শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-৪+৫

0
439

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-৪

কুয়াশার চাদর সূর্যের আলোয় পাতলা আর মিহি হতে শুরু করেছে। চারপাশে পাখির কোলাহল বাড়ছে একটু একটু করে। নকশি ভাতের মাড় গালতে পাতিল উপুড় করতেই মনে পড়লো আয়শাকে সে লেপটা ঠিকঠাক দিয়েছিলো তো! কাটাকুটি তার শেষ এখন একবার আয়শাকে দেখে আসা দরকার। আজ শিফা ভাবী এখনো ঘর থেকে বের হয়নি নইলে ভাবীই একটু খেয়াল রাখতো ততক্ষণে সে রান্নাটা সারতো। তরকারি ধুয়ে একপাশে রেখে উনুনের মুখের জ্বলন্ত লাকড়িটা বের করে রাখলো। বড় বড় পা ফেলে ঘরে ঢুকলো আয়শাকে দেখতে আর আজও বুকটা ধক করে উঠলো। বিছানায় আয়শা নেই আর না ঘরটাতে কেউ আছে। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে আকস্মিক আর্তনাদ করে উঠলো। শরতের মা নিজের ঘরের পেছনে ছিলেন হাঁস মুরগি ছোট্ট ঘরটি থেকে ছাড়ছিলেন বলে। তিনিই প্রথম শুনলেন নকশির কান্না। হাতে থাকা মুরগির খাবারের বাটিটা ফেলেই দৌড়ে এলেন। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর পেলেন না৷ কিন্তু বিছানায় আয়শাকে না দেখে বুঝতে বাকি নেই কি হয়েছে। ঘর থেকে বের হয়ে শিফাকে ডাকলেন। আহসানুল্লাহ বাড়ি নেই তিনি ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে দোকানে যান। শিফা মাত্রই রান্নার ব্যবস্থা করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলো। জা’য়ের ডাক আর নকশির কান্না শুনে ভীত হলো সে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জয়তুন বেগম বললেন, ‘তোমার শিশির কই?’

‘কি হইছে ভাবী?’

‘আয়শা নাই বিছানায়। শিশিররে ডাকো ওর কাছেই হইবো।’

শিফা আতঙ্কিত হলো শুনে। কাল রাতেও সে কত করে বোঝালো ছেলেটাকে। কিন্তু কিছুই বুঝলো না। ছয় বছর বয়সী একটা বাচ্চা কি এতোটাই অবুঝ হয়! বুঝে আসে না শিফার তার ভয় হচ্ছে ছেলেটা আবার আঘাত না করে বসে বাচ্চাটাকে। সে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে জোরে ডাকলো, ‘শিশির!’

পরপর কয়েকবার ডাকতেই শিশির কাঁপা স্বরে জবাব দিলো। নকশির ঘরের পেছন থেকে আওয়াজটা শোনা যেতেই তিনজনে দৌঁড়ে ঘরের পিছনে গেল। বিপদ! সত্যিই বিপদ ঘটিয়েছে ছেলেটা। ছোট্ট আয়শাকে আলতায় লাল করে ঘাসের ওপর ফেলে রেখেছে। গা কাঁপানো শীতে এইটুকুনি বাচ্চাকে এভাবে ফেলে রেখেছে দেখতেই জাপটে কোলে তুলে নিলো নকশি। শিফা ভীত চোখে চেয়ে আছে আয়শার দিকে৷ বাচ্চাটা কাঁপছে থরথর করে কিন্তু মুখে কান্নার ভাব নেই একটুও। বুকের মাঝে চেপে ধরে নকশি তাকে আঁচলে পেঁচিয়ে নিলো। কোন কথা না বলে চলে গেল ঘরের দিকে। নকশি যেতেই শরতের মা শিশিরের দিকে চেয়ে একটা ধমক দিয়েই চলে গেলেন নকশির কাছে৷ দেখা দরকার বাচ্চাটার কি অবস্থা। তারা যেতেই শিশির ভয়ে ভয়ে তাকালো মায়ের দিকে৷ যে চোখে সে কখনো রাগী ভাব দেখেনি সে চোখেই আজ ক্রোধের আগুন ঝরে পড়ছে। ভয়ে কাটা দিয়ে উঠলো তার সারা শরীর। সে আমতা আমতা করে মাকে বলতে লাগলো, ‘আমি ওরে কিছু করি নাই।’

