শখের সাদা শাড়ি পর্ব-১৩+১৪

0
231

#শখের সাদা শাড়ি
#ফাতেমা তুজ
পর্ব-১৩+১৪
১৩.
ব্যস্ততা মানুষ কে ভোগায়। ব্যস্ততা মানুষ কে কাঁদায়। সমীর উর্মি দুজনেই ব্যস্ত। যখন একজনের ফ্রি টাইম আসে তখন আবার অপরজন ব্যস্ত থাকে। এই করে করে দশ টা দিন পেরিয়ে গেল। শুধু হাই হ্যালো ছাড়া আর কিছুই বলা হয় নি। উর্মি আজকাল চটপটে ভাব হারিয়ে ফেলে। প্রায় সময় ক্লান্ত হয়ে বসে থাকে। যখন সৌমেন এর কল আসে তখন হুরমুরিয়ে উঠে কাজে নামে। এমন করে তিন দিন সিডিউল এর গড়মিল করেছে। সৌমেন খুব বকেছে ও। উর্মির খারাপ লাগে নি। সে নির্বিঘ্নে চলে এসেছে। আজকাল আবার সৌমেন এর ব্যবসা খারাপ যায়। সে ব্যস্ত হয়ে মিটিং বসায় হুটহাট। সবাই কে খুব কাজ করতে হচ্ছে। এই নিয়ে উর্মি পরেছে যন্ত্রণায়। লাঞ্চ টাইমে নিয়ম করে কল করে সমীর কে। সমীর বলে ব্যস্ত আছি উর্মি। পরে কল করছি। হুম বলে কেঁটে দেয় উর্মি। যখন সমীর কল করে তখন আবার উর্মির মাথায় কাজ। রিসিভ করেই বলে কাজ করছি। দুজনেই দু প্রান্তে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সব কিছু সময়ের সাথে সাথে কেমন যেন তিক্ত হয়ে আসে। ভালো লাগে না এই কাজ। কর্ম কে নিকৃষ্ট মনে হয়। তবে এই কর্মেই পেট চলে। চলে কারো সংসার। দুদিন আগেই মেঘনার ব্যথা উঠেছিল। উর্মি এতো কাজের চাপে যেতেই পারে নি। আজ যাবে বলে স্থির করলো। হাতে সময় মাত্র দেড় ঘন্টা। তড়ি ঘড়ি করে ফোন দেয়। মেঘনা জানায় সে এখন ঠিক আছে। আর কোথায় নাকি ঘুরতে এসেছে। উর্মি ব্যস্ত হয়। এই সময় টা ঘুরাঘুরির না সেটা বোঝায়। তবে মেঘনা বলে নয়ন আছে পাশে। কিছু হবে না তাঁর। উর্মি স্থির থাকে। কথা শেষে আবার কাজে নেমে পরে। প্রচুর কাজ। একবার কল করে সমীর এর নাম্বারে। সুইচ অফ বলে। হয়তো কাজের মাঝে আছে। উর্মি কাজ করে তবে মন নেই একটু ও। হাত মুখে পানি দিয়ে আসে। সৌমেন এর রুমে গিয়ে মিটিং করে। সৌমেন কে কেমন রুগ্ন দেখায়। গলার কাছ টা কেমন বার বার উঠা নামা করে। ফর্সা গাল টা রক্তিম।
” আপনি কি অসুস্থ স্যার? ”

” কিছু টা। ঠান্ডা লেগেছ। ”

” ওও। ”

উর্মি আবার কাজে ফিরে। মাইশা আসে। হাতে কিছু ফাইল। উর্মি কাজ শেষ করে চলে আসে নিজ কেবিনে। এক মনে তাকিয়ে থাকে জানালা দিয়ে। বাসায় কল করে। অন্তু জানায় তার মা চাচি আবার ঝগড়ায় নেমেছে। আগে কখনোই এমন টা হয় নি। ইদানিং দুজনেই খুব ঝগড়া করছে। চিন্তিত হয় উর্মি। মাথা ঘুরায়। মেঘনা কে কল করলে মেঘনা খুব সুন্দর করে মিথ্যে বলে। তবে উর্মি জানে মেয়ে টা ভালো নেই। মন কে চেপে ধরে উর্মি। আজ যাবে মেঘনার শশুর বাড়ি। গিয়ে দেখবে কেমন ভালো আছে তাঁর আপা।

