শুকনো পাতার বৃষ্টি পর্ব-০৭

0
334

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি [০৭]
#ফারজানা_আক্তার

কি সম্পর্ক মানে? সাইমন তোমার স্বামী হলে আমার নন্দাই হবে, এটাই তো সম্পর্ক তাইনা?
খানিকটা চিন্তা করে বলে আদিবা।

“ওও এই কথা তাহলে। যদি এটাই আসল কথা হয়ে থাকে তাহলে চিন্তা করে কেনো বলতে হলো তোমায় কথাটা? হুট করেও তো বলে দিতে পারতে।”
“তুমি হঠাৎ করে এমন অদ্ভুত ভাবে কথা বলতেছো কেনো বুঝলাম না। আর এসব কেমন সন্দেহ জনক প্রশ্ন করতেছো তুমি আমায়?”
কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে আদিবা। সানিয়ার রাগ হচ্ছে এই মুহুর্তে আদিবার উপর কারণ সানিয়া বেশ বুঝতে পারছে যে আদিবা কথা লুকানোর চেষ্টা করছে। সানিয়া রাগান্বিত কন্ঠে বলে “তুমি কেনো সিয়াকে সাইমনের সাথে খেলতে নিষেধাজ্ঞা করেছো? আর এটা শোনে সাইমন কেনো রেগে চলে গেলো? আছে তোমার কাছে এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর?”
“হ্যাঁ আছে উত্তর? সাইমন কেনো রেগেছে তা আমার জানা নেই আর সিয়াকে আমি সাইমনের সাথে খেলতে নিষেধাজ্ঞা করিনি আমি শুধু সিয়াকে বলেছি যেনো অপরিচিত কারো সাথে যেনো সে না মিশে না খেলে। সাইমনকে হঠাৎ দেখে চিনতে না পেরে হয়তো সিয়া আমার বলা কথাটা বলেছে। সব কথা স্পষ্ট ভাবে না জেনেশোনে এভাবে সন্দেহ করা উচিত হয়নি তোমার।”
কথাগুলো বলেই আদিবা ডাইনিংয়ে চলে যায়। ভয়ে এখনো কাঁপছে আদিবার পুরো শরীর। সানিয়ার খুব লজ্জা লাগছে, সবটা না জেনে এভাবে ভাবিকে সন্দেহ করার জন্য কিন্তু সাইমনের ওভাবে রেগে যাওয়াটা সন্দেহের সৃষ্টি করতেছে সানিয়ার মনে বারংবার। সানিয়া আদিবার কথা বিশ্বাস করবে কিনা সেটাও ভাবতেছে।

খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে যাওয়ার সময় সানিয়া আদিবাকে বলে “ভাবি একটু আমার রুমে আসবে প্লিজ।”
আদিবা সিয়াকে নিয়ে রুমে যেতে বলে আহান কে। আহান চলে যায় রুমে কিন্তু সানিয়া হঠাৎ আদিবাকে রুমে ডাকলো কেনো সেই বিষয়টা ভাবাচ্ছে আহানকে।
সানিয়া হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে যায় আদিবাকে। আদিবাকে বিছানায় বসতে দিয়ে সানিয়া বলে “ভাবি সরি ওইসময় শুধু শুধু সন্দেহ করেছিলাম বলে। ক্ষমা করবে তো এই ছোট বোনটাকে।?”
বেশ নরম কন্ঠে বলে সানিয়া কথাটা।
আদিবা সানিয়ার হাতজোড়া ধরে বলে “এমা কি বলতেছো এসব তুমি? তোমার সন্দেহ করা টা হয়তো স্বাভাবিক ছিলো। কিছু মনে করিনি আমি।”
সানিয়া মিষ্টি করে একটা হাসি দেয়।
আরো কিছুক্ষণ খোশগল্প করে আদিবা পা বাড়ায় নিজের রুমের পানে। হঠাৎ করে কেনো জানি সানিয়াকে দেখলেই কষ্ট হচ্ছে আদিবার, মনে পরে যাচ্ছে সাইমনের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত। সানিয়াকে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না আদিবার তবুও তা প্রকাশ করতে পারবেনা এই মুহুর্তে আদিবা। আদিবা সব সত্যি না জানলেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারতেছে খালেদা খাতুনের কথার ধরণে। আদিবার কেনো জানি বারংবার মনে হচ্ছে ওর সুখের নীড়ে সানিয়ার বি’ষা’ক্ত প্রবেশ পরেছিলো। যদিও এসব কিছুই এখনো স্পষ্ট নয় আদিবার কাছে, শুধুমাত্র ধারণা করতেছে ও এসব।
আদিবা আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রবেশ করে নিজের রুমে।
আহান সিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছিলো আদিবার জন্য। আদিবা আসতেই আহান প্রশ্ন ছুঁড়ে ওর পানে “সানিয়া কেনো ওর রুমে নিয়ে গেলো তোমায়? কি চলছে এসব ঘরে? একবার মা ডেনে নিয়ে যায় অন্যবার সানিয়া। কি চলছে বলবে একটু?”
“এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেনো আপনি? মেয়েদের কত পার্সোনাল কথা থাকে সব কি বলা যায় পুরুষদের? ঘুমান এখন, আমারও বেশ ঘুম পাচ্ছে। ”
এটা বলেই আদিবা শুইয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে দ্রুত। নয়তো যে আহান সব কথা বের করে ফেলবে তার পেট থেকে। আহান সব জানলে অনেক সমস্যা হয়ে যাবে এই ঘরে। আদিবা চাইনা তার বিয়ের একমাস না গড়াতেই এসব ঝামেলায় পরুক আহান।
আদিবার এমন অস্পষ্ট কথায় খুব বেশি রাগ হচ্ছে আহানের তবুও সে চুপচাপ শুয়ে পরে। কারণ সে জানে আদিবার সাথে কথা বলে কোনো লাভ নাই এখন। আদিবা সহজে কোনো কথায় বলেনা স্পষ্ট ভাবে যা আহান প্রথম থেকেই জানে।

