শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-১০+১১

0
347

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১০

প্রচণ্ড রকম ধুমধামে হলুদ হচ্ছে বাড়ির ছাদে। শিফা বহুদিন বাদে ভাই বোনদের সাথে কোন আনন্দে শামিল হয়েছে তাই হয়তো খেয়াল নেই আলতা আর শিউলির। শিউলি মিশে গেছে তার চেয়ে বড় আর সমবয়সী এ বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের সাথে। কিন্তু আলতা একা ছিলো। তার সমবয়সী কেউ নেই আর শিউলি নিষেধ করেছে তাদের সাথে সাথে যেন না থাকে। শিউলি অনেক আগে থেকেই আলতাকে সহ্য করতে পারে না তার রূপ সৌন্দর্যের জন্যই৷ ইদানীং আরো বেশি অসহ্য লাগে তার আলতাকে। ক’দিন আগেই একটা ছেলের সাথে কলেজে একটু ভাব হয়েছিলো তার । একদিন লাইব্রেরিতে দেখা করতে গিয়ে আলতার সাথে দেখা হয়। আলতা তো শিউলি আপা বলতে পাগল ছিলো দৌঁড়ে সামনে যায় তাদের। দু চার কথার পর বাড়িতে কাউকে বলে না দেয় সেই ভয়ে ছেলেটিকে বন্ধু বলে পরিচয় দেয় আলতার কাছে। সেই ছেলে এখন আর তার সাথে মিশছে না। বিভিন্ন বাহানায় তাকে এড়িয়ে চলে আর প্রায়ই আলতার স্কুলের সামনে যায়। এই থেকেই শিউলি তাকে চক্ষুশূল হিসেবেই দেখে। মনের ভেতর তাই নিয়েই সে কি চাপা রাগ শুধু শিশিরের ভয়ে সে আলতাকে কিছু বলতে পারে না। আলতা নেই চোখের সামনে অনেকটা সময় ধরে এ নিয়ে কারো চিন্তা নেই। যে মানুষটার চিন্তা হয় সে’ই নিজের ভুলের কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আলতা কোথায় তা নিয়ে মাথা ঘামানোর আপাতত কেউ নেই।

অন্ধকার ঘরে দু হাটু মুড়ে মেঝেতে বসে আছে আলতা। থরথর কর কাঁপছে পুরো শরীর সেই সাথে হিম শীতল হয়ে আছে তার গা। কিশোরী মন ভয়ংকর অথচ অন্যরকম অজানা এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে এইতো খানিক আগেই। কি ছিলো সেই অনুভূতি তা তার জানা বোঝার উর্ধ্বে। উষ্ণ স্পর্শ, পরিচিত জন আর অযাচিত মুহূর্ত! এইতো গত বছরেও সে তার স্কুলের বাংলা ম্যাডামের কাছে শুনেছে এই বয়সেই কত কত ব্যাপারে সাবধান থাকার কথা। সেই সাবধানতায় এমন কিছুর ইঙ্গিতও কি ছিলো! ভয়ার্ত মন হাজার রকম ভাবনা ভাবতে গিয়ে মনে হলো শিশির ভাই যা করলো তা অন্যায়, অনেক বড় খারাপ কাজ করেছে তার সাথে। কিন্তু…..

এরপর তার ভাবনা ফাঁকা। শুধু মনে পড়ে শিশির কিভাবে ঘরে ঢুকেই তাকে জড়িয়ে নিলো নিজের মাঝে! এই শিশির ভাই অন্য এক মানুষ। যাকে সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে, যেই শিশির ভাই তার মায়ের অতি আদুরে, যেই শিশির ভাই তার চোখে যমদূত সে এই শিশির ভাই নয়। কিশোরী আলতার ভেতর তুমুল এক ঝড় বয়ে গেল । চঞ্চল, দুরন্ত আলতা হঠাৎ থমকে গেল তার চঞ্চলতার বিসর্জন ঘটিয়ে। মধ্যরাত অব্ধি অনুষ্ঠান চলল তারপর যখন শিফা নিচে এলো তখন তার মনে পড়লো সে আলতাকে দেখেনি একবারও। চিন্তায় বুক ধড়ফড় করে উঠলো এবার। শিউলিও তার সাথেই নিচে নামছিলো শিফা তাকেই প্রশ্ন করলো, ‘আলতা কই শিউলি?’

