রৌদ্র মেঘের আলাপণ পর্ব – ০৯

0
352

#রৌদ্র মেঘের আলাপণ
#পর্ব-৯
#WriterঃMousumi Akter

পাশের রুম থেকে ভাঙা চুরা আর কাঁন্নার আওয়াজে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো রৌদ্র।মেঘ ও পেছন পেছন গেলো।

–রৌদ্র একটা মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলছে,শান্ত হ আপু।এই পৃথিবীর সব সুখ তোর হাতের মুঠোয় এনে দিবে তোর ভাই।ভুলে যা না আপু ওই বিষাক্ত কালো অতীত।তোকে এইভাবে দেখলে আমার মনে হয় আমি একটা অপদার্থ ভাই।ভাই হয়ে রক্ষা করতে পারিনি তোকে।প্লিজ আপু আমাদের সবার জন্য ভুলে যা সেই খারাপ ঘটনা।মানুষের জীবনে তো অনেক কিছুই ঘটে যায় সব কি মনে রেখে অন্ধকারে ডুবতে হবে।তোর সাথে যা হয়েছে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা আপু।

–মেয়েটি নিজের মাথার চুল টেনে টেনে ছিড়ছে।আর পাগলের মতো কাঁদছে।

–মেঘ বেশ অবাক হয়ে ভাবছে,রৌদ্র কাকে আপু ডাকছে।রৌদ্রর আপু নিশ্চয়ই। কিন্তু কেউ তো পরিচয় করালো না তার সাথে।তাছাড়া কি হয়েছে মেয়েটির এইভাবেই বা ভাঙা চোরা করছে কেনো?হ্যাঁ কাল রাতে তো এ ঘর থেকেই কাঁন্নার আওয়াজ পেয়েই ভুত ভেবে ভয় পেয়ে গেছিলো।এ বাড়িতে সবার সাথেই তার পরিচয় হয়েছে কেউ তো এই মেয়েটির কথা বলেনি।মেঘ বেশ চিন্তিত হয়েই বিষয় টা দেখছে।

–ততক্ষণে আনোয়ার হোসেন এবং সেলিনা বেগম সেখানে উপস্হিত হয়।মেঘ কে দেখে তারা বলে মা মেঘ তুমি উঠে পড়েছো।মেঘ মাথা কাত করে জানায় জ্বী।

“মেঘ বলে আঙ্কেল, ওখানে কে?আর কাঁদছে কেনো?”

“আনোয়ার হোসেন বলেন,আঙ্কেল কেনো মা। আমি তোমার বাবা হই।আমাকে কি বাবা ডাকতে ঘৃণা লাগছে মা।তুমি বাবা ডাকলে খুব খুশি হবো আমি।তোমার শ্বাশুড়িকে কাল আন্টি ডেকেছো আমি তখন কিছু বলিনি, এখন বলছি মা বলে ডাকবা।”

মেয়েটির কাছে আনোয়ার হোসেন আর সেলিনা বেগম গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাচ্ছে।মেঘ কে দেখিয়ে বলছে,

”মা তৃধা দেখো কে এসছে।তোমার ভাবী, তোমার ভাইয়া বিয়ে করে এনেছে তোমার জন্য।তুমি না একা থাকো,তাই তোমার ভাইয়া তোমার জন্য একটা ভাবী এনেছে।”

রৌদ্র চোখের পানি মুছে বেরিয়ে গেলো।

মেয়েটির চোখের নিচে কালো হয়ে আছে,এলোমেলো চুল, দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন অসুস্থ এই মেয়েটি।মানসিক কোনো সমস্যা।শরীর দেখতে বেশ রোগা পাতলা,মাথার চুল ও পড়ে গিয়েছে।খুব একটা বয়স বলে ও মনে হচ্ছে না।এত কম বয়সে মেয়েটির এমন অবস্থা কেনো?আনোয়ার হোসেন একটা ইনজেকশন দিয়ে মেয়েটিকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।সবার মন খুব খারাপ দেখে মেঘ কিছুই বললো না কাউকে।

–কিচেনে শ্বাশুড়ির সাথে বসে মরিচ, পেয়াজ কাটছে মেঘ।যদিও তার শ্বাশুড়ি তাকে কিছু করতে নিষেধ করেছে।কিন্তু তার সামনে তার থেকে বয়সে বড় কেউ কাজ করবে আর সে বসে থাকবে দেখতে খারাপ দেখাবে।মেঘ নিজে থেকেই কাজ করা শুরু করলো।মেঘের মনের মাঝে সেই তখন থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে ওই মেয়েটির কথা। কি হয়েছে ভীষণ জানতে ইচ্ছা করছে।কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা ভাবছে মেঘ।

