শত ডানার প্রজাপতি পর্ব-৪৮

0
4668

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট :৪৮

বাড়িতে ফিরার পর থেকে অগ্নি আমার সাথে কোনপ্রকার কথা বলেনি । ভালো খারাপ কোনো কিছুই না । অগ্নির এই শান্ত স্বভাব আমার বড় কোন ঝড়ের পূর্বাভাস মনে হচ্ছে ।
আমি অগ্নির অপরাধী ,আমি মানি আমি যা করেছি তা ভুল অন্যায় আর বোকামি । অগ্নির কাছে কোনকিছু এক্সপ্লেইন করার মত আমার মুখ নেই । আমি আমার ভুলের কথা চিন্তা করে মাথা নত করে আছি । মন খুব কু ডাকছে না জানি কি হবে । খাবার টেবিলেও আসেনি । আসার পর থেকে মায়ের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে । ডাকার সাহস হয় নি । যদি রেগে যায় ?
কোন রকম ডিনার করে রুমে চলে আসি ।অগ্নি রুমে নেই কিছুতেই চোখে ঘুম আসছে না । চিন্তায় মাথা ভাড় হয়ে আছে । বিছানায় হেলান দিয়ে লাইট অফ করে বসে আছি । ঘড়ির কাটাতে রাত বারটা ছুঁই ছুঁই । এমন সময়ই দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসে । দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি অগ্নি রুমে এসেছে । লাইট অন না করেই কাবার্ড থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় । অগ্নির প্রত্যেকটা কাজ আমি খুব মন দিয়ে দেখছি । একবারের জন্যও বিছানায় তাকায়নি । এতো টা রাগ আমার উপর ?
না ,এভাবে রাগারাগি করলে কোন সমস্যার হাল বের হবে না । অগ্নিকে আমার সাইডটা বোঝাতে হবে । অগ্নিকে বুঝতে হবে আমি কেন এই রাস্তা বেছে নিয়েছি । বিছানায় হেলান ছেড়ে একটু উঠে বসি সবটা এক্সপ্লেইন করার জন্য নিজেকে প্রিপারেট করে নেই ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই অগ্নি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে । আমার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে বড়বড় পা ফেলে বারান্দায় চলে যায় । আমি শান্ত চোখে সবটা লক্ষ করলাম । তারপর অগ্নির পিছনে পিছনে বারান্দায় চলে যাই । অগ্নি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দুহাত বারান্দার রেলিং এর উপর রাখা ।আমিও অগ্নি পাশে যেয়ে দাড়াই । এইতো খানিক পূর্বেই বৃষ্টি থেমেছে । আকাশ একদম পরিষ্কার কোন মেঘ নেই । একদম সচ্ছ ।ঠান্ডা শীতল খাওয়ার গাঁ শিরশির করে উঠছে ।গাঁয়ের পশম দাড়িয়ে গেছে ।ঘাড় ঘুরিয়ে অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখি অগ্নি অন্যমনস্ক । চোখ এখনো আকাশের দিকে । কোন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন । আমার উপস্থিতি এখনো টের পায়নি ।আমি গলা ঝেড়ে নত স্বরে বলি ,

– “এখনো কি আমার উপর রেগে আছেন ? একবার জিগ্যেস করবেন না কেন করেছি ? জানতে চাইবেন না কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি ! ”

অগ্নির কোন সাড়া না পেয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি । অগ্নি অন্যমনস্ক ,যেন আমার কোন কথা উনার কানে যায়নি । আমি অগ্নির পাশে এতো টা সময় ধরে আছি উনার কোন খেয়াল নেই । অগ্নি এমন বিহেভ করছে যেন আমি এখানে নেই । অগ্নির এই নীরবতা স্থব্দতা সবকিছু আমাকে ভেঙেচুরে দিচ্ছে । পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শাস্তি গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে ইগ্নোর করা ।অগ্নি আমাকে সেই সবচেয়ে কঠিন শাস্তিটাই দিচ্ছে । আমাকে প্রচন্ড রকম ইগ্নোর করছে ।আমি পারছিনা অগ্নির এই শাস্তি ভোগ করতে । আমার চোখজোড়া ঘোলাটে হয়ে আসছে । তিলেতিলে হচ্ছি । মনে হচ্ছে কেউ বুকে মাঝে হাজার সুঁই এর ঘাই দিচ্ছে । আমি ছুটে গিয়েচ অগ্নিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরি । চোখের জলের বাঁধ ছেড়ে দেই । শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলি ,