মুখের কথাটা শেষ হতেই শিফা এক হাতে ছেলের বাজু ধরে অন্য হাতে চড় থাপ্পড় লাগাতে শুরু করলেন৷ তার থাপ্পড়ের চোটে হাউমাউ করে কাঁদছে শিশির। আহসানুল্লাহ মাত্রই বাড়ি ফিরেছিলো। ছেলের কান্না শুনে ঘরে ঢুকলেন কিন্তু সেখানে কেউ নেই। ঘর থেকে বের হতেই দেখলেন নকশি দৌড়ে ঘরের পিছে যাচ্ছে। তাকে অনুসরণ করে সেদিকে এগোতেই দেখলো শিফা ইচ্ছেমত মারছে শিশিরকে আর নকশি আড়াল করতে চাইছে ছেলেটাকে। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ কোন কথা মুখে আসলো না আহসানুল্লাহর। তারপরই স্ত্রীকে ধমকে উঠলেন এভাবে ছেলেকে আঘাত করার জন্য। এগিয়ে গিয়ে শিশিরকে টেনে কোলে তুলে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। শিশিরের শ্যামবর্ণ গালে হালকা লালচে আভা আর আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবার বুকে মাথা রাখতেই আহসানুল্লাহ বললেন, ‘থামো বাবা। কি হইছে আম্মা তোমাকে মারলো কি জন্য?’

শিফা রাগের চেয়ে ভয়টাই বেশি পেয়েছিল। শিশিরের ভুলে যদি বাচ্চাটার কিছু হয়ে যেত! তখন কি হতো? নকশিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলেন আর আজ নতুন করে তারাই তার ক্ষতির কারণ হয়ে যেত। ভাবতেই তো গায়ে কাঁটা দেয়। নকশি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে ধীরে হাত রাখলো শিফার কাঁধে। হঠাৎ কাঁধে হাত পেয়ে চমকে উঠে শিফা।

‘ঘরে যান ভাবী। শিশিরটারে এমন কইরা মারা ঠিক হয় নাই।ও তো ছোট মানুষ কষ্ট পাইয়া এমন করছে। আমারাও তো ভুল করছি ওরে একটুখানি আদর করলেই ও বুঝতো।’

করুণ গলায় কথাটা বলছিলো নকশি। তার চোখে পানি ছলছল করছে কাঁদছে শিফাও।

‘তুমি ঘরে যাও নকশি। আয়শারে একটু ভালো কইরা তেল মালিশ কইরা বুকে নিয়া লেপ মুড়ি দিয়া শোও। শরীর গরম রাখা দরকার তার নইলে ঠান্ডার সমস্যা হইবো।’

কথাটা বলেই শিফাও চলে গেল নিজের ঘরে। আহসানুল্লাহ বিছানায় বসে ছেলেকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে আছে। আর শিশিরও হিচকি তুলে কাঁদছে, বারবার বলছে, ‘আমি আলতারে মারি নাই একটুও৷ শুধু ফালাইয়া রাখছি বাইরে যেন তারে না পাইয়া আম্মা আর ফুপু আম্মায় আমারে আদর করে।’

‘আলতা কে!’
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন আহসানুল্লাহ। শিশির বুঝলো না বাবা কি বলল। সে যে কান্নার ঘোরে আয়শাকে আলতা বলছে তা সে বোঝেইনি। কিন্তু আহসানুল্লাহ খেয়াল করলো শিশিরের হাত-মুখ সব আলতায় লাল হয়ে আছে। বুঝলেন, ছেলে হয়তো কাঁদতে কাঁদতে ভুল বলছে। সে অতি আদুরে গলায় তাকে অনেক কথা বলে বোঝাচ্ছেন। শিশিরের কান্না থামতেই বললেন, ‘চলো আব্বা আমরা আজ হোটেলে নাশতা করে স্কুলে যাবো। তুমি দাঁত মেজেছো?’