“মেঘ মুখ ফুটে বলে উঠলো,মা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

রৌদ্র কে মেনে নিক আর না নিক রৌদ্রর মা বাবাকে সে প্রথম এসেই মেনে নিয়েছে।তাদের ভালবাসায় মেঘ তাদের মা বাবা বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।তাছাড়া মেঘ খুব ভদ্র, শান্ত মেয়ে। বড়দের সাথে বেয়াদবি পছন্দ করে না।রৌদ্র কে যায় বলুক তার পরিবারের সাথে ভুলেও খারাপ ব্যবহার করবে না।তাছাড়া অনেক দায়িত্বশীল মেয়ে।

“সেলিনা বেগম বললো,হ্যাঁ মা বলো কি জানতে চাও।মা মেঘ তুমি নিঃসংকোচে যা ইচ্ছা আমাকে বলতে পারো।তুমি যা বলো আমি কখনো কিছু মনে করবো না।আমার একটা মেয়ে থাকতেও নেই।আর ছেলেটা মন মরা ছিলো এতদিন।তোমাকে পেয়ে আমার ছেলের মুখে হাসি ফুটেছে।মেঘ মা আমার ছেলে আমাদের সব বলেছে।আমি জানি মা একটা মেয়ে হয়ে হুট করেই তোমার পক্ষে এসব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।একটা পরিবার থেকে এসেছো,হঠাত নতুন একটা পরিবেশ তুমি হয়তো আমাদের মেনে নিতে পারছো না।আমাদের তোমাকে মেনে নিতে এক সেকেন্ড সময় ও লাগে নি মা।তোমার বাবা আর আমি সারাজীবন ভাল মন নিয়ে থেকেছি তবুও আমাদের সাথেই সব খারপ হয়েছে মা।রৌদ্র তোমাকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করেছে এটা ওর অন্যায় তবে তোমার ভালোর জন্যই করেছে ।রৌদ্র চায় না যারা তোমাকে ভালবাসে না তাদের কাছে থেকে রোজ কষ্ট পাও।তোমাকে ভাল রাখার জন্যই রৌদ্র এমন করেছে মা।তোমার ভাল চাওয়াটা যদি অন্যায় হয় তাহলে মা হিসাবে বলবো তোমার কাছে অপরাধী রৌদ্র।”

মনে মনে বেশ লজ্জিত হলো মেঘ।আসলেই তো রৌদ্র যা করছে মেঘ কে ভালবেসেই করছে।মেঘের ভাল চাইছে যে তাকেই ঘৃনা করছে সে।তবুও মানুষ তো এক মুহুর্তে তো সব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

“মেঘ বললো, মা তৃধার কি হয়েছে।উনি কি রৌদ্রর বড়।আপু বলে ডকছিলো।”

“তৃধা হয়তো তোমার বয়সী হবে।রৌদ্র ভালবাসে আপু ডাকে।অনেক স্নেহ করে তৃধা কে।”

“তৃধার এমন হয়েছে কেনো মা?”

“আমাদের কপাল খারাপ মা।”

“কেনো মা?”

