শানুর সংসার পর্ব-০৬

0
207

#শানুর_সংসার (৬)

‘আগামীকাল থেকে মিশু বোরখা পরে স্কুলে যাবে, এটাই আমার শেষ কথা। ‘

শানু দুপুরের খাবার হিসেবে টেবিলে ডিমের ঝোল আর পাটপাতায় মুশুর ডাল সাজিয়ে রেখে মাত্র গোসলে ঢুকে ছিলো। আলেয়া আক্তার ডাইনিং এ বসে লেবু কাটছেন। মিশু স্কুল থেকে ফিরে লেবুর শরবত খায়। আলেয়া আক্তার নাতনীর জন্য শরবত বানাবেন। দরজায় প্রচন্ড করাঘাত হওয়ায় তিনি চমকে উঠলেন। করাঘাতের পর শুরু হলো ঘণঘণ বেল বাজানো। দরজর ওপাশের মানুষটির যেনো তর সইছে না। আলেয়া আক্তার শানুকে ডাকলেন,
‘এই শানু, দেখ তো কে এলো। তোমার বান্ধবীর মনে হয় লবন ফুরায় গেছে। চুলায় তরকারী বসায়ে লবন নিতে আসছে। ‘

শানু ভেজা শাড়ি কোন মতে গায়ে লেপ্টে দিলো। বড় তোয়ালে দিয়ে শরীর ঢেকে দরজা খুললো শানু। আসিফ হিড়হিড় করে মিশুকে টেনে এনে প্রায় ছুঁড়ে দিলো ঘরের ভেতরে। মিশু ভীত হরিণ শাবক। শানু ছুটে গিয়ে মেয়েকে বুকে তুলে নিলো। মিশু থরথর করে কাঁপছে। তার গালে পাঁচ আঙুলের লাল দাগ শক্ত হয়ে বসে আছে। শানু মেয়েকে জোরে চেপে নেয় বুকের ভেতর৷ মিশুকে মেরেছে আসিফ? আসিফ ঘরে ঢুকে কাঁধ থেকে ব্যাগ রাখেনি। তার আগেই চিৎকার শুরু করলো।

‘বেজন্মা মেয়ে, স্কুলে যায় না প্রেম করতে যায়। ‘
‘আল্লাহ, আসিফ আস্তে কথা বল। পাড়া প্রতিবেশী শুনতে পায়।’
‘ও! আমি আস্তে কথা বলি, আর আপনার নাতনি রাস্তায় নষ্টামি করুক। ‘
‘আমার মেয়ে এমন কিছু করতে পারে না’।
‘এক দম কথা বলবে না, শানু। চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব তোমরা মা-মেয়ের।’

শানুর নাকের বাঁশি থেকে থেকে ফুলে উঠছে। মিশুটা মনে হয় বমির উদ্বেগ তুললো। শানুর চোখ বেয়ে জল পরে অনবরত। মেয়েকে সোফায় বসিয়ে পানির বোতল বের করে হাতে দেয়।

‘খাওয়াও, আরো মিষ্টি মন্ডা এনে দেই। ওসব খাওয়াও।’
‘আহা, বলবি তো হয়েছে কি।’

আলোয়া আক্তারের খারাপ লাগছে। মিশু তার আদরের নাতনী। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে। হুজুর রেখে কোরআন শরীফ খতম দেয়ানো হয়েছে। হুজুর এখনো মসজিদের চাঁদা নিতে আসলে মিশুর মাথায় হাত রেখে দোয়া করে যান। মিশু প্রতি শুক্রবার আলেয়া আক্তারের পিঠ ডলে ধুয়ে দেয়। এমন ভালো মেয়েকে নিয়ে আসিফ কি শুরু করলো।

‘ভাগ্যিস আজকে অফিস থেকে আগে ফিরেছি। নইলে কি দেখতে পেতাম? ‘
‘কি দেখেছো’। শানু খুব আস্তে প্রশ্ন করে।
‘কি দেখেছি? দেখেছি, বাসার সামনে সাইকেল নিয়ে একটা হা রা ম জা দা তোমার মেয়ের জন্য গান গাইছে। ‘
‘মিশুর জন্যই যে গাইবে এটা তুমি ভাবলে কেনো?’