*
সানিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেলকনি দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি আসলেই সানিয়া পুরোনো স্মৃতিতে মেতে উঠে খুব করে কিন্তু তার সাথে নিয়ে আসে একরাশ হতাশা। চারবছর আগেই সানিয়ার জীবন সুন্দর ছিলো, এটা ভেবেই বেশ আফসোস করে সানিয়া। এই বৃষ্টি মুখর দিনেই সানিয়ার দেখা হয়ছিলো মিনহাজ নামের এক ছেলের সাথে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্বও হয়ছিলো তাদের। কিন্তু সম্পর্ক টা বন্ধুত্ব থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো যদিও দু’জনই দু’জনের প্রতি দূর্বল ছিলো কিন্তু কেউ কারো কাছে সেটা প্রকাশ করার সুযোগ পাইনি। ভালোবাসা শুরু হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু কারো সামনে কেউ সেটা প্রকাশ করতে পারেনি তার আগেই খালেদা খাতুন ইমোশনাল ব্ল্যা’ক’মে’ই’ল করে সাইমনের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় সানিয়াকে। সানিয়াকে এই বিয়েতে রাজি করতে একবছর সময় লেগেছে খালেদা খাতুনের। খালেদা খাতুন বলেছিলেন সানিয়া এই বিয়ে না করলে উনি নিজেকে শেষ করে ফেলবেন কিন্তু সানিয়া এখনো জানতে পারেনি যে তার মা এটা শুধু মাত্র অভিনয় করেছিলেন।
সানিয়া মিনহাজের কথা ভেবে নিজে নিজে মিষ্টি হাঁসে। ইদানীং মনে হয় মিনহাজ শুধুই তার কল্পনা। কখনো বাস্তব হতে পারবেনা মিনহাজ আর তার জীবনে। চার বছর ধরে কোনো যোগাযোগ হয়নি আর মিনহাজের সাথে। তবুও মনের কোনো এক কোণে রয়ে গেছে মিনহাজ নামটি। ভালোবাসা হয়তো এমনই। যুগ যুগ ধরে যোগাযোগ না হলেও বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা কমেনা হৃদপিণ্ড থেকে। ভালোবাসার অনুভূতিটাই অদ্ভুত রকমের। ভালোবাসার মানুষ জীবন জোড়ে থাকুক বা না থাকুক ভালোবাসা থেকেই যায়।
হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে সানিয়া কেঁপে উঠে। ভাবনার মাঝে হঠাৎ এমন শব্দ একদমই পছন্দ না সানিয়ার। সানিয়া ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়। সাইমন কল করেছে। এই মানুষটাকে যতই ইগ্নোর করছে ততই যেনো মানুষটা ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখতে চাইছে। কল রিসিভ করেই সানিয়া বলে “কেনো কল দিয়েছেন? এখন কি ঘুমাতেও দিবেননা নাকি?”
“রেগে যাও কেনো সবসময়ই? বিয়ের চার বছরেও তুমি স্বামী মানতে পারোনি আমায় তবুও সব মেনে নিয়েছি কিন্তু আর নয় এবার ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিতে চাই আমি।”
সানিয়া অবাক হয়, কিছুটা নরম কন্ঠে বলে “মানে? কেমন সিদ্ধান্ত?”