– ” কেন এমন করছেন ? কেন ? আমি পারছিনা তো আপনার ইগ্নোর সহ্য করতে । আপনি আমাকে মারেন ,বকুন ,ধমকান ! কিন্তু প্লিজ এই নিষ্ঠুর শাস্তি দিয়েন না । এই শাস্তি থেকে মরণ ও উত্তম । আমার সাথে কথা বলেন অগ্নি প্লিজ ,প্লিজজ ! ”

অগ্নি কোন কথা বললো না । ঠাই আগের ভঙ্গি তে দাড়িয়ে আছে । আমি আগের মতই চোখ মুখ বন্ধ করে কান্না করছি । অগ্নিকে অনবরত বলছি আমার সাথে কথা বলতে কিন্তু অগ্নির কোন সাড়া নেই । পাথরের হয়ে দাড়িয়ে আছে । আজ আমার চোখের পানি ও অগ্নির পাথর ন্যায় মন গলাতে পারছে না । এতোটা রুষ্ট আমার উপর ? আমি আর মানতে পারছি না ।এই নীরবতা স্থব্দতা নিতে পারছি না । আমি নিজের মাঝে থাকতে পারছি না । সব হুস জ্ঞান ভুলে অগ্নি সামনে চলে যাই । দুহাতের অগ্নির মুখ চেপে ধরে জোর করে অগ্নির মুখ আমার দিকে ঘুরাই ।
জোর করে অগ্নির ঠোঁটে আমার ঠোঁট জোড়া চেপে ধরি । জোর করে তাকে কিস করি । কিছুক্ষণ পর অনুভব করতে পারি অগ্নির তড়প থেকে কোন সাড়া নেই । আমি হতাশ চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখি । অগ্নি সবটা শান্তা চোখে দেখছে । আমি অগ্নির থেকে কিছুটা দূরে চলে যাই । চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলি ,

– “কেন এমন নির্দয় হচ্ছেন ! আপনি শুনতে পারছেন না আমার কথা ? আমার কান্না চোখের পানি আপনি দেখতে পাচ্ছেনা ? এতো নিষ্ঠুর শাস্তি কেন আমাকে দিচ্ছেন ? আপনার আমাকে এভাবে এড়িয়ে চলা ,আমাকে পাগল করে দিচ্ছে । এর চেয়ে ভালো আপনি আমাকে মেরে ফেলেন । নিজের দুহাতে আমার গলা চিপে প্রাণ নিয়ে নিন ! নিন ! নিচ্ছেন না কেন ? ”

আমি পাগলের মত বিহেব করছি ।জোর করে অগ্নির হাত আমার গলার কাছে টেনে আনছি। অগ্নি আমার প্রত্যেকটা কাজ শীতল চাহনি তে পর্যবেক্ষন করছে । উনার চোখে কোন প্রকার ভাব নেই । না আছে কোনো ভাষা !
অন্যদিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো ,

– ” অনেক রাত হয়েছে ,রুমে যেয়ে ঘুমাও । ”

অগ্নির কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে থাকলাম । উনার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে নিজেকে সামলিয়ে বললাম ,

– ” ঠিক আছে ,আমার সাথে কথা বলবেন না তো ? আমার দিকে তাকাবেন নাও পর্যন্ত !
তাহলে আমার এখানে ,এই বাড়িতে ,আপনার কাছে থেকে কি লাভ ? আমি কেন এখনে পড়ে আছি । আমার এখান থেকে চলে যাওয়াই উত্তম ! ”

কথা শেষ করেই হুরহুর করে অগ্নির সামনে থাকে চলে আছি । রাগ জেদ খারাপ লাগা আমার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে । আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই । পিছন থেকে তুফান বেগে অগ্নি এসে আমার বাহু ধরে আটকায় ।
আমাকে টানতে টানতে বিছানায় ফেলে ।অগ্নির চোখ জ্বলন্ত লাভা’র মত জ্বলছে ।
আমার হাতের ডানা শক্ত করে ধরে চিৎকার করে বলে ,