শিশির মাথা নাড়লো ‘না’। আহসানুল্লাহ আবার ছেলেকে কোলে তুলে নিলেন কলপাড়ে যাবেন বলে। দরজায় দাঁড়ানো শিফাকে দেখতেই ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়েই তাকে এড়িয়ে ঘর ছেড়ে বের হলেন। বাড়িতে এখন থমথমে ভাব। নকশি ঘরে বসে আয়শার গা, হাত পা মুছিয়ে ভালো করে গা ঢাকলো। মেয়েটার পুরো শরীর হিম হয়ে আছে। ভয় হচ্ছে এত ছোট বাচ্চা আর তীব্র শীতে শিশিরে ভেজা ঘাসে ভিজেছে। জ্বর, নিউমোনিয়া না হয়ে যায়!

আহসানুল্লাহ ছেলের মুখ ধুইয়ে নিয়ে এলেন নকশির ঘরে। তাকে দেখতেই নকশি বসা থেকে উঠতে যাচ্ছিলো। তিনি বললেন, বসো উঠতে হবে না।

নকশি বসে রইলো। আহসানুল্লাহ চৌকির সামনে এসে আয়শার মাথায় হাত বুলিয়ে শিশিরকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার বোনকে ভালো লাগে না আব্বা!’

শিশির কাঁচুমাচু মুখ করে চেয়ে আছে বাবার দিকে৷ আহসানুল্লাহ খুবই শান্ত স্বরে পুনরায় প্রশ্ন করলে শিশির জবাব দিলো, ‘আব্বা আলতা অনেক ফর্সা দেখেই আম্মা তারে বেশি কোলে নেয়, ফুপুআম্মাও।’

নকশি জড়িয়ে ধরলো শিশিরকে। তার মায়া হলো খুব শিশিরের জন্য । এ বাড়িতে আসার ঠিক কয়েকদিন পর থেকেই বাড়ির তিনটি বাচ্চাই তার খুব কাছের হয়ে গিয়েছিলো। বিশেষ করে শিশির পড়াশোনার ফাঁকে বেশিরভাগটা সময় গা ঘেঁষে থাকতো। কতগুলো মাস একসাথে কাটিয়ে বাচ্চাটা তার ন্যাওটা হয়ে গেছে। খারাপ লাগলো তার তাই জড়িয়ে ধরে চুমো খেলো শিশিরকে। সে বলল, ‘এমন আর হইবো না বাবা। আদর তো আমি তোমারেই বেশি করি।’ আহসানুল্লাহ শীতল স্বরে কাছে ডাকলো শিশিরকে। তাকে বিছানায় তুলে বলল এই বাবুটাকে একটু আদর করো তো বাবা। শিশির আলতো হাতে আয়শার গাল ছুঁয়ে বলল, ‘ও খুব তুলতুলে আব্বা।’

‘হ্যাঁ ও তো খুব ছোট আর তুলতুলে। তুমি যদি তাকে তুলতুলে হাতে না ধরো তাহলে তো সে কষ্ট পাবে তাই না! তুমি না তার বড় ভাই হও! তুমি কষ্ট দিবে তাকে?’

শিশির চুপ করে রইলো। সে মনে মনে ঠিকই ফুঁসে আছে কিন্তু বাবার সামনে কিছু বললে বাবা নিশ্চয়ই তাকেও ধমক দিবে যেমন করে মাকে দিয়েছিল। সে বলল এখন থেকে তাকে আদর করবে খুব। বাবার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শিশির। যথা সময়ে স্কুলেও রওনা দিলো। মন খারাপ ভাবটা তার রয়েই গেল। মনে মনে ঠিক করলো আর কয় দিন দেখবে। তারপরও যদি আম্মা আর ফুপুআম্মা তাকে কম আদর করে তাহলে সে আলতাকে বাড়ির বাইরে বটতলায় রেখে আসবে। সেখানে একটা পাগল বুড়ি আছে তার কাছে ছেড়ে আসবে তখন দেখবে সে, তারা কাকে আদর করে!

