আছে। রায়ান যদি সেই অদৃশ্য আততায়ী হয় তাহলে ওর গাড়ি ঠিক ওই সময়টাতে ওখানেই থাকার কথা। হাফিজ, তুমি এখনই ব্যবস্থা করো।’

হাফিজ আশ্বস্ত করে বলে, ‘স্যার, কাল সকালেই রিপোর্ট পেয়ে যাবেন।’

রাহাত মাথা নাড়ে। একবার যদি এগুলো সব মিলে যায়, তখন রায়ানকে চেপে ধরতে হবে।

ট্রাফিক বিভাগের সিসিটিভির ফুটেজ পেতে পেতে তিনটা দিন পার হয়ে যায়। রাহাত এর মধ্যে রায়ানদের বাসার সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলেছে। একটা ঘটনা কেউ উল্লেখ করেনি, সেদিন নাকি রয়ার বাসায় একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এসেছিল। রয়া যে খাটে ঘুমিয়েছিল সেখানে সিলিং ফ্যানটা নাকি হঠাৎ ছিড়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল। অল্পের জন্য নাকি রয়া বেঁচে যায়। রাহাত সেই মিস্ত্রির সাথেও কথা বলে জেনেছে যে ফ্যানের নাটবল্টু নাকি লুজ ছিল।

রাহাত সেদিন এটাই ভাবছিল, রায়ান হয়ত রয়াকে সরাসরি না হলেও একটা দূর্ঘটনা সাজিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কথাটা ভাবতেই ওর চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়।

হাফিজকে ডাকতেই ও একটা পেনড্রাইভ নিয়ে ঢোকে, উত্তেজিত গলায় বলে, ‘স্যার, ট্রাফিক বিভাগ একদম গাড়ির নাম্বার, সময়, লোকেশনসহ একটা রিপোর্ট দিয়েছে, সাথে এই ভিডিওটা। আপনার ধারণা একদম ঠিক স্যার। ঠিক ওই সময়গুলোতেই রায়ানের গাড়ি স্পটের আশেপাশে দেখা গেছে।’

হাফিজের কথা শেষ হতে হতে রাহাত ততক্ষণে পেনড্রাইভ থেকে ভিডিওটা ওপেন করে ফেলেছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ভিডিওটা দেখে। ট্রাফিক পুলিশ একটা বৃত্ত দিয়ে রায়ানের গাড়িটা চিহ্নিত করে দিয়েছে। প্রথম মেসেজের সময় গাড়িটা ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে ছিল। দ্বিতীয় মেসেজের সময় গাড়িটা জ্যামে ধীরে ধীরে চলছিল। গাড়ির ভেতরে দেখার উপায় নেই। রাহাত এবার শেষ মেসজের আর ফোন কলের লোকেশনটা দেখে। এক্ষেত্রে গাড়িটা হাতিরঝিলে ঢুকতে দেখা গেছে, কিন্তু কোথাও থামেনি। তাহলে? গাড়ির ভেতর থেকেই তবে মেসেজ আর কল দিয়েছে? ইশ, একটাবার যদি ওকে দেখা যেত! যাক, এটাও কম পাওয়া না। এটুকুতে অন্তত এটা পরিস্কার রায়ানই সেই অদৃশ্য আততায়ী। এখন অন্তত রায়ানের মুখোমুখি হওয়া যায়। দেখা যাক ওর বক্তব্য কি।

২.
রায়ান একটা অস্বস্তি নিয়ে পুলিশ অফিসে বসে আছে। এই থানার নতুন পুলিশ অফিসার ওর সাথে কেসের ব্যাপারে একবার আলাপ করতে চায়। রায়ান বলেছিল, ও তো ওর যা বলার সবই বলেছে। তখন ওপাশ থেকে ওকে আশ্বস্ত করে বলেছিল এটা নাকি সৌজন্য সাক্ষাৎ। কিন্তু কেন জানি ওর কাছে এটা সৌজন্য সাক্ষাৎ মনে হচ্ছে না। একটা আলাদা রুমে ওকে বসিয়েছে। এই রুমে আগেও অনেকবার এসে বসেছে ও। ঘন্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এরা। দেখা যাক আজ কি বলে এরা আবার।

রাহাত কাচের ভেতর দিয়ে একবার দেখে রায়ানকে। সাদা শার্ট, ছাই রঙের প্যান্ট, চকলেট রঙের জুতো, বেল্ট। চোখে একটা সুন্দর বাদামি ফ্রেমের চশমা। একদম কর্পোরেট লুক। এমন একটা মানুষের ভেতর কি সত্যিই কোনো ভয়ংকর খুনি বাস করে? রাহাত কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

ভাবনাটা মন থেকে তাড়িয়ে ও ভেতরে ঢুকেই হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘আমি রাহাত, এই থানার দায়িত্বে আছি। আপনি নিশ্চয়ই রায়ান?’

