শুকনো পাতার বৃষ্টি পর্ব-১১

0
354

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি [১১]
#ফারজানা_আক্তার

একটু একটু করে পৃথিবীকে আলোকিত করে সূর্যোদয় হচ্ছে। চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে পাখির কলকল শব্দ। সকালে কুয়াশায় ঘেরা থাকলেও পৃথিবী গরম দিনের বেলা কিন্তু ভ্যাবসা পরতেছে। জানালার কাছে বসে প্রকৃতি উপভোগ করছে সানিয়া। এতোদিন হয়ে গেলেও সেই অপরিচিত কন্ঠের মানুষটাকে খোঁজে পাওয়া গেলোনা এখনো। সবার অজান্তে সানিয়া প্রায় কয়েকবারই হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছে কিন্তু তার নামটাও জানতে পারলোনা। মনটা বড্ড ছটপট করছে। শূন্য লাগছে চারপাশ। সাইমন শুয়ে শুয়ে সব দেখতেছে সানিয়ার অবস্থা। সাইমনের আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে তার স্ত্রী প্রেমে পরেছে কিন্তু কার প্রেমে এতোটা আনমনা হচ্ছে সে দিনদিন। ভাবছে সাইমন।
চার বছর সংসার করেও দুজনের মনে দুজনের জন্য কোনো প্রেমের ফুল ফুটেনি। সাইমনের মনের সবটা জুড়ে এখনো আদিবার বসবাস। এখনো আদিবাকে অনুভব করে সাইমন যদিও পাঁচবছর আগে তা উপলব্ধি করতে পারেনি কিন্তু আজ ভীষণ আফসোস হচ্ছে। কাছে থাকলে কেউই বুঝেনা কিন্তু দূরে গেলে ঠিকই গুরুত্ব বুঝে। সাইমনের সাথেও ঠিক এমনটাই হয়েছে। আজ বড্ড বেশি মনে হচ্ছে সেসময় খালেদা খাতুনের কথার গুরুত্ব না দিলে হয়তো আদিবা আর সিয়া ওর বুকেই থাকতো আজ। কষ্টগুলো যেনো ঘূর্ণিঝড়ের মতো বইছে শরীরে।
সানিয়া ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সাইমনকে বলে “কিছু কি লাগবে আপনার?”
সাইমন মুখে কোনো কথা বলেনা শুধু না সূচক মাথা দুলাই। তারপর সানিয়া ছাঁদের দিকে পা বাড়ায়। সকালের ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস গায়ে না মাখলে যেনো সকালই শুরু হয়না সানিয়ার। সানিয়া ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির পাশে যেই রেস্তোরাঁ খুলেছে নতুন সেই রেস্তোরাঁ টা ছাঁদ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সানিয়া এক নজরে তাকিয়ে আছে সেই রেস্তোরাঁর ছাঁদের পানে। রেস্তোরাঁর ছাঁদ টা দারুণভাবে সাজানো হয়েছে, দেখে মন হচ্ছে যেনো বিয়ে বাড়ি। সানিয়া শুনেছিলো এই রেস্তোরাঁর ছাঁদে সবসময়ই বার্থডে, বিবাহ বার্ষিকী, আকদ্ এবং বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এই রেস্তোরাঁয় যাওয়ার বড্ড স্বাদ জাগে সানিয়ার মনে প্রাণে।

*
আহান বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো। সিয়া এখনো ঘুমে। আহানের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে আদিবা। দু’জনের মুখেই কোনো কথা নেই। দু’জনই সকালের নামাযের পর আর ঘুমাইনি। কিভাবে রাতের অন্ধকার কাটিয়ে দিনের আলো ফুটে সেই দৃশ্য একসাথে উপভোগ করবে বলে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ভালোবাসার মানুষের সাথে সময় কীভাবে ফুরিয়ে যায় দ্রুত তা বলা মুশকিল। সুন্দর মুহুর্ত গুলো বেশি সময় স্থায়ি থাকেনা। সকাল হয়ে এসেছে। রোদ চিক চিক করছে চারদিকে। আদিবা বলে উঠে “আপনি বসুন আমি দেখি সিয়া উঠলো কিনা।”
আহান কিছু বললো না। আহানের মনে ভয় বাসা বেঁধেছে। সে আর সত্যি টা গোপন করতে পারছেনা আদিবার কাছ থেকে। নিজেকে কেমন জানি অপরাধী মনে হচ্ছে আহানের। সত্যি টা জানার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আদিবার। কিন্তু আদিবাকে সত্য টা বলার সাহস হচ্ছে না আহানের। যদি আদিবা ওকে ছেড়ে চলে যায়। আদিবাকে আর সিয়াকে ছাড়া যে দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাবে সে।