মেয়ের জন্য শানু লড়বার চেষ্টা করে। সে লড়াইও দূর্বল। আসিফের মুখের ওপর কথা বলার সাহস তার হয় না। নিজের মাকে কোনদিন বাবার সাথে তর্ক জুড়তে দেখেনি। শানু বরাবর জেনে এসেছে, পরিবারে পুরুষেরা প্রধাণ। তাদের কথাই শেষ কথা। মহিলারা নিজের মত জানালেও পুরুষের অনুমতি নিয়ে বলবে। আলেয়া আক্তার চাকরী করতেন। তাই হয়তো, তার গলায় সামান্য জোর ছিলো বা আছে।

‘গেটের ভেতর তোমার মেয়ে বসে নাগরের গীত শুনছিলো।’

শানু মিশুর দিকে তাকালে মিশু প্রবলভাবে মাথা নাড়ে। বাবা মিথ্যে বলছে। কিন্তু, বাবা ইচ্ছে করে মিথ্যে বলবে কেনো? মিশু তাহলে খারাপ মেয়ে। কিন্তু, মিশু কখনো খারাপ কাজ করেনি। তাহলে বাবা আজকে এত নোংরা অপবাদ মিশুকে দিলো। মিশুর অবশ্যই কোন দোষ হয়েছে। মিশুর নিজের ঘেন্না লাগে। সে আরো সমঝে চলতে পারতো। আরো আগে স্কুলের জন্য বের হলে, ছেলেটা তাকে দেখবে না। তবে, বাবার রণমুর্তির সামনে মিশু কিছু বলতে পারছে না। বাবা তাকে খুব ভুল বুঝেছে। মিশু কি শরীর দেখিয়ে চলেছে? কই না তো। মিশু ছেলেটার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। ছেলেটা ইচ্ছে করে মিশুকে উত্যক্ত করে। ঐ ছেলেটার আগ্রাসী আচরণ সবার কাছে স্বাভাবিক। মিশু কিছু না করেও সমস্ত দোষে দোষী। ছেলেটার অপরাধ প্রমাণ করতে কারো চেষ্টা নেই। মিশুর গায়ে বস্তা বস্তা কাপড় চাপিয়ে দেবে সবাই৷

‘ও হয়তো বিপদে পরে ছিলো।’
‘মাথা তোমার। মহিলারা যে মাথা মোটা, এমনি এমনি বলে না। ‘
‘আমি বোকা বলে আমার মেয়েও বোকা হবে? ‘
‘তোমার অওকাদ কতটা আমার জানা আছে। সামান্য একটা বিএ পরীক্ষার গন্ডি পেরোতে দুই ভাঙায় পাশ। ‘

শানুর কান্নায় গলা বন্ধ হয়ে যায়। প্রতি বার পরীক্ষার আগে সে কনসিভ করেছে। তারপর ঔষধ খেয়ে রক্ত গিয়ে দূর্বল হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা। বিছানায় পরে থেকেও শান্তি ছিলো না। পরীক্ষার পড়া পড়বে৷ নাকি বাচ্চাদের দেখবে। আসিফ তো তার ঘাড়ে সময় মতো পিল না খাবার দায় দিয়ে খালাস। তাও সেই কত বছর আগের কথা। শানু আঁচলে মুখ মুছে নেয়। তার খুব ঘাম হচ্ছে। সোফায় মিশু ভীতু কুকুরের মতো গুটিয়ে আছে। আসিফ অনেকটা সময় চিৎকার করে থামলো।

‘আমার ডিসিশন হলো, মিশু আগামীকাল থেকে বোরখা পরে স্কুলে যাবে।’
‘আমি স্কুলে যাবো না, বাবা।’
‘কেনো? নাগর যেমন পথের মিসকিন, ওরকম হবে প্লান করেছো?’
‘কটা দিন বাদ দাও না, ওর হয়তো ভালো লাগছে না।’
‘সামান্য একটা মেয়েকে মানুষ করতে পারো না, কেমন মা তুমি শানু? এমন মা থাকার চে’ না থাকা ভালো। ‘

মিশু চুপ করে থাকে। বাবার কথার উত্তর করতে তার ভয় লাগছে।
‘এই প্রেম পিরিতির চ্যাপ্টার কত দিন থেকে চলছে?’
‘আমি ঐ কু ত তার বাচ্চাকে চিনি না, বাবা।’

