শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-১২+১৩

0
357

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১২

ব্যস্ত শহরের যানজট ঠেলে বিকেলে এসে পৌঁছুলো শিশির তার নিজ গন্তব্যে। হলে উঠে নিজের রুম নম্বর আর চাবি নিয়ে রুমে ঢুকতেই ঝটকা খেল শিশির। তার ঘরের দরজা খোলা আর তার সঙ্গীর জায়গায় একসাথে তিনটে ছেলে। সে যতদূর জেনেছে তার রুম মেট সিনিয়র এক ভাই কিন্তু তিনজন একসাথে তাও আবার সিগারেট ফুঁকছে! ভারী আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো তাকে সতর্ক করা হয়েছে হলে সিগারেট, নেশাপানি করা কেউ টের পেলে তার বিচার ওপরতলা থেকে করা হবে। সে কখনো সিগারেট ছুঁয়ে দেখেনি তাই ভয়ও নেই কিন্তু রুমমেট এমন হলে তো বেশ বিপদ। তটস্থ হলো শিশির আর তাকে ব্যাগপত্র হাতে দেখে একটা ছেলে বলল, ‘কি চাই?’
সাথে সাথেই অন্য একজন বলল, ‘ও বোধহয় আমার নতুন রুমমেট ব্যাগপত্র সাথে দেখছিস না?’

শিশির বুঝলো দ্বিতীয় ব্যক্তিটি তার ঘরসঙ্গী। সে খুব বিনীতভাবে জবাব দিলো, ‘জ্বী আমি এই রুমে নতুন মেম্বার।’

‘আচ্ছা আচ্ছা আসো ঘরে। এটা আমার বিছানা ওই পাশেরটা তোমার।’

শিশির তাকিয়ে দেখলো তার বিছানা যেটাকে বলা হচ্ছে তাতে একটা তোশক জাতীয় কিছু আছে। একজন লম্বাটে হয়ে শুয়ে আছে সেটাতে আর তার চারপাশ সিগারেটের ছাই আর ফিল্টারে ভরা। ঘর জুড়েও রয়েছে উৎকট বিশ্রী গন্ধ। অস্বস্তি হলো তার ঘরে থাকতে কিন্তু কিছু করারও নেই। ব্যাগ দুটো কোথায় রাখবে ঠিক বুঝতে পারছে না। ছেলেগুলো একটুও নড়ছে না নিজের জায়গা থেকে। বাধ্য হয়েই সে বলল, ‘ভাইয়া একটু সরে বসলে ভালো হতো।’

কথাটা শেষ হতে না হতেই ধারালো দৃষ্টিতে তাকালো তৃতীয় ছেলেটি। শিশির ঠিক বুঝতে পারলো না তার ভুলটা। এভাবে তাকিয়ে কি বোঝাতে চাইছে! কিন্তু শিশির তো গ্রামের হাবাগোবা কোন শান্ত ছেলে নয় সে শুধু সময়পোযোগী ব্যবহার করছে ব্যস। বসা ছেলেটা সরছে না বলেই সে এবার গলা ঝেড়ে কাশলো।

‘ভাইয়া, আমার বিছানাটা খালি চাইছি ‘ শান্ত তবুও কঠিন শোনালো শিশিরের গলা। রুমমেট ছেলেটা বোধহয় একটু ঘাবড়ে গেল তাই ছেলেটা বাকি দুজনকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘চল একটু সংসদের দিকে যাবো কাজ আছে।’

শুয়ে থাকা ছেলেটা নড়লো না। বেশ শক্ত হয়েই শুয়ে রইলো যেন বিছানাটা এই মুহুর্তে ছাড়া তার জন্য অপমানজনক হয়ে যাবে। বসা ছেলেটা উঠে পড়েছে। শিশিরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল, ‘পরবর্তীতে গলার স্বর যেন নিচু থাকে নইলে,,,’

