শানুর সংসর পর্ব-০৪

0
226

#শানুর_সংসর (৪)

‘সারাদিন কষ্ট করি কি লবনপোড়া খেতে, শানু? তোমার ধ্যান কোথায় থাকে?’

আসিফের প্রশ্নে শানু চোখ নামিয়ে টেবিলক্লথের ফুল দেখছে। এই ক্লথটা বাজারের কেনা। শানু তৈরী করেনি। আসিফকে বললে, পরে হয়তো খুশী হবে।
‘কথা বলছো না, কেনো। সামান্য কাজের ভেতর করো ঐ রান্নাটুকু। তাও মুখে তোলা গেলো না।’

শানু আমতা আমতা করে। তখন রেহানা ভাবী আসলো। কাজের ফাঁকে লোক আসলেই জুটে যায় উৎকট যন্ত্রণা। এই যেমন, রান্না খারাপ হয়েছে। তবে, কচু বাটা ভালো হলেও কচুর মুখী দিয়ে ইলিশের মাথার তরকারীটা হয়েছে জঘন্য। অথচ, আসিফের কচুর মুখী সবচে’ প্রিয়। যে বেলা মুখীর তরকারী হয়, আসিফ তা দিয়ে ভাত খেয়ে নেয়। শখ করে প্রথমেই মুখীর তরকারীর লোকমা মুখে তুলে আসিফ প্লেট সরিয়ে রাখে। শানুকে আসলে নেয়া যাচ্ছে না।

‘আম্মা, আপনি ও বাসায় করেন কি। শানুর দিকে খেয়াল রাখতে পারেন না?
‘ওর কাছে কত শত লোক আসে। এত বাইরের মহিলা এলে রান্না ঠিক থাকে না। ‘

আসিফকে শানু নতুন প্লেট এনে দেয়। আসিফের সরিয়ে রাখা প্লেট টানে নিজের জন্য। অত দামের নাজিরশাইল চালের ভাত৷ এতগুলো মুখী, মাছের মাথার অংশ ফেলে দিতে বুকে লাগে। সদাই পাতির বাজারে আগুন লেগে আছে। শানু রোজ হেঁটে হেঁটে ঘুরে, যেখানে কম পায় বাজার করে আনে। ওতে পয়সা বাঁচে। শানুর নিউমার্কেট যাওয়ার পুঁজি জোরালো হয়।

‘মাথাটা দাও এদিকে। তুমি আবার এই প্লেটে খেয়ে কি প্রমাণ করতে চাও। লবন ঠিক আছে?’
‘না, ফেলতে খারাপ লাগছে। আমি একটু বেশী ভাত মেখে খেয়ে নেব। ‘
‘খাও, আরো বেশী ভাত খাও। শরীরের দিকে তাকিও। বেলুন না হয়ে যাও।’

রাজু মায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলেও আসিফ নিজের রসিকতায় উচ্চস্বরে হাসে। কচু বাটা খেয়ে ভালো লাগছে। শানুর হাতে জাদু আছে। রান্নায় একটু আধটু এদিক সেদিক হয়ে যায়, সেটা আসিফ জানে। তবে, মহিলাদের এসব ছেড়ে দিলে তারা বেড়ে যায়। ঘরের বউকে এত বাড়তে দেয়া ঠিক না। মুখীর তরকারীর সাথে মুশুর ডালের আম ডলে খায় আসিফ। চমৎকার লাগছে এখন। শানু হয়ত ডালে লবন কম দিয়ে ব্যালেন্স করে ছিলো। আসিফের ধমকের চোটে ভুলে গেছে৷ স্বামীকে তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখে শানু খুশী হয়ে যায়। প্লেটে কাঁচমরিচ ডলে নেয় শানু। লবনটা এখন আরো কম লাগছে। খেতে খেতে আসিফ আবার মাকে প্রশ্ন করে,
‘আপনি বলছিলেন, লোক আসে আম্মা। কে আসে?’