আসিফ এগিয়ে এসে ঠাস করে মিশুর গালে চড় লাগিয়ে রুমে চলে যায়। যাবার সময় বলে গেলো,
‘যেমন মা তেমন মেয়ে। বেয়াদবের বংশ পালছি বসিয়ে বসিয়ে।’

শানু আসিফের কাজে মর্মাহত। মিশু বড় হয়েছে। এত বড় মেয়ের গায়ে বারবার হাত তুলতে আসিফের বাঁধলো না। আলেয়া আক্তার এগিয়ে এসে শানুকে ঠেলে মিশুকে ধরতে গেলে মিশু দাদীর কাছে গেলো না। মায়ের কাছে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
‘আমি স্কুলে যাবো মা। বোরখা পরেই যাবো। শুধু, তোমরা বিশ্বাস করো, আমি ঐ ছেলেটাকে চিনি না, মা। কাউকে চিনি না। আমি খারাপ মেয়ে না মা। আমি কারো সাথে প্রেম করি না।’

শানু মেয়েকে আগলে নেয়। মিশুর জন্য এখন আশ্রয় দরকার। শানু আর কিছু পারুক আর না পারুক, মিশুর জন্য মহীরুহ হতে পারবে। আসিফের মাথা ঠান্ডা হলে তাকেও বুঝিয়ে বলতে হবে। মিশুকে রুমে নিয়ে যেতে যেতে শানু ভাবে, কি করলে আসিফ একটু শান্ত হবে।

রাজু কলেজ থেকে ফেরার পথে আনন্দের সমুচা আর বিস্কিট নিয়ে এসেছে। ডিবেট কম্পিটিশনে সে প্রথম হয়েছে। কমিশনার স্যার এসে ছিলেন। বিজয়ীদের নগদ অর্থ দেয়া হয়েছে। রাজু ক্রেস্টটা ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝোলাতে গিয়ে খেয়াল করে আগের ক্রেস্ট গুলোয় এক কণা ধুলো নেই। তার মানে, মা প্রতিদিন যত্ন করে এসব মুছে রাখে। রাজুর খেয়াল হয়, নতুন আরো ক্রেস্ট রাখার জন্য একটা তাক বানানো দরকার। মাকে বললেই হবে। মা কাঁচাবাজারের ফাঁকে, ঔষধ কেনার সময় ঠিক কাউকে দিয়ে তাক বানিয়ে বাসায় লাগিয়ে দেয়াবে। মা মানে এঞ্জেল। মা মানে সব কিছু সম্ভব। রাজুর ক্রেস্টের শেল্ফের পাশে আসিফের সাথে রাজুর একটা বড় ছবি টাঙানো৷ মেহমান আসলে আসিফ গর্ব করে তাদের ক্রেস্ট দেখায়, ‘আমার ছেলে অলরাউন্ডার। পড়ায়, লেখায়, তর্কে, খেলাধূলায় ফার্স্ট। ‘ মেহমানরা আগুন সেদ্ধ শানুর হাতের চপ কাটলেট খেয়ে ঢেঁকুর তুলে দুধচায়ে চুমুক বসায়, ‘আলবাত, আরে কার ছেলে দেখতে হবে না!’

রাজুর মনে পরে না, বাবা কখনো তাকে কোনো প্রাকটিসে নিয়ে গেছে। স্কুল কলেজের প্যারেন্টস মিটিং এ যাবার সময় ও বাবার হয়নি। মা এক হাতে রান্না সেরে ঘামঘাম শাড়িটা বদলে কোন মতে রাজুর হাত ধরে, মিশুকে কোলে চেপে হাজির হয়েছে অভিভাবক সভায়। সেখানে, অন্যান্য অভিভাবকদের কি সদর্প পদচারণ। শানু সবচেয়ে পেছনে কোনার দিকের সিটে কয়েকজন অভিভাবকের আড়ালে বসে সবার কথা শুনত। ক্লাস টিচার যখন ফার্স্ট বয়ের মাকে ডাকতেন, শানু লজ্জিত ভাবে হাসি হাসি মুখে ভাঙাচোরা হয়ে উঠতো। যেন, রাজু প্রথম হয়েছে এটা রাজুর কৃতিত্ব। শানু তার মা, এ বরং শানুর কাছে অবাক কান্ড। রাজু ছুটে গিয়ে মাকে সামনে টেনে আনতো৷ অন্যন্য অভিভাবকগণ নাক সিটকে থাকতেন। ঘামের গন্ধ নিয়ে শানু ডায়াসে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে দুই লাইন বক্তব্য দিয়ে শেষ। তারপর, হেড স্যারের ভাষণের সময় শানু খালি চোখ মুছতো। রাজু তার জন্যে এত বড় সম্মান নিয়ে আসে।