‘দেখিনি কাকি।’

‘কি বলতেছিস! ওরে তো তোর সাথে থাকতে কইছিলাম।’

‘ছিলো না’ বলেই শিউলি চলে গেল ঘরের দিকে। যে ঘরে তাদের থাকতে দিয়েছে সে ঘরে ঢুকতেই শিউলি চিৎকার করে উঠলো। শিফা দৌঁড়ে আসছিলো চিৎকার শুনে তখন আবার তৌহিদও কোন কারণে সেদিকেই এসেছে।

‘কি হয়েছে ফুপু কে চিৎকার করলো?’

‘শিউলির গলা।’

শিফা কথাটা বলেই ঘরে ঢুকলো পেছন পেছন তৌহিদ। ঘরে ঢুকতেই শিফার মাথা যেন ঘুরে গেল। আলতা মেঝেতে পড়ে আছে তার গায়ের আঁচল ঠিক জায়গায় নেই। চোখের নিচে কাজল লেপ্টে গালেও দাগ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে চোখের পানিতে কাজল ধুয়েমুছে একাকার হয়েছিলো। শিফা দ্রুত মেঝেতে বসে আলতার কপাল, গাল ছুঁয়ে দেখলো। তাকে জোরে জোরে দুবার ডাকতেই আলতা জেগে গেল সাথে হিচকি যেন এখনই সে কান্না করছিলো। শিফা ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করছে একের পর এক তার কি হয়েছে, মেঝেতে কেন?
আলতা একদম থম মেরে বসে আছে। উৎকন্ঠা শিফার প্রশ্নগুলোর জবাব কি দিবে? কেন সে এখানে পড়েছিলো! আলতা মুখ খোলার আগেই তৌহিদ বিড়বিড় করলো, ‘ যা রোমান্টিক মুভি চালাইছে সন্ধ্যায় তাতে ক্লান্ত হয়েই মনে হয় বিছানায় যাওয়ার সময় পায় নাই। বয়সে তো এখনো পোনামাছ কিন্তু কাজে একদম ভরযৌবনা।’

তৌহিদের বিড়বিড়িয়ে বলা কথা তিনজনই শুনলো কিন্তু কেউ স্পষ্ট কিছু বুঝলো না। শিউলির একটু বোধহয় সন্দেহ হলো সে জানার জন্যই জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বললেন তৌহিদ ভাইয়া?’

‘কিছু না।’

তৌহিদ চলে গেল। শিফা আবারও প্রশ্ন করলো আলতাকে সে এখানে কিভাবে এলো, নিচে কেন শুয়েছিলো। আলতা বুঝতে পারলো না মামীকে কি বলবে। শিশির যা করলো তা কি মামীকে বলে দিবে? এতদিন তো তাই করেছে। মা, মামীরা বলতো কোন ছেলে গায়ে হাত দিলে বা তোর পাশ ঘেঁষতে চাইলে বা অন্যকিছু যাই হোক কখনো যেন তাদের তিনজনের কাছে না লুকায়। কিন্তু আলতার এই মুহুর্তে মনে হলো আজ যা হয়েছে তা মামীকে বলা যায় না। শিউলি আপাকেও না আর না নিজের মাকে। সে কাউকে বলবে না কিন্তু শিশির ভাই অমন করলো কেন! রাগে তো সবসময় থাপ্পড় মারতো অথবা চুলের বেণী টেনে ধরতো কিন্তু আজ যা করলো তা ভিন্ন। সে বেশি না হলেও মুভি, ড্রামা দেখেছে কিছু। কিছুদিন আগেও শিউলি আপার সাথে বসে বিদেশি মুভি দেখেছে। আর তাতে এমন কিছুও হয়েছিলো কিন্তু সেখানকার চরিত্র দুজন ছিলো একই ভার্সিটিতে পড়ুয়া বন্ধু। তাদের মধ্যে ছিলো বন্ধুত্ব যা পরে প্রেমে বদলে যায়। কিশোরী আলতা বেখেয়ালেই কিছু মিথ্যে বলে যায় মামীর কাছে। তার শরীর ভালো লাগছিলো না হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো। নিজেই নিজের ওপর আশ্চর্য বোধ করলো। শিফা নিশ্চিন্ত না হতে পেরে ভালো করে দেখলো আলতাকে। তার শাড়ি বদলিয়ে বিছানায় শুতে বলল। এরপর তার চুলে হাত বুলিয়ে ঘুমাতে সাহায্য করলো। ততক্ষণে শিউলিও নিজের শাড়ি বদলে মুখ হাত ধুয়ে এসেছে। শিফাকে মাঝে রেখে দুজন দুপাশে শুয়ে পড়লো। সারাদিন বিছানায় গা ঠেকায়নি বলেই হয়তো শিফার খুব দ্রুত চোখ লেগে এলো। তার ঘুমটা ভারী হওয়ার আগেই আবার সে জেগে গেল। শোয়া থেকে বসেই সে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো, ‘শিশির!’

