শুকনো পাতার বৃষ্টি পর্ব-০৯

0
324

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি [০৯]
#ফারজানা_আক্তার

বি’ষা’ক্ত লাগছে চারপাশ সানিয়ার। অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা আসছে মনে। সকালের নাস্তা খাওয়ার পর সানিয়া নিজের রুমে বসে ছিলো, অপেক্ষায় ছিলো সাইমনের। সাইমন ফোন করে জানিয়েছে সে অফিসের কাজ শেষ করে ফিরবে বিকালের দিকে। সানিয়ার স্পন্দন যেনো বেড়ে চলেছে যত সময় গড়াচ্ছে। সানিয়া এখনো ভাবতেছে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলো তো সে? নাকি আফিয়ার উপর রেগে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো? রাগ সবসময়ই বিপদের মুখে ঠেলে দেয় আমাদের। রাগ খুব খারাপ জিনিস। রাগের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্ত কখনোই সঠিক হতে পারেনা। কি করবে এখন সানিয়া বুঝতে পারছেনা, এইদিকে সাইমনকে বলে দিয়েছে সে বাচ্চা নিতে রাজি। সবকিছু অসহ্য লাগছে সানিয়ার কাছে। মিনহাজের কথা মনে পরতেছে কিন্তু মিনহাজ তো ওর জীবনের টুকরো অংশ মাত্র। মিনহাজের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই বিয়ের পর থেকে। কোথায় আছে মিনহাজ তাও জানা নেয় সানিয়ার। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে সানিয়ার। মনে মনে দোয়া করতেছে আল্লাহর কাছে সাইমন যাতে আজ না আসে।

*
আফিয়া নিজের রুমে বসে বসে কিছু একটা ভাবছে। আহান চলে গেছে অফিসে। আদিবা ঘরে একা। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনা আফিয়া। আফিয়া পরিকল্পনা করছে কিভাবে আদিবাকে আহানের জীবন থেকে সরানো যায়। তখনই আফিয়ার রুমে প্রবেশ করে খালেদা খাতুন। খালেদা খাতুন কে দেখে মুখটা মলিন করে ফেলে আফিয়া। আফিয়া এই মুহুর্তে খালেদা খাতুনের সামনে নিজেকে খুব অসহায় ভাবে উপস্থিত করতে চাই যাতে উনি আদিবাকে বের করে দেয় বাসা থেকে কিন্তু আফিয়ার অজানা খালেদা খাতুনের হাতে কিছুই নেই এখন কারণ আদিবাকে আফজাল খান পছন্দ করেন খুব।
আফিয়া মুখটা মলিন করেই খালেদা খাতুনের পানে চেয়ে বলে “ফুফি খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি কিছুতেই ওই আদিবাকে সহ্য করতে পারছিনা।”
খালেদা খাতুন বলেন “চিন্তা করিস না মা। আমি থাকতে তোর জায়গা কেউ দখল করতে পারবেনা।”
খালেদা খাতুন কথাটি বলে না থামতেই পেঁছন থেকে আদিবা বলে উঠে “আমি কারো জায়গা দখল করিনি মা। আমি নিজে নিজেও আসিনি। আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি আমার জায়গায় আছি এটা কেউ মানতে না পারুক বা আমাকে কেউ সহ্য করতে না পারলে তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। সিয়ার বন্ধু আমাকে ভালোবেসে আর এটাই আমার শক্তি।”

“তোর সাহস কি করে হয় আমার রুমে আসার? তোকে তো আজকেই খু’ন করবো আমি। তুই সব কেঁড়ে নিয়েছিস আমার।”
খুব উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে আফিয়া ছুটে যায় আদিবার কাছে। আদিবাকে স্পর্শ করার আগেই আদিবা থা’প্প’ড় লাগিয়ে দেয় আফিয়ার বাম গালে। আর ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে “একদম কাছে আসবেনা জ্ব’লে পু’ড়ে ছাই হয়ে যাবে। মোটেও আমাকে পানি ভেবে ভুল করবেনা না, আমি অ’গ্নি বুঝতে পেরেছো? কথায় কথায় যেভাবে মানুষের গায়ে হাত তুলতে এগিয়ে যাও এতে বুঝাই যায় কেমন তোমার পরিবার আর কেমন তোমার শিক্ষা সাথে আচরণ তো আছেই। অ’স’ভ্য একটা মেয়ে লজ্জা করছেনা অন্যের সংসার ভা’ঙ্গ’তে আসছো? সাবধান করে যাচ্ছি তোমায় আমার সংসারে নজর দিবেনা, ফল কিন্তু ভালো হবেনা।”
আফিয়া গালে হাত দিয়ে র’ক্তি’ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিবার দিকে। আদিবা কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলেই খালেদা খাতুন বলে উঠে “ডিভোর্সি মেয়ের মুখে পরিবার শিক্ষা আর আচরণের কথা মানায় না। তোমার নিজেরই যদি শিক্ষা ভালো হতো তাহলে ডিভোর্স হলো কেনো তোমার?”
আদিবা এবার আর চুপ থাকলোনা। এদের সাথে অস্পষ্ট থাকা চলবেনা নয়তো আবারো সংসার ভা’ঙ্গা’র মতো য’ন্ত্র’ণা সহ্য করতে হবে ওকে। আদিবা দাঁতে দাঁত চেপে ধীর কণ্ঠে বলে “আমার আগের সংসার কার দ্বারা ভে’ঙ্গে’ছে এবং কে নিজের স্বার্থের জন্য ষ’ড়’যন্ত্র করেছে সব কিন্তু আপনি আর আমি জানি খুব ভালো করেই। দয়া করে আমার মুখ খুলবেননা সবার সামনে। নয়তো পরে নিজের সংসার নিয়েও টানাটানি করতে হবে আপনাকে।”

