শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-৬+৭

0
388

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-৬

শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশের নীলরঙে নীলাভ ধরনী। বাড়ির কলপাড়ের পেছনে বড় এক কড়ই গাছ। তাতে এক সপ্তাহ হলো একজোড়া কাকের বাস। সকাল হলেই কা কা শুরু হয় তাদের। আলতা প্রচণ্ড বিরক্ত এই কাক দম্পতির সংসারের দৈনন্দিন কলকলে৷ তাই আজ সকালেই সে গুলতি হাতে এসে উঠোনে দাঁড়িয়েছে। ক্লাস এইটে ওঠার পর পরই তার মেয়েলি ঘটনা ঘটলো। শারিরীক পরিবর্তন সাথে মাসিক এই মেয়েলি ব্যপারে সে এখন প্রতি মাসেই দু চারদিন ক্লাস ফাঁকি দেয়। আজও সে তার সেই বাহানা কাজে লাগিয়ে ঘরে বসেছিলো। নকশি হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছে কয়েক বছর ধরেই। সে এলকায় দুটো ছাত্রী পড়ায় সকালে। সে কারণেই সকালে রান্না সেরে আটটার মধ্যে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আবার বিকেল চারটা। মাঝে শুধু টিফিনে বাড়ি আসে আলতাকে সঙ্গে নিয়ে খেয়ে আবার মেয়েকে নিয়েই স্কুলে যায়। আজ আর আলতা যায়নি সে বাড়িতে একা। শিশিরও এখন কোচিং করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য শিউলিও কলেজের প্রথম বছর শেষ করেছে। সকাল থেকে বাড়িতে জয়তুন আর শিফা ছাড়া তৃতীয় কেউ না থাকায় আলতার আজ মহা আনন্দ হচ্ছে। সে গুলতি তাক করে গাছের ডালে ডালে নিশানা করছে। যে করেই হোক একটা কাক তো সে অবশ্যই মারবে আজ। শিফা ঘরের বারান্দায় বসে পোলাওয়ের চালে কাঁকর খুঁজছেন। শিশির কতদিন ধরে ভুনা খিচুড়ির আবদার ধরেছে। আলতাকে ছুটতে দেখেই ডাকলো, ‘আলতা! তোর না বলে শরীর খারাপ? স্কুলে গেলি না বাহানা কইরা আর এখন এমনে গুলতি নিয়া দৌঁড়াস ক্যান!’

কিছুটা ধমকের সুরেই বলেছে শিফা। সে ধমক আলতা গায়ে মাখলো বলে মনে হলো না। তার চোখ মুখে চিন্তার ছাপ৷ কাকটা আজ যে করেই হোক মারতে হবে। মামী তো কতই বকে বকুক তার কি! শিফা আবারও ধমকালো কিন্তু তার শোনার নাম গন্ধ নেই। উল্টো দৌড়ে এসে কুলো থেকে এক মুঠো চাল নিয়ে উঠোনে ছড়িয়ে দিলো সে পাখি ধরার জন্য । শিফা চেঁচিয়ে উঠলো, এই মেয়েকে সে কিছুতেই কথা শোনাতে পারে না। বাড়িতে একমাত্র শরতের মা আর শিশিরই যা ভয় দেখাতে পারে। বাকি সবার আহ্লাদ তো একে কাঁধে চড়িয়ে রেখেছে। শিফা যারপরনাই হতাশ হয়ে বলল, ‘আসুক আজ শিশির তারেই বলবো তোর কান্ডকারখানা। স্কুল কামাই দিয়া তুই কি করোস আজ সব ছুটাইবো সে।’

শিশিরের নাম শুনতেই আলতা চোখ রাঙিয়ে তাকালো মামীর দিকে, নাকের পাটা ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিলো।