নামটা শুনতেই আলতাও চমকে গেল। সে একটুও নড়লো না তবে তার মন চঞ্চল হলো। ভেতরটা কি একটু কেঁপে উঠলো? কে জানে!

শিফা আবার বিছানা ছাড়লো। সে তার ছোট ভাতিজার ঘরে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতেই শিশির এসে দরজা খুলল।

‘তুই ঘুমাইছিলি?’

‘ না আম্মা।’

‘ কই ছিলি সারাটাক্ষন? আমি একবারও দেখি নাই তোরে।’

‘এদিকেই ছিলাম আম্মা। রাত অনেক হইছে ঘুমাও তুমি।’ পুরো বাক্যটা শেষ করতে শিশির একবারও মায়ের দিকে তাকায়নি। শিফা খেয়াল করেনি হয়তো নইলে এই মধ্যরাতেই হাজারটা প্রশ্নে আরো সময় ব্যয় করতো। শিফা চলে যেতেই শিশিরও বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চারপাশে তাকিয়ে বুঝলো মহিলারা কেউ আপাতত ঘরের বাইরে নেই। ছাঁদে কেউ থাকলেও থাকতে পারে। এই মুহুর্তে তার একটু খোলা হাওয়া দরকার। বিশাল আকাশের নিচে বিস্তৃত খোলা কোন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিয়ে একটু ভাবতে ইচ্ছে করছে খুব। আজ সে যা করলো তা কেন করলো! একটু জানা দরকার কেন সে এত বড় একটা অঘটন ঘটালো? প্রতিদিন চড় থাপ্পড়ের মত কাজ ছিলো না সে যা করেছে তা কি পরিমাণ বড় অপরাধ নিজেও জানে না৷ ধীর পায়ে সে চলে গেল ছাঁদের দিকে। আজ যা ঘটলো যা করেছে এরপর সে আলতার মুখোমুখি হবে কি করে!

চারদিকে কিচিকিচি পাখির ডাক আর চোখের পাতায় আকাশের শুভ্র নীলের আলো খুব ভারী ঠেকলো শিশিরের। কাল রাত আর তার ঘুম হয়নি। রাতের শেষ দিকে চোখ আর খোলা রাখা গেল না বলে বিয়ের স্টেজটাতেই সে শুয়ে পড়েছিলো গুটিশুটি মেরে। ঘরে যাওয়ার একদমই ইচ্ছে না থাকায় এই স্টেজেই খোলা হাওয়ায় ভালো লাগছিলো তার। কিন্তু রাতের পর্দা সরতেই আকাশটা তার নিজস্ব রুপ রঙে চোখ ঝলসে দিচ্ছে৷ শিশির শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাত্র তো ঘন্টাখানিক ঘুমিয়েছে অথচ মনে হচ্ছে সে যেন অনেকদিন ধরে শয্যাশায়ী ছিলো। কাঁধ দুটো একদম ব্যাথায় বিবশ হয়ে গেছে। পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখলো চারটা পঞ্চাশ। বাড়ির পুরুষরা প্রায় সবাই জেগে আছে আর বেশিরভাগেই তাড়াহুড়ো করছে হলে যাওয়ার জন্য। সেখানে রান্না বান্নার কাজ চলছে তাই বাড়ির লোকেরা থেকে সব নজরদারি করা ভালো। শিশির ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দেখলো বাড়ির মেইন গেইট খোলা আছে। বড় মামা মাত্রই বেরিয়ে গেলেন সাথে জাহিদ ভাইকে নিয়ে। শিশির ঝটপট নিচে নেমে মুখ হাত ধুলো৷ মায়ের ঘরের এখনো দরজা বন্ধ তারমানে তারা এখনো জাগেনি। শিশির আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো এ বাড়ি থেকে৷ তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয় আলতার সম্মুখে আসা। ভারী এক চিন্তার পাহাড় বুকে চেপে সে চলে গেল কাউকে কিছু না বলে।