দরজা খুলতেই চমকালো মেঘনা। কপাল বেয়ে নেমে আসা ঘাম আর শরীরে মলিন কাপড়। সব মিলিয়ে বাড়ির কাজের লোক টার ও বোধহয় এমন হাল হয় না। উর্মির গলা টা ধরে আসে। খেই হারিয়ে ফেলে। এটা তার আপা? মাত্র কয়েক দিনে কি হাল করে ফেলেছে অমানুষ গুলো! উর্মি স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনে। মেঘনা বৃথা হাসার চেষ্টা করলো। তবে চোখ গুলো যেন হাজার খানেক অভিযোগ দাঁড় করায়। মেঘনা লুকাতে চায় সেসব। চোখের পানি আড়ালে নিতে বোন কে জড়িয়ে ধরে। কুশলাদি করার চেষ্টা চালায়। পাশেই বালতি ভর্তি নোংরা জল। বোঝা যায় ঘর মুছছিল মেঘনা। উর্মি চুপ করে থাকে।আশ পাশে তাকায়। ওম্নি করে উর্মির শাশুড়ির হাক ডাক ” মেঘনা মেঘনা কি করো এতো সময় ধরে। কখন বলেছি চা করে দিতে। ঘর ঝাড়ু দিয়ে মুছতে এতো টাইম লাগে। ”

মেঘনা চুপ করে থাকে। লজ্জায় মাথা কাঁটা যায় যেন। উর্মি তাকায় আপার নিকট। মেয়েটা কাঁদতে চাইছে না। তবে বেহায়া চোখ থামে না। ফুপিয়ে উঠে সে। মেঘনার চোখের একেক বিন্দু উর্মির উপর বিষ ঢেলে দেওয়ার মত যন্ত্রণা দেয়। এরা মানুষ?
” মেঘনা, এই মেঘনা কথার উত্তর দেও না কেন। একটু কাজ সেটা ও এত লেট। মেঘনা — ”

মেঘনার শাশুড়ি ড্রয়িং রুমে এসে থেমে যান। উর্মি সৌজন্য বোধ থেকে সালাম টুকু দেয় আর তারপর ই আপার হাত ধরে বের করে নিয়ে আসে এক কাপড়ে। নয়ন ভাই এর সাথে বোঝাপড়া টা না হয় পরেই হবে।

সৌমেন টেবিলে মাথা গুজে আছে। সব কিছু তে অদ্ভুত তিক্ততা নেমে এসেছে। বিজনেস যাচ্ছে রসাতলে। প্রায় সময় ই অসুস্থ বোধ করে। সৌমেন এর বাবা মাহফুজ সাহেব ছেলের এই অবস্থা দেখে চিন্তিত। মা বাবার যত্নের ছেলে সৌমেন। বড্ড বেশি ভালোবাসেন। অবশ্য অতি দরদের কারণ বিয়ের নয় বছর পর এই সন্তান লাভ। খুব ছোট বয়সে বিয়ে করেন মাহফুজ সাহেব। বিয়ের নয় বছরে ও সন্তান হচ্ছিল না। অবশেষে আল্লাহর দয়া তে পেলেন চাঁদের টুকরো কে। সেই চাঁদের টুকরো আবার অসুস্থ। তিনি ষাট বছরে পা রেখে ও যতো টা সুস্থ ছেলেটা যেন আজকাল ততোটাই অসুস্থ। স্থবির ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন স্ত্রীর সাথে এই বিষয়ে গম্ভীর এক আলোচনায় বসতে হচ্ছে। ছেলেটা আবার কোনো রোগে পরে নি তো। কি যে চেকাপ করালো সেদিন কে জানে। সব সুস্থ থাকলে এতো ক্লান্ত হয়ে পরে কেন?

