শুকনো পাতার বৃষ্টি পর্ব-০৪

0
343

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি [০৪]
#ফারজানা_আক্তার

অন্তরীক্ষে আজ তারার মেলা। চাঁদ টাও বেশ গোলাকার আকৃতি ধারণ করেছে। আলোকিত হয়ে আছে সর্বত্র। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস বইয়ে চলেছে আপন মনে। জ্যোৎস্না মাখা এই রাতে উঠানে শীতল পাটি বিছিয়ে শুইয়ে আছে আহান সিয়াকে নিয়ে। বেশ জমে উঠেছে বাপ বেটির সম্পর্ক আবার। খুনসুটি করছে দুজন আর খেলছে। সিয়া আহানের নিজের মেয়ে না হলেও সিয়াকে অসম্ভব রকম ভালোবাসে আহান। যেনো পূর্বে কোনো সম্পর্ক ছিলো আহানের সাথে সিয়ার। ওদেরকে এভাবে আনন্দ করতে দেখে আদিবা আর ওদের কাছে গেলোনা। কিছুক্ষণ একা সময় কাটাতে দিয়েছে আদিবা বাবা মেয়েকে কারণ আদিবা জানে ওরা দুজন একে অপরকে অনেক ভালোবাসে। জন্ম থেকে নিজের বাবাকে কাছে পাইনি সিয়া তাই আহানকে বাবা রুপে পাওয়ার পর থেকে সিয়া ভীষণ দূর্বল হয়ে পরেছে আহানের প্রতি। সিয়ার জন্যই আজ আহান আর আদিবা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছে। আদিবা এক নজরে তাকিয়ে আছে আহান আর সিয়ার দিকে। আঁড়াল থেকে বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে নিজের মনকে শান্তনা দিচ্ছে এই বলে যে “বিধাতা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সাইমন যদি আমার জীবন থেকে চলে না যেতো তাহলে এই মানুষটাকে পাওয়া হতোনা আমার। হাজার শুকরিয়া খোদার কাছে।”

মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আদিবার। তখন সে অনেক চেষ্টা করে আবার ঘুমানোর কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসেনা। মনটা হঠাৎ কেমন চটপট করছে আদিবার। “জানিনা আগামীকাল সিয়াকে নিয়ে খান বাড়িতে গেলে কি হবে। আল্লাহ গো আমার মেয়েটাকে কেঁড়ে নিওনা আমার কাছ থেকে, সিয়া আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।” নিজে নিজেই এসব কথা বলছে বিড়বিড় করে আদিবা, চোখে জলও জমাট বেঁধেছে, অনুমতি পেলেই বুঝি গড়িয়ে পরবে জলগুলো কান্না হয়ে। কপাল ভাজ হয়ে গেছে চিন্তায় আদিবার। শুইয়ে থাকতে আর ভালো লাগছেনা ওর তাই ও উঠে বসে আছে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মাত্র বাজে ১ঃ৪৪টা। বুকটা কাঁপছে আদিবার। খালেদা খাতুনের বলা কথাগুলো যেনো বারংবার কানে বাজছে ওর। পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে ও।
“আমি যা করেছি নিজের স্বার্থে করলেও তোমাদেরকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি, প্লিজ ছেড়ে যেওনা আমায় তোমরা। তোমাদেরকে ছাড়া আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো।”
আহান ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করে এসব বলছে। লক্ষ করেছে আদিবা কিন্তু কথাগুলো খুব আস্তে গুন-গুন করে বলায় আদিবা বুঝতে পারেনি কিছু। আদিবা এসে আবার শুইয়ে যায় নিজের জায়গায় এসে।