‘পারো তো ওই একটাই কাম। যমদূত একটা বাড়িতে আছে কথা নাই বার্তা নাই খালি মারে। ইচ্ছা কইরাই আমারে মাইর খাওয়ায় মা আর শিউলি আপায় এহন তুমিও করো হু।’

ফর্সা চোখ, মুখ একটু রাগতেই লালচে রঙ ধারণ করলো আলতার। সেও কম যায় না কিছুতে। মামী বড় ইমোশনাল মানুষ দু চার কথা একটু বাঁকিয়ে বললেই গলে যায়। কিন্তু আজ তো তার শনিরদশা লাগবে আগেই ঠিক ছিলো। তাইতো আজ সময়ের আগেই শিশির এসে হাজির হলো বাড়িতে। গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই শুনলো আলতার সব কথা। শিশিরকে দেখতেই আলতার ঝকঝকে দিনটা অমাবস্যার রাতের মত আঁধারে ছেয়ে গেল। ঋতুস্রাবের কারণে হওয়া যে ব্যথা সে সহ্য করছিলো সেটা আকস্মিকই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। ব্যথাটা তার শরীরের চেয়ে মস্তিষ্কেরই বেশি মনে হলো। শিশির দ্রুত পায়ে ঘরের বারান্দায় পা রাখতেই শিফাও আঁতকে উঠলেন। কাঁধের ব্যগটা বারান্দায় রেখেই শার্টের হাতা গুটিয়ে আলতাকে ডাকলো, ‘এদিকে আয়।’

মাথাটা সাথে হাত পায়ের তালু প্রচন্ডরকম ঝিমঝিম করছে আলতার। চোখে অন্ধকার দেখছে; এই যমদূত কি এখন তাকে কানে ধরিয়ে গেটের বাইরে দাঁড় করাবে!

‘কথা কানে যায়নি? আসতে বলেছি তোকে।’

‘থাক বাবা, ওর শরীর ঠিক নাই।’ শিফা বলল কিন্তু শিশির তা আমলে নিলো না।

‘এ্যাই তুই কেন দাঁড়িয়ে আছিস? আম্মা তুমি যা করছো তাই করো।’

শেষের বাক্যটা মাকে বলেই শিশির আবার আলতার দিকে তাকালো। গুটিগুটি পায়ে আলতা এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো। আগে শিশিরদের ঘর ছিলো টিনের দেয়াল, মাটির মেঝে। বছর কয়েক হলো আধপাকা ঘর হয়েছে তাদের শুধু টিনের চাল দেওয়া। ঘরের সামনে বারান্দার মত লম্বাটে জায়গা। শিশির দরজার দিকে পা রেখে বারান্দার মেঝেতে বসে ছিলো। আলতা সামনে এসে দাঁড়াতেই সে সপাটে এক থাপ্পড় মারলো আলতার গালে। এ আর নতুন কিছু নয় তবুও চমকে গেল শিফা। সে ধমক দিলো শিশিরকে কিন্তু শিশির কখনো বাবা আর শরত ভাই ছাড়া কারো সামনেই নিচু হয় না। বসা থেকে উঠে সে আলতার এক বেণী করা চুল টেনে বলল, ‘কতদিন বলেছি অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি না! তোকে পড়াশোনা কি এসব করার জন্য শেখাচ্ছে!’ হাতের গুলতি দেখিয়ে বলল শিশির। শিফা এসে টেনে হাত ধরলো শিশিরের কিন্তু সে ছাড়ার পাত্র নয়।

‘তুই স্কুলে না গিয়ে ছেলেদের মত গুলতি, মারবেল, লাটিম নিয়ে খেলবি এজন্যই ফুপু আম্মা পরিশ্রম করে! আর তোকে বলেছিলাম পাড়ার শেষ মাথায় যেন রকিব, শাওন এদের সাথে না দেখি বা কেউ যেন না বলে তুই সেদিকে গিয়েছিস! বলেছিলাম?’ কান্না চেপে চুলে আর শিশিরের হাত ধরে আছে আলতা। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে নিঃশব্দে। ব্যথা পেয়েও আওয়াজ করছে না দেখে শিফা ভয় পেয়ে গেল। রান্নাঘরে ঢুকে খুনতি এনে শিশিরের হাতে বারি দিলেন তবে যেয়ে সে হাত ছাড়লো।