মাস্টার বাড়িতে হাতে গুণে মাত্র আট জন সদস্য ছোট্ট আয়শাকে নিয়ে। অথচ বাড়িটা তাদের অনেক বড়। এ বাড়িতে পাড়ার মানুষদের আনাগোনা খুব বেশি নয় তবে বিপদগ্রস্তরা সবাই প্রায় এ বাড়িতে পা রাখেন। আহসানুল্লাহ সাধ্যমত সহায়তা করে আবার বুদ্ধি পরামর্শও দেন। আজও তেমনি একজন এসে হাজির হয়েছেন। তার বিপদ তেমন কিছু না শুধু তার পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজী করানোর আবদার নিয়ে এসেছেন জরিনা খালা। জরিনা বেগমের একটি মাত্র সন্তান জহির। আহসানুল্লাহ আর জহির দুইজন বন্ধু কিন্তু জহির একটু অন্তর্মূখী স্বভাবের। অজানা কোন এক কারণে সময়মত বিয়েটা করেনি। আহসানুল্লাহ আর পাড়ার অন্যান্য বন্ধুরা সবাই বিয়ে করে দুই, তিন সন্তানের বাবা হয়ে গেছে। কিন্তু জহির পড়ালেখা করে পদ্মাদিঘি বাজারে বই, খাতার দোকান খুলে বসে আছে। ভালো চাকরির সুযোগ পেয়েও কোন চাকরি বেশিদিন করতে পারেনি একা মাকে রেখে। তাই গ্রামেরই বাজারে দোকান দিয়ে বসেছে। কিন্তু তার সমস্যা একটাই সে বিয়ে করতে সম্মতি দেয় না। তাই আজও জহিরের মা কান্নাকাটি করে এলেন আহসানুল্লাহর কাছে। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। আহসানুল্লাহ বাড়িতেই থাকবে দুপুর পর্যন্ত আর তাই জরিনা বেগম সকাল সকাল এলেন। নকশি সবে তার কাপড়চোপড় নিয়ে কলপাড়ে যাচ্ছিলো। জরিনা তাকে দেখে কি যেন মনে পড়ার মত করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। জয়তুন বেগম তার ঘরের দরজায় বসে পুইশাক কাটছিলেন৷ জরিনা বেগমকে খেয়াল করতেই নকশিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ বুড়ি কি কইলো রে নকশি?’

‘কিছু বলে নাই বড়ভাবী।’

‘মতিগতি ভালা না জহিরের মা’র। আমি কিন্তু আগেও দেখছি বুড়ি তোর দিকে কেমনে জানি তাকায়।’

নকশি বুঝলো না শরতের মায়ের কথা। সে ভাবলো মহিলা তো আগে থেকেই চিনে হয়তো অন্য কোন কারণে ওভাবে তাকিয়েছে। কিন্তু না জয়তুনের কথাই ঠিক হলো আরো ছ’মাস পরে। হঠাৎ একদিন আহসানুল্লাহ ডাকলেন নকশিকে নিজের ঘরে। শিফা আর জয়তুনও উপস্থিত ছিলো। কথার শুরুটা ছিলো শিশিরের ডাক নিয়ে। আয়শাকে আজকাল খুব আদর করে শিশির কিন্তু তার সাথে আরো একটা নতুন ঘটনা ঘটেছে। বাড়িতে কেউ আয়শা নাম বললেই শিশির সবাইকে খুব করে বলল যেন আয়শা না তাকে আলতা বলে ডাকে।

আহসানুল্লাহ প্রথমে সে কথাই বললেন, ‘ শিশির তো দেখি আয়শা নাম একদমই শুনতে পারে না৷ তার নাকি পিচ্চি বাবুকে আলতার মত লাল লাগে তাই আলতা ডাকতে চায়। তার তো দারুণ একটা আবদারও আছে।’

ঘরে সবার মুখেই উচ্ছলতার হাসি। নকশিও হেসে জানতে চাইলো কি সেই আবদার। এবার আহসানুল্লাহর আগে শিফাই বলল, ‘আয়শারে সবাই এখন থাইকা আলতা ডাকবো।’

‘এ আর এমন কি আবদার ভাবী। ভালোই তো নামটা আলতাই ডাকমু। আয়শা নাম তার খাতায় কলমে থাকবো ডাকনাম আলতা থাকলো।’

‘হ, কত কাহিনি করবো পোলাপান অহন। বড় হইতাছে আর রঙঢং শিখতাছে সবগুলানে।’ হাসতে হাসতে জয়তুন বেগম কথাটা বলেই আবার যোগ করলেন, ‘তা অনেক তো হইলো নকশি মাইয়া নিয়া একলা সংসার। এই বার কিছু ভাববি না?’