– ” কি খুব সাহস বেড়েছে ? খুব ? একবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কলিজা বড় হয়ে গেছে । কথায় কথায় বাড়ি ছাড়া ? আমার থেকে মুক্তি চাস ? যাহ ,তুই মুক্তি !
বাবা ,মা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে । তুই ও যা । কাউকে লাগবে না আমার । কাউকে না ! যা তুই । যাহ্‌ । ”

এসব বলতে বলতে পানির জগটা মাটিতে ছুড়ে মারে । রুমের সব কিছু ভাঙচুর করতে লাগে ।পাগলের মত কাজ করছে । আমি ভয়ে কুঁকড়িয়ে গেছি । ডুকরে কান্না করছি । অঝোরে চোখ থেকে পানি পড়ছে । অগ্নির এই ভয়ংকর তান্তব আমি আগে দেখিনি । ভয়ে চুপসে গেছি । মুখ চেপে ধরে কান্নার করছি । সব ভাঙচুর করে কিছুক্ষণ পর হেলতে দুলতে আমার দিকে আসে । হাত থেকে রক্ত পড়ছে। কিন্তু সেদিকে উনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ।
অগ্নি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই । যে কোন সময় যে কোন কিছু করতে পারে ।
আমি ভয়ে পিছিয়ে যাই ।ভয়ে সাড়া শরীর কাঁপছে । অগ্নি আমার সামনে দপ করে বসে আমার দিকে হাত বাড়াতেই আমি সড়ে যাই । এতে যেন উনার রাগ আরো বেড়ে যায় । একটানে আমাকে টান দিয়ে তার বুকে সাথে জড়িয়ে নেয় ।
আমি ভয়ে তখনো ঠকঠক করে কাঁপছি । কি আশ্চর্য যেই বুকে নিজের শান্তির ঠিকানা খুঁজে নিতাম । আজ সেই বুকে মাথা রাখতে ভয় লাগছে । পরিস্থীতি কত কিছু পাল্টিয়ে দেয় ।
আমি আদো আদো স্বরে বলি ,

– “আমাকে ছেড়ে দিন আমার আপনাকে ভয় করছে খুব? ”

অগ্নি আমার কথায় ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায় । আমার গালে উনার দুহাত চেপে ধরে । চোখ বন্ধ করে আমার নাকের সাথে উনার নাক ঘষতে ঘষতে বলে,

– “আর আমি যে তোমাকে হারানোর ভয়ে সেকেন্ড সেকেন্ডে মরছি ! তুমি এতো স্বার্থপর কেন? কেন আমাকে এমন ভয়ংকর শাস্তি দিতে চাও । আমার একটা ভুলের জন্য তুমি আমাকে এতো শাস্তি দিচ্ছো ! আমি না হয় তোমাকে চিনতে পারিনি যে তুমিই আমার ভালোবাসা ,আমার পরীজান তাই বলে এতো কঠিন শান্তি দিবে ?
বাবা কে খুব কমবয়সে হারিয়েছি । তার পর মা ই সব ছিলো । কিন্তু মাও ছেড়ে চলে গেছে । তোমাকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন বুনেছি । আমার মন জান প্রাণ ধ্যান সবকিছু তোমাকে উৎস্বর্গ করেছি । তোমাকে ঘিরে আমার দুনিয়া বানিয়েছি এখন তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছো । আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারো ? ”

অগ্নির চোখে পানি আমার গাল বেয়ে পড়ছে । আমি চোখ খুলে দেখি অগ্নির চোখ বন্ধ ।
উনার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝোড়ছে । ছেলেরা সহজে কাঁদে না ।বুকে প্রচন্ড রকম বড় কষ্ট না পেলে তাদের চোখের পানি ঝড়েনা । আমার কাজ্ব অগ্নি এতোটা কষ্ট পেয়েছে । এতোটা ?
এতো গভীর আঘাত দিয়ে ফেলেছি নিজের ভালোবাসার মানুষটা কে !