‘জিতেছিস?’ রাজু দেখে সোনালী ক্রেস্টের উজ্জ্বল অংশে শানুর মলিন অবয়বের ধূসর ছায়া পরেছে। দ্রুত মায়ের দিকে ফেরে সে।
‘কি হয়েছে, মা।’
‘তোর বাবা মিশুকে মেরেছে’।

রাজু বুঝতে পারে না, মিশুর মার খাবার কারন কি হতে পারে। পরীক্ষার ফলাফল মিশুর ভালো আছে। স্কুল থেকে মিশুর নামে কমপ্লেন আসে না।
‘মিশুকে কোন ছেলে কি বলেছে, তোর বাবা ভেবেছে মিশু প্রেম করে’।

রাজু ক্রেস্টে আঘাত করে বসায় হাতের অনেক খানি ছড়ে গেলো। শানু ‘হায় আল্লাহ’ বলে আঁচল দিয়ে হাত ধরেছে ছেলের।
‘তোর বাবা মাথা গরম করে। তুই ও করবি?’
‘মা, মিশুর স্কুল বদলে দাও। গার্লস স্কুল থেকে কো এজুকেশন ভালো হবে। সাথে ছেলেপেলে থাকলে বখাটে উৎপাত কম করে। আমি মিশুকে স্কুলে দিয়ে কলেজে যাবো। তুমি নিয়ে এসো। ‘
‘এখন ক্লাস নাইন শেষ হবে। স্কুল বদলানো মানে বুঝিস, রাজু?’
‘তুমি এত ভেবো না। মিশু পড়াশোনা সামলে নিবে।’
‘স্কুল মানে কি শুধু পড়াশোনা? ওর বন্ধু স্যার ম্যাডাম সবাই পরিচিত। হঠাৎ, স্কুল বদলালে মেয়েটার মনে কত চাপ পরতে পারে।’

রাজু শানুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার মা কত কিছু ভাবে, চিন্তা করে। বাবা কখনো এভাবে ভাবতে পেরেছে সন্তানদের নিয়ে? বাবাকে আইডল বলা হয়। সন্তানের কৃতিত্ব মানে বাবার কৃতিত্ব। সন্তানের সুনাম মানে বাবার সুনাম। আর সন্তানের দূর্নামের ভাগীদার কেবল মা। মায়ের কপালে যত দুঃখ জোটার জুটুক। বাবাদের ছোঁয়া যাবে না। বাবারা হয় আকাশসম, মায়েরা পাতালে বসে দুঃখ পাতা জুড়ে শীতলপাটি হয়ে থাকবে। দরকারে তাদের গায়ে জড়িয়ে কাজ করাও। দরকার ফুরোলে, ‘বোকা মহিলা’ বলে দূরে আঁছড়ে মারো। শানু রাজুর হাতে ক্রিম লাগাতে লাগাতে বললো,
‘মিশুকে তোর বাবা বোরখা পরতে বলেছে। ‘
‘একদম না মা। মিশুর ওপর এটা চাপিয়ে দিও না।’
‘ তুই এ নিয়ে কিছু বলিস না। দেখা যাবে, লোকটা ভাত না খেয়ে বাইরে চলে গেছে।’