নকশি বুঝলো না বড় ভাবীর কথা। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই আহসানুল্লাহ বলল, ‘বস তুই এখানে। একটা কথা বলি শান্ত মনে শুনবি তারপর বিচার- ভাবনা করে পরেই জবাব দিবি।’

বাড়িতে সবাই এতদিনে নকশিকে তুই বলেই সম্মোধনে নেমে এসেছে। বিশেষ করে আহসানুল্লাহ যেমন বোন পরিচয়ে নকশিকে বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছে তেমনি নিজের বোনের মতোই শাসনে, স্নেহে রাখছে। নকশির কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা কয়েক মাস পরই কিন্তু আজই সে নকশির জন্য বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছে জরিনা কাকীর কাছ থেকে। তার বন্ধু জহির নাকি অনেক আগে থেকেই নকশিকে পছন্দ করছে কিন্তু বয়সের ব্যবধান আর নকশির বাচ্চা হওয়া সব মিলিয়ে অনেক দ্বিধায় ছিলো সে। এতদিনে তার জড়তা কেটেছে বলেই সে তার মাকে জোর করেছে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। পাড়ায় সবাই জানে নকশির তিন কূলে তেমন কেউ নেই আহসানুল্লাহরা ছাড়া তাই তার কাছেই প্রস্তাব রেখেছে। নকশি ভীত চোখে চাইলো আহসানুল্লাহর দিকে। সে আশ্বাস দিলো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

‘জরিনা কাকি তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিছে। জহিরকে তো চিনিস তুই আমার বন্ধু। ঈদেও বাড়িতে আইসা দাওয়াত খেয়ে গেল!’

নকশি মাথা দোলালো সে চিনে। কলেজে যাওয়ার সময় প্রায়ই দেখতো জহির তার দোকানের বাইরে বসে থাকতো দোকান ফেলে। আবার খাতা কলম কিনতে গেলেও হাজারটা বাহানা দিতো টাকা না নেওয়ার কিন্তু নকশি বুঝতে পারেনি লোকটার মনে তাকে নিয়ে কিছু ছিলো।

আহসানুল্লাহ তাকে জহির সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন। সে মানুষ হিসেবে কতোটা ভালো তাও বললেন৷ সব শুনে নকশির মাথায় প্রথমেই যে কথা এলো, ‘সে বিয়ে করবে না আর।’

আহসানুল্লাহ বলল, ‘সপ্তাহ খানেক সময় নিয়েছি আমি তারপর জানাবো তাকে তোর উত্তর তাই তুই ভালোভাবে ভেবে নিশ্চিন্তে সিদ্ধান্ত নে। তোর ভালোটা দেখার দ্বায়িত্ব আমাদের।’

চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-৫

মাস্টার বাড়ির আঙিনায় দুইটা শীত পেরিয়ে দ্বিতীয় বসন্ত কাটছে নকশির আর তার মেয়ের। গত মাসেই আলতার জন্মদিন গেল এক বছরের। গ্রাম্য সংস্কৃতিতে জন্মদিন পালন বলতে কেক কাটা খুব বেশিই অভিজাত পরিবারে হয় মাত্র। মাস্টার বাড়ির আহসানুল্লাহ শহরে থেকে পড়াশোনা করা মানুষ। সেখানকার সংস্কৃতি কিছু না কিছু নিজের মধ্যে ছিলো বলেই অতি শখের বশে ভাগ্নির জন্য কেক আর মোরগ, পোলাওয়ের আয়োজন করে মানুষজন দাওয়াত করেছিলেন। এই আয়োজন শুধু আলতার জন্মদিন উপলক্ষে না ছিলো নকশিকে নিজের নিকটত্ব প্রকাশেরও। যেবার নকশির জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলো জহিরের বাড়ি থেকে সেবারই নকশি প্রথমে প্রস্তাব নাকচ করে। কিন্তু আহসানুল্লাহ মনে করে নকশির বয়স অনেক কম, দেখতেও সে অপরুপ সৌন্দর্যের অধিকারীণী। যতোই সে অভিভাবক হয়ে, বড় ভাই হয়ে আগলে রাখুক সমাজে কিছু লোক সেসবের তোয়াক্কা করবে না। স্বামীহীনা নারীর জীবন সহজ নয়। তার পথে হাজারো পুরুষ চোখের বিষাক্ত ছোবল হরহামেশাই থাকবে। তাই সবাই মিলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো বিয়েটা জরুরি। আর জহিরের সাথে বিয়ে হলে তার ভালোমন্দ খোঁজটা আহসানুল্লাহ সবসময় রাখতে পারবে। নকশি মানলো না সে কথা। না ভেবেই সে প্রস্তাব ফেরায়নি বরং খুব ভালো করে ভেবে দেখেছে। আওলাদের কাছে ফিরে সে কখনোই যাবে না তারওপর কদিন আগেই জেনেছে আওলাদ দেশে এসে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আর সেক্ষেত্রে তার আর তার মেয়ের জীবনে একটা পুরুষ ছায়া সত্যিই জরুরি। কিন্তু সেই ছায়াটা সত্যিই ছায়া দেবে তো! বিয়ে হলেই আরো সন্তান আসবে সেই সন্তানের বাবা তখন তার এই সন্তানকে পরসন্তান মনে করে অবহেলা করবে নাতো! নাহ, কিছুতেই সে নতুন কোন সম্পর্কে জড়াবে না। বাড়ির সবার পীড়াপীড়িতে কিছুদিন ভেবেছিলো জহিরকে নিয়ে। কিন্তু মেয়েটার কথা ভাবতে গেলেই তার আর কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। জহির নিঃসন্দেহে মানুষ ভালো কিন্তু বিয়ের পর কি এমনই ভালো থাকবে! না নকশির আর বিয়ে করা হলো না। কলেজের ফাইনাল দিয়ে আহসানুল্লাহর পরামর্শে স্কুলে চাকরি নিলো। ততদিনে গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে শেখা আয়শা বাড়িতে সবার আলতা হয়ে চোখের মণি হয়ে গেছে। ঋতুর সাথে পাল্লা দিয়ে বদল হলো আলতার দৈহিক গঠন। ছোট্ট তুলতুলে মেয়েটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে গেল। সেই ধীরে বড় হওয়াটাই যেন চোখের পলকে চলে গেল। নকশির বয়সও বেড়ে চেহারায় বড় বড় একটা ছাপ এসে গেছে। আলতার বয়স তখন পাঁচ চলছে। শিশির ক্লাস সিক্সে পড়ে আর শরতও নাইনে উঠেছে। বাড়িতে সারাক্ষণ ছোটাছুটি করা আলতার হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। শিশির আর শরত দুজনেই ছোট্ট আলতাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আবার শিশিরের শাসনও চলে খুব । পাড়ায় খেলতে গেলে শিউলিকে সাথে না নিয়ে গেলেও আলতা থাকে শিশিরের একমাত্র সঙ্গী। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাচ্চারা বড় হতে হতেই আহসানুল্লাহর দৃষ্টিতে বিঁধলো বাচ্চাদের পরিবর্তন। বিশেষ করে বাড়িতে থাকা চারটে বাচ্চার চার রূপ দেখে হতাশা সাথে খুশির মিশ্র অনুভূতি হয় তাঁর। পাঁচ বছরের আলতা খুব চঞ্চল প্রকৃতির আর তার চলন বলনে মনে হয় সে ছেলেদের খুব অনুসরণ করে। ছেলেদের খেলার জিনিসপত্রে তার নজরে টিকে থাকে। বাড়ির আরেক কন্যা শিউলি। আহসানুল্লাহর ভাতিজি শিউলি ক্লাস ফোরে পড়ে। তেমন একটা খেলায় আগ্রহী নয় মেয়েটা সারাক্ষণ সাজগোজ আর সব ব্যপারেই কেমন এক কূটচাল ভাবে থাকে অথচ তার মা মাটির মানুষ। আহসানুল্লাহ হতাশ হয় তার কথা ভেবে। মেয়েটা কাউকে কিছু দিতে চায় না এমনকি নিজের ভাই শরতকেও সে নিজের ভাগের কিছু দিতে রাজী হয় না৷ মেয়েটা কি বড় হলেও এমনই থাকবে! ভাবতেই খারাপ লাগে। বাড়িতে তৃতীয়জন শিশির। এই আরেকজনকে দেখেও আহসানুল্লাহ কষ্ট পায়। ছেলেটা যতোই বড় হচ্ছে ততোই আচরণে রূঢ় আর কঠোর মনের হয়ে উঠছে। ছোট্ট আলতাকে সে প্রথমে পছন্দ না করলেও পড়ে খুব আদর করতো। কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছে ততোই তার অত্যাচার বাড়ছে মেয়েটার প্রতি। একসাথে চারজন পড়তে বসে নকশির কাছে। আলতা সবে বর্ণমালা শিখছে কিন্তু এখনই তার ভুল পেলে নকশির আগে শিশিরই তাকে চড়, থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ওইটুকুনি মেয়ে একা একা গেইট পেরিয়ে বাড়ির বাইরে যেতেই শিশির এসে তাকে ধমক দেয়। পড়াশোনা তার ঠিক থাকে সর্বদা কিন্তু পাড়ায় অন্য বাচ্চাদের ওপরও কেমন জোর খাটানো আচরণ করে এটা নিয়ে হতাশার চেয়ে বেশি ভয় হয় আহসানুল্লাহর। বাড়ন্ত বয়স থেকেই তার মন- মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটবে আর সেই বিকাশ এমন উশৃংখল হলে কি করে হবে! আর বাড়ি বড় ছেলে শরত। সে সত্যিকার অর্থেই বাড়ির বড় ছেলে হয়ে উঠেছে। ক্লাস নাইনে উঠতেই যেন সে ঘর সংসার সব বুঝতে শিখে গেছে। আহসানুল্লাহ স্কুলের পাশাপাশি নিজের দোকানে বসেন। আজকাল শরত খুব করে ধরেছে, ‘ কাকা আমাদের দোকানের ভাড়াটা ছাড়িয়ে দেন। স্কুলের ফাঁকে আমিই বসবো দেকানে।’