তুলির সাথে সৌজন্যের ঝগড়া চলছে।
নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে ছোট ভাবি। সহসা এদের বিষয়ে নাক গলায় না উর্মি। তবু ও আজ সহ্য হচ্ছে না। ছোট ভাইয়ের রুমের কাছে এসে দাঁড়ালো। তুলি তখন বলছে–
” বউ পালা না পারলে বিয়ে করেছো কেন? সংসারে টাকা ঢেলেই সব টাকা শেষ হয়ে যায় তাই না। আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি? সাজ গোজ করতে ইচ্ছে করে না আমার। ”

” পাঁচ হাজার টাকা তে ও তোমার হচ্ছেনা তুলি। জানোই তো সেদিন জব টায় ধরা খেলাম। দেখলে তো কতো গুলো টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হলো। এখন তুমিই বলো আমি কি করবো। এই সময়ে দশ হাজার টাকা করে দেওয়া কি করে সম্ভব? ”

” কেন সম্ভব না। নতুন চাকরির বেতন তো ত্রিশ হাজার টাকা। সংসার খরচ কেন বেশি দিচ্ছো? সেখান থেকে হাজার দুয়েক টাকা কমিয়ে নাও। তোমার বোন ও তো কম করেই দেয়। ”

” আহ তুলি। তুমি তো জানোই ”

” সরো সামনে থেকে। ”

সৌজন্য কে ধাক্কা দিয়ে সরে আসে তুলি। দশ হাজার টাকা সংসার খরচ কেন দেয় এটা তুলি জানে ঠিক ই। তবু ও তুলি বেশি কথা বলছে। এই যে রাত দিন চব্বিশ টা ঘন্টা এসি অন করে বসে থাকে তুলি এই কারনে বিল আসে তিন হাজারের ও উপরে। রোজ নিয়ম করে যে পানির কল ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হাত পা পরিষ্কার করে। এসবের খরচা তো কম হচ্ছে না। তবু ও সেই খরচা নিয়ে প্রশ্ন করে তুলি। অন্য কারো ঘরে তো এসি নেই যে সমান ভাগ তুলবে। সৌজন্য চিন্তায় বসে থাকে। সেভিং এর টাকা টা কোনো মতে চালাতে হচ্ছে। না হলে বছর শেষে যে লাভ টা পাওয়ার কথা সেটা আর পাবে না। উর্মি দরজার কাছ থেকে সরে আসে। নক করার ইচ্ছে হয় না। সে মনে মনে এক সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তুর জন্য সেভিং এর টাকা টা যেমন দিয়েছে ঠিক তেমনি ভাবে ছোট ভাবির জন্য ভাইয়ার হাতে কিছু টাকা গুজে দিবে। তুলির আবার সম্মানবোধ খুব। টাকার জন্য জ্বলবে ঠিক তবে উর্মি নিজ হাতে দিলে ফিরিয়ে দিবে। বলবে আমি কি ফকির নাকি?

পনেরো টা দিন পর আজকের দিন টা ফ্রি পেল সমীর। লোকে বলে ব্যস্ততা নাকি গুরুত্বের উপর ডিপেন্ড করে। তবে এ কথা টা শতভাগ সত্য নয়। উর্মি তার নিকট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবুও ব্যস্ততার জন্য উর্মির সাথে ঠিক ঠাক কথা হয় নি। সোশ্যাল সাইট গুলো তে যাওয়া হয় নি অনেক গুলো দিন। আবার সেভাবে দেখতে গেলে ব্যস্ততা সত্যিই গুরুত্বের উপর ডিপেন্ড করে। সে যাই হোক না কেন সমীর আজ উর্মি কি কল করেছে। গভীর রাতে কল করায় ব্যলকনিতে এলো উর্মি। ধীরে ধীরে ঘুম জড়ানো কন্ঠ টা খোলসা করলো।
” কেমন আছো তুমি? ”

” ভালোই। ”

” বেশি ভালো না? ”

” উহু। কি করে বেশি ভালো থাকি বলো উর্মি। এই সব কিছু ফেলে চলে আসতে ইচ্ছে করে। ”