‘আরে ছাড় তো বাচ্চা ছেলে নতুন এসেছে।’ রুমমেট ছেলেটা টেনে বন্ধুকে সরিয়ে নিলো। শুয়ে থাকা ছেলেটাও কি মনে করে উঠে পড়লো। রুম ছেড়ে যেতে যেতে বলল, ‘সময় হোক সব রং দেখিয়ে দেবো।’

হোস্টেলে উঠতেই সময়টা খারাপ হয়ে গেল শিশিরের। নিয়ম কানুন যতটুকু জেনে এসেছে সে আর এদের যা আচরণ তাতে বুঝলো তার জানায় কিছু ফাঁক আছে। থাকতে থাকতে বাকিটুকুও জানা হয়ে যাবে।

সারাদিন ক্লাসে মূর্তির মত বসে রইলো আলতা। তার কারণ তার আজ একটুও ইচ্ছে করছিলো না ক্লাস ছেড়ে বের হতে। টিফিন টাইমেও নকশি তাকে খেতে বাড়ি যাবে বললে সে এড়িয়ে গেল। পেটে ব্যথা কিছু খাবে না আর হেটে বাড়ি গেলে ব্যথা বাড়বে। ভয় পেল নকশি মেয়ের তো এখন পিরিয়ড চলছে না। আবার মনে হলো গ্যাসে সমস্যা হচ্ছে নাতো! আলতাকে কয়েকরকম প্রশ্ন করে বুঝলো গ্যাসের নাও হতে পারে। তবুও ব্যথা নিয়ে আর বাড়ি যেয়ে কাজ নেই। সে স্কুলের পাশেই তো বাজার সেখান থেকে মুড়ি কিনে দিয়ে গেল। শুকনো মুড়ি কয়েকটা চিবিয়ে আবার ব্যাগে ভরে রাখলো আলতা। মোটেই খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না তার। কিন্তু এত খারাপ লাগা কিসে তাও তো জানে না। ক্লাসের মেয়েরা কয়েকজন টিফিন নিয়ে এসেছে তারা খাচ্ছে। আলতার করার কিছু নেই সে ব্যাগ থেকে বায়োলজি বইটা বের করে মেলে ধরলো। প্রথম পৃষ্ঠার নিচের পিঠে তার নাম লেখা আয়শা আহমেদ। কয়েকদিন আগেই রেজিস্ট্রেশন হয়েছে আর তখন শিশির ভাই তার জন্ম সনদসহ রেজিষ্ট্রেশন কার্ড সব ফরমেই আয়শা আহমেদ নামটা লিখে দিয়েছে। আগে তো স্কুলের কাগজে আয়শা আক্তার ছিলো হঠাৎ আহমেদ লেখায় সে মুখ ফুলিয়েছিলো খুব। শিশির বলেছে আয়শা আহমেদ নামটা মানায় বেশি। বইটা আবার বন্ধ করে দিলো আলতা। শিশির ভাই যাওয়ার সময় তার
কিছু বলে যায়নি কেন? অন্যসময় তো বকে, ধমকে শাসন করে তবেই বাড়ির বাইরে যায়। অথচ আজ কত কত দিনের জন্য গেল তার ঠিক নেই। সারাদিন ক্লাসে মন রইলো না আলতার। বয়সটা তার চৌদ্দ শেষ হবে হবে করছে। আর এইটুকু বয়সেই মনে এত উতলাভাব তাও কিনা সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে! কিশোরী বয়স নিয়ে সে একেবারে অজ্ঞ নয় তবুও সব বদলে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। শিশিরের প্রতি যেখানে তার রাগ আর ঘৃণা থাকার কথা সেখানে তার ভাবনা শূন্য। শিশির কে তাই যেন সে ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না। জন্মের পর থেকে দেখে আসা মানুষটাকে সে চিনছেই না যেন! ঘন্টা বাজলো; টিফিন আওয়ার শেষ হয়েছে। ছোট একটা অথচ আজ তিনদিন ধরে এত বেশি বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে যে আর ক্লাসে মন বসানো যাচ্ছে না। পেটে ব্যথার কথা বলে ক্লাসটাও করলো না। চোখ মুখও তার এমন যা দেখে স্যারও ভাবলো সত্যিই অসুস্থ তাই নকশিকে ডাকলো। নকশি এলেই আলতা বলল তার বসতে কষ্ট হচ্ছে৷ নকশি আর কিছুই বলার মত পেল না সে নিজেই স্কুলে ছুটি চেয়ে নিলো। মেয়েকে নিয়ে অটো করে বাড়ি যাওয়ার পথে ফার্মেসিতে গিয়ে ব্যথার জন্য ঔষধও নিলো। বাড়ি ফিরে আলতা কোনরকম কথা না বলেই শুয়ে পড়লো। বাড়িতে শিফা, জয়তুন দুজনেই একটু অস্থির হয়ে আলতাকে দেখলো৷ কারোই কিছু বোধগম্য হয়নি তবে জয়তুন বলল, ‘চিড়া ভিজাইয়া গুড় দিয়া খাওয়া পেট ঠান্ডা থাকবো বেদনাও কমবো।’