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১১

শুক্রবার দোকানে কাস্টমার অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশিই থাকে তাই শরত খুব ভোরেই দোকান খোলে। আজও তাই সে সকালে নাশতা না করেই বেরিয়েছিলো। বাজারে এসে পৌঁছুতেই দেখলো দোকানের সামনে এক বেঞ্চে বসে আছে শিশির। কাকডাকা ভোরে বিয়ে বাড়ি ছেড়ে সে গ্রামে চলে এসেছে দেখেই মনটা বিচলিত হলো তার। শিশির অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে তার দৃষ্টি অদূরে বাসরাস্তায়। শরত সামনে এসে আলতো করে কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠলো শিশির।

‘এত ভোরে তুই এখানে কেন?’

‘আমি.. হঠাৎ মনে পড়লো আমার কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। হলে যাওয়ার আগেই সেগুলো গোছাতে হবে। কলেজেও একটু কাজ ছিলো ভাইয়া।’

সূর্যের তেজ বাড়েনি এখনো। সবেই তো সকাল হলো। গাছে গাছে পাখিদের কলরব শুরু আর বাজারের প্রতিটা দোকানের ঝাপ খোলা হচ্ছে। শরত তার দোকান খুলতে খুলতে কিছুটা ভাবলো। বিয়ে বাড়িতে কোন ঝামেলা হতে পারে নয়তো কাকী আর শিউলিদের ছেড়ে শিশির চলে আসবে এ অসম্ভব। চুপচাপ থাকা শরতও জানে শিশিরটা স্বভাবে যতোই উগ্র হোক দ্বায়িত্বে সে যথেষ্ট সতর্ক। আরো ছোট থেকেই সে দ্বায়িত্ববান অনেকটা শরতের মতোই শুধু আচরণে দু’জন আগুন আর পানি। শরত আপাতত শিশিরকে ঘাটাতে চাইছে না তাই বলল, ‘ বাড়ি যা কাজ শেষ কর গিয়ে। কাকা মসজিদ থেকে ফিরে আর শোয়নি হয়তো দোকানে আসারই প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুই পারলে এখন কাকার সামনে পড়িস না নয়তো এত সকালে দেখে টেনশনে পড়বেন।’

শিশির বসা থেকে উঠে তাকায় ভাইয়ের দিকে। ভাইয়ের বিশেষ এই গুণটাই তাকে বরাবর মুগ্ধ করে। সব টের পাবে কিন্তু ঘাটাবে না৷ এই যে সে এত ভোরে চলে এসেছে তাতে যে কেউ বুঝবে কোন সমস্যা হয়েছে অথচ ভাই বুঝেও এড়িয়ে গেল এই প্রশ্ন করাটা। শিশির মুগ্ধ চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একশ টাকা হবে ভাই?’

শরত বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে শিশিরকে এগিয়ে দিলো। শিশির কোন কথা না বলে সোজা হেঁটে গেল বড় রাস্তা ধরে। কলেজ ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটতে থাকলো যতক্ষণ ইচ্ছে হলো৷ বেলা বাড়লে তবেই ফিরবে সে বাড়িতে আর মাকে ফোন করে বলবে জরুরি কাজে এসেছে। দুপুরে বাবা তো যাচ্ছেই বিয়েতে তাদের নিয়ে আসবে সাথে করে৷

আলতার সকালে ঘুম হালকা হতেই কানে এলো শিফার কন্ঠ। সে ফোনে কথা বলছে, ‘আমি কি শুনবো তুই শোন, আধঘন্টার মধ্যে ফিরবি বাবা। কি বাজে কথা তুই সকালে গেলি। তোর বড় মামী খুব কষ্ট পাবে।’