মিশুকে দুগাল খাইয়ে কপালে চুমু দিয়ে শানু গায়ে চাদর টেনে পাশে বসে থাকে। মেয়ে ঘুমোক। বেঁচে থাকলে পড়াশোনা হবে। মিশুর ছোট মনের ওপর খুব চাপ পরেছে। শানু কি পারবে ঐ বাজে ছেলেকে খুঁজে বের করতে। কয় জনের সাথে লড়বে শানু। মেয়েকে নিজের ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখে বড় করতে হবে। দরকার লাগলে পাড়া বদলে ফেলবে। মিশু ঘুমিয়ে গেলে, শানু ওর বইপত্র গুছিয়ে রাখে। কি মনে করে বইয়ের পাতায় উল্টে পাল্টে দেখে। ধ্যাৎ, মিশু তো বললো, ও প্রেম করে না। শানু তাহলে মেয়ের খাতাপত্র দেখছে কেনো। বাতি নিভিয়ে দরজা ভিজিয়ে শানু চলে গেলে মিশু গা থেকে চাদর খুলে কাঁদতে থাকে। তারমানে, মাও বাবার কথা শুনে তাকে অবিশ্বাস করলো। নইলে, বইয়ের ভেতর মা ঘাঁটবে না। হয়তো, মা প্রেমপত্র খুঁজেছে। মিশু দুমড়ে মুচড়ে গুমরে মরে কাঁদে। একটা ষোল বছরের কিশোরী মেয়ের সমস্ত জীবনে এক নিমিষে কালো চাদর টেনে দিয়েছে তার পরিবার। সে যে একা, বড্ড একা। তাকে বিশ্বাস করার কেউ নেই।

আসিফ খাবার টেবিলে বসে দেখলো, শানু তার পছন্দের খিচুড়ি, গুর্দা ভুনা, গরুর মাংস রেঁধেছে। মিশু খেতে আসেনি। আলেয়া আক্তার বসে খাবার আগের ঔষধ খুলছিলেন। আসিফকে দেখে ঔষধ খেয়ে বললেন,

‘বউটা এত কিছুর পর কষ্ট করে রেঁধেছে। ওকে আবার গালি গালাজ করিস না। ‘
‘ আরো মাথায় তোলেন। আমার খাটনীর দাম জিরো।’
‘আমি তা বলছি নাকি’।
‘ আপনার দোকানের শেষ পর্যন্ত কি হলো।’
‘শানুকে নিয়ে যাবো। ওরা একজন উকিল আনবে। আমার পক্ষে তো কেউ নেই।’
‘নেই কোথায়। বেশী ঝামেলা হলে বলবেন, লোক পাঠিয়ে দেব।’
‘কাশিফকে বলেছি। বউমার ভাইয়ের বন্ধুর কথা বলেছে।’

আসিফ আয়েশ করে খিচুড়ি চেবায়। দুনিয়ায় যাই ঘটে যাক না কেনো, শানু রান্না করবে ফার্স্ট ক্লাস। মুখে প্রশংসা না করলেও তৃপ্তি নিয়ে খায় আসিফ। ছেলে মেয়ে কেউ আজ টেবিলে আসেনি। শানুকেও দেখা যাচ্ছে না। না থাকুক। মাঝে মাঝে ভয় পাওয়া ভালো। সংসার মানে পুরুষের দাম। রাজুর ঘাড় মোটা হওয়ার আগে নরম করতে হবে। বাইরের জগতে পা রাখতে চলা ছেলেকে সামলাতে আসিফ রাজুকে ডাকে।
‘বলো বাবা, পড়ছিলাম।’

রাজু অন্য সময় হলে চেয়ার টেনে বসতো। আজকে দাঁড়িয়ে রইলো। আসিফ ছেলের আপাদমস্তক দেখে আবার বলে,

‘বাসায় থাকো কি খেতে আর ঘুমাতে?’ তোমার মা -বোন কি কান্ড করে বেড়ায় খবর রাখো?’
‘রাখি বাবা। মিশুকে আমি স্কুলে দিয়ে আসবো।’
‘তারপর কলেজের প্রথম পিরিয়ড বাঙ্ক মেরে ঘুরতে যাবে, তাই তো। কলেজে উঠলে তোমাদের গলা বদলে যায়। কলার ওঠানো ঐ দিন আমরাও পার করেছি, বুঝলে। সব বুঝি।’

রাজু আসিফের কথা বিশ্বাস করতে পারে না। বাবা সব বুঝলে মিশুকে মারতো না। বোরখা পরতে জোর করতো না। মিশু একটা বাচ্চা মেয়ে। রাজু নিজের বোনকে ভালো করে চেনে৷ বাবার কোথাও ভুল হচ্ছে।

‘সমস্যা নেই বাবা। আর সেকেন্ড ইয়ার প্রায় শেষ। পরীক্ষার প্রস্ততি, প্রাকটিকাল নিয়ে সময় চলে যায়। ‘
‘তোমার মা কোথায়? খাওয়া শেষে আমি একটু মিষ্টি খাই, ও জানে। ‘