হাত ছাড়লেও শিশির ভয়ংকর রকম রেগে আছে। কারণটা শুধু আলতার স্কুল কামাই কিংবা অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা নয়। সে কোচিংয়ে যেতেই তার এক বন্ধু বলল আলতা নাকি কাল সন্ধ্যের দিকে শাওনের সাথে মারবেল খেলেছে। খেলায় আলতা হেরে যাওয়ায় তার সাথে টানা হেচড়া করে আম বাগানে নিয়ে যাচ্ছিলো, গায়ে হাত দিচ্ছিলো। শাওনের হাতে কামড় বসিয়ে পালিয়ে এসেছে আলতা। আর এইসব ঘটনা শিশিরের বন্ধু নিজে দেখে শাওনকে মেরেছে আর আজ দেখা হতেই শিশিরকে বলল, ‘আলতাকে সাবধান করিস। বড় হচ্ছে সে আর শাওন তো তার সমবয়সীও না। খেলা তো বাহানা মাত্র।’

সেই থেকেই রাগে চিড়বিড় করছে তার মাথা। কোচিংয়ে মন বসাতে না পেরেই বাড়ি ফিরে এসেছে। আর আলতার দূর্ভাগ্য আজ সে বাড়িতেই আছে। শিফার চেঁচামেচিতে শিশির আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। আলতাও ছাড়া পেয়ে থম মেরে বসে রইলো চুপচাপ। শিফা তার গালে,মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সারাটা দিন শিশির বাড়ি আসেনি। সন্ধ্যার আগে শরত বাড়ি ফিরলো শিশিরকে নিয়ে। শিশিরের কপাল ফুলে আছে, হাতের বাজুতে ব্যান্ডেজ। তার অবস্থা দেখেই বাড়িতে হৈ চৈ বেঁধে গেল। আলতার সকল পরিকল্পনা শিশিরের অবস্থা দেখে ভেস্তে গেল। আজ শিশির তাকে মারার সময় সে কান্না চেপেছিলো ইচ্ছে করেই৷ সে কান্না জমাচ্ছিলো মামা আর শরত ভাই এলেই সকল কান্না একেবারে ঢেলে দিতো। তার কান্না দেখলে এমনিতেই মামা গলে একদম নরম মাটির মত হয়ে যান। তখন আলতা যা বলে মামা তাই শুনে। আজও সে মামাকে গলিয়ে শিশির ভাইয়ের নামে নালিশ করতো। ইচ্ছেমতো বকা খাওয়াতো আর রেগে গেলে মামা থাপ্পড়ও মারেন শিশির ভাইকে৷ আর শরত ভাইয়ের সামনে কান্না করলেই তিনিও একদম তুলোর মত কোমল হয়ে আলতা কিছু বললেই এনে দিতো৷ কিন্তু এখন কি হবে তার!

শিশিরের অবস্থা দেখে বাড়ির মহিলারা একটু বেশিই আতঙ্ক বোধ করছে। তার অবস্থা এতোটাও খারাপ নয়। আহসানুল্লাহ ছেলেকে দেখে শরতকেই প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে ওর?’

‘মারামারি করেছে।’
শরত দু বাক্যে জবাব দিলো।

‘কার সাথে আর কেন?’