আলতার মনটা ভীষণ উদাস হলো। কাল কি হলো এটা আর কেনই’বা হলো! মনের অস্থিরতা তার বেড়েই চলল। সারাদিন শিফাও মনমরা রইলো ছেলেটা নেই বলে। আজই তার মন ভার হয়ে গেল শিশিরের ঢাকা যাওয়ার কথা মনে পড়তেই। আর মাত্র দুটো দিন তার পরই সে চলে যাবে দূর শহরে। শিফার আর মন রইলো না বিয়ে বাড়ি, ধুমধাম আর হট্টগোলে। কোনমতে দুপরটা কাটিয়ে আহসানুল্লাহর সাথে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরলো তিনজন। শিউলির কিছুতেই আসতে ইচ্ছে করছিলো না তবুও যেতে হবেই। সন্ধ্যে নাগাদ বাড়িতে ফিরে আলতা ঘরে ঢুকে কাপড় বদলে মায়ের পাশে বসলো। নকশি বসে বসে কিছু প্রশ্ন আলাদা করে খাতায় তুলছিলো। পরবর্তীতে এগুলো থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন সাজাবে সে। আলতা একদম গা ঘেঁষে বসায় নকশি একটু অবাক হলো। এই মেয়ে এই যে এত বড় হলো কখনো তাকে জোর না করে পাশে বসাতে পারতো না। রাতে ঘুমানোর সময় পর্যন্ত টেনে জড়িয়ে ধরতো নকশি আর ঘুমের মাঝেই মেয়েটা হাত ছাড়াতো। তবে সে গা ঘেঁষা হয় শুধু একজনেরই যদিও শুধু মাত্র নিজের প্রয়োজনে। যখনই তার কোন আবদার থাকে তখনই সে শিফার গা ঘেঁষবে, আহ্লাদে জড়িয়ে ধরবে আবার আদর করে পাশে শুতে চাইবে সেটাও অল্প সময়ের জন্য । মায়ের চেয়ে বেশি সখ্যতা তার শিফা মামীর সাথেই। নকশি হাতের কলম খাতার ওপর রেখে ফিরে তাকালো। মেয়ের মুখটা দেখতেই সে চমকে গেল। চোখ, মুখ কেমন অন্যরকম লাগছে মেয়েটার! না, কোথাও কোন আঁচর কিংবা দাগ নেই কিন্তু চঞ্চল মুখশ্রীর চঞ্চলতা গায়েব প্রায়। এমনটা আগে কখনোই সে খেয়াল করেনি। মনে মনে খুব ভয় পেয়ে গেল নকশি।

‘কিছু কি হয়েছে?’

মায়ের প্রশ্নে বিব্রত হলো আলতা। কি বলবে বা তার কি হয়েছে সে নিজেই জানে না। মনে যে কথা ঘুরপাক খাচ্ছে তা বলা দরকার আবার ভাবে কি বলবে! শিশির ভাই কাল যা করেছে তা লজ্জাজনক সেটা কি মাকে বলা যায়! দোটনায়, দ্বিধায় গিজগিজ করছে তার ছোট্ট মস্তিষ্ক সে আর মাকে বলল না কিছু। জড়িয়ে ধরে বসে রইলো কিছুক্ষণ নকশিও ছাড় দিলো। মনে তার সন্দেহ দানা বাঁধলেও তা আপাতত খুঁচিয়ে দেখা ঠিক হবে বলেই ধরে নিলো। শিশির আর আলতার দেখা হলো না সারাটাদিন। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই স্কুলের সময় হয়ে গেল। আলতা চলে গেল স্কুলে শিশর তখন ঘুমে। এভাবেই কাটলো আরও দু দিন অথচ একই বাড়িতে থেকে মুখোমুখি হলো না শিশির আলতা। খুবই সন্তর্পণে এই অদেখা ব্যপারটুকু শিশির নিজে সাজিয়েছে। সে নিজেই চাইছে না আলতা তার সামনে পরুক। হয়েছেও তাই কিন্তু সোমবার সকালে শিশির যখন তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি তখন আলতা নিজেই দৌঁড়ে গেল শিশিরের ঘরে। তার মনে হয়েছিলো শিশির ভাই যাওয়ার আগে তার কিছু কথা আছে বলার মত। শিশিরের ঘরে পা দিতেই সকল কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল বাষ্পের মত৷ একলা ঘরে শিশির আর সে মুখোমুখি হতেই তার মনে পড়লো সেই সন্ধ্যার কথা। আপনা থেকেই তার হাঁটু কাঁপতে লাগলো, হাত পায়ের তালু হিম হয়ে এলো ধীরে ধীরে। শিশিরেরও চোখের দৃষ্টি আলতা ছাড়া ঘরের সবখানেই বিচরণ করছে। দমবন্ধকর অথচ কোমল এক অনুভূতি আবারও স্রোতের মত বেয়ে গেল আলতার দেহ জুড়ে। সে ইতস্তত করতে করতেই আবার ফিরে যাচ্ছিলো তখনই শিশির ডাকলো, ‘আলতা শোন।’