শানু ঝটপট উত্তর দেয়,
‘বাইরের কেউ না। পাশের বাসার রেহানা ভাবী। ‘
‘মহিলার চলন ভালো না। যখন তখন এসে পরে।’

আলেয়া আক্তার চান ছেলের বউকে ছেলের মুখ থেকে দু’কথা শুনিয়ে রেহানার ঘণঘণ যাওয়া আসা থামাতে। শানু অধোবদনে আবার ভাত টেপে। রেহানা ভাবী এটা সেটা নিয়ে যায় ঠিক। তবে, আসলে ভালো লাগে। এক ঝলক মুক্ত বাতাসের স্বাদ পাওয়া যায়। শানুর একা ঘরকন্না করতে ভালো লাগে না। রাজু-মিশু যখন ছোট ছিলো, শানুর সময় উড়তো বাতাস থেকে দ্রুত গতিতে। রাজুকে খাইয়ে মিশুকে গোসল দিয়ে নিজের মুখে গপাগপ ঠুসে আবার রাজুকে নিয়ে পড়তে বসা। মেয়েকে ছড়া শেখানো। আসিফের ভাই কাশিফ তখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে হল ছেড়ে ভাইয়ের বাসায় উঠেছে৷ কাশিফের নানা আবদার রাখা। হুট করে একগাদা বন্ধু নিয়ে এসে বাসায় হাজির হলে, তাদের ডিমের ঝোল ভাত রেঁধে খাওয়ানো। শানুর অবসর বলতে ছিলো না। আজকাল কাজ কমে এলেও শানুর আগের মতো মন টানে না। রাজুটা বড় হয়ে নিজের আলাদা জগত রচেছে। মিশু পড়াশোনার পর মাকে জড়িয়ে থাকে। তাও বা কতক্ষণ। মেয়ের আঁকার ঝোঁক আছে। ইজেল প্যালেট প্যাস্টেল নিয়ে বসে পরে ছবি আঁকতে। রেহানা ভাবী আসলে তাও গল্প শোনা যায়। ভাবলো না হয় শানুকে একটু বোকা। শানু বোকাই তো। বোকার হদ্দ। নইলে, আসিফের প্রিয় তরকারিতে দু’বার লবন দেয়!

আলেয়া আক্তার ছেলের সাথে জরুরী আলোচনা সারতে চান। খাবার টেবিল বাদে আসিফের সাথে কথা বলার সুযোগ মেলা ভার। কাশিফের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। আসিফের মত জানা দরকার।
‘তুমি জানো দোকান দুইটা আমার পছন্দ হইছে। ‘
‘জানি আম্মা। বায়না করছেন?’
‘বায়না করব, টাকা তুলতে হবে। ‘
‘শানুকে নিয়ে ব্যাংকে চলে যাবেন। কবে যাবেন আগের দিন বলবেন।’
‘বললে কি হবে, তুমি যেতে পারবে?’

আসিফ খাওয়া থামিয়ে আলেয়া আক্তারকে মেপে নেয়। আম্মাকে রাগানো যাবে না। বুড়ো মানুষ, রেগে গেলে বিপি বেড়ে যাবে। তখন আবার আরেক যন্ত্রণা লাগবে। আসিফ কৌশলে মায়ের মন রক্ষা করে।

‘আমি যাব কিভাবে আম্মা। চাকরী থেকে যখন ইচ্ছে বার হওয়া যায় না। ‘
‘অতগুলো টাকা, দুই জন মেয়ে মানুষ একা গিয়ে তোলা নিরাপদ হবে? ‘
‘না আম্মা, এই জন্যে বলেছি, আগের দিন বলে রাখলে আমি অফিসের গাড়ি পাঠাবো।’
‘ড্রাইভার বিশ্বস্ত হবে? এখনকার কাজের লোক, ড্রাইভার কাউকে ভরসা করা যায় না।’
‘শানু, হা করে ভাত গেলা থামাবে? একট জরুরী কথা বলছি। তুমি খেয়েই যাচ্ছো, খেয়েই যাচ্ছো। ডায়নোসররাও মনে হয় খাবারের মাঝে বিরতি দিতো। খেতে বসলে তোমার হুঁশ থাকে না।’

শানু হাত চেটে খেয়ে স্বামীর দিকে মনোযোগ দেয়। স্বামী আসিফের এই সব অপমান তার গায়ে সয়ে গেছে। সে একটু খেতে ভালোবাসে। সবসময় না, মাঝে মধ্যে জিভটা তারিয়ে ওঠে। মাসিকের আগে দিয়ে শানুর বেশ ক্ষুধা পায়। এত বছর সংসার হয়ে গেলো, আসিফ এখনো শানুর সম্পর্কে কিছুই মনে রাখে না। শানু দীর্ঘশ্বাস ঝেড়ে ফেলে।