রাজু ফ্রিজ খুলে আসিফকে দই’র বাটি এগিয়ে দেয়। আসিফ দেখে চামুচটা সোনালী, অর্থাৎ, শানু বাটিতে দই বেড়ে ঠান্ডায় রেখে গেছে। রাজু তা জানে। মা-মেয়ে- ছেলে মিলে আসিফকে এড়িয়ে চলছে। চলুক, এই এড়িয়ে চলাটা ভয়ের অংশ। সামনে পরতে চায় না।

‘তোমার কক্সবাজার যাওয়ার পোকা নেমেছে?’

আসিফ দই মুখে দিয়ে আরাম পায়। শানুর হাতে জাদুর পরশ আছে। দইয়ের সাথে হালকা মিষ্টির আম মেশানো।

‘না বাবা। আমরা সামনের সপ্তাহে যাবো। আবহাওয়া খারাপ, তাই পেছালো।’
‘আমি তোমাকে যাওয়ার টাকা দিচ্ছি না।’

রাজু বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হবার ক্রেস্ট নিয়ে এসে আসিফকে দেখায়।

‘এখানে এক হাজার টাকা পেয়েছি৷ তোমার টাকা দেয়া লাগবে না, বাবা। আমার রোজগার দিয়ে যেতে চাই। তুমি মানা করলেও আমি এবার যাবো। বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে। সো, প্লিজ ডোন্ট সে নো। ‘

শেষের কথাটা খুব শক্ত করে উচ্চারণ করে রাজু চেয়ার টেনে বসে খাওয়া শুরু করে। বাবার সামনে থেকে সে চলে যাবে না। আজকে যেনো, মিশুর সাথে হওয়া ঘটনায় তার মন আরো বিগড়ে গেছে। এইযে পিঠ দেখিয়ে ঘটনা থেকে পালিয়ে না গিয়ে মুখোমুখি খেতে বসা, এটা একটা প্রতিবাদ।

আলেয়া আক্তার রাজুর মাথায় হাত বোলান। ছেলে বাপের সাথে বেয়াদবি করলে সংসারের ভারসাম্য নষ্ট হয়। আসিফের বাবা ঠিক আসিফের মতো ছিলেন। সে মানুষ হাজার ভুল বকলেও আলেয়া কখনো ছেলেদের বাপের মুখের ওপর জবাব দিতে দেননি। আসিফ রাজুকে আর প্রশ্ন করে না। রুমে ঢুকে টিভি ছেড়ে বসে। ফোনে কোন ম্যাসেজ আসলে আসিফ ফিরতি কল করতে বারান্দায় চলে আসে। সে খুব হাসছে, চুল ঠিক করছে। আসিফ বেশ সুখী মেজাজে আছে।

শানু বোলে করে ঈষদুষ্ণ গরম পানি নিয়ে রুমে ঢোকে। আসিফের পায়ে ব্যাথা করে। হালকা গরম পানিতে পা ভিজিয়ে রাখলে ব্যাথা কমে যায়। শানু তখন আসিফের পা পরিষ্কার করে। স্বামীকে বারান্দায় হাসতে দেখে শানুর বুকের পাথর নামে। যাক, মুড ঠিক হয়েছে। শানুকে বারান্দায় আসতে দেখে আসিফ দ্রুত ফোন কেটে দেয়।
‘গরম পানি এনেছি, পা ভেজাবে।’
‘জরুরী কলের মধ্যে আবার এসব কেনো।’
‘আসো, পানি ঠান্ডা হয়ে যাবে ‘।

আসিফ টের পায় শানু তাকে খুশী করার চেষ্টা করছে। শানু পানিতে আসিফের পা ডোবায়। নরম ব্রাশ দিয়ে নখের কোনা ধোয়। আরামে আসিফের চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