আলতা ফিরে তাকালো। খুব মনযোগে শুনতে সে অপেক্ষা করলো কিন্তু শিশির শেষ পর্যন্ত কিছুই বলল না। ততক্ষণে শিফা এসে ঢুকলো ঘরের মধ্যে। হাতে তার এক বক্স নারকেলের নাড়ু। বক্সটা শিশিরের দিকে এগিয়ে দিতে দিতেই বলল, ‘এই যাওয়ার সময় আর বকিস না ওকে। এমনিতেই দু দিন ধরে পড়ায় খুব মনযোগী হইছে। ‘

‘ফুপুআম্মা কই?’ ভীরু গলায় প্রশ্ন করলো শিশির। আলতা চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জবাব না দিয়ে। শিফাই বলল, ‘এই সময় ওর প্রাইভেট পড়ায় তো হেনেই গেছে।’

‘ওহ!’ মন খারাপ হলো শিশিরের। ফুপুআম্মা জানে আজ সে ঢাকা যাবে তবুও এই সময়টা একটু অপেক্ষা করলো না? শিশিরের গোছগাছ শেষ । শরত আজ দোকানে যাবে অনেক পরে তাই সেই একটা অটোরিকশা ডেকে আনলো। শিশিরের বড় একটা কাপড়ের ব্যাগ আর তার কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে শরতই যাচ্ছিলো তাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিতে। হঠাৎ তড়িঘরি নকশি এসে হাজির হলো। শিফা ছেলেকে ধরে কাঁদছিলেন সাথে জয়তুনও। নকশি এসে শিশিরের কাঁধে হাত রাখতেই এবারও তারও কান্নার ঢল নামলো। শিউলিরও খারাপ লাগছে কিন্তু মন চাচ্ছে শিশির ভাই জলদিই যাক এতে তার অনেক সুবিধে আছে। আহসানুল্লাহ কিছু উপদেশ দিলেন ছেলেকে তারপরই সময় কম বলে তাড়া দিলেন অটোতে উঠতে৷ শিশির একপলক তাকিয়ে দেখলো সবাইকে। উঠোনে উপস্থিত আলতা ছাড়া বাকি সবাই আছে। একটিবার মন চাইলো আলতাকেও দেখতে কিন্তু তা আর হলো না। বাড়ি থেকে যেতে যেতে শিশিরের মন প্রমোদ গুণলো, ‘যতোটা দূরত্ব পথের বাড়ছে ততোটা যেন আপন মানুষ গুলোর সাথে না বাড়ে।’

স্কুলের সময় হতেই আলতা তৈরি হয়ে ব্যাগ কাধে বেরিয়ে পড়লো। আজ আর মামী তাকে জিজ্ঞেস করেনি খাবার খেয়েছে কিনা। মা বাড়িতেই আছে এখনো তবুও একটিবার বলেনি আমার সাথে যাস। মামাও আজ ডেকে জিজ্ঞেস করেনি স্কুলের পড়া সব শিখেছিস? শরত ভাই এমনিতেই চুপচাপ মানুষ তবুও প্রায়ই একটা আইসক্রিম কিনে দেওয়ার কথা বলে আজ আর বলার সুযোগ নেই। শরত ভাই গেছে আজ শিশির ভাইকে বাসে তুলে দিতে। আলতার মন খারাপ হলো ভীষণরকম কিন্তু সেই মন খারাপটা কিসের জন্য তা জানে না। স্কুলে পৌঁছে সে আজ চুপচাপ বসে রইলো পেছনের এক বেঞ্চে । আর তাকে দেখেই আজ তার বান্ধবী অতশী এসে বলল, ‘জানিস আলতা আজকে না আমি একটা জিনিস দেখছি।’

‘কি?’ নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর আলতার।

অতশী আবার বলল, ‘তোর যমদূত না আজ বাস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার পথে আমার অলি আপার কাছে গেছিলো। সাথে দুইটা গোলাপ ফুলও ছিলো। কি কি যেন কথা বলল তারপর একটু চিল্লাচিল্লি কইরা আপা ফুলগুলা ফিক্কা মারছে তোর যমদূতের ওপরে।’

শত মন খারাপের মাঝেও ভারী বিষ্ময় চেপে ধরলো আলতাকে। কি বলল অতশী? ‘তার অলি আপা আর শিশির ভাই!’

চলবে