‘শাওনের সাথে।’

আহসানুল্লাহ বিরক্ত হলেন। শরত দিনকে দিন এতো বেশি অন্তর্মুখী হয়ে উঠছে যা সহ্যের বাইরে। ছেলেটা এত ভালো হয়েও শুধু মাত্র তার চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় কত ভালো চাকরিটা হাতছাড়া হলো তার। পড়াশোনায় ভালো একটা রেজাল্ট করলো অনার্সে এরপর সে পুরোপুরি সংসারের দ্বায়িত্বে ডুবে গেল দোকানদারিতেই। আহসানুল্লাহর খারাপ লাগে যখন তাঁর পাশের দোকানে বসে শরতকে দেখে চাল, ডাল তেলের ওজন করছে। দোকানদারি খুব ভালো ব্যবসা কিন্তু তাঁর মন চাইতো এই ছেলেটাকে সে শহরের বড় কোন অফিসে সাহেব হয়ে ঢুকছে দেখবে৷ একা কাঁধে সে শুধু নিজ সন্তান নয় বাড়ির প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ের পড়ালেখায় নজর রেখেছে। চারজনের চারটা উজ্জ্বল মঞ্জিল কল্পনা করে সবসময়। আগে নকশিকে নিয়েও ছিলো কল্পনাটা কিন্তু বাস্তবতা খুবই করুণ আর কঠিন৷ নকশি একা নয় তার মেয়েরও তার সমান খাওয়া-পরা আরো কত খরচ। তাই সরকারিতে কোনমতে পড়াশোনা চালিয়ে সে শিক্ষকতাটা করতে পারছে। বেশি কিছুর আশায় থাকতে গেলে তার ঘরের হাঁড়ি খাবারশূন্য থাকতো। শিশির আজ যা করেছে তাতে শিশির কতোটা দোষী তা আর ঠিকঠাক জানার ইচ্ছেটা রইলো না। শরতকে আর কিছু বলতে না দিয়ে শিশিরকে বললেন, ‘মারামারি কেন করেছো আর দোষ কার জানতে চাইবো না৷ শুধু বলে রাখছি এমন কিছু করো না যার জন্য আমাকে লোকের সামনে মাথা নিচু করতে আর না হাত জোর করতে হয়। আমি সারাজীবন শিক্ষক হিসেবে অনেক সুনাম কামিয়েছি। টাকার চেয়ে সেটাই বড় সম্বল আমার। তোমার জন্য তা খোয়াতে পারবো না।’

শিশির কোন জবাব দিলো না। কাকা সরে যেতেই শরত বসলো শিশিরের পাশে। সে তো নিজেও সবটা জানে না শুধু কয়েকজন বলল শিশির আর শাওন মারামারি করছে। তাই শুনে শরত দৌড়ে গেল সেখানে৷ দুজনকে থামাতেই দেখলো দুজনেরই হাত, নাক কেটেছে৷ দুটোকেই নিজে এলাকার ডাক্তারকে দিয়ে ব্যন্ডেজ করিয়েছে৷ এখন তার কৌতূহল হচ্ছে জানার কি নিয়ে মারামারি হলো! সে আগে দেখলো আশেপাশে কে কে আছে। শিউলি ছাড়া কেউই নেই। শরত ইশারা করলো শিউলিকে ঘর থেকে যেতে। সে যেতেই শরত মুখ খুলল, ‘কি নিয়ে হলো মারামারি?’

‘কিছু না ভাই।’

‘আমার দিকে তাকা।’

শিশির তাকালো চোখ তুলে। শরত আবারও বলল, ‘সত্যিটা বল।’

শিশির বলল শাওন কাল আলতার গায়ে হাত দিতে চেয়েছিলো। তার সাহস কত্তো বড় আমাদের বাড়ির মেয়ের দিকে তাকায়! ওর তো কপাল ভালো চোখ তুলে নেইনি।’