‘মিশুকে মাফ করে দাও। ছোট মানুষ। ভুল হয়ে গেছে।’
‘ভুল হয়েছে ভালো কথা। আর যেনো ভুল না হয় তাই বোরখা পরবে।’
‘ও মানতে পারছে না। কয়টা দিন পর পরুক। কলেজে উঠে পরবে। আমি কথা দিচ্ছি ‘।
‘তুমি নিজেই তো ঠিক না। রাজু একটা কুলাঙ্গার ছেলে হচ্ছে দিনকে দিন। আজকে আমাকে নিজের রোজগারের কথা শোনালো। ‘
‘ছি, ছি। এভাবে বলো না। বয়সের দোষ। দেখবে, ঠিক হয়ে যাবে। ‘
‘আম্মার দোকানের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলো। কাশিফের বউকে ঢুকতে দিও না এর মধ্যে। ‘
‘ও থাকলে তো ভালো। কাকে যেনো আম্মার হয়ে কথা বলতে দিবে।’

আসিফ বিছানায় শুয়ে পরলে, শানু স্বামীর পায়ে লোশন মাখিয়ে দেয়।
‘চাকরী বাকরী করা মহিলারা হয় বাজারের মেয়ে ছেলে। এদের না থাকে হায়া, না থাকে ইজ্জত। কাশিফ হলো বউয়ের গোলাম। বউয়ের টাকা খায়। তুমি আবার এসবে তাল দিও না। ‘

একটু পর আসিফ ঘুমিয়ে পরলে, নাক ডাকার আওয়াজ আসে। শানুর মন শান্ত হয়েছে। ঘরের ভেতর জমে ওঠা কালো মেঘ সে দূর করতে পেরেছে। পছন্দের খাবার, যত্ন পেয়ে আসিফ মিশুর ওপর বোরখা পরার চাপ হয়ত কয়েক দিনের জন্য তুলে নেবে। ততদিনে, মিশুকে রাজী করিয়ে নেবে শানু। তবে, কাশিফের বউকে নিয়ে আসিফের কথাগুলো শানুর ভালো লাগে না। আসিফের চোখে চাকরী করতে না পারা মেয়ে মানুষরা অথর্ব। ওদিকে ওর অফিসের মহিলা কলিগদের প্রশংসা আসিফ পঞ্চমুখে করে। ব্যাংকে গেলে মহিলা অফিসারদের সাথে হেসে কথা বলে আসিফ।

অথচ, আপন ভাইয়ের বউয়ের নামে আজেবাজে কথা বলে দিলো। শানু রান্নাঘর গোছায়৷ আলেয়া আক্তার তাকে খেয়ে নিতে বলেন। শানু খাবে না। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়েছে। শানু চুল আঁচড়ে খোলা চুলে বারান্দায় বসে। ঠান্ডা বাতাস বইছে, শানুর অন্তর জুড়িয়ে যায়। গুনগুন করে কেউ ওপর তলায় গান গাইছে, রেহানা ভাবী হয়তো। শানু দেখে আসিফের ফোনটা টি -টেবিলের ওপর রয়ে গেছে৷ শানু ঘুমোতে যাবার জন্যে ওঠে, সকালে আগে জেগে কাল থেকে রাজু -মিশুকে এক সাথে স্কুল কলেজের জন্যে বিদেয় করবে। এটা সেটা ভাবতে ভাবতে শানু টের পায় আসিফের ফোন ভাইব্রেট করে অপরিচিত নম্বর থেকে একটা মেসেজ এলো,

‘ আজকের সকালটা আমাদের কাটানো সময়ের ভেতর অন্যতম। বেশী অপেক্ষায় রেখো না, আবার কবে আসবে।’

শানু কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে পরে। দরজার ওপাশে আসিফ নিশ্চিন্তে সুখনিদ্রা যায়। শানু কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। আসিফের ফোন পাসওয়ার্ড দিয়ে আটকানো। বিছানায় পৌছে ফোন স্বামীর বালিশের নিচে রেখে দেয়। দু’হাতে বুক চেপে বিছানায় এক কাত হয়ে শুয়ে থাকে শানু। তার চোখ গড়িয়ে পরা জলকণারা মূল্যহীণ। জগতের কাছে ‘ক্ষুদ্র মহিলা’ রূপে পরিচিত শানুর অন্তর কাঁচের বাটির ন্যায় অজস্র টুকরোয় চৌচির। ক্রমাগত বিদ্রুপ সয়ে যাওয়া বোবা হৃদয়টির যেমন ফাটল দেখা যায়নি, তেমনি ভাঙনের শব্দ ও কেউ শুনতে পায় না।

(চলবে)