শানুর সংসার পর্ব-০৭

0
207

#শানুর_সংসার (৭)

শানু এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছিলো। মিশুর স্কুলের সামনে বেজায় ভীড়। রাজ্যের অভিভাবক জটা পাকিয়ে বসে আছে। শানু ওদিকে গেলো না। মিশুকে স্কুলে ঢুকিয়ে সে ফিরতি পথে রওয়ানা হলো। মেয়ে বোরখা পরেই যাবে বলে জেদ করেছে৷ বাবা তাকে বিশ্বাস করে না৷ শানু যখন বললো, মিশুকে সে বিশ্বাস করে। মিশু ঠিক অপরিচিত মুখ করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। শানু সইতে পারেনি। বোরখা বানিয়ে আনলে মিশু পরে যাবে, বলে মেয়েকে বুঝ দিয়েছে শানু। মিশুটা টিফিন বাক্স ফেলে এলে, শানু জোর করে হাতে বিশ টাকা গুঁজে দিয়েছে। মেয়েটা সারা পথ ভীত হয়ে চলেছে। ব্যাগটা পর্যন্ত শানুর হাতে দেয়নি। মাথা নিচু করে কুঁজো হয়ে চলছিলো মিশু। শানু ছিলো কখনো মেয়ের পেছনে, কখনো পাশে। এদিক ওদিক চেয়ে নিয়ে আবার মাথা হেঁট করে মিশু রাস্তা পার হয়েছে। শানুর পরশ লাগতে শঙ্কিত হয়ে পিছন ফিরে মাকে দেখে বোকার মতো হেসেছে। মেয়ের ঐ ফ্যাকাশে হাসি দেখে শানুর অন্তর কেঁপেছে খুব। মিশুটার আত্মসম্মান ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে ওর বাবা। স্কুলের কাছে গিয়ে মিশুর কপালে চুমু খেয়ে শানু বলে দিয়েছে, রাজু এলে তবেই যেনো মিশু গেট ছেড়ে বেরোয়। রাজু বোনকে নিয়ে ফিরবে, শানু ঐ সময়টা নিশ্চিন্ত।

কড়া রোদের আঁচ বাড়ে, পথচলায় গতি হয়ে আসে ধীর। আজকাল জৈষ্ঠ্যমাসে ভাদ্রের উত্তাপ পাওয়া যায়। গনগনে চুল্লী হয়ে ওঠা তাতানো মেজাজের মানুষেরা হুটহাট লেগে চলে একে অপরের সাথে। এসবের মাঝে শানু যেনো অনুপস্থিত। অন্য দিনকার শানুর সাথে তাকে ঠিক মেলানো যায় না। পরিচিত কুলফি ওয়ালা শানুকে ডাকে, শানু মিষ্টি হেসে তাদের কাছে যায় না। এমনকি, যে বুড়ো ভিখেরী, শানুকে দেখলেই কম্পিত স্বরে মৃদু হেসে, ‘মা’ বলে হাত পাতে, তার ঝুলি শূন্য রেখেই শানু হাঁটে। ভিখেরীর চোখ ভিজে যায়। মায়ের আজ মন খারাপ হয়তো। নয়তো, পয়সা দিয়ে মাথা পেতে ভিখেরীর দোয়া নিতে শানু ভোলে না।

আজ আসিফের কাপড় দেখে ধুতে দেয়া হয়নি। চলেতে চলতে শানুর মনে হলো, যে মানুষটার অধিকার সে হারিয়েছে, তার ফেলে রাখা দশ বিশ টাকার মতো শানু ও মূল্যহীন। আসিফ হয়ত প্রতিদিন ইচ্ছে করে পকেটে টাকা ঢুকিয়ে রেখে শানুকে বোকা বানায়। আঁচল জড়িয়ে শানু ফুটপাত ঘেষে হাঁটে। বাসায় চাল শেষ। মুদি দোকান থেকে বস্তা আনাতে হবে৷ শানু হিসেব কষে, পঁচিশ কেজির বস্তায় তার আড়াই মাস চলে যায়। সাথে শুক্রবার পোলাও হয়। পোলাওয়ের চাল চার শুক্রবারে দেড় কেজি। বাচ্চারা রাতেও পোলাও খায়। আচ্ছা, আসিফ যেখানে যায়, ওখানে পরিবারের সদস্য সংখ্যা কয়জন?