” চলে আসো তাহলে। ”

” সত্যিই চলে আসবো? ”

” আরে পাগল নাকি। কাজে গেছো। কত টা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেটি ভেবেছো? ”

” বাট তোমার থেকে তো নয়। ”

নিশব্দে হাসলো উর্মি। সমীর হঠাৎ ই আবেগঘন হয়ে পরলো। ভীষণ ভাবে আকর্ষিত কন্ঠে বলল–
” আমি তোমায় ভালোবাসি উর্মি। ভীষণ ভালোবাসি। নিজের থেকে ও বেশি। আমার শখের মানুষ তুমি। যাকে পেলে আমার জীবনের সব থেকে সুন্দর শখ টি পূর্ণতা পাবে। আমার শখের প্রণয়িনী। ”

চলবে…….

#শখের_সাদা_শাড়ি
১৪.
উর্মির ফোন পরে আছে। মেঘনা কে দৌড়ে জাপটে ধরলো উর্মি। মেয়েটা হঠাৎ ই তীব্র আর্তনাদ করে উঠেছিল। ব্যথায় কাতরে উঠছে। দু চোখের ধার বেয়ে নেমে যাচ্ছে গরম জলের স্রোত। মেঘনার চোখ দুটো ক্লান্তি তে বুঝে এলো বোধহয়। আর তার পর ই সব অন্ধকার হয়ে এলো। হাত টা এখনো পেটে চেপে রাখা। যেন বাচ্চা টি কে পরম আদরে জড়িয়ে রেখেছে এক মা।

তিন টা দিন কম নয়। উর্মি কে পাওয়া যাচ্ছে না ফোনে। সৌমেন অসুস্থ থাকা তে আজকাল অফিসে ও যেতে পারছে না। তাই মাহফুজ সাহেব ই যান। তার কাছে খবর এসেছে উর্মি কোনো ইনফর্ম করা ছাড়াই তিন দিন অফিস কামাই দিয়েছে। তিনি ফোন করলেন অথচ ফোন অফ বলছে। উর্মির বাসায় যাবে বলে স্থির করলেন তিনি। ছেলে কে বললে ছেলে ও চিন্তিত হলো। সচরাচর উর্মি এমন করে না। আর সৌমেন তো নিজ চোখে দেখেছে কাজের প্রতি উর্মির কি ভালোবাসা। মাহফুজ সাহেব ঠিকানা অনুযায়ী উপস্থিত হলেন। চার তলা বাড়ি টা দেখে ভ্রু কুচকালেন। কোন তলা তে থাকে উর্মি?

মেঘনার মাথায় হাত বুলাচ্ছে উর্মি। গত তিন দিনে কি ঝড় গিয়েছে ওর উপর দিয়ে সেটা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো জানার কথা না। সত্যি বলতে আপা কে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর তার অনাগত সন্তান কে নিজ সন্তানের মতো। এতো টা ভালোবাসে যে অন্তু যদি সেটা দেখতে পেতো তাহলে নিশ্চয়ই হিংসে করতো। উর্মি দেহ বাকিয়ে বসে আছে। তখনি তুলি এসে বলল মাহফুজ স্যারের কথা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে উর্মি উঠে এলো। বুঝতে পারলো গত তিন দিনে অনুপস্থিত হওয়ার জন্য কোনো ইনফর্ম করা হয় নি। ফোন টা ভেঙে গেছে। আর নাম্বার গুলো অন্য কোথাও তোলা নেই। এমন কি কার্ড টা কোথায় আছে সেটা ও খেয়াল নেই। উর্মি প্রথমেই গেল না। আগে চুলোয় গরম পানি বসালো তারপর সেটা তে চিনি দুধ আর কফি পাউডার দিয়ে মোটামুটি একটা কফি বানিয়ে নিলো। মাহফুজ সাহেব চার পাশে চোখ বুলাচ্ছিলেন। বাড়ি টা মুটামুটি পুরনো। রঙ উঠে গেছে দেয়াল গুলো তে। তবু ও ঘর গুলো পরিপাটি গুছানো। ঠিক যেমন প্রাচুর্যতা নেই ঠিক তেমনি নেই অভাব। সালাম দিয়ে বসলো উর্মি। প্রথমেই নিজের জন্য সাফাই না গেয়ে বলল
” সৌমেন স্যার কেমন আছেন স্যার? ”

