রৌদ্র মেঘের আলাপণ পর্ব – ০৬

0
382

#রৌদ্র মেঘের আলাপণ
# পর্ব-৬
#WriterঃMousumi Akter

–বুকে হাত বেঁধে মেঘের ন্যায় মুখ কালো করে পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র।চোখে মুখে কোনো হাসি নেই বিষন্নতায় ভরা মুখ খানি অন্ধকারে ছেয়ে আছে।কিছুক্ষনের মাঝেই তার মা বাবা দাদা তার পেছনে এসে দাঁড়ালো।রৌদ্র তাদের উপস্হিতি টের পেয়ে তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।

‘তার মা বাবা কিছু বলার আগেই সে বললো,

–মা বাবা আমি জানি আমার মা বাবার থেকে ভালো মা বাবা এই পৃথিবীর কোথাও নেই।আমার সব সিদ্ধান্ত তোমরা এতদিন মেনে নিয়েছো।আমি জানি অন্য যে কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে তোমরা এতটা অবাক হতেনা যতটা অবাক হয়েছো মেঘ কে দেখে।কেননা মেঘ মাহির ভাবি হয় সেজন্য।আমি তোমাদের বলছি শোনো।

মেঘ কে আমি চিনি যখন মেঘ ক্লাস এইটে পড়ে, তখন আমি ভার্সিটির ষষ্ট সেমিষ্টারে।সেই তখন থেকেই মেঘ কে আমার ভাল লাগতো,খুব বেশী ভাল লাগতো।আমার চোখের সামনেই মেঘ এস.এস.সি,ইন্টার পাশ করলো।তখন আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে গিয়েছে।মেঘ আমার থেকে আট বছরের জুনিয়র ছিলো।একদিন রাস্তায় আমি মেঘের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম মেঘের বাবা দেখে ফেলেছিলো।মেঘের বিয়ে ঠিক ছিলো আমি জানতাম না। মেঘের জন্য ঠিক করা পাত্র কে মেঘ মেনে নিয়েছিলো,বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবে না বলে আমার প্রস্তাবে কখনো সায় দেয় নি মেঘ।আমি চেয়েছিলাম মেঘের ঠিক হওয়া পাত্রকে বলে বিয়ে টা ভেঙে আমার জীবনে মেঘ কে আনতে।আমি বলেও ছিলাম মেঘের হবু স্বামিকে আমার এক বন্ধুকে দিয়ে বলিয়েছিলাম।কিন্তু সে মেঘের বাবাকে জানায় অতঃপর মেঘের বাবা মেঘ কে খুব মারধর করে সাথে অনেক বাজে কথা শোনায়।মেঘ কে অনেক খারাপ সিসুয়েশন এ পড়তে হয়েছিলো।মেঘ আমাকে বলেছিলো আমি যেনো ওর জীবনে কখনো অশান্তি করতে না যায়,মেঘ মুক্তি চেয়েছিলো আমার কাছে সেদিন কেঁদে বলেছিলো সে তার হবু স্বামি কেই ভালবাসে।সেদিন মেঘ কে আমি কিছুই বলিনি।মেঘের কোথায় বিয়ে হয়েছে,কার সাথে,কে সে কোনো কিছুর ই খোজ নেই নি।আমি চাই নি মেঘের জীবনে অশান্তি করতে।মেঘের বাবা বলেছিলো মেঘ বিয়ে করে বিদেশ চলে গিয়েছে।মেঘের জন্য ভীষণ কষ্ট হতো এক নজর দেখার জন্য আমিও ছুটে গিয়েছিলাম মালায়েশিয়াতে।কিন্তু সেখানেও দেখা পাই নি মেঘের।সেদিন মাহিকে দেখতে গিয়ে মেঘ কে দেখেই আমার ভেতর কেঁপে ওঠে।ওর গায়ের সাদা শাড়ি ভীষণ ভাবাচ্ছিলো আমাকে।