নকশি তাই করলো। চিঁড়া ভিজিয়ে আলতাকে খেতে দিলো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরায় সে রাতের রান্নাটা বসিয়ে দিলো। মাকে ঘর থেকে বের হতে দেখেই সে আবার শোয়া থেকে উঠে বসলো। সত্যিই কি পেটে ব্যথা তার! নিজেই বোকা হয়েছে সে নিজের আচরণে। চিঁড়া পড়ে রইলো, ঔষধও পড়ে আছে আলতা সেগুলো ছুঁয়েও দেখলো না। সন্ধ্যার আজান হতেই সে বইখাতা নিয়ে বসলো টেবিলে। নকশি রান্নার ফাঁকে ঘরে ঢুকে একবার বকাঝকা করে গেল কিছুই খেলো না বলে। আলতা তা কানেও তুলল না বরং সন্ধ্যার পর এক নাগাড়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত রইলো। ইংরেজি, বাংলা আর বায়োলজি বইটাতে হঠাৎ করেই যেন তার জরুরি পড়া আছে বলে মনে হলো। রাত যখন নয়টা পেরুলো তখন আর নকশির ভালো লাগলো না। সে আলতাকে টেনে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে তোর?’

‘কিছু না আম্মা।’

‘মিথ্যা বলিস না আলতা৷ সত্যিটা বল আমাকে তুই দু দিন ধরেই এমন চুপচাপ হয়ে আছিস। আমার কাছে কিছু লুকাস না মা বল।’ আকুতির স্বরে নকশি মেয়েকে বলছে। আলতাও মাকে জড়িয়ে ধরলো। ভেতরটা অস্থির হলো কিছু বলতেই পরক্ষণেই মনে হলো এ কথা মাকে বলা যায় না।
নকশি পারলো না আলতার মুখ থেকে কিছু বের করতে। পরেরদিন থেকে আলতার পরিবর্তন আরও বেশি হলো। ডাকার আগেই বিছানা ছাড়ে সে। স্কুলে যাওয়া, ফিরে আসা আর কোচিং এইটুকুতেই সীমাবদ্ধতা চোখে পড়লো তার। পাড়ার বাচ্চারা মারবেল, লাটিম কখনোবা রুটি খেলার জন্য ডাকতে এসে ফিরে যায়। আলতার সময় হয় না কোন খেলায় যোগ দেওয়ার। স্কুলেও এখন টিফিনের সময় গাছের ডালে ডালে পাখির খোঁজ লাগায় না সে। গুলতিটা তার আর কখনও ব্যবহৃত হয়নি। প্রথম প্রথম নকশির চিন্তা হচ্ছিলো খুব। আহসানুল্লাহ আর শিফাকেও নিজের মনের ভয় জানায় নকশি। শিফা বলল, ‘তুই এত চিন্তা করিস না আলতা আমার লগে সব কথা কয়। আমি বাইর করতাছি কি হইছে ওর।’

আহসানুল্লাহ বলল, ‘একটু চোখে চোখে রাখিস তো। পাড়ায় বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে কোন ঝামেলা করেছে কিনা। হতে পারে গন্ডগোল পাকিয়েই এখন আর কারো সাথে মিশছে না!’