রায়ান মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলে, ‘জ্বি, আমি রায়ান।’

রাহাত বসতে বসতে বলে, ‘আসলে এখানে আমি নতুন এসেছি। আপনার স্ত্রীর কেসটা নিয়ে দেখলাম কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলি।’

রায়ানের চোখেমুখে একটা দুঃখভাব ফুটে ওঠে, মনমরা গলায় বলে, ‘সেই লোকটা যে রয়াকে ভয় দেখাত তাকে খুঁজে বার করুন প্লিজ। ওর জন্যই আমার রয়া ছাদ থেকে পড়ে মারা গেল।’

রাহাত রায়ানের গলায় নিখাদ মায়া টের পায়। মাথা নেড়ে বলে,’হ্যাঁ, অবশ্যই। সেই লোকটাকে ধরতে আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, সেদিন আপনি হঠাৎ করে কেন লাল গোলাপ নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলেন? আর মেসেজও আসলো যে একজন লাল গোলাপ হাতে খুনি আসছে রয়াকে মেরে ফেলতে। এটা কি নিছকই কাকতাল?’

রায়ান মনে মনে সতর্ক হয়। ধীরে ধীরে রাহাত নামের লোকটা ওকে জিজ্ঞাসাবাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ও মন খারাপ গলায় বলে, ‘আসলে রয়া লাল গোলাপ খুব পছন্দ করত। বিয়ের পর প্রতিদিন আমি এই লাল গোলাপ নিয়ে আসতাম। একদিন না আনলেই অভিমান করত। সময় গড়াল, ভালোবাসা ফিকে হতে থাকল, তার সাথে বাচ্চা না হবার যন্ত্রণা। আমরা দু’জনেই দু’জনের কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছিলাম। রয়াকে আমি হারিয়ে ফেলছিলাম। তাই এবারে যখন ভ্যালেন্টাইন সপ্তাহ শুরু হলো, হঠাৎ করেই আমার মনে হলো পুরনো প্রেমটা আবার নতুন করে জুড়া যায় কি না। তাই ফেব্রুয়ারির সাত তারিখ যেদিন ছিল রোজ ডে, সেদিন ওর জন্য লাল গোলাপ নিয়ে আসি। এরপর প্রতিদিন যা যা করার কথা তাই করি। রয়াও খুব খুশি ছিল, ফিরে আসছিল। শুধু ওই মেসেজগুলো সব এলোমেলো করে দিল।’

শেষের কথাটা সত্যিকারের আক্ষেপ নিয়েই বলে রায়ান।

রাহাত মাথা নেড়ে বলে, ‘আসলেই, ওই লোকটা সব এলোমেলো করে দিয়েছে। আচ্ছা রায়ান, একটা জিনিস জানার ছিল। সেদিন আপনারা যখন রিসোর্টে যাচ্ছিলেন সেটা কবে বুকিং করেছিলেন?’

রায়ান একটু থমকায়, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহাতের দিকে, ঠোঁটে হালকা একটা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি ফুটে ওঠে। সামনে ঝুঁকে এসে বলে, ‘রাহাত সাহেব, আপনি খুব ভালো করেই জানেন যে সেদিন আমি রিসোর্ট বুকিং দেইনি। প্রশ্নটা এমন করে করলেন তাতে আপনি ভেবেছিলেন আমি রিসোর্ট বুকিং দেবার একটা তারিখ বলব। অবশ্য আপনাকে দোষ দেই না, আপনি তদন্ত করছেন তাই প্রশ্নটা মাথায় আসা খুব স্বাভাবিক। আমরা রিসোর্টে বেড়াতে যাচ্ছিলাম অথচ আমি কেন রিসোর্ট বুকিং দেইনি। কারণ রিসোর্টটা আমার বন্ধুর। ওকে বলে রেখেছিলাম। এক দু’টো রুম সবসময় মালিকপক্ষের জন্য রিজার্ভ থাকে। আসলে রয়ার তো তখন হঠাৎ করেই মুড চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছিল। তাই ফরমালি কোনো বুকিং দেইনি। আপনি চাইলে ব্যাপারটা চেক করে দেখতে পারেন। এই যে আমার বন্ধুর নাম্বার।’