দ্বায়িত্ব জ্ঞানের বিকাশ তার মস্তিষ্কে এখনই যেন প্রবল হয়ে গেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে তার মায়ের সব রকম কাজেই হাত বাড়ায়। গর্ব হয় আহসানুল্লাহর ভাতিজার দিকে তাকালে। মন বলে এই ছেলেটা খুব উপরে উঠবে। সে কিছুতেই শরতকে পড়াশোনায় অবহেলা করতে দিবে না। পর হয়ে যদি নকশিকে পড়ানোর কাজটা করতে পারে তবে শরত তো তার নিজের ভাইয়েরই রক্ত।

শরৎ কালের শুরু ; আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভেসে বেড়ায় সারাটাদিন। বিকেল হলেই বাড়ির পেছনে একটা ধানি ক্ষেত পানিতে ভরা তার পাশেই গিয়ে বসে আলতা। সাথে থাকে শিউলি আর তার পাড়ার খেলার সাথীরা। ক্ষেত ভরা পানি জমে আছে বর্ষার। ঋতুর বর্ষা শেষ হলেও মাঠ ঘাটের পানি এখনও নামেনি। নকশি আজ কাঁথা সেলাই করতে বসেছে তাই শিউলির সাথে পাঠিয়েছে খেলার জন্য। শিউলির সেদিকে মন নেই সে তার সাথীদের সাথে খেলতে খেলতে আম বাগানে চলে গেল। আলতা বাগানের কিনারায় যেখানে ঢালু জমি আর নিচে ক্ষেত ঠিক সেখানটায় বসেই খেলছে একা একা। হাতে তার কচু পাতা। কচু পাতার ঠোঙা বানিয়ে উপুর হয়ে সে পানি তোলার চেষ্টা করছে। তার পা টলছে , পানির নাগাল কিছুতেই পাচ্ছে না। শরত ভাই দেখিয়েছিলো এই পাতায় পানি নিলে কেমন বলের মত হয়ে গড়িয়ে পড়ে! আশ্চর্য হয়ে দেখেছিলো সে। আজ তাই নিজেই তেমনটা করার চেষ্টা। সামনে ক্ষেত ভরা পানি তার মাথা অব্দি ঠাঁই হবে না। ছোট্ট আলতার কি তা বোঝার সাধ্যি হয়েছে! সে আরো এক পা নিচে নেমে এবার একদমই কুঁজো হলো হাত পানি ছোঁয় ছোঁয় ঠিক তখনি কোথা থেকে শিশির এসে চিলের মত ছোঁ মারলো। ঠিক যেন, চিল এসে তার শিকার নিয়ে উড়ে গেল। বাগানের মাঝে নিয়েই শিশির দু গালে শক্ত করে চড় মারলো আলতার। তারপরই ডান হাতের কব্জি টেনে বাড়িতে নিয়ে গেল। উঠোনে বসে পান চিবুচ্ছেন জয়তুন বেগম পাশেই কাথায় ফুল তুলছিলো নকশি। ক্রোধে শ্যামলা মুখের কঠিনভাব আর ফর্সা আলতার গালের লালিমা দেখেই আঁতকে উঠলো নকশি।