আহসানুল্লাহর কথা শুনে শিফা হেসেছিলো খুব কিন্তু হাসির কারণ সে বলেনি। হাসি অবশ্য নকশিরও পেয়েছিলো। সে বুঝতে পারছে আহসান ভাই আলতাকে এখনো সেই ছোট্টটি ভেবে বসে আছে। মেয়েটা কৈশোরে পড়েছে, আবেগি বয়সের প্রথম ধাপে সে। নকশির মন বলল মেয়ের ঘটনা অন্যকিছু। তাতে চিন্তাটা কমছে না তার। কয়েকটাদিন আর জানা হলো না আলতার পরিবর্তনের কারণ। তারওপর শিশিরের সাথে একদিন কথা হলো ছেলেটা কেমন মনমরা হয়ে কথা বলছিলো। শিশির তার ভালোমন্দ মা’কে না বললেও ফুপুআম্মাকে সব বলতো। কিন্তু এবার তো ছেলেটা কিছুই বলল না। নকশির মনে হলো তার মাথার ভেতর অজস্র চিন্তা পেঁচিয়ে যাচ্ছে একত্রে। একদিকে নিজের মেয়েকে নিয়ে ভাবনা অন্যদিকে শিশিরটারও কিছু হয়েছে মনে হচ্ছে। নতুন শহর, নতুন পরিবেশ আর নতুন সব মানুষের ভীড়ে কোন ঝামেলায় পড়লো নাতো!

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১৩

‘শিশির আহমেদ, বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এর নতুন ছাত্র কোন রুমে থাকে বল তো?’

হলের নিচ তলায় দাঁড়িয়ে মন্টু নামের এক মাস্তান টাইপের ছেলে জিজ্ঞেস করলো শিশিরকেই। ছেলেটা শিশিরকে চিনে না বলেই তার কাছে তার খবর জানতে চাইছে। শিশিরও খুব স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘২০৪’ নম্বর রুম।

ছেলেটা আর কিছু না বলে সিঁড়ির দিকে গেল। শিশির ডেকে বলল, ‘এই যে ভাই কি হয়েছে কি করেছে ওই শিশির?’