‘বলো, কি বলবে। মিষ্টি দেই। ‘
‘পরে, আম্মার সাথে যখন ব্যাংকে যাবা বড় ব্যাগ নিয়ে বোরখা পরবা। ‘
‘আমি বোরখা টোরখা পরতে পারব না। গরম লাগে৷ আম্মা, আপনি বলেন তো, এই গরমে বোরখা পরে হাঁটা যায়? ‘
‘আসিফ, আমি বলছিলাম কি, তুই যদি আধাবেলা ছুটি নিয়ে টাকা গুলা তুলে দিতি।’

আসিফ শানুর এনে দেয়া মিষ্টি ভেঙে মুখে দেয়। শানু এই মোয়াটা দারুণ বানায়। আজকে এত পদ রান্না শেষে আবার কুচো নারকেলের সন্দেশ করেছে। হালকা ঘিয়ের গন্ধ, স্বাদ দুই জিভ ও ইন্দ্রিয় চনমনে করে তোলে। আসিফ শানুর কাছে জানতে চায়,
‘আর আছে নাকি?
‘আছে তো? তোমাকে আরো দেব? ‘ শানু কি যে খুশী হয়েছে, আসিফের ভালো লেগেছে দেখে।
‘আর দিতে হবে না। কালকে স্যারের জন্যে বক্সে করে দিয়ে দিও।’
‘কয়টা দিব? তিনটা না চারটা। সবগুলো দিয়ে দেই। আবার বানাবো।’
‘মাথামোটা মহিলা। সব দেবে না। দশ বারো পিস দেবে। টিস্যুতে মুড়িয়ে দিও। আর প্লিজ, বক্সটা মেজে দেবে। আদা রসুনের গন্ধ যেনো না আসে।’

শানুর চোখে পানি চলে এলো। বাচ্চাদের সামনে তাকে আসিফ যা নয় তা বলে ফেলে। শানু কিছুই হয়নি ভাব করে মেনে নিলেও, মাথামোটা শব্দটা ভালো লাগে না। আলেয়া আক্তার ছেলের বউয়ের ভেজা চোখ খেয়াল করেন। ছেলেকে শাসন করলে ছেলের বউ মাথায় উঠবে। তিনি বুদ্ধিমানের পন্থা অবলম্বন করে চুপ থাকলেন।

মিশু প্লেটের ভাত নেড়ে যাচ্ছে। আসিফ মেয়েকে লক্ষ্য করে ঝাড়ি দেয়।
‘পড়ার খবর নেই, ভাত কয়টা বসে টিপে গলাচ্ছো। টেস্ট পরীক্ষার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত হও। ‘
‘জি বাবা। ‘
‘ম্যাথে কত পেয়েছো।’
‘দুটো সিটি মিলিয়ে ফুল মার্কস আছে। কিরে মিশু, তোর বাবাকে খাতা দেখাসনি ‘

মায়ের কথার জবাব দেয় না মিশু। রাজু আসিফের কাছে কলেজে আয়োজিত জনসেবা মূলক কাজে যাবার অনুমতি চায়।

‘দুই দিনের প্রোগ্রামে একটা প্রতিষ্ঠান থেকে প্লাস্টিকের বোতল ও জিনিষপত্র কুড়োবার একটা ক্যাম্পেইন আছে বাবা। ওরা কক্সবাজার নিয়ে যাবে, আবার নিয়ে আসবে। আমাদের শুধু থাকা খাওয়া বাবদ সামান্য কিছু চাঁদা দিতে বলেছে। ‘

‘ময়লা টোকাতে কক্সবাজার যাবে? যাও! কি শানু, ছেলের এইম ইন লাইফ মুচি মেথর হয়ে যাচ্ছে, তোমার খবর নেই। নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও কেবল।’

‘মা মানা করেছে বাবা। মাকে দোষ দিও না।’

প্রতি কথায় মাকে টেনে দোষী করার বাবার স্বভাব। রাজু ছোট থেকে দেখে এসেছে। বাবা বাড়ি থাকলে, মা কিছু বলতো না। তবে, যেই বেড়িয়ে যেতো, মা দরজা জানালা দিয়ে কাঁদতে বসতো। কাঁদতে কাঁদতে কাজ করতো। কাপড় ধুতো, বাসন মাজতো। ঘর মুছতে মুছতে কেঁদে কেটে আবার চোখের পানি মুছে নিতো। রাজু তখন অনেক ছোট। মাকে কাঁদতে দেখে বাবার ওপর রাগ হতো খুব। শানু কখনো ছেলেকে আসিফের বিরুদ্ধে দুটো কটু কথা শেখায়নি।