” ভালো। তবে এখনো উইক। ঝিমুনি আসে সারাক্ষণ। ”

” ঠান্ডা লেগে আছে এখনো? ”

” হ্যাঁ। সেটা তো জন্মব্যধি। ছেলেটা আমার শ্বাস নিয়ে কতো কষ্ট ই না করলো জীবনে তবে মাঝে সুস্থ ই ছিল। হঠাৎ করেই আবার কি যে হলো। ”
একটু থামলেন ভদ্রলোক। কফি টা হাতে তুলে নিয়ে আবার বলল‍েন–
” বুঝলে সৌমেন নাকি টেস্ট করিয়েছে। অথচ কোনো রোগ ধরা পরে নি। ভাবছি বিদেশ পাঠাবো। ”

” ভালো ভেবেছেন স্যার। আগে থেকেই চিকিৎসা করা উচিত। ”

” হুম। তা উর্মি তোমার কি অবস্থা? তিন দিন ধরে খোঁজ খবর নেই। ”

উর্মি নিশ্বাস নিলো। লম্বা এক নিশ্বাস। আর তারপর ই বললো সে রাত্রি তে মেঘনার হঠাৎ ব্যথা উঠে যাওয়ার কথা টা। মাঝে শুধু বাদ দিলো শশুড় বাড়ি তে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার কথা। উর্মির গলা টা নুইয়ে আসে বার বার। মাহফুজ সাহেব আশ্বস্ত করে আর ও দুদিন ছুটি কাটাতে বললেন। তবে উর্মি জানালো সে কাল থেকেই অফিস যাবে। এমনি তেই কোম্পানির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।

সিম কার্ড টা নতুন ফোনে লোড করতেই সমীর এর কল এলো। নাম্বার টা একে বারে মুখস্ত না থাকলে ও চিনতে অসুবিধা হলো না মোটে ও। সময় না নিয়েই রিসিভ করলো উর্মি।
” হ্যালো, হ্যালো উর্মি। তোমার নাম্বার বন্ধ কেন বলে। অফিস ও যাও নি গত তিন দিন। কি হয়েছে সব ঠিক ঠাক তো। তুমি ঠিক আছো তো। ”

” শান্ত হও সমীর। আমি ঠিক আছি। ”

” হ্যাঁ ঠিক আছো বুঝলাম। তবে ফোন কেন অফ? ”

” ফোন টা ভেঙে গেছে। নতুন ফোন কিনে নিয়ে আসলাম আজ। ”

” ও আচ্ছা। খুব টেনশনে ছিলাম। ”

” আচ্ছা শোনো রাখছি এখন। অফিসে আছি। ”

চেয়ারে বসলো সমীর। হাতে পাসপোর্ট আর প্লেনের টিকেট। গত তিন দিনের টিকেট পাচ্ছিলো না কোনো মতেই। আজ কের টাই পেয়েছে সেটা ও অনেক কষ্টের পর। যাওয়ার আগে আবার উর্মি কে কল করেছিল যদি কোনো খোঁজ আসে। একটু করে হাসলো সমীর। তবে সেদিনের বলা ভালোবাসি শব্দ টা শুনতে পায় নি উর্মি। শখ করে বলা মূল্যবান শব্দ গুলো মূল্যহীন ই ঠেকলো। হঠাৎ ই জোরালো শব্দ এলো কানে। আকাশের পানে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেল মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে প্লেন টা।