‘তা জেনে তুই কি করবি?’ ছেলেটা বলেই চলে গেল। শিশিরের ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীনে দেখলো প্রভোস্ট স্যার কল করেছে। রিসিভ করতেই স্যার বলল দেখা করতে। বিকেলের রোদ পশ্চিমে হেলেছে রাস্তায় রাস্তায় জনমানবের কোলাহল। শিশিরের মন ভালো নেই আজ কতগুলো দিন হয়ে এলো। তার মনের বিষাদ আর বিষন্নতার খবর নিয়ে সে জেনেছে তার কারণ। ‘আলতা’ ছোট বেলায় তার সবচেয়ে অপ্রিয় বাচ্চাটাই আজ তার জীবনের বিষাদের সবচেয়ে বড় কারণ। সেই রাতে যা করেছিলো তা কেন করেছিলো তা শিশির এই বিগত এক মাসের দূরত্বে বুঝে গেছে। তৌহিদ ভাই আলতাকে নিজের করতে চাইছিলো এটাই তার মনকে বিক্ষিপ্ত করেছিলো। সে যে আলতাকে কতখানি ভালোবাসে তা সেদিন উপলব্ধি করতে না পারলেও আজ পারছে। তাকে হারানোর ভয়েই সেদিন এত বড় একটা অন্যায় করেছিলো সে। আলতার মত বাচ্চা একটা মেয়ে কি করে বুঝবে তার মনের এই বিধ্বস্ত আকাঙ্ক্ষার কথা। যেই আকাঙ্ক্ষায় শুধু আলতার অস্তিত্ব! হলে উঠে প্রথম দিনের সেই ছেলেগুলো শিশিরের পেছনে খুব ভালোভাবেই লেগেছিলো। সিনিয়র বলে কথা! তবুও তার সৌভাগ্য প্রভোস্ট স্যার মানুষটা খুবই ভালো আর সৎ। তাই শুরুর দিকেই সব খবর জেনেছিলেন৷ বলা যায় সুহৃদ হয়েই শিশিরের প্রতি আলাদা এক নজর রেখেছেন৷ আজও যেই ছেলেটা শিশিরকে খুঁজলো সেই ছেলেটা সিনিয়রদেরই পরিচিত তবে হলের কেউ নয়। শিশিরের পেছনে লাগতেই এসেছিলো কিন্তু কি করে যেন প্রভোস্ট স্যার পর্যন্ত খবরটা চাউর হয়ে গেছে। তাই স্যার কল করে তাকে ডেকেছিলেন। সাথে ওই ছেলেটাকেও আর এখন স্যার তাদের একসাথে বসিয়ে কথা বলে তবেই ছেড়েছেন। প্রভোস্ট স্যারের কাছ থেকে বেরিয়েই শিশির হলে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলো আলতার কথা। সূর্য ডুবছে সাথে ডুবে যাচ্ছে ধরনীর আলোর মেলা৷ একটু পরই শহরের রাস্তায় জ্বলবে নিয়নবাতি আর জ্বলবে সদ্য কৈশোর পেরোনো শিশিরের বুকের ভেতরটা। আজকাল খুব কষ্ট হয় তার একটা মুখ না দেখতে পারায়। ভিডিও কল সে প্রতিদিনই দেয় মাকে আর তাতে ফুপুআম্মা, শিউলি আর জেঠিমাও থাকে। শুধু থাকে না তার শাসনে সর্বদা তাকে মনে মনে গালি দেওয়া ছটফটে পাখিটা। শিশিরও কেন জানি মুখ ফুটে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারে না আলতার কথা। কি যেন ভয় নাকি লজ্জা না সংকোচ কিছু একটা খুব করে জড়িয়ে ধরে তাকে। বাড়ি থেকে আসার দিনটাতেও সে চোখ মেলে ঠিকঠাক দেখতে পারেনি আলতাকে। আর এখন চাইলেও দেখার সুযোগ নেই। আনমনে হাটতে হাটতে কখন যে হলের রাস্তা বদলে সে ফুটপাত ধরে এগিয়ে এসেছে খেয়াল নেই। যখন খেয়াল হলো তখন মনে পড়লো স্যার তাকে একটা টিউশনির কথা জানিয়েছিলো। ক্লাস নাইনের একটা মেয়েকে পড়াতে হবে। ফোনের ওয়ালে তারিখ দেখলো। নাহ, আজ নয় কালকে থেকে যেতে হবে। সন্ধ্যে গড়াচ্ছে আর মনপাখিটাও বড্ড অস্থির হচ্ছে। শিশির আবার হাটলো হলের দিকে। রুমে ঢুকে বই নিয়ে বসে পড়বে। এতেই মন কিছুটা শান্ত হবে তার। এক মাস ধরে এভাবেই চলছে তার নতুন সময়।

‘ভাবী, আমার আর ভালো লাগছে না কিছু। আলতার এত পরিবর্তন এখন ভয়ের কারণ হয়ে গেছে।’

‘তুই বেশি বেশি ভাবোস নকশি। আলতা ঠিক আছে আর এখন হয়তো বুঝছে বড় হইছে। তাই বাড়ির বাইরে খেলতে যায় না আবার পড়াশোনাও তো এখন অনেক তাই সময় পায় না।’