‘আপা, সাইড হন, মোটরের নিচে পরে যাবেন তো!’ পথচারীর ডাকে হুঁশ ফেরে শানুর। পেছনে ক্রমাগত হর্ণ বেজে চলেছে৷ শানু দেখে একটা মোটর সাইকেল তাকে সাইড হবার জন্য আওয়াজ দিচ্ছিলো। শানু’ সরি ভাই’ বলে ফুটপাতে উঠে পরে। আজ রিকশা নিতেও ইচ্ছে করছে না। শানু রোদে পুড়ে বাড়ি যাবে। হাতের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে শানু আস্তে আস্তে হাঁটে। রান্না কি হবে দুপুরে? আসিফ গতকাল কাঁকরোল এনেছে, বড় পাঙাস মাছ দিয়ে লম্বা করে কাটা কাঁকরোল আলুর পাতলা ঝোল, আমের ফলির টক, চিংড়ি মাছ ভর্তা। আসিফ যাবার সময় কড়কড়ে আলু ভাজি খাবে বলেছে৷ সেটা আসিফ খেতে বসলে ভাজতে হবে। নয়ত, আলু নেতিয়ে যাবে। শানুর জীবনটা আলু তরকারীর মতো। সব জায়গায় খাটে, আবার নুয়ে পরে আছে লতানো গুল্মের ন্যায়। হঠাৎ, পেছন থেকে কেউ জোরে শানুকে ডেকে ওঠে। চমকে গিয়ে শানু ইটের সাথে হোঁচট খায়।

‘থামো, একটু হলে মাথা ফাটাতে।’ শানুকে কেউ আঁকড়ে নিয়েছে বাহুডোরে। পুরুষের ছোঁয়ায় শানু আঁতকে ওঠে। পরপুরুষ তাকে এমন করে ডেকে আগলে নিলো কেনো। বেশ শক্ত একটা জবাব দিতে গিয়ে শানু দেখে, হেলমেট খুলে সামনে এক মধ্যবয়সী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে চাপ দাঁড়ি, পরনে সফেদ পায়জামা পাঞ্জাবি। টাখনুর ওপরে তোলা পায়জামা দেখে শানু আবারো অবাক হয়। আসিফ কোনদিন এখানে তুলে কাপড় পরে না।

‘কি, চিনতে পারছো না তো?’ পুরুষটি হাসে। শানির মনে হয়, তাকে বিদ্রুপ করা হচ্ছে। পুরুষটি হয়তো শানুর মনোভাব বুঝতে পারে৷ চশমা খুলে নিতে শানু এবার চমকে যায়। এত বছর পর বাবু এসে হাজির হলো, তাও ঠিক শানুর সমুখে, এভাবে!

‘কেমন আছো শানু?’ আরো সুন্দর হয়েছো। বর খুব ভালোবাসে না? তোমার ছেলে মেয়ে ক’জন। অনেক বড় চাকুরী করা বরের সাথে খুব ভালো আছো নিশ্চয়ই। ‘ বাবু সকৌতুকে প্রশ্ন করে। পুরনো প্রেয়সীর কাছ থেকে দশ মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছে সে৷ শানুকে, ‘চা খাবে’ বলতেই শানু রাজী হয়ে গেলো। ওরা বসে আছে স্কুলের বাহিরের ক্যান্টিনে। বেলা দশটা বেজে কুড়ি। শানুর এতক্ষণে বাড়ি পৌছে, আলেয়া আক্তারের সাথে চা খেতে খেতে ডিবিসি নিউজে দিনের খবর দেখে হালকা বাক্যালাপ করার কথা। চুলোয় চেপে যেতো গোটা করে কাটা পাঙাস মাছ। অন্য চুলোয় আগের বাসী তরকারী জ্বাল চলতো। বুয়া গতকাল বলেছে, বল সাবান শেষ। শানু নড়ে ওঠে। আজ সবান কিনতে হতো। কাপড় কাঁচা হবে না। গুড়ো সাবান থাকে আলমারির ওপর। বুয়াকে কঠিন করে আলোয়া আক্তার ধরতে নিষেধ করেছেন। কাপড় ধুতে হবে সাবান ঘষে। বড় চাদর- কভার ধুতে গেলে গরম পানিতে সাবান সেদ্ধ করে নামাতে হবে। শানু বারবার ঘড়ি দেখে। এখানে দু’কাপ চায়ের ফাঁকে একদা বহু পরিচিত পুরুষটির সাথে দেখা হবার মুহূর্তটিতে সে আনমনা। দুধের চাঁছি জ্বাল করছে কোথাও। একটা দুটো মাছি সেখানে বসে সামনের পায়ে করে নিয়ে এসেছে দানাদার সাদাটে পদার্থ। চায়ের পিরিচে বসে মাছিরা দ্রুত পা নাড়ে। তাদের চলনশীল পদযুগলের মতো শানুর মনে ভাসে নিত্যকার সংসার চিত্র।

শানু গরম চায়ের পেয়ালার মুখে নরম আঙুল বৃত্তাকারে ঘোরায়। এত প্রিয় কড়া জ্বালের হোটলের সর তোলা মিষ্টি স্বাদের ঘণ মালাই চা তীব্র তিতকুটে ঠেকছে। তার বাড়ি ফেরা দরকার, বাড়ি ফেরা জরুরী। শানুর ফিরতে ইচ্ছে করছে না।

(চলবে)