সকালে নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করেই খানবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ওরা। আফজাল খান ফোন করেছে আহানের কাছে, বাবার সাথে কথা বলা শেষ করেই আহান গাড়ি স্টার্ট দেয়। আদিবার মুখটা শুকনো হয়ে আছে। চিন্তার চাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আদিবার চেহারায়। লক্ষ করে সবটা আহান। আহান সামনের দিকে তাকিয়ে বলে “এতো চিন্তা কিসের তোমার? অসুস্থ হতে হবেনা চিন্তা করে। আমি আম্মুকে বলেছি সিয়া আমার নিজের মেয়ে এবং তুমিও এখন থেকে সবাইকে এটাই বলবে সিয়া আমার মেয়ে। সবাই জানবে সিয়া আমার মেয়ে আর কিছু শুনতে বা বুঝতে চাইনা আমি।”
অবাক হয়ে শুনছে আদিবা আহানের কথা। তবে ভাবছে আবার সাইমনের কথা কারণ ও সিয়াকে দেখলেই বুঝে যাবে যে সিয়া ওরই মেয়ে কেননা ওদের ডিভোর্সের বয়স আর সিয়ার বয়স একই। মনে মনে বড্ড বেশি ভয় পাচ্ছে আদিবা। তবুও নিজের সব ভয় ভীতিকে কন্ট্রোল করে আদিবা বলে “আপনাকে একটা কথা বললে কিছু মনে করবেননা তো?”
“কিছু মনে করার কি আছে। বলো কি বলবে।”
“আসলে আমি তো খান বাড়িতে নতুন, কিছু জানিনা এখনো ওই বাড়ি সম্পর্কে। সানিয়া আপুর ব্যবহার খুব ভালো লেগেছে আমার, মেয়েটা বড্ড নিষ্পাপ কিন্তু আমার মাথায় একটা বিষয় আসতেছেনা।”
“কি বিষয়?”
“সানিয়া আপুর বিয়ের চার বছর হয়ে গেলেও উনি শ্বশুড় বাড়িতে যান না কেনো?”
“এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও জানিনা। ওর বিয়ের ছয় মাস আগেই ওর শ্বশুড় শ্বাশুড়ি মারা যায় একটা দূর্ঘটনায়, ওর শ্বাশুড়ি ছিলো আম্মুর বান্ধবী। আম্মুকে সবসময়ই বলতে শুনি যে শ্বশুড় শ্বাশুড়ি নাই আর সাইমনও বেশির ভাগ সময় দেশের বাহিরে থাকে ওখানে নতুন বিজনেস শুরু করেছে নাকি চারবছর আগে তাই সানিয়া ওখানে একা থাকতে পারবেনা বলে যেতে চাইনা। বিয়ের পর সানিয়া শুধু একরাত ছিলো সাইমনের বাসায় গিয়ে এরপর আর কখনো এক মুহুর্তর জন্যও যায়নি আর সাইমনও কখনো জোর করেনি। সাইমন যখনই দেশে আসে আমাদের বাড়িতেই থাকে।”

সাইমনের বাবা মায়ের মৃত্যুর কথা শোনে অজানা এক কষ্ট ভর করে আদিবার বুকে। সাইমন অবহেলা করলেও এই মানুষ দুজন ভীষণ ভালোবাসতো ওকে, সবসময়ই আগলে রাখতো। সাইমনের সাথে বিচ্ছেদের পর ইচ্ছে করেই আদিবা আর তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি কারণ উনাদের সাথে কন্টাক্ট থাকলে সাইমনের মায়া কাটাতে পারতোনা আদিবা কিছুতেই। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে আদিবার। আহান ড্রাইভ করছে সামনে তাকিয়ে তাই লক্ষ করতে পারেনি। চোখের জল মুছে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আদিবা বলে
“তাহলে সানিয়া আপু স্বামীর সাথে বিদেশ গিয়ে থাকেনা কেনো? আমার তো মনে হচ্ছে কোনো কারণ আছে এর পেঁছনে।”
“তুমিওনা নাহ। কি কারণ হতে পারে বলো তো, ছেলে ভালো।”
“ওহ্”
“হুম। সানিয়া একা থাকতে পারবেনা হয়তো তাই যায়না স্বামীর সাথে। সাইমন কাজ নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে।”