শিফা আশ্বস্ত করতে চাইলো নকশিকে। কিন্তু নকশির মন কিছুতেই মানছে না। তার মনে হচ্ছে আলতা কোনরকম একটা কিছুতে চরম বিষ্ময়ে আছে। এটা তার বয়সের পরিবর্তন নয়। হঠাৎ পরিবর্তন আর বয়সের পরিবর্তন দুটো দু’রকম। শিফার সাথে কথা বলেও সে শান্তি পাচ্ছে না নকশি তা যেন শিফা বুঝলো। আর তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো আজ কথার ছলেই জানবে কি হয়েছে তার। শিফা নিজেও বোঝে আলতার পরিবর্তনের পেছনে বড় কোন ব্যপার আছে কিন্তু নকশি তার মা চিন্তায় খারাপ কিছু না হয় তাই সান্ত্বনা দিতে সবটা স্বাভাবিক বলছে। নকশি বিকেলে একটা টিউশনি করে আজও সেখানে যেতে প্রস্তুত হচ্ছিলো। আলতা স্কুল থেকে এসেই খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়েছে সবে। শিফা নিজের ঘরের বারান্দায় বসে নজর রাখছে নকশি কখন বেরিয়ে যায়। কয়েকমিনিটের মধ্যেই নকশি বেরিয়ে গেলে শিফা ঢোকে নকশির ঘরে। বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা আলতার পাশে বসে মাথায় হাত বুলায়। কয়েক সেকেন্ড এর স্পর্শেই আলতা চোখ মেলে তাকায়।

‘মামী!’

‘হু, আমি। এদিকে আয়।’ শিফা তার পা দুটো বিছানায় তুলে আলতাকে ইশারা করলো কোলে মাথা রাখতে। আলতাও আদুরে বিড়ালের মত তাি করলো৷ শিফা তার মাথায় আঙ্গুল চালিয়ে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলো, ‘শরীরটা কি ভালো না?’

‘ভালো তো।’

‘তাহলে কি তো মনটা খারাপ।’

‘নাতো মামী।’

‘মিথ্যা কবে থাইক্যা বলিস তুই?’

‘মিথ্যা বলছি না তো।’

আলতা একটু জোর গলাতেই বলল। শিফা বিশ্বাস করলো না। সে আবারও বলল, ‘তুই আমার কাছে লুকাবি? তোর তো নাড়ীর খবর তোর মায়ের চেয়ে বেশি আমি ভালা জানি।’

‘মিথ্যা বলি নাই সত্যি।’

‘ আরো একটা সত্যি বল তাইলে।’

‘কি?’

‘আমার বাপের বাড়িতে গিয়ে হলুদের দিন কি ঘটছিলো।’

শিফার প্রশ্নে আলতার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। মামী কি কিছু বুঝতে পেরেছে!

‘কিছুই ঘটে নাই?’

‘নাতো।’

‘কিছু না হইলেই শিশির তোর লগে কথা কয় না আর তুই শিশিরে না থাকার পরেও তার নামে কুছু বলিস না এটা আমার বিশ্বাস করতে হইবো?’

আলতার এবার আর বোধগম্য হচ্ছে না কি বলা উচিত। মামিকে কিছু দেখেছিলো সে রাতে! শিফার দৃষ্টি আলতার দ্বিধাগ্রস্ত মুখেই টিকে রইলো। সে আবারও বলল, ‘আজ একটা মাস গেল আমার যে ছেলে তোর সারাদিনের সব খবর নিয়া তোরে শাসন বারণে কঞ্চির ডগায় রাখতো সে এতদিনে একটাবার জিগায় নাই আলতা পড়াশোনা ঠিকমত করে কিনা, বাড়ির বাইরে এখনো খেলে কিনা! আর তুই’

শিফা থেমে গেল আলতার মুখ দেখে। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে ভাব হয়ে গেছে। শিফার সন্দেহ এবার সত্যি বলে মনে হলো। যা ঘটেছে বা যা হচ্ছে সবটা শিশিরের কারণেই। আলতা বদলেছে তার পেছনে বড় কারণ শিশির। মায়ের মন অনেক না বলা কথাই বোঝে তারওপর এই মেয়েটা বলতে গেলে শিফার হাতেই মানুষ হয়েছে। শিফা আর সময় না নিয়েই আলতাকে টেনে বসালো।
‘আমাকে সত্যিটা বল মা। তোর মুখ, চোখ কিছু লুকাইতে চায় তা স্পষ্ট টের পাই আমি। আমার ভাতিজির হলুদের রাত থাইক্যা তোর পরিবর্তন, সেদিন হঠাৎ কইরাই তুই চোখের আড়াল হইলি শিশির হইলো। তারপরে তোরা দুইজনই কেমন জানি আগলা হইয়া গেছিস। শিশির একবারও জিগায় না তোর কথা আর তুই যে কিনা শিশির বাড়ি না থাকলেই তারে গালমন্দ করার সাহস দেখাইতি সেই তুই একটা টু শব্দ করোস নাই।’