রাহাত তাকিয়ে থাকে ওর মোবাইলের স্ক্রিণের দিকে, যেখানে আবু সুফিয়ান নামে একজনের মোবাইল নম্বর দেখা যাচ্ছে। একটা ধাক্কা খায় মনে মনে। ভেবেছিল, প্রশ্নটা শুনে রায়ান ঘাবড়ে যাবে, আমতাআমতা করবে। খোঁড়া যুক্তি দেবে। কিন্তু একবারের জন্যও ওর গলা কাঁপেনি। শক্ত নার্ভের মানুষ। দেখা যাক, কতক্ষণ এই নার্ভ থাকে।

রাহাত ফোন নাম্বারটা নেয়, তারপর বলে, ‘কিন্তু ফেব্রুয়ারি ১, ৭ আর ১৩ এপ্রিল, এই তিনদিন যে লোকেশন থেকে মেসেজ আর কল এসেছিল আপনার গাড়ির অবস্থানও তার আশেপাশেই ছিল। প্রথম ক্ষেত্রে সেটা ছিল চন্দ্রিমা উদ্যানর পাশে, এরপর সামরিক জাদুঘর আর পরেরটা হাতিরঝিল। আপনি কি বলবেন এটাও কাকতাল ছিল?’

শেষের কথাটা একটু কঠিন সুরেই বলে রাহাত।

রায়ান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা রাহাত সাহেব, প্রথম মেসেজটার লোকেশন যদি চন্দ্রিমা উদ্যান না হয়ে গুলশান আড়ং হতো, দ্বিতীয় মেসেজের ক্ষেত্রে সামরিক জাদুঘর না হয়ে মহাখালী হতো, আর তৃতীয় মেসেজের ক্ষেত্রে হাতিরঝিল না হয়ে তেজগাঁও ফ্লাইওভার হতো, তাতে কি হিসেবটা বদলে যেত? আপনি তো সেখানেও আমার গাড়ি দেখতেন। কারণ এই পুরো রাস্তাটা আমার বাড়ি ফেরার রাস্তা। কেউ নিশ্চয়ই এটা জানে। আর এটাও জানে আমি কখন অফিস থেকে বের হই। আর ফেব্রুয়ারি ১৪ তারিখ যে মেসেজটা আসে তখন তো আমি রয়ার পাশেই ছিলাম। আমি যে সেই অদৃশ্য মেসজকারী না এটা তো পরিস্কার। তাই আমাকে অযথা সন্দেহ না করে আসল অপরাধীকে খুঁজে বার করুন। আপনার আর কোনো জিজ্ঞাসা না থাকলে আমি যেতে চাই।’

রাহাত এবার সত্যিই বেকায়দায় পড়ে যায়। রায়ানের কথায় যুক্তি আছে। আসলেই তো, অন্য কেউ যদি আগে থেকেই চন্দ্রিমা উদ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে আর রায়ানের গাড়ি দেখা মাত্রই মেসেজ পাঠায় সেক্ষেত্রে রায়ানের উপরই দোষটা যেয়ে পড়বে। আর রায়ান যে মেসেজ দেয়নি তার প্রমাণও তো আছে। ১৪ তারিখের দিন ও তো পাশেই ছিল রয়ার। আর মেসেজ লোকেশনও আলাদা, ইকবাল রোড। নাহ, সব কেমন পেচিয়ে গেল। হয় রায়ান আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে না হলে অন্য কেউ এর পেছনে জড়িয়ে আছে।

রাহাত ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘ঠিক আছে আপনি আসুন। লাগলে আবার ডাকব আপনাকে।’

রায়ান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, ‘অবশ্যই ডাকবেন রাহাত সাহেব। তবে আমার মনে হয় আপনি আমার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করছেন। আসি, ধন্যবাদ।’

রাহাত ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, একটা পরাজয় টের পায়। প্রশ্নের উত্তরগুলো যেন সব গুছিয়েই এসেছিল, এতটুকু অপ্রস্তুত হয়নি। এতটা শক্ত নার্ভ!