অগ্নির চোখের জল মুছে দিয়ে বলি,

– “আপনি আমাকে একবার বুঝার চেষ্টা করলেন না ! আমি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা জানতে চাইলেন না ? আমি আপনাকে কোন শাস্তি দিতে চাইনা । এমন করার চিন্তাতো আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না ।
শতবছর আপনার সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছি । কিন্তু তখন পরিস্থীতি এমন ছিলো আমি ভেঙে পড়েছিলাম । রাগের বসে আপনাকে ছেড়ে তো গিয়েছিলাম কিন্তু বাঁচার জন্য আমার কাছে কোন কারণ ছিলোনা । আমি পারতাম এবরশন করতে কিন্তু তারপর কি নিয়ে বেঁচে থাকতাম !
মায়ের আদর ভালোবাসা শাসন আমি কখনো পাইনি । তা কেমন জানি না । তাই আমি চেয়েছি আমার সন্তানের শৈশবে নিজের শৈশব খুঁজে পাওয়া । তাকে দুনিয়ার সবরকম সুখ এনে দিতে । আমি যা যা থেকে বঞ্চিত হয়েছি সে সব আমার সন্তানকে দিতে চেয়েছি । এতে যদি আমার জীবনে কোন প্রকার ঝুঁকি আসে তো আসুক আমি লড়াই করে নিবো । সিলেট থেকে ফেরার পর অনেক বার আপনাকে বলতে চেয়েছি কিন্তু সাহস জোটাতে পারিনি ।আমি জানি আমার কাজে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু আমি মা হয়ে কি করে আমার গর্ভের সন্তান কে হত্যা করতাম ? এতোটা সাহস যে আমার মাঝে নেই !
যেখানে আমার মা হওয়ার সম্ভাবনা ফিপটি পার্সেন্ট ছিলো সেখানে মহান আল্লাহ্‌ র দোয়ায় আমি সেই সৌভাগ্য লাভ করেছি । আমি কি করে আল্লাহ্‌ র এই দানকে অস্বীকার করতাম ? আমার যে এই বাচ্চাটা চাই অগ্নি ! ”

– “আমার তোমাকে চাই ।পৃথিবীর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই আমার শুধু আমার পরীজান কে চাই । বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেকটা নিশ্বাস এর জন্য শুধু তোমাকে চাই ।এবার আমার থেকে দূরে গেলে সত্যি সত্যি আমি মরে যাবো ।
আমার কোন বাচ্চা চাইনা আমার শুধু আমার হুরকে চাই । ব্যসসস ! ”

অগ্নি আমার কোলে মাথা রেখে এসব পাগলের মত প্রলাপ করছে । অগ্নির প্রত্যেকটা কথায় আকুল আবেদন । অগ্নির ভালোবাসার গভীরতা কতোটা তা আমার জানা । আল্লাহ্‌ না করুক যদি কোনদিন আমার কোন কিছু হয়েও যায় অগ্নি আমাদের সন্তানের মুখ থেকে কখনো তাকে দূরে ঠেলে দিবেনা । বুকের মাঝে নিয়ে ঠিক আগলে রাখবে । আমি অগ্নির চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলি ,

– “এমন বলতে নেই ,এই সন্তান আমাদের দুজনের অংশ । যদি আমার কখনো কিছু হয়েও যায় । আমাদের সন্তানের মাঝে আমার ছায়া পাবেন । ”

অগ্নি ধমকের স্বরে বলে,

– ” শার্ট আপ ,হুর ! আর কখনো এমন বাজে কথা বলবেনা । তোমার কিছু হবেনা । তোমার আমার জন্য বাঁচতে হবে । আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না । অগ্নির হুর শুধু অগ্নির কাছেই থাকবে । ”

অগ্নির ধমকে মুচকি হাসি । আমি জানি এই ধমকের পিছনে অফুরন্ত ভালোবাসা আছে । আমি পাশ থেকে মেডিসিন বক্সটা নিয়ে অগ্নির হাতে কাটা জায়গায় মেডিসিন লাগিয়ে দেই । অগ্নির মাথায় ঠোঁট ছুঁয়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলি ,

– “হুম , আপনার পরীজান শুধুই তার রাক্ষসরাজের ”

চলবে…..❤️❤️❤️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন 😊😊😊।