কথাটা শুনে ঠান্ডা মেজাজের শরতেরও চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। মাস কয়েক আগেই তো শিউলির পেছনে লাগায় কলেজের এক ছেলেকে সে তার ভারী, শক্ত হাতে তিনটি থাপ্পড় লাগিয়েছিলো। সেই থাপ্পড়ে ছেলের নাকি দাঁত নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখন তার শাওনকেও ঠিক এভাবেই মারতে ইচ্ছে করছে। শরত পারে নিজের রাগ সংবরণ করতে তাই আপাতত সে নিজেকে দমিয়ে রাখলো।

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-৭

চৈত্রের দাবদাহে চামড়া ঝলসানোর জোগাড়। নতুন বছরের নতুন পড়াশোনায় তিক্ত আলতার মেজাজ চড়ে আছে প্রচণ্ড। ক্লাস নাইনের পড়াশোনা নিয়ে আগে থেকেই খুব পেরেশানিতে ছিলো কিন্তু শিশির ভাই তো বাড়ির শেয়াল পন্ডিত সব কিছুতেই তার পন্ডিতি দেখাতে হবে৷ গ্রুপ সাবজেক্ট ঠিক করা নিয়ে মাকে সে রাজি করিয়েছে ব্যবসায় শাখা নিবে। মামা বলেছিলো বিজ্ঞান নে পরে আবার বলেছে তোর ইচ্ছে। শরত ভাই বলল আগে ভেবে দ্যাখ তুই কোন সাবজেক্টে আগ্রহী সেটাই নিবি। সবই ঠিক সে তো স্কুলে ব্যবসা শাখাই ঠিক করলো অথচ শয়তান শিশির ভাই নিজেই মাতব্বরি দেখিয়ে সাবজেক্ট পাল্টে আসলো। আর কি বলল, ‘তুই এইখানে কোনমতে স্কুল পাস কর। তোরে ঢাকায় ভর্তি করাবো কলেজে। তারপর তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তোকে পড়তে হবে তাই মেহনত এখন থেকেই শুরু কর।’

আলতা মুখের ওপর কিছু বলতে পারলো না শিশিরের তবে মনে মনে সে গালির ঝড় তোলে। তার গালিতে প্রথমেই থাকে, তেলের শিশি শীতকালে থাকতে পারিস না শুধু! আমার জীবন তামা করতে সারাবছরই কেন থাকিস তুই! সবটাই মন খুশি করতে মনে মনে বলা। তার সাহস নেই শিশির ভাইকে কিছু বলে চুল ছেঁড়ার। আজকাল থাপ্পড় কমই দেয় সে কিন্তু কথায় কথায় চুল টেনে ধরে। সেদিন তো এমন করে ধরেছিলো যে বড় মামী রেগে বলছে এই চুল টানার ঝগড়া তোর বউয়ের লগে করিস। বইনে গো চুল ধরবি না এমনে। তারপর অবশ্য দু আড়াই মাস কেটে গেল এখন অব্দি শিশির কোন কারণেও আলতার ওপর চটেনি। তাই বলে মারবেল খেলা তার বন্ধ হয়নি কোনভাবেই। পাড়ায় ঘুরে খেলা বন্ধ করে এখন সে তাদেরই বাড়ির সামনে খেলে। শিশিরকে রাস্তার আশেপাশে কিংবা বাড়ি আসতে দেখলেই সব মারবেল ওড়নায় লুকিয়ে বাড়ি ঢোকে। কখনও কখনও আবার মারবেল ফেলেই চলো আসে আর তার সাথীদের আগাম বলা থাকে মারবেল কুড়িয়ে এনে নিজেদের কাছে রেখে দেওয়ার। আজও তেমন একটা দিন আলতার তবে আজ ভুল করেই ফেলেছে৷ পাশের বাড়ির ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া তপন এসে একবার বলল, ‘আলতা আপা আমরা আজকা বাজিতে খেলা ধরছি। যে জিতবো হেরে দুইটা দেশি মুরগির ডিম দিবো।’