‘আমি যেতে চাই বাবা। দুইশ টাকা চাঁদা দিতে হবে। ‘
‘টাকা গাছে ধরে না রাজু। দুইশ টাকা এমন কোন টাকা না যে আমি দিতে পারব না। কিন্তু, তুমি পিঠে ছালা বেঁধে টোকাই সাজবে, এটা হবে না।’
‘একটা টিউশনি শুরু করেছি আমি। ওখান থেকে এডভান্স নিব, তাহলে’।

আসিফের মাথা গরম হয়ে গেছে। বেয়াদব ছেলে একে মুখে মুখে তর্ক জুড়েছে। শানুর হয়ে ওকালতি ধরছে। আবার টিউশন শুরু করেছে, কারো অনুমতি না নিয়ে।

‘তুমি এসব কিছুই করবে না। পড়াশোনা করো। ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেতো হবে। নইলে ডিগ্রী পড়বে। তখন টিউশনি করে পড়ার খরচ চালিও। ‘

রাজু মায়ের মুখের দিকে তাকায়। রাগে তার নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে৷ শানু করুন দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ছেলেকে চোখের ভাষায় থেমে যেতে বলে। রাজু একবার মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আসিফের সামনে আর একট শব্দ না করে উঠে গেলো।

‘বায়োলজিতে কত পেয়েছো মিশু? তোমার স্যার ফোন করে ছিলো।’
‘সাতাশি বাবা। স্যার নম্বর কেটেছেন। ছবি সুন্দর হয়নি’।

আসিফ মেয়ের ওপর চোটপাট করে না। মিশুর চোখমুখ ফুলে আছে।

‘লেখাপড়া ভালো না লাগলে বলো। লোকাল স্কুলে ভর্তি হও। আমার খরচ কমবে। ‘

মিশু ভাতে পানি ঢেলে দিয়েছে। শানু দেখতে পেয়ে বলে,
‘দুধভাত খাবি?’ গরুর দুধ জ্বাল দেয়া আছে, খেলে বল, সবরী কলা কচলে ভাতে মেখে দেই।’

মিশুর চোখ থেকে ঝরঝর করে ঝর্ণা গলে পরে। শানু মেয়ের কান্না দেখে কিছু বুঝতে পারছে না। আসিফ এমন কিছু বকা দেয়নি যাতে মিশু কাঁদতে শুরু করে। মেয়েটা এত ছিঁচকাদুনে হলে লোকে শানুকেই গাল দেবে। বলবে, মেয়েকে মা কিছুই শেখায়নি। কথায় কথায় ন্যাকামি করে।

‘কাঁদছিস কেনো। তোর বাবা বকেনি তো। আরে কোথায় যায়, আবার।’

মায়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মিশু কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে দরজা দেয়। দুপুরে দোকানে থাকা ছেলেটার খিকখিক হাসিতে মিশে যাওয়া নষ্ট কথা গুলো কানে বাজছে,

‘ ডা সা মা ল চোখ এড়িয়ে গেলো কেমন করে। দু ধের প্যাকেটের সাইজ কত? ও মামা, কলা খায় নাকি তোমার পাখি? ভালো ক লা আছে। লাগলে লাগিয়ে
দেব নে’।

মিশু কান চেপে দরজার ওপাশে বসে বসে কাঁদে। এ কথা কাউকে বলা যাবে না। মা শুনলে আর বেরোতে দেবে না৷ ভাই জানলে মারামারি করবে। বাবাকে লজ্জায় বলতেই পারবে না মিশু। দাদী শুনলে উল্টো মাকে দায়ী করবে৷ কাঁদতে কাঁদতে মিশু আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। বুক জেগে ঠেলে ওঠা নব পুষ্পকলিদের দেখে নিজের পরিবর্তনের আনন্দ মিশুকে স্পর্শ করে না। বরং, স্পর্শকাতর নোংরা শব্দেরা দেয়াল তুলে মিশুর চারপাশ আটকে দিতে থাকে। সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের জীবনে এত কষ্ট দিতে যদি তৈরী করলেন, তাহলে মেয়েদের সৃষ্টির প্রয়োজন ছিলো না। মিশুর মনে হলো, মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া পাপ। এ পাপের জন্যে একমাত্র সে দায়ী।

(চলবে)