“তৃধা কোনো একটা ছেলের সাথে রিলেশন করতো।আমরা কেউ জানতাম না।তার সাথে দেখা করতে গেছিলো আর সেই ছেলেটি তার বন্ধুদের নিয়ে তৃধাকে গন ধর্ষ*ণ করেছিলো।তারপর রাস্তায় ফেলে চলে গেছিলো।তারা কারা আজ ও খুজে পেলাম না।আমার মেয়েটা সেখান থেকে অসুস্থ পাগল হয়ে গিয়েছে।ও যদি ঠিক ভাবে বলতে পারতো তাহলে সেই কুলাঙ্গার দের খুজে বের করতে পারতাম।রৌদ্র বলেছে একদিন হলেও সেই অপরাধী কে খুজে বের করে খু*ন করবে।এটা রৌদ্র প্রতিজ্ঞা করেছে।বোনের জীবনের এই করুণ অবস্থা রৌদ্র সহ্য করতে পারেনা।ছেলেটা সেখান থেকে রাগী,গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।আজ কি আমার তৃধার জীবন এইভাবে অন্ধকার ঘরে কাটানোর কথা।ওর বয়সী মেয়েরা ফুলের মতো সুন্দর জীবন কাটাচ্ছে।মেয়েটা কত কষ্টে ছটফট করে।এমন কেউ নেই যে ওর বয়সী ওকে একটু সময় দিবে সারাক্ষণ সঙ্গ দিবে।চোখের সামনে মেয়েটা আমার দিন দিন অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে।আমরা সব সময় ওর খেয়াল রাখি তবুও ওর বয়সী কেউ যদি থাকতো।ওর সাথে এই ঘটনা ঘটার পরে ওর বান্ধবীরাও আর আসে না,সবাই অন্য চোখে দেখে তৃধাকে।সবাই যার যার জীবনে ব্যাস্ত আমার মেয়েটা এই বাড়ির ওর এক ঘরেই বন্ধী জীবন কাটাচ্ছে।একটা মেয়ে হয়ে তুমি উপলব্ধী করতে পারবে নিশ্চয়ই ওর কষ্ট টা।হসপিটালে রেখে ও লাভ নেই সমস্যা ওর ভেতর থেকে হয়েছে।ওর সাথে ঘটে যাওয়া ওই দূর্ঘটনা ভুলতে পারে না।আগে তো প্রায় সুইসাইড করতে যেতো সারাক্ষণ পাহারায় রাখতাম।সব সময় চাইতাম আমার রৌদ্র যদি একটা বিয়ে করতো সে যদি তৃধার সাথে মিশে একটু মেয়েটাকে ভাল করতে পারতো।আমার ছেলেটা যে তোমাকে ভীষণ ভালবাসতো তাই কোথায় বিয়ে করাতে পারিনি।তাছাড়া মেয়ের জীবন তো নষ্ট হয়েই গিয়েছে চেয়েছি ছেলেটা বিয়ে করে ঘর সংসার করুক।অনেক সাধনার পরে আমার ছেলে বিয়ে করেছে।আমার রৌদ্র কে ছেড়ে যেও না মেঘ মা হয়ে অনুরোধ করছি।ছেলেটা তাহলে আমার মেয়ের মতোই পাগল হয়ে যাবে।রৌদ্র ভাল নেই মা,ভেতরে ভেতরে বোনের সাথে হয়ে যাওয়া ঘটনার জন্য পুড়ে শেষ হচ্ছে।রাতের পর রাত জেগে থাকে।তারপর যাকে ভালবাসতো সে ও হারিয়ে গেছিলো।একমাত্র তুমি পারো আমার রৌদ্রকে ভাল রাখতে।মা হয়ে সন্তানের ভালোর জন্য আজ এসব বলতে বাধ্য হলাম। মেঘ আমার তৃধার সাথে কখনো খারাপ ব্যাবহার করোনা।আমার তৃধার মনে ভীষণ কষ্ট মা,হয়তো ওইভাবেই মারা যাবে কবে আমরা বুঝতেও পারবো না।আমার তৃধাকে কখনো অবহেলা করোনা।”

সেলিনা বেগম কথা গুলো বলতে বলতে ভীষণ কাঁন্নায় ভেঙে পড়লো।এতক্ষণ তৃধার জীবনের ঘটনা গুলো শুনে মেঘের চোখ দিয়ে ঝরছে অঝরে পানি।এই ঘটনা কোনো মেয়ের সাথে ঘটলে তার বেঁচে থাকা সত্যি কষ্টকর ব্যাপার।মেঘ চোখ বুঝে একবার অনুভব করলো তৃধার জায়গা নিজেকে শিউরে উঠলো মেঘ আতংকে।এমন ভয়াবহ ঘটনা মেনে নেওয়া আর সহ্য করা দুটোই অসম্ভব।সেলিনা বেগম কে এভাবে কাঁদতে থেকে মেঘ সেলিনা বেগম কে জড়িয়ে ধরে নিজেও খুব কাঁদলো।রৌদ্রর কষ্ট টাও অনুভব করবো মেঘ।

এখান থেকেই শুরু হলো হলো মেঘের প্রেমের দ্বীতীয় বসন্ত।শুরু হলো প্রতিশোধের ভয়ংকর নেশা মেঘের।নারী আত্মা গর্জে উঠলো।একটা মেয়ে হয়ে অনুভব করলো আরেকটা মেয়ের সাথে হয়ে যাওয়া ভীষণ অন্যায়।লোমহর্ষক এই ঘটনার বিবরণ শুনে মেঘ নিজ থেকে আটকে গেলো এই পরিবারের মায়ায়,কোনো অজানা কর্তব্য দায়িত্ব মেঘ কে বলে দিলো মেয়েটার জন্য জাস্টিস প্রয়োজন,মেয়েটাকে সুস্থ স্বাভাবিক করা প্রয়োজন।অদ্ভুত এক দায়িত্ব কর্তব্য ভর করলো মেঘের উপর।মেঘ আজ সকালেই ভেবেছিলো যেভাবেই হোক সে আজ এখান থেকে পালিয়ে যাবে।কিন্তু মুহূর্তে বদলে গেলো মেঘের মন। নিয়তি নিজ থেকেই বেধে দিলো মেঘকে,আটকে দিলো বিনি সুতোর বাঁধনে।কারো বউ হবার পর একটা পরিবারে যে দায়িত্ব থাকে মেঘ নিজে থেকে নিজের উপর নিয়ে নিলো।নিয়তি যদি কিছু চাই সেটা হবেই, নিয়তি যদি কোনো সম্পর্ক জুড়ে দিতে চাই তাহলে সেটা যেকোনো ভাবেই হবেই।আর তৃধার সাথে অন্যায়করীর বিনাশ হয়তো মেঘের হাতেই ছিলো।

চলবে,,