মারবেল আলতার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। তার ওপর বাজিতে খেলায় কেমন যেন একটা নেশা নেশা লাগে। আগেও সে অনেকবার বাজিতে খেলেছে আর প্রতিবারই সে জিতেছে। এই লেদাপোলাপানের সাথে জিতে যাওয়া কোন ব্যপারই না। রাজী হয়ে গেল আলতা আজই সে খেলতে গেল। প্রথম দিন পাঁচ জনের সাথে সেখান থেকে তিনজন আজই বাদ পড়বে কাল ফাইনাল। বিকেল বেলায় নিজের সব মারবেল ওড়নায় লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। খেলা চলল মাগরিবের আজান পর্যন্ত। তিনজন বাদ পড়লো কিন্তু সেই তিনজনে আলতা নেই। কাল ফাইনাল আলতা আর হিন্দু পাড়ার শুভংকরের মধ্যে। মারবেল নিয়ে বাড়ির ফেরার পথেই শিশিরের মুখোমুখি পড়ে সে। “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয় ” প্রবাদটা আলতার জীবনে ষোল আনাই সঠিক তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পেল সে। কিন্তু ঐ যে সন্ধ্যার আজান পড়ছে সেটাই তার সৌভাগ্য। শিশির চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থেকে তাকে সতর্ক করলো এই শেষ আর যেন তাকে মারবেলসহ না দেখে আর সন্ধ্যের বাড়ির বাইরে তো ভুল করেও না!

কাল ছাড়া পেয়ে স্বস্তিতে ঘরে ফিরে। আজ ফাইনাল খেলা এটা কি করে ভুলবে সে! শিশির ভাই না জানলেই হলো কথাটা ভেবে সে আবারও বিকেলে বেরিয়ে গেল মারবেল নিয়ে। খেলা শুরু হলো যথাসময়ে এবং চলতে থাকলো সন্ধ্যা পর্যন্ত। জিতে যাবে যাবে অবস্থায় পৌঁছে আলতা ভুলে গেল সন্ধ্যে হয়েছে বাড়িতে তার খোঁজ পড়বে। এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে খুব মনযোগে নিশানা ঠিক করছিলো অমনি তার চুলের বেণীতে জোরে টান পড়লো। গালি দিয়ে ফিরে ঘাড় বাকিয়ে তাকালো আলতা, ‘কে রে শালা আমার চুলে টান দিলি?’

যতখানি জোরে চেঁচিয়ে আলতা কথাটা বলল ঠিক ততখানি জোরেই থাপ্পড় পড়লো তার গালে। কিন্তু সেই থাপ্পড়ে তার তেমন কিছুই হয়নি। যা হয়েছে শিশির ভাইয়ের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত জ্বলতে থাকা চক্ষু দেখে। ভয়ে তো পরানপাখিটা ফুরুৎ হওয়ার পথে। আজ আর রক্ষে নেই তার। কালও কত করে বলেছিলো, ‘দ্যাখ আলতা ভুল করেও যেন তোকে পাড়ায় ছেলেদের সাথে মারবেল খেলতে না দেখি!’ পই পই করে বুঝিয়েছে শিশির কিন্তু সে শোনেনি। আজ উল্টো পাড়ার সবচেয়ে নিরব বাড়ি মুক্তাদের সেখানেই এসেছে দলবল নিয়ে। সন্ধ্যে নেমেছে চারপাশে অন্ধকারের পাতলা চাদরে ছড়িয়ে পড়ছে অথচ তার বাড়িতে ফেরার নাম গন্ধও নেই। তাই চিন্তিত হয়েই খুঁজতে বেরিয়েছে শিশির আর আলতার মা। নকশি আজ মেয়েকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে সেই সাথে তার মুখ নিঃসৃত শব্দে। শালা! গালি হিসেবেই ব্যবহার করেছে আলতা। নকশি ভেবে পায় না তার মেয়ে এতোটা উশৃংখল কি করে হলো! আলতা ডানপিটে স্বভাবের তাতো তাকে ছোট থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু নকশির শাসন, বারণও তো কম ছিলো না সেই সাথে শিশিরও কত শাসন করে। আর তার মামা মামীরাও কি কম করে! অথচ মেয়েটার কোন পরিবর্তনই হচ্ছে না। ভয়েই বুক শুকিয়ে আসে তার। আর মাত্র বিশ কি বাইশ দিন শিশির থাকবে এখানে। হলে সিট পাওয়ার অপেক্ষা এরপরই ছেলেটা চলে যাবে কয়েক বছরের জন্য। এই মেয়ে তো স্বাধীনতা পেয়ে বসবে আরো বেশি। বাড়ি যেতে যেতে নকশি আনমনেই উদাস হয়ে গেল মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবনায়।