খাবার টেবিলে বসে নাস্তা করছে সবাই। আজ আফিয়া সবার সাথে নাস্তা করতে বসেছে। আফিয়ার মুখে মিটিমিটি হাসি যা দেখে গা জ্ব’লে যাচ্ছে সানিয়ার। আদিবাও ভাবছে আফিয়ার মুখের এই হাসির রহস্যের কথা। আহানের এতোদিকে খেয়াল নেই। সে নিজের মতো করে নাস্তা করছে আর সিয়াকেও খাইয়ে দিচ্ছে। খালেদা খাতুন আদিবার দিকে অ’গ্নি দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বারংবার। সুযোগ পেলে এখনই যেনো খু’ন করতেন তিনি আদিবাকে। সাইমন আজ একটু সুস্থ আছে তাই সেও আসছে সবার সাথে নাস্তা করতে। সাইমন আসলে আফজাল খান খুশি হয়ে নিজের পাশেই ওকে বসতে দেন। আদিবার সোজাসুজি হয়ে বসে সাইমন। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে আদিবার। আফিয়া সাইমনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দুষ্টু হাসে যা সাইমন দেখেও না দেখার ভান করে। খাওয়ার মাঝখানেই সানিয়া সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে আজ দুপুরের খাবার সবাই বাড়ির পাশের সেই “স্নেহময় মা” রেস্তোরাঁয় খাবে। সবাই ওর কথা মতামত দিলেও খালেদা খাতুন স্পষ্ট বলে দেন উনি যাবেননা। কেউ আর জোর করেননি উনাকে শুধু আফজাল খান একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন না যাওয়ার কারণ কিন্তু খালেদা খাতুন কোনো উত্তর করেননি।