পরে আমি ওখান থেকেই জানতে পারি বিয়ের মাত্র দু’মাসে মারা গিয়েছে ওর হাজবেন্ড।শুনে আমার মনের মাঝে এত তীব্র অশান্তি শুরু হয়েছিলো যে অশান্তিতে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।আমাকে বিশ্বাস করো তোমরা আমি যদি দেখতাম মেঘ ওর শ্বশুর বাড়িতে ভাল আছে আমি এমন কিছুই করতাম না।বিগত ছাব্বিস টা মাস আমি মেঘ কে এক নজর দেখার জন্য ছটফট করেছি।ভেবেছি দূর থেকে দেখবো,তাও দেখা পায় নি।এত গুলো দিন পরে এভাবে দেখবো ভাবতে পারিনি।মেঘের শ্বাশুড়ি অনেক বেশী টর্চার করে মেঘ কে।আমার সামনেই সেদিন রুড বিহেভিয়ার করেছে।আমি খোজ নিয়েছি নিচের ফ্ল্যাটের৷ প্রতিবেশীর কাছে তারা বললো,জেল খানার কয়াদী রাও এতটা কষ্টে থাকে না।মেঘের শ্বাশুড়ি সাদা থান ছাড়া পরতে দেয় না,বাড়ির সমস্ত কাজ করায়,গায়ে ও হাত তোলে, সারাদিন গালি গালাজ করে,নিজের ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী মেঘ কেই করে।কোনো অনুষ্ঠানে মেঘ কে যেতে দেন না তার কাছে মেঘ কে অপয়া মনে হয়।মেঘ কোনো শুভ অনুষ্টানে গেলে অশুভ কিছু হবে এমন ই ধারনা মেঘের শ্বাশুড়ির।নিজের বাড়িতে যে যাবে কার কাছে যাবে।ওর তো নিজের মা নেই।ওর মা মারা গিয়েছে,মা মরার পর থেকে বাবা সেকেন্ড বিয়ে করেছে।সেখানে তার সন্তান আছে তাদের বিয়েই নতুন সংসার তার।মেঘের বাবা চাই না মেঘ কে তার সংসারে নিয়ে অশান্তি করতে।যার নিজের বাবা ই ভালবাসে না সেখানে স্বামিহীন শ্বশুরবাড়ির মানুষ কিভাবে ভালবাসবে।মেঘের বাবা বলে মেঘ অপয়া তাই মা আর স্বামি অকালে মারা গিয়েছে।মেঘ যেনো তার বাড়িতে না যায়।মাহিমের মা বাবার দেখাশুনা করে।তোমরাই বলো মেঘের বয়স কতটুকু?ওর কি এমন জীবন প্রাপ্য। আসলেই কি অপয়া বলে কিছু হয়।ওর বয়সী মেয়েরা রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ছে আর ওর জীবন রঙহীন সাদা থানে মানুষের অবহেলায় পড়ে থাকবে।আমি পারবো না মা মেঘ কে এমন জীবনে দেখে নিজে বিয়ে করে সংসার করতে।মেঘের কেউ নেই বাবা।মেয়েটা ভীষণ অসহায়।ওকে ভালবাসার মতো এই পৃথিবীতে কেউ নেই।আমি চাই মেঘ কে সুন্দর একটা জীবন দিতে একটা পরিবার দিতে।মেঘ কে আমি ভালবাসি মা,ভীষণ ভালবাসি আমি জীবীত অবস্থায় মেঘ কে এইভাবে দেখে সহ্য করতে পারবো না।রৌদ্রের চোখে পানি ছলছল করছে।দুই হাত জোড় করে নতজানু হয়ে মা বাবাকে বললো,প্লিজ তোমরা মেঘ কে কষ্ট দিও না কখনো।তৃধার মতোই মেঘের জীবন টা অন্ধকারআচ্ছন্ন।তোমরা বলো আমি কি খুব ভুল করেছি।আমি একটা ভুল করেছি মেঘ রাজি হচ্ছিলো না বিয়েতে তাই আমি ওকে তুলে নিয়ে জোর করে বিয়ে করেছি।শুধু মাত্র তোমাদের কাছে মেঘ কে রাখার জন্য এটা করেছি।