আলতা নড়েচড়ে বসলো যেন।

‘না মামি কিছু হয় নাই।’ নিরাসক্ত গলা শোনালো আলতার। শিফা বুঝলো নরম স্বরে আর হবে না। নকশি তাকে খুব করে অনুরোধ করেছে আলতার সাথে কথা বলে জানতে কি হয়েছে তার। নকশির কারণেই শিফার মনেও একটু জোর এসেছে। তার শুরু থেকেই একটু সন্দেহ হলেও সে জোর করার মত যুক্তি পাচ্ছিলো না। আজ যখন প্রতিটা কথাতেই আলতার চোখ মুখের রং বদলাচ্ছে তখন সে নিশ্চিত শিশির আর আলতার মধ্যেই বড়রকম কোন ঝামেলা ঘটেছে। তাই আর নরম নয় একটু গরমও হওয়ার চেষ্টা করলো। আলতার হাত তখনও শিফার মুঠিতে সে হাতজোড়া ধরে রেখেই বলল, ‘আর শুনতে চাই না তোর মিথ্যা। দুইজনে কি করছিস তা জানতে চাই। কোন মিথ্যা কইবি না আলতা সত্যিটা বল।’

আলতা ভয় পেলো না মামিকে কিন্তু মন মগজে একটা হালকা তরঙ্গ ছিল যা তাকে ধাতস্থ করলো সবটা বলতে। লজ্জা আর খারাপ লাগা থাকলেও সে বলল, ‘সেইদিন শিশির ভাই ঘরে ঢুকেই আমাকে জড়িয়ে ধরছে চুমা খাই….’

পুরো কথাটা শেষ হওয়ার আগোই শিফা হাত চেপে দিলো আলতার মুখে। কথা বলতে বলতেই আলতার গা শিউরে উঠেছিলো। শিফা থমকে গেছে ; নির্বাক সে। মনের ভয় তার যা ছিলো তা নয় ব্যাপারটা নাকি তার চেয়ে বেশি! সত্যি বলতে সেদিন শিশিরের আলতাকে খোঁজা সন্দেহজনক ছিলো না কিন্তু হঠাৎ শিশিরের অনুষ্ঠানে না থাকা, আলতার মেঝেতে পড়ে থাকা আর পরেরদিন ভোরের আগেই শিশির কাউকে না বলে চলে আসা তার কাছে একটু কেমন কেমন লেগেছিলো। তাই বলে ঘটনা এতদূরের হবে বুঝতে পারেনি। কিশোরী আলতা যে সেদিনের ঘটনায় কিছুটা আতঙ্কিত তা বোঝা যাচ্ছে না। আবার মনে হচ্ছে আলতাই হয়তো সবটা বলছে না। হতে পারে দুজন দুজনকে ভালোবাসে শিশির দূরে যাচ্ছে বলে মান অভিমানে কথা বলা বন্ধ করেছে! শিফার এলোমেলো লাগছে খুব। ওদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা কখনো হতে পারে এ অসম্ভব ধারণা নয়। তার আরো আগে থেকেই মনে হতো এই দুটো ছোট থেকে সাপে নিউলে ছিলো বড় হলে নিশ্চয়ই আমে দুধে মিলে একাকার হবে। কিন্তু এ কেমন মিলমিশ! তার মনে হলো আলতাকে একবার জিজ্ঞেস করে শিশির তাকে প্রেম ভালোবাসার কথা বলেছে কিনা! কিন্তু এখন জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না ভেবে চুপ রইলো।

চলবে