নাক ফুলিয়ে বসে আছে সৌমেন। প্রচন্ড রাগে কেঁপে উঠলো সে। একটু দূর থেকে চোখের পানি ফেললো মাইশা। কল্লোল টার জন্য বার বার বকা খাচ্ছে সে। এমনি তেই মাথা ঠিক নেই সৌমেন স্যারের। তার উপর বার বার কল্লোল এর জন্য কাজ কর্মে ভুল করে বসছে। স্যরি বলে বেরিয়ে গেল সে। সৌমেন দূর্বল শরীর টা কে সতেজ রাখার চেষ্টা করছে। বাবা কে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ি তে। এটা তার বিজনেস। সে চায় বাবার টাকা কে না স্পর্শ করে একটা ভালো পজিশন দিতে। অবশ্য পেরেছিল ও বটে। তবে আচানাক আচানাক কি যেন হয় আর সুন্দর গড়ে উঠা পরিকল্পনা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এদিকে শরীর এর যে হাল। উর্মি নক করতে ভয় পায়। একটু আগেই দেখেছে মাইশা ম্যাম চোখ মুছে বের হলো। নিশ্চয়ই স্যার রেগে আছেন। এদিকে উর্মি ও যে খুব ভালো কাজ করে যাচ্ছে তেমন না। অসাধারণ কিছুই হচ্ছে না। এর ফলে কোম্পানির অবস্থা আর ও নিচু হতে শুরু হয়েছে। উর্মি শ্বাস নিলো। এতে অনেক টা স্বস্তি এলো। তারপর নক করলো। শীতল কন্ঠ টা অনুমতি দিতেই প্রবেশ করলো উর্মি। সালাম দিয়ে বলল–
” গুড ইভিনিং স্যার। ”

” গুড ইভিনিং উর্মি। বসো। ”

” এখন আপনি কেমন আছেন স্যার? ”

” ভালো। তবে তোমরা সবাই ভালো থাকতে দিচ্ছো না আমায়। ”

” জী স্যার? ”

” এই যে অসাধারণতা পাচ্ছি না। প্রায় সয় ভুল ভাল কাজ হচ্ছে। এতে লস না হোক তবে বেনিফিট তো আসছে না। আর টাইম ওয়েস্ট তো হচ্ছেই। সে দিক থেকে বলতে গেলে ক্ষতিই হচ্ছে। ”

” দুঃখিত স্যার। তবে আমরা সবাই চেষ্টা করবো নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে। ”

” সেটাই দেখার অপেক্ষা। কফি খাবে? ”

” ওকে। ”

বেল প্রেস করে সৌমেন কফি আনতে পাঠালো। ততক্ষণে আর ও কিছু কথা হলো দুজনার। সৌমেন জানালো বাবা খুব চাপ দিচ্ছে ফরেন কান্ট্রি তে গিয়ে চেকাপ করার জন্য। আর সে নিজে ও এখন সেটাই চাচ্ছে। এদিক টা একটু গুছিয়ে তারপর ই যাবে বলে মনস্থির।

বাসায় ফিরতে একটু লেট ই হলো। রাত তখন সাড়ে দশটা। উর্মি ঝটপট ছাতা গুটালো। যা বৃষ্টি হচ্ছে না বাহিরে। দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল। ঘরের সামনে গিয়ে বুঝতে পারলো নতুন কেউ এসেছে। আর জুতোর মাপ দেখে অনেক টাই নিশ্চিত হলো মানুষ টি কে হতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই ভেতরে এলো। ড্রয়িং রুমে কেউ নেই।
যা বুঝার বুঝলো উর্মি। ব্যাগ পত্র ড্রয়িং রুমে রেখেই আগে ফ্রেস হলো। তারপর জামা বদলে আপার রুমে গেল। নয়ন মেঘনার পা ধরে বসে আসে। উর্মি কে দেখে নয়ন নড়লো না এক চুল। মেঘনা দ্রুত সরে আসার চেষ্টা করলো। ইশারায় স্থির থাকতে বলল উর্মি।
” কেমন আছেন নয়ন ভাই? ”

” উর্মি। বোন মাফ করো আমায়। ”

” কিসের জন্য? ”

” তোমার আপার খেয়াল না রাখার জন্য। প্লিজ মাফ করো। ”

” মাফ তাকে করা যায় যে ভুল করে আর আপনি তো করেছেন অন্যায়। স্যরি নয়ন ভাই আমি আপনাকে মাফ করতে পারলাম না। আর না আপনার সৃষ্টিকর্তা আপনাকে মাফ করবে। কেন জানেন? কারণ আপনি আপনার স্ত্রীর গর্ভে থাকা নিজ সন্তান কে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। ”