রাত বাজে আটটা ; আহসানুল্লাহ সবে মাত্র মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরেছে। বাড়ির গেইটে পা দিতেই কানে এলো শিফার আনন্দিত কণ্ঠস্বর আর সাথে তার বড় সুমুন্দির। কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল পা। তাঁর আর শিফার বিয়ের বয়স তেইশ আর এত বছরে এই সুমুন্দি লোকটা এ বাড়িতে পা রেখেছে হাতে গুণে চারবার। প্রথমবার তাদের বিয়েতে, দ্বিতীয়বার আহসানুল্লাহর মায়ের মৃত্যুতে, তৃতীয়বার শিশিরের জন্মের এক সপ্তাহ পরে মিষ্টি নিয়ে এসেছিলো আর চতুর্থবার শরতের বাবার মৃত্যুর দিন। এরপর আর কখনো পা মাড়ায়নি এদিকে। সে নিজেও চাইতো না লোকটা এদিকে আসুক। অতি ধূর্ত আর ধুরন্ধর স্বভাবের এই লোক অনেক ফুসলেছে শিফাকে তারা যেন শহরে চলে যায়। আহসানুল্লাহর জন্য বড় বড় চাকরিও জোগাড় করেছে রাজনৈতিক জোর খাটিয়ে। উদ্দেশ্য ছিলো বোন জামাই যেন তাঁর ভাইয়ের সংসারের হাল না ধরে। শিফার বাপের বাড়ির লোকজন সহজ, সরলই ভাবতো আহসানুল্লাহকে। কিন্তু সেতো এতোটাও সহজ নয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রেখে বড় ভাই পরপারে গেছেন। ভাবীরও বয়স কম ভয় ছিলো দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যাবেন। তখন তার সন্তানতূল্য ভাতিজা- ভাতিজি দুটোর কি হতো! গ্রামের বাড়িতে খাওয়া, পরা জোগাড় করা যতটা না কষ্টের তার চেয়ে বেশি হতো শহরে গেলে। সেখানে পানি আর আগুনটাও কেনা। আহসানুল্লাহ কানে তোলেনি শিফার বড় ভাই, বোনের কোন পরামর্শ আর শিফাও স্বামীর বিপরীতে যাওয়ার সাহস করেনি কখনো। চাইলেই সে জোর করতে পারতো তবুও করেনি। তখন তো বাড়িতে টিনের ঘর, মাটির মেঝে ছিলো। হয়েছে তো এখন তার পাকা ঘর আল্লাহ চাইলে কখনো ঘরের পাকা ছাঁদও হবে! এই ভেবেই শিফা সুখী হয় খুব।