সেদিন রাতে রাহাত বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষে করবীর সাথে গল্প করছিল। করবী ওর কথা না শুনে মোবাইলে কি যেনো করছিল। রাহাত বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কি ব্যাপার, আমার কথা শুনছ না। কি করছ মোবাইলে বলো তো?’

করবী হেসে বলে,’আর বলো না। গতবার তো আমার প্রিয় বান্ধবী রিক্তার জন্মদিনটাই ভুলে গেলাম। ওকে উইশ করে মেসেজ দেইনি তাতে খুব রাগ করেছিল। আর ক’দিন পরেই ওর জন্মদিন। তাই এবার আগে থেকেই মেসেজ লিখে সময় আর তারিখ ঠিক করে দিলাম যাতে সেদিন ঠিকঠাক মেসেজ পেয়ে যায় ও।’

রাহাত আধশোয়া হয়ে কথা বলছিল। করবীর কথা শুনে তড়াক করে উঠে বসে, উত্তেজিত গলায় বলে, ‘কি বললে তুমি? মানে আজ মেসেজ লিখে তারিখ আর সময় সেট করে রাখলে, সেটা ওইদিন ওইসময় অটোমেটিক চলে যাবে?’

করবী ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘হ্যাঁ, যাবে তো। এই আজ যেমন আগস্ট মাসের ২১ তারিখ। রিক্তার জন্মদিন ২৫ তারিখ। আমি আজকেই ‘শুভজন্মদিন রিক্তা’ মেসেজটা লিখে তাতে ২৫ তারিখ সকাল ৯টা সময় সেট করে দিলাম। এখন আমি যদি ভুলেও যাই তবুও মেসেজটা অটোমেটিক ওইদিন ওইসময়ে চলে যাবে। তুমি এই সিম্পল জিনিসটা জানো না? তুমি পুলিশে চাকরি করো না অন্য কিছু!’

রাহাতের কাছে হঠাৎ করেই সব পরিস্কার হয়ে যায়, কি করে রায়ান রয়ার পাশে বসেও মেসেজটা পাঠিয়েছিল। মেসেজটা আগেই লিখে তারিখ আর সময় সেট করে রেখেছিল। ইশ, এটা ওর মাথাতেই আসেনি একবারও। এবার বেটাকে ও ছাই দিয়ে ধরবে।

রাহাত এবার করবীকে জড়িয়ে ধরে, খুশি খুশি গলায় বলতে থাকে, ‘আহ, কি একটা ক্লু দিলে। একটা বিরাট খটকা তুমি দূর করে দিলে। পুরো কেসের মোড়টাই ঘুরে গেল। এই না হলে আমার বউ।’

শেষ কথাটা বলে রাহাত করবীর গালে শব্দ করে একটা চুমু খায়। করবি একটা হাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, ‘হয়েছে, আহ্লাদ করতে হবে না। এতক্ষণ তো মুখ অন্ধকার করে বসেছিলে।’

রাহাত হাসে, তারপর বলে, ‘করবী, তুমি ভাবতে পারো কী নিষ্ঠুর মানুষ ওই রায়ান! আমি ওকে ওর অপরাধের শাস্তি দিয়ে ছাড়ব।’

সেদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে একটা কথা মনে হতেই রাহাত আবার ধন্দে পড়ে যায়। আচ্ছা, ও ধরেই নিয়েছে এই মেসেজটা রায়ানই আগে থেকে মোবাইলে তারিখ আর সময় সেট করে পাঠিয়েছিল। কিন্তু এটা যে রায়ানই পাঠিয়েছিল তার প্রমাণ কী? একটা ক্ষেত্রেও রায়ানই যে মেসেজ করেছে তার কোনো প্রমাণ নেই। সেই মোবাইল আর সিমটাও যদি রায়ানের কাছে পাওয়া যেত তাহলে একমাত্র ওকে অপরাধী প্রমাণ করা যেত। রাহাত একটা হতাশা টের পায়। একটা শক্তপোক্ত প্রমাণ যে খুব দরকার!

(চলবে)