দুপুর ১ঃ৩০। সবাই বসে আছে “স্নেহময় মা” রেস্তোরাঁয়। খাবার অর্ডার করা হয়েছে। আহান আদিবা সিয়া সাইমন আর সানিয়া এসেছে। খালেদা খাতুন আসেননি তাই আফজাল খানও আসেননি। আর আফিয়াকে কেউ সেধেও চাইনি তাই খুব রেগেমেগে সকালে নাস্তার টেবিলে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সে।
খাবার আসতেই সিয়া খুব উত্তেজিত হয়ে পরে খাবার খাওয়ার জন্য। আহান খুব যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে সিয়াকে যা দেখে য’ন্ত্র’ণা’য় বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে সাইমনের। নিজের সন্তানকে চোখের সামনে দেখেও ছুঁয়ে দেখতে না পারার মতো য’ন্ত্র’ণা কি হতে পারে আর।
সবাই খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিয়েছে কিন্তু সানিয়া শুধু আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। পুরো রেস্তোরাঁ টা খুব গুছানো। দেখতে একদম নিদারুণ। সানিয়া চেয়ে চেয়ে দেখছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। সানিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে তুলতে যাবে তখনই সেই পরিচিত কন্ঠস্বর টা আবার শুনতে পেলো। অস্থির হয়ে চারপাশ চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলো কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলোনা। সাইমন জিজ্ঞেস করলে বলে রেস্তোরাঁর সাজগোজ দেখছিলো আর কিছুনা।
একটু দূরেই সাইমন দেখতে পেলো সেদিনের সেই ছেলেটাকে যে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। সাইমন ছেলেটাকে দেখে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলো সেই ছেলেটার দিকে। ছেলেটার সাথে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার পর পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য খাবার টেবিলের সামনে নিয়ে আসলো তাকে। সানিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে খাবার খাচ্ছিলো। ছেলেটা আহানকে সালাম দিতেই চট করে চোখ তুলে তাকায় সানিয়া ওর দিকে। সানিয়ার সাথে ছেলেটাও অবাক। সানিয়ার চোখে জল টলমল করছে। ছেলেটার চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছে কিছুটা। সানিয়া বসা থেকে দাঁড়িয়ে ছেলেটার চোখে চোখ রেখে বলে উঠে “মিনহাজ তুমি??? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে হুট করে? কত খুঁজেছি জানো তোমায়? ১৫দিন পর কলেজে গিয়ে যখন শুনলাম তুমি সাতদিন আগে থেকেই কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছো তখন পাগলের মতো এদিক সেদিক খুঁজেছি তোমায়। জানো সেদিন প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমি যে তোমায় ভা…..।”
এইটুকু কথা বলেই ঢুক গিলে ফেলে সানিয়া। সাইমন আহান আদিবা অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামিয়ার দিকে। মিনহাজ নিজেকে কন্ট্রোল করে শান্তভাবে বলে “শুনেছিলাম বিয়ে করেছো তুমি। তারপর আর ওই কলেজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম নাহ তাই অন্য কলেজে চলে গিয়েছিলাম। এভাবে চারবছর পর হুট করে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি কখনো। যাইহোক বাদ দাও সময় গরিয়েছে, সবকিছু বদলে গেছে। তোমার স্বামী কোথায়?”
সানিয়া কিছু বলতে পারছেনা কান্নার জন্য। চারবছরের জমানো কান্না যেনো সব একসাথেই কাঁদতেছে। সানিয়ার কান্না মিনহাজের সহ্য হচ্ছে না আবার বুকেও জড়িয়ে নিতে পারছেনা পাগলীটাকে। দু’জনের মনেই অদ্ভুত রকমের কষ্ট হতে লাগলো। সানিয়া লোনা জলে সব কষ্ট প্রকাশ করতে পারলেও মিনহাজ পারছেনা। মিনহাজের বুকটা বড্ড বেশি ভার হয়ে আছে। হতভম্ব হয়ে সবকিছু দেখছে সাইমন আহান আদিবা। খানিক বাদে আদিবা শান্ত করার চেষ্টা করে সানিয়াকে। কিছুটা স্বাভাবিক হয় সানিয়া। মিনহাজ জানতে পারে সেদিন যার জীবন সে বাঁচিয়েছে সেই মানুষটাই তার ভালোবাসার মানুষটার জীবনসঙ্গী। সানিয়ার মুখে হাসি নেই আর সাইমনের মনে অশান্তির ঝ’ড় বইছে। সাইমন বেশ বুঝতে পারছে এই ছেলের জন্যই চারবছর ধরে সানিয়া তাকে স্বামীর অধিকার দিতে পারেনি। সাইমন ঠিক করে বাসায় গিয়েই এই বিষয়ে কথা বলবে সানিয়ার সাথে সে। জীবনের চারটা বছর নষ্ট হয়েই গেছে। এভাবে বেঁচে থাকা যায়না। বাঁচতে হলে অক্সিজেনের সাথে মানসিক সুখ শান্তিরও প্রয়োজন হয়।
ওরা খাবার খেয়ে বিল পরিশোধ করতে গেলে মিনহাজ বলে লাগবেনা। এতে সবাই একটু অবাক হয়। তারপর মিনহাজ সবার উদ্দেশ্যে বলে এটা তার রেস্তোরাঁ। ওর মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার জন্যই এই রেস্তোরাঁ বানিয়েছে সে। আর এটা ওর মায়ের সম্পদ। ওর মায়ের স্বপ্ন সানিয়া বেশ অবাক হয়। তার ভালোবাসার মানুষটি তার এতো কাছে ছিলো তবুও সে এতদিন তাকে খুঁজে পেলোনা। এই কারণেই হয়তো এই রেস্তোরাঁর প্রতি তার এতো অনুভূতির সৃষ্টি। আহান মিনহাজকে বলে কোনো একদিন সময় করে তাদের বাসায় গিয়ে ঘুরে আসার জন্য। তারপর তারা বেরিয়ে পরে সেখান থেকে কিন্তু সানিয়া আর মিনহাজ চোখ সরাতে পারছিলোনা একে অপরের দিক থেকে। সানিয়ার মনে হচ্ছিলো সে তার আত্মাটা রেখে আসছে বুঝি ওখানে।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।