রৌদ্র মেঘের আলাপণ পর্ব – ০২

0
492

#রৌদ্র মেঘের আলাপণ
#পর্ব-২
#WriterঃMousumi Akter

নিজের জীবনের সব থেকে পছন্দের মানুষ টা কে সাদা শাড়িতে বিধবা দেখার মত ভয়ংকর যন্ত্রণা বোধহয় এই পৃথিবীতে আর নেই।যে মানুষ টাকে রঙিন শাড়িতে রাঙিয়ে রাখতে চেয়েছিলো, যে মানুষ টার হাসি মুখ দেখার জন্য পৃথিবীর সব কিছু তছনছ করতে পারতো রৌদ্র আজ সেই মানুষ টার জীবন রংহীন, হাসিহীন অন্ধাকারআচ্ছন্ন।গিটারে টুং টাং বিষাদের সুর তুলেছে রৌদ্র।হাতে জলন্ত সিগারেট তার।মাঝে মধ্য স্মোক করার অভ্যাস আছে তার।খুব টেনশন হলে সিগারেট কে হাতিয়ার করে সে।তবে এটা তার অভ্যাস ছিলো না, কেউ একজন ছেড়ে যাবার পরেই মাঝে মধ্য অতিরিক্ত চিন্তা থেকে দূর হতেই স্মোক হাতে নেয়।

আনোয়ার হোসেন এবং সেলিনা বেগমের দুই সন্তানের মাঝে রৌদ্র বড় সন্তান আর ছোট মেয়ে তৃধা। দুই সন্তান ই তাদের চোখের মনি।আনোয়ার হোসেন একজন ব্যাবসায়ী। আগে তার অবস্থা খুব একটা ভাল ছিলো না, ব্যাবসায়ী হলেও আগে এতটা ভাল দিন ছিলো না।মধ্যবিত্ত একটা সুখের সংসার ছিলো তাদের।একটা অজানা ঝড় এসে তাদের সুখের সংসার তছনছ করে দিয়েছিলো।নিজের একমাত্র মেয়ে হঠাত একদিন কলেজ থেকে আর বাড়ি ফিরে নাহ।সারারাত মেয়েকে খুজেও পাওয়া যায় না। পরের দিন গনধর্ষন করে কেউ বা কারা রাস্তায় ফেলে যায়।কে বা কারা আজ ও খুজে পাওয়া যায় নি তাদের।পত্রিকায় পত্রিকায় নিউজে নিউজে হেডলাইন হয়ে হয়ে গেছিলো।সেই সময়ে টিভি নিউজ খুললে ব্রেকিনহ নিউজ হিসাবে তৃধার গণধর্ষন দেখাতো।পরে জানা যায় একটা ছেলের সাথে তৃধার রিলেশন হয়, আর সেই ছেলেটার সাথে কোথাও ঘুরতে গেছিলো আর সেই তার বন্ধুদের নিয়ে ধর্ষণ করে তৃধাকে।রাতের আধারে কাউকে দেখতে পারে নি তৃধা।ছেলেটার সাথে অন লাইনে এক বছর রিলেশন হয়,আর সেদিন ই তাদের প্রথম দেখা ছিলো,এটা ছাড়া আর কিছু বলতে পারে নি তৃধা।না কোনো ছবি না কোনো প্রমান কিছুই দেখাতে পারে নি তৃধা পুলিশকে।আজ দু ‘বছরের বেশী সময় হয়ে গিয়েছে তৃধা অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।এই দুই বছরে নিজের ঘর ছাড়া বাইরে যায় নি তৃধা।বোনের সাথে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনায় রৌদ্র ধীরে ধীরে আরো ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে।দিনে দিনে পলিটিক্স এ জড়িয়েছে আর বেশী করে।একজন বদরাগী,ক্ষিপ্ত মানুষে পরিণত হয়েছে সে।বাবার ব্যাবসায় মন দিয়ে দু’বছরে অনেক ডেভেলপ করে।রৌদ্রের বাবা এখন বিজনেস এ মন দিয়েছেন।রৌদ্র পলিটিক্স এর পাশাপাশি ব্যাবসা ও দেখছে বাবার সাথে।বয়স ত্রিশে পা দিয়েছে রৌদ্রের,পারিবারিক ঝামেলা কাটিয়ে উঠে এখন তাদের সময় খুব ভাল যাচ্ছে।একটা ঘটনার জন্য পুরা ফ্যামিলি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকুক সেটা চায় না আনোয়ার হোসেন এর বাবা।সে তার একমাত্র পুতার বৌ দেখতে চায়।তাছাড়া আনোয়ার হোসেন ও চাইছেন অতীত ভুলে ছেলে মেয়ে বিয়ে দিয়ে সুখের জীবন যাপন করতে।কিন্তু রৌদ্রকে কোনো ভাবেই বিয়েতে রাজি করানো যাচ্ছে না।গত ছয় মাসে কয়েক শ মেয়ে দেখানো হয়েছে অথচ রৌদ্র রাজি হয় হয় নি।বিয়ের কথাটা শুনলেই রেগে যায় রৌদ্র।