“কি কাজ নিয়ে এতো ব্যাস্ত থাকে তা আমার ভালো করেই জানা আছে।”
মনে মনে বলে আদিবা।

আহান ড্রাইভ করছে। আদিবা ঝিমাচ্ছে। গাড়িতে উঠলেই আদিবার ঘুম আসে। সিয়া হঠাৎ বলে আহানকে “বন্ধু গাড়ি থামাও।”
সিয়ার মিষ্টি মাখা নরম কন্ঠে আহান গাড়ি থামিয়ে দেয়। তারপর সিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আদুরে কন্ঠে বলে “এখানে তো কিছুই নেই বন্ধু। এখানে নেমে কি করবে? সামনে একটা রেস্তোরাঁ আছে সেখানে নামলে হিসু করতে পারবে।”
“আরে বোকা বন্ধু আমি হিসু করার জন্য গাড়ি থামাতে বলিনি।”
নিজের কপালে হাত মেরে বলে সিয়া। ওদের এমন কাহিনী দেখে কুটকুট করে হেঁসে ফেলে আদিবা। আদিবার হাঁসি দেখে কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায় আহান। আহান ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় সিয়ার দিকে। সিয়া একগাল হেঁসে বলে “ওই দেখো কত বড় কাঁশফুল বাগান। চলোনা বন্ধু আমরা যায় ওখানে। প্লিজ প্লিজ চলোনা।”

মুচকি হাঁসে সিয়ার আচরণ দেখে আহান। আহান যাওয়ার জন্য গাড়ি থেকে নামতে গেলেই আদিবা শক্ত কণ্ঠে বলে উঠে “কোথাও যেতে হবেনা এখন। ক্লান্ত লাগছে বাসায় যাবো।”
আদিবার কথা শুনে মন খারাপ করে ফেলে আহান আর সিয়া। দু’জনেরই ইচ্ছে করছে কাঁশফুল গুলো ছুঁয়ে দিতে। আহান আদিবার কানে কানে ফিসফিস করে বলে “আমরা যাচ্ছি, তুমি আসলে আসো আর না আসলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে আমার।”
আদিবা ঢুক গিলে আর আমতা আমতা করে বলে “ক কী ব ব্যবস্থা?”
“দেখতে চাও?”
“উঁহু, বলুন শুনি।”
“কোলে করে নিয়ে যাবো।”
আহান এটা বলতেই আদিবা নিজে নিজে গাড়ি থেকে নেমে যায়। গাড়ি থেকে নেমে আদিবা বলে “থাকো তোমরা বাপ বেটি, আমি তোমাদের আগে চলে যাবো কাঁশফুল বাগানে।”
আদিবা এটা বলেই হাঁটতে লাগলো। কাঁশফুল বাগান টা রাস্তা থেকে একটু দূরে তাই কয়েক পা হেঁটেই যেতে হবে। আহান দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা ধরে আদিবার সাথে পা মিলিয়ে। আহানের কোলে সিয়া। হাঁটতে হাঁটতেই আহান বলে “জানো এই সময়গুলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। এই মুহুর্তগুলো সারাজীবন বুকে জড়িয়ে রাখবো আমি।”
আদিবা কিছু বলেনা। চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করে সবসময় আদিবা। আহান একটু একটু কথা বলতে চাই আদিবার সাথে কিন্তু আদিবা প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা কথা বলেনা।

ওরা তিনজন অনেক আনন্দ করতেছে কাশফুল বাগানে। সিয়া বিভিন্ন ভঙ্গিমা করছে আর সেগুলো ক্যামরাবন্ধি করছে আহান। সময়টা ধরে রাখা অসম্ভব হলেও স্মৃতি গুলো সহজেই বন্ধি করা যায়।

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে আসে ওদের। পথে রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়া সেরে এসেছে তাই এসেই ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আদিবা। সিয়া আদিবার সাথে ঘুমালেও ওর আগে ঘুম থেকে উঠে যায়। সিয়া ঘুম থেকে উঠে দেখে আদিবা ঘুমিয়ে আছে, পুরো রুম খোঁজেও আহানকে না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সিয়া। ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সিয়া। সাইমন অফিস থেকে ফিরেছে। নিজের রুমের দিকে এগুতেই সিয়াকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় সাইমন। সিয়া গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে সাইমনের দিকে। মুখে মিষ্টি হাঁসি লেগেই আছে ছোট্ট পরীটার। সাইমন দুই পা সামনে এগিয়ে সিয়াকে বলে “এতো চেনা চেনা কেনো লাগছে তোমায় ছোট্ট পরী? কে তুমি?”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়। গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।