–রৌদ্রের বাবা মা দাদা সবার ই চোখে পানি চলে এসছে।একটা মেয়ের জীবন এতটাও কষ্টের হতে পারে।রৌদ্রের বাবা চোখের পানি মুছে ছেলেকে বললেন,আমাদের আগে বলবা না তুমি।আমরা মাহির মা বাবার কাছে মাহি নয় মেঘ কেই চাইতাম।আমাদের ছেলে কোনো ভুল করতেই পারে না।আমরা তোমার পাশে আছি, তুমি একটুও ভেবো না।মেঘের কোনদিন কোনো অসুবিধা হবে না বাবা।

–রৌদ্রের দাদা বললো,দাদু ভাই মেঘ আমাদের বাড়ির প্রাণ হয়েই থাকবে। তুমি একদম ঠিক করেছো।তুমিই হলে প্রকৃত প্রেমিক।ভালবাসলে এমন ই ভালবাসা উচিত বুঝলে।

–রৌদ্রের মায়ের মুখে হাসি। তারা সবাই ছেলেকে সব রকমের সান্ত্বনা দিতে থাকলেন।

–কিছুক্ষণ পরেই মেঘের রুমে গেলো সবাই।মেঘ বিছানার এক কোনে বসে চোখের পানি ঝরিয়ে যাচ্ছে।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মেঘের।রৌদ্রের মা মিসেস সেলিনা বেগম মেঘের পাশে বসে মেঘের কাধে হাত রেখে বললো মা মেঘ আমাকে তো তুমি আগেও দু’একবার দেখেছো আমাদের অনেক গল্প ও হয়েছে। তুমি তো অনেক টায় ফ্রি আমার সাথে আমার সাথে কি কথা বলবে না মা।আজ কি আমাকেও খারাপ ভাববে।তাকাও মা আমার দিকে।

–মেঘ মুখ তুলে তাকালো,চোখ দুটো কেঁদে রক্তজবার মতো হয়ে আছে।চোখের পাপড়ি গুলো ভিজে আছে।এমন টানা টানা চোখের চাহনি, এমন ভুবন ভোলানো রুপ লুকিয়ে ছিলো মেঘের মাঝে।এতদিনে সাদা থানে মোড়ানো মেঘ কে যে রঙিন কাপড়ে এতটা সুন্দর লাগতে পারে ভাবতে পারেনি মেঘের মা বাবা।মিসেস সেলিনা আর মেঘ এর আগে কয়েক বার অনেক গল্প করেছে বেশ খানিক টা পরিচিত দুজনে।মেঘ মিসেস সেলিনার দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিয়ে বললো,আমাকে ক্ষমা করুণ আন্টি আপনারা প্লিজ,আমি নিজ ইচ্ছায় এটুকু বলতেই মিসেস সেলিনা থামিয়ে দিলেন মেঘ কে।মিসেস সেলিনা বললেন,কিচ্ছু বলতে হবে না মা।আনোয়ার হোসেন মেঘের পাশে এসে বসে বললেন মা মেঘ,এখানে কাউকে ভয় পেওনা তুমি।এ বাড়ি এ ঘর আজ থেকে তোমার মা।জন্ম, মৃত্যু বিয়ে সব ই উপরে একজন আছে তার হাতে মা।যার সাথে যার ভাগ্য আছে যেভাবেই হোক হবেই মা।সেলিনা বেগম বললেন,আজ তোমার আমাদের মেনে নিতে অনেক অসুবিধা হচ্ছে কিছুদিন হবেও কিন্তু দেখো একদিন আমাদের তোমার পৃথিবীতে সব থেকে আপন মনে হবে।আনোয়ার হোসেন তার আলমারির চাবি মেঘের হাতে দিয়ে বললো,মা আমার তো মা নেই আজ থেকে তুমি আমার মা।এই ছেলেটার যখন যা লাগে তোমার থেকে চেয়ে নিবে।পারবে না মা কষ্ট করে দিতে।