ক্লাস এইটে পড়তো তখন মেঘ।রৌদ্রর ভার্সিটির পাশ দিয়ে রোজ হেঁটে স্কুলে যেতো।তখন বর্ষাকাল, বর্ষার প্রথম কদম ফুটেছে গাছে।মেঘ একটা স্কার্ট আর একটা গেঞ্জি পরে কদম ফুল পাড়ার জন্য লাফাচ্ছিলো।বার বার লাফ দিয়ে গাছের ডাল ধরার চেষ্টা করছিলো।রৌদ্র তখন বাসা নিয়ে থাকতো আলাদা অস্ট ইউনিভার্সিটি এর পাশে।বাচ্চা মেয়েটির কদম পাড়া দেখে রৌদ্র মুগ্ধ হয়েছিলো।সে নিজে কয়েক টা কদম ছিড়ে মেঘের হাতে দিয়ে বলেছিলো কদম ফুল কি খুব পছন্দের।মেঘ এত গুলো কদম ফুল একসাথে পেয়ে খুশি হয়ে বলেছিলো হ্যাঁ।

–খুশি হয়েছো এই ফুল গুলো পেয়ে?

–খুব।

–নাম কি তোমার?

–মেঘ।

–ভারী মিষ্টি নাম তো তোমার।কোন ক্লাসে পড়ো।

–এইটে।

–নিব্বি বালিকা।কাল যদি আবার ও কদম ফুল চাই এখানে চলে এসো।

–মেঘ রোজ ফুল নিতে আসতো আর রৌদ্র অপেক্ষা করতো।

এভাবেই শুরু হয়েছিলো রৌদ্র আর মেঘের আলাপন।ধীরে ধীরে রৌদ্রর ভিতরে জন্ম নেয় ভয়ংকর রকমের ভালবাসা মেঘের জন্য। যে ভালবাসায় পাগল ছিলো রৌদ্র।এক ভাবে ছয়টা বছর ফলো করেছে সে মেঘ কে।এই মেঘের জন্য সব কিছু তছনছ করতে পারতো রৌদ্র।কিন্তু ভাগ্যর নির্মম পরিহাসে মেঘের বিয়ে অন্য কারো সাথে হয়ে যায়।রৌদ্র তখন লেখাপড়া শেষ করে মাত্রই ব্যবসায় মন দিয়েছে।ওই দিকে যার সাথে বিয়ে ঠিক হয় তাকেই ভালবেসেছিলো মেঘ মন প্রাণ দিয়ে।

রৌদ্র আজ ছাদে বসে মেঘের কথা ভাবছে।

আনোয়ার হোসেন এবং সেলিনা বেগম ছাদে যেতেই রৌদ্র তার হাতের সিগারেট নিচে ফেলে দিয়ে ধোয়া সরানোর চেষ্টা করলো।হাত খানিক টা পুড়ে ও গেলো রৌদ্রের।