“দেখো সানিয়া আমি স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করি। আমি কোনো কথা অস্পষ্ট রাখতে পারিনা তাই সরাসরিই বলছি আমার বাচ্চা লাগবে, তুমি আমায় বাচ্চা দিলে দিবে নয়তো ডিভোর্স। আগামীকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দিলাম তোমায়। সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জানিয়ে দিও আমায়। তুমি ডিভোর্স দিবে বললে আমি ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো যাবোনা ওই বাড়িতে আর কখনো। আর যদি বাচ্চা নিতে চাও তবে আলহামদুলিল্লাহ। নতুন করে সংসার শুরু করবো আমরা।”
কথাটা বলেই কল কেটে দেয় সাইমন। রোবটের মতো শক্ত হয়ে কানে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সানিয়া। হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো মানুষটার? কেনো এমন ভাবে কথা বলছে ও? এসব ভাবতে একদম ভালো লাগছেনা সানিয়ার। নিজের অজান্তেই চোখের জল গড়িয়ে পরে সানিয়ার গাল বেয়ে। চারটা বছর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো যে মানুষটার সাথে সেই মানুষের এমন আচরণ সহ্য করতে পারছেনা সে। বিয়ের চার বছরে কখনো সাইমন জোর করে ওকে টাচ করেনি যদিও ওর সম্পূর্ণ অধিকার ছিলো আর সেই মানুষ কিনা সরাসরি ডিভোর্সে চলে গেলো। সানিয়া ডিভোর্স এর কথা ভাবতেই খালেদা খাতুনের চেহারা ভেসে উঠে ওর চোখে বারেবারে। সি সিদ্ধান্ত নিবে ভাবতে থাকে আর চোখের জল ফেলতে থাকে সানিয়া।
আর অন্যদিকে সাইমন বসে বসে একটানা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। খালেদা খাতুনের কথাতেই সে সানিয়াকে এসব বলতে বাধ্য হয়েছে। সাইমন জানে খালেদা খাতুন সানিয়াকে কখনোই ডিভোর্সের মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দিবেনা। কিন্তু সাইমনের মনের কোণায় এখনো আদিবার স্মৃতি রয়ে গেছে কিছুটা।
সাইমনের কেনো জানি আজ একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে। নিজের সন্তানকে চোখের সামনে পেয়েও কোলে তুলে নিতে না পারা, আদর করতে না পারা, ছুঁয়ে দেখতে না পারা যে কতটা কষ্টের তা একমাত্র সেই মানুষটাই বুঝে যার সাথে এসব ঘটে।

*
সকালের নামায পড়ে আদিবা কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করে আবারো শুয়ে পরেছিলো। আহানের চোখ লেগে এসেছে নামাযের পর।
হঠাৎ সকাল ৭টার দিকে ড্রয়িংরুম থেকে চিৎকার চেঁচামেঁচির শব্দ ভেসে আসে আদিবার কর্ণকুহরে। আদিবা উঠে বসে শোয়া থেকে। কান লাগিয়ে শুনতে থাকে কি হচ্ছে ড্রয়িংরুমে কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা সে। পরে কোনো পথ না পেয়ে আহানকে ডেকে বলে “শুনুন একটু দেখে আসুননা উঠে ড্রয়িংরুমে কিসের চেঁচামেঁচি হচ্ছে এসব। মনে হচ্ছে কোনো ঝামেলা হয়েছে।”
আহান উঠে বসে ভালো করে খেয়াল করে দেখে, আদিবার কথায় সত্য। ঘরে ঝামেলা হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে। আহান দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে এগিয়ে যায় ড্রয়িংরুমের দিকে। আদিবাও পেঁছন পেঁছন যায় আহানের।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।