” মিথ্যে– ”

” থামেন নয়ন ভাই। আপনি নিজের হয়ে সাফাই গাইতে পারেন তবে ছবি কখনো মিথ্যে বলবে না। ”

ছবির কথা শুনে বসা থেকে উঠে পরলো নয়ন। উর্মি তাচ্ছিল্য করে তাকালো। এতো সময় চুপ থাকলে ও এবার মেঘনা মেজাজ হারালো। চিৎকার করে উঠলো।
” কু’ ত্তার বা”চ্চা তুই আমার সন্তানের দিকে নজর দিয়েছিস। আমার ফুলের মতো বাচ্চা যে কি না এই পৃথিবীর আলো দেখতে পেল না এখনো। ”

” মেঘনা কি বলছো এসব! আমি কেন আমার সন্তান এর ক্ষতি করবো। তোমাদের ভুল হচ্ছে। ”

” তুই আর লুকাতে পারবি না জা”নোয়ার। তিক্ত রাতের আঁধারে সোহাগ দেখিয়ে দিনের আলো তে আমায় অন্ধ করে রেখেছিলি তুই। তোর মা আমাকে দিয়ে এতো কাজ করিয়েছেন তবু আমি চুপ ছিলাম। তুই তো রাতে এসে ঠিক ই আমার যত্ন নিতি। এসব ভেবে আমি মুখ বুজে ছিলাম। সেদিন যে বাথরুমে পরে গিয়েছিলাম সেগুলো সব ছিল তোর প্ল্যান যাতে আমি আমার সন্তান কে হারিয়ে ফেলি আর তুই অতি সহজেই ডিভোর্স দিতে পারিস আর ঐ নতুন মেয়ে টা কে বিয়ে করতে পারিস। নোংরা মেয়ে টা কে। কি যেন নাম। খুব পয়সা তাই না। তোর মিথ্যের দরদে জানি না আমার সন্তান টা কেমন আছে। তবে এই কথা মাথায় রাখ তোর ডিভোর্স পাবি না তুই। আমি যতো দূর যাওয়া লাগে যাবো। আর আমার সন্তান ও এই পৃথিবীর আলো দেখবে। ”

কথা বলতে বলতে মেঘনা বেডের উপর বসে পরলো। উচ্চস্বরে কথা বল‍াতে পেটে খুব ব্যথা করছে। উর্মি নয়ন এর নিকট এসে দাঁড়ালো। শুধু বলল ” আমার আপা কি দোষ করেছিলো নয়ন ভাই? সে দেখতে খারাপ নাকি আপনাকে শারীরিক ভাবে খুশি করতে পারে নি। বলেন কি দোষ আমার আপার। বড় শখ করে আব্বা বিয়ে দিয়েছিল। আমার আপার পেছনে তখন পুলিশ সুপার এর ছেলে আলিদ ভাই ঘুরঘুর করছে। আপনার থেকে দেখতে হাজার গুন সুন্দর। আপার বান্ধবীরা জানেন কি বলেছিল বিয়ের দিন। বলেছিল মেঘনা তুই কাকে বিয়ে করছিস? এই ছেলের থেকে আলিদ ভাই কতো সুন্দর। পয়সা ও তো কম না। আর তুই কি না এই সাদা মাটা সাধারণ জব করা এক ছেলে কে বিয়ে করিস। আপা সেদিন খুব হেসেছিল আর বলেছিল শখ করে বিয়ে করছি রে, এই টুকু বুঝেছি এই ছেলে আর যাই হোক আমায় কাঁদাবে না। আমার আপার শখের বিয়ে টা কেন এমন হলো নয়ন ভাই? বলেন কেন আমার আপার কপাল টা এভাবে পুরলো। কি দোষ ঐ ফুটফুটে বাচ্চা টার। সে কেন পাচ্ছে বাবার অবহেলা। শুধুই টাকা!”

চলবে…..