আনোয়ার হোসেন খানিক টা গম্ভীর ভাবে বললেন,,

–কি সমস্যা রৌদ্র তুমি এভাবে বিয়েটা ভেঙে দিলে কেনো?মেয়ে কি তোমার পছন্দ হয় নি।

–আমি তো মেয়ের দিকে সেভাবে তাকায় নি বাবা তাহলে পছন্দ অপছন্দ কিভাবে বুঝবো।

–কেউ কি নিষেধ করেছিলো তাকাতে।চোখে মুখে রাগ আনোয়ার হোসেনের।

–চুপ আছে রৌদ্র।কপালে বিরক্তির ছাপ পড়েছে রৌদ্রর।

–এই নিয়ে কয়েকশ মেয়ে দেখা হয়ে গেলো।আজ ও কোথাও বিয়ে করলে না।তোমার দাদা তোমার বউ দেখবে বলে পাগল হয়ে গিয়েছে।আমি সাত দিনের মাঝে এ বাড়িতে বউ চাই।আমার বাবার শেষ ইচ্ছা তোমাকে পূরণ করতেই হবে।আমার এ বাড়িটা কি মরুভুমি হয়ে থাকবে।এখুনি ফোন করে মাহির বাবাকে বলো তুমি এ বিয়েতে রাজি।

–কি সমস্যা বাবা,বউ চাই তোমাদের এটাই তো।ওকে পেয়ে যাবে।

–তাহলে মাহির বাবাকে বলে দাও ফোন করে।

–বউ পাবে এটা বলেছি,কিন্তু মাহিকে বিয়ে করবো সেটা বলিনি বাবা কপালের চামড়া কয়েক টা ভাজ করে বললো রৌদ্র।

–মাহির মাঝে কি সমস্যা আছে রৌদ্র।মেয়েটা তোমাকে ভালবাসে।সে জানে এ বিয়ে ৯৯% হবে ভেবেই সে তোমাকে ভালবেসেছে।মেয়েটা কেঁদে কেঁদে একাকার হয়ে যাচ্ছে।তাছাড়া মাহিকে আমাদের পছন্দ।

–বাবা কি দেখে ভালবাসে আমায় সে?আমি কি তার সাথে কমিটেড।নাকি কোনদিন কথা বলেছি।এ কেমন হাস্যকর ভালবাসা বাবা।হু লাভ মি আই ডোন্ট কেয়ার।

বলেই নিচে চলে গেলো রৌদ্র।

তৃধা আনমনে বসে আছে রুমে।কি আছে তার জীবনে?সেই কাল রাত্রী সেই বেঈমানের কথা কি কখনো ভুলতে পারবে সে।কি উদ্দেশ্য ছিলো তার যে এইভাবে তৃধার জীবন টা শেষ করে দিলো।

_______________________________
ননদের বিয়ে ভাঙার জন্য অকারণ অনেক খারাপ কথা শুনতে হচ্ছে মেঘকে।স্বামি মাহিম এর ছবি বুকে নিয়ে ভীষণ কাঁদছে।মাহিম তাকে বলেছিলো তার মা বাবার পাশে যেনো মেঘ আজীবন থাকে।তাছাড়া নিজের বাবার ফ্যামিলিতে মেঘের কোনো দাম নেই বললেই চলে।মেঘের বাবা মেয়ের কোনো খোজ ই নেন না।মেঘের মায়ের মৃত্যুর পরে তার বাবার বিয়ে হয় সেখানে দুইটা ছেলে আছে। এমনিতেই প্রায় ফ্যামিলিতে ছেলের গুরুত্ব বেশী দেওয়া হয়।মেঘের বাবার ক্ষেত্রে ও তাই।মেয়ের থেকে ছেলেদের নিয়ে তার ভাবনা বেশী।মেঘ কে ক্লিয়ার বলে দিয়েছে মাহিমের মা বাবার পাশে থাকতে।একটা বার ও ভাবে নি এই বয়সে বিধবা মেয়ে কিভাবে থাকবে।

চলবে,,