আহসানুল্লাহ পা বাড়ালো। ঘরে গিয়ে সুমুন্দি আর তাঁর বউকে দেখে সালাম দিলো। সুমুন্দির মুখ দেখে বোঝা গেল না তিনি এখানে এসে অস্বচ্ছন্দ বোধ করছেন কিনা। তবে শিফার ভাবী খুব খুশি। মিনিট কয়েক গড়াতেই তাদের উপস্থিতির কারণ স্পষ্ট হলো। বারো দিন পর বড় সুমুন্দির মেয়ের বিয়ে আর সে উপলক্ষেই তারা দাওয়াত নিয়ে এসেছে। শিফা তার ভাই – ভাবীর সাথে কথায় ব্যস্ত দেখে আহসানুল্লাহ, ‘একটু আসছি আমি’ বলেই ঘর থেকে বের হলো। শিশির রাতে দোকানে বসে। যতক্ষণ শরতের দোকান খোলা থাকে ততক্ষণই তাদেরটাও আবার শরতের সাথেই বাড়ি ফিরে আসে। সাথে তার প্রয়োজনীয় বইও থাকে সাথে। কাস্টমার না থাকলে পড়াশোনা চলে আবার সমস্যায় পড়লে ভাইয়ের সহযোগিতা তো আছেই। রাত দশটার মধ্যেই দু ভাই বাড়ি ফিরে। বাইশ দিন পর শিশির ঢাকায় চলে যাবে তারপর থেকে আবার রাত পর্যন্ত আহসানুল্লাই দোকান সামলাবে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় টর্চটা নিয়েছে সে। টর্চের আলোয় আঁধার কেটে পথে হাটছে আহসানুল্লাহ। মেহমান এসেছে তাতে মোটেও অখুশি নয় সে কিন্তু এই দাওয়াতের নামে শিফা আবার বদলে যাবে কিছুদিনের জন্য। আগেও এমনটা হতো বাপের বাড়ি যে ঈদ উৎসবে। সেখানে গিয়ে সে দু চার দিন থেকে ফিরতেই তার আচরণে পরিবর্তন দেখা যেত। তার মাথায় ঘুরতো পাকা বাড়ি করবে, শহরে থাকবে। তার ভাই কত ভালো ভালো চাকরির অফার দিচ্ছে। এ যুগে কে পড়ে থাকে গ্রামে! ব্যস কয়েকটাদিন আহসানুল্লাহর অসহ্যরকমে কাটতো। এবার তো বছর পাঁচেক হলো বাপের বাড়ি যায় না, বোনের বাড়ি যায় না। মোবাইল ফোন কেনা হয়েছে তাতেই যোগাযোগ চলছে তবে এ যোগাযোগে তাদের কুমন্ত্রণা কাজে লাগেনি।

আহসানুল্লাহ বাজারে পৌঁছে প্রথমেই গেল দোকানে। শিশিরকে বলল দোকান বন্ধ করে বাড়ি যা মামা-মামী এসেছে। শরতকেও বলল, ‘তুইও চলে যা আজ।’

শরত, শিশির কেউই ফিরলো না। দুজনেই আহসানুল্লাহর সাথে বাজারে ঘুরে মুরগি আর মশলাপাতি কিনলেন। গরুর মাংস পাওয়া গেল না আর পোলাওয়ের চাল ঘরেই আছে। তিনজনে বাড়ি ফিরে দেখলো মেহমান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজব লাগেনি আহসানুল্লাহর। এই সুমুন্দি যে দাওয়াতের জন্য তাকে প্রায়োরিটি দেবে না তা সে আগেই জানতো। তবুও নিজ বাড়িতে আসায় আন্তরিকতা বজায় রেখে সে অনুরোধ করলো রাতের খাবার খেয়ে যেতে। শিশির মামাকে খুব একটা পছন্দ করে না কিন্তু মামী তাকে মায়ের মতোই আদর করে। তাই মামীকে দেখেই তার আনন্দের সীমা নেই। শিশির আসাতেই যেন মামা মামী আরে একটু দেরি করলো। শিফার হাতে হাতে নকশি আর শিউলিও সাহায্য করলো রান্নায় কিন্তু কিছুতেই আলতাকে আনা গেল না। তার এক কথা এই রাত বিরাতে সে কিছু করতে পারবে না এখন তার ঘুমের সময়।

চলবে