–মেঘের চোখের পানি নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।পৃথিবীতে এত ভাল মানুষ ও আছে।তার নিজের বাবা তো তাকে কখনো এতটা ভালবাসেনি।এতটা স্নেহ করেনি।মেঘ ভীষণ মুগ্ধ তাদের ভালবাসায়।সেলিনা বেগম মেঘের হাতে, গলায় গহনা পরিয়ে দিয়ে বললো, তোমার একার মা না বুঝলে আমার ও মা।

–দাদু বললো,মেঘ দিদি তোমার রাগ হোক যায় হোক এই বুড়ো না মরলে এইখান থেকে যেতে পারবে না।আমরা দুজনে সুখ দুঃখের গল্প করবো

রৌদ্রের পরিবার তাদের সব টা দিয়ে চেষ্টা করছে যেনো মেঘ এখান থেকে চলে না যায়।ছেলের জীবনের শান্তির জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছে।

দাদু বললো,অনেক রাত হয়েছে ওদের ঘুমুতে দিয়ে চলো আমরা যায়।
সেলিনা বেগম নিজে হাতে মেঘ কে খাবার খাইয়ে ঘুমুতে বলে চলে যান।

এই পরিবার টা এত ভাল কেনো?মানুষ বড় মায়াবী।যেখানে ভালবাসা পাবে সেখানেই মায়ায় আটকে যাবে এটাই নিয়ম।মেঘ নিমিষেই যেনো এই পরিবারের মানুষ গুলোর মায়ায় আটকে গেলো।

–সবাই চলে গেলে রৌদ্র থুতনিতে হাত বাধিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছে মেঘ কে।মেঘের প্রেমে, মেঘের রুপে ভেতরে ভেতরে খুন হয়েছে অজস্র বার।ভালবাসার মানুষ কে আপন করে পাবার আনন্দের থেকে ভীষণ আনন্দ এই পৃথিবীতে আর কিছুতে হতে পারে না।শ্যামবর্নের মায়াবী চেহারার ছেলেটির চোখে মুখে ভীষণ মুগ্ধতা। মেঘের গায়ের বেনারসী তার গহনায় যেনো পৃথিবীর সব মুগ্ধতা ভর করেছে মেঘের উপর।রৌদ্র যেনো বেহায়ার মতো তাকিয়েই আছে।মেঘের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে রৌদ্র কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে।রৌদ্র কোনভাবেই চোখ সরাতে পারছে না।এ দেখা যেনো দীর্ঘ দিনের না দেখার তৃষ্ণার দেখা।

–মেঘ বললো,কি ব্যাপার আপনি কি দেখছেন এভাবে।এখন কি আমার কাছে আসবেন।আমাকে যদি স্পর্শ করেন আমি কি করবো জানিনা।

–তোমাকে দেখছি,প্লিজ তোমাকে ছুতে না হয় পারবো না দেখতে তো দোষ নেই।দেখতেও বাধা দিও না।আমি তোমার এমন আবদার মানতে পারবো না।

-ছুতে পারবেন না তাহলে বিয়ে করেছেন কেনো?

–শরীর ছুয়ে কি হবে, যদি মন ই না ছুতে পারি।

–আপনার ক্ষমতা আছে চাইলেই শরীর ছুতে পারবেন কিন্তু মন ছুতে পারবেন না।

–চ্যালেঞ্জ করছো?

–ধরে নিন তাই।আপনার জন্য বিয়ের আগেই বাবার কাছে কলঙ্কিত,শ্বাশুড়ি এক্স নিয়ে খোটা দিয়েছে অসংখ্যবার।আপনি কোনদিন আমার চোখে ভাল হতে পারবেন না।জোর করে এখানে আটকে রেখে কি শান্তি পাবেন আপনি।আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করেছেন আমাকে।আপনাকে জাস্ট নিতে পারছি না আমি।এ বাড়ির সবাই ভালো শুধু আপনি ছাড়া।

–রৌদ্র খানিক টা হেসে বললো,ঘুমিয়ে পড়ো।

–আর আপনি?

–আমি জেগে থাকবো।

–কেনো?

–ঘুমোলে যদি পালিয়ে যাও।

–এইভাবে কতদিন পাহারা দিবেন।

–যতদিন প্রাণ আছে।

চলবে,,,