‘কি হইছে বাবা ওরে মারো ক্যান।’

‘মারবো না তো কি! কত্ত বড় কলিজা অর ক্ষেতের আইলে বইসা উপুত (উপুর) হইয়া পানি ধরে। এখনই তো আমি না দেখলে ক্ষেতে ডুবতো।’

ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল শিশির কথা শেষ করে। অবাক হয়ে জয়তুন বেগম তাকিয়ে রইলেন নির্বাক। এতটুকু ছেলে অথচ তার রাগ আকাশছোঁয়া। কিন্তু এটাও তো ঠিক বাগানের পিছে ক্ষেতে পানি বড়দের কোমর সমান। গ্রামের ওপাশটা একটু বেশি ঢালু বলেই নদীর পানি শরৎ কালেও খুব থাকে। ভাবতেই নকশির গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। জয়তুন চিন্তিত মুখে বললেন, ‘ওই হারামজাদীর লগে এইডারে দেওয়াই ভুল হইছে। আলতা তোর শিউলি আপা কই?’

শেষের প্রশ্নটা তিনি আলতাকে করলেও কান্নারত আলতা জবাব দিতে পারলো না। শিশির ভাই তাকে সবসময় মারে কিছু ভুল করলেই মারে। সে মাকে জড়িয়ে ফোঁপাতে লাগলো। শিশিরও চোখ পাকিয়ে আরেকবার আলতাকে দেখে চলে গেল সেখান থেকে। আজ মা, বাবা কেউ বাড়িতে নেই তার । আহসানুল্লাহ আর শিফা গেছে শিফার বাপের বাড়ি। অনেক বছর হলো তাদের বিয়ের। শিশির একটাই ছেলে দ্বিতীয় সন্তানের খুব শখ। কিন্তু কোন ভাবেই তা সম্ভব হচ্ছে না। শহরের হাসপাতালেও কত টাকা খরচ করলো কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। হতাশায় ভুগতে থাকলো শিফা এই নিয়ে। যে যখন যা বলছে তাই করছে দ্বিতীয়বার একটা সন্তানের জন্য। এবার তার ভাবী এক কবিরাজের কথা বলল। আহসানুল্লাহ মানছিলেন না কিন্তু এবার শিফা খুব করে জেদ ধরলো। বাধ্য হয়েই আজ সে শিফাকে নিয়ে গেল শ্বশুরবারি। শিশিরকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু এই জেদী ছেলেটা তার নানা বাড়ি তেমন একটা পছন্দ করে না। থেকে গেল সে জেঠি আম্মা আর ফুপুআম্মার সাথে। দুপুরেও নকশি খুব যত্ন করে খাইয়ে দিলো। রাত হতেই জেঠি মার পাশে শুয়ে পড়লো। মাস্টার বাড়ির আবহাওয়া দিনভর চঞ্চল আর রাত হলেই একাকীত্বের পর্দা টানে জয়তুন আর নকশির ঘরে।

চলবে