“এই মেয়ে কি বলছিস তুই এসব আমার ফুফিকে। ফুফি তুমি কিছু বলছোনা কেনো এই মেয়ে আজেবাজে কথা বলছে তোমায় এতো।”
মেজাজ দেখিয়ে বলে উঠে আফিয়া। থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনমনা হয়ে খালেদা খাতুন। ভাবছে খালেদা খাতুন “কি বলছে এই মেয়ে এসব?” কপাল ঘামছে। হাত পা কাঁপছে।
আদিবা আফিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে “কি বলবে তোমার ফুফি আর? ফেঁসে গেছো তোমরা নিজের পাতানো জালে। দেখো কেমন করে কাঁপছে তোমার ফুফি।”
এটা বলেই আদিবা সেই স্থান ত্যা’গ করে। ধপাস করে বসে পরে খালেদা খাতুন। সাইমনের কানে সব গেলে উনার খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, সানিয়া শেষ হয়ে যাবে মুহুর্তে এসব ভেবেই থরথর করে কাঁপছে শরীর। আফিয়া কিছু বুঝতে পারছেনা। খালেদা খাতুন বিড়বিড় করে বলে উঠে “নাহ, আমার এতোদিনের লুকানো সত্য এভাবে প্রকাশ পেতে পারেনা। আমি এটা কিছুতেই হতে দিবোনা।”
“ফুফি কি বিড়বিড় করছো এসব তুমি?”
আফিয়ার কথায় লাফিয়ে উঠে খালেদা খাতুন। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে খালেদা খাতুন আফিয়াকে বলে “তুই চলে যা মা এখান থেকে। আ… আ.. আমি কথা দিচ্ছি। আদিবাকে আমিই তোর রাস্তা থেকে সরাবো। শুধু তুই এখন চলে যা এখান থেকে প্লিজ।”
খালেদা খাতুনের এমন অনুরোধ কিছুতেই রাখতে পারবেনা বলে দিলো মুখের উপর আফিয়া। খালেদা খাতুন বুঝে গেছে আফিয়াকে আটকানো উনার পক্ষে সম্ভব না। যেমন ফুফি তেমন ভাতিজি। র’ক্ত র’ক্তে’র মতোই হয়েছে। যতক্ষণ না চাওয়ার জিনিসটা পাবে ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। খালেদা খাতুন আফিয়াকে আর কিছু না বলে চলে গেলো নিজের রুমে।

*
সিয়া বেলকনিতে বসে বসে খেলছে। আদিবা মেয়ের খেলা দেখছে বসে বসে আর উপভোগ করছে মৃদু বাতাস। আহান অনেক রকমের খেলনা এনেছে সিয়ার জন্য সেসব দিয়েই খেলছে সিয়া।
আদিবা ডুব দেয় একটু আগে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর ভাবনায়। আদিবা শুধুমাত্র খালেদা খাতুনের হাবভাব বোঝার জন্যই কথাটা বলেছে কিন্তু সে মোটেও জানতোনা সত্যি সত্যিই খালেদা খাতুন এভাবে রিয়েক্ট করবে। খালেদা খাতুনের শরীরের ঘাম আর কাঁপুনি দেখে আদিবা বুঝে নিয়েছে যে ওর জীবনের অতীত জোড়ে এই মহিলার ছায়া রয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছেনা আদিবা কিভাবে সব সত্যি সবার সামনে প্রমাণ করবে সে। খালেদা খাতুন মহিলাটা বড্ড রহস্যময়, সহজে কিছুই প্রমাণ করা যাবেনা। আদিবা মনে মনে ভাবে যেভাবেই হোক শুকনো পাতার বৃষ্টি ওকে এই বসন্তেই ঝড়াতে হবে। সিয়া খেলা করতে করতে হঠাৎ কান্না করে দেয়। সিয়ার কান্নায় ধ্যান ভাং’গে আদিবার। আদিবা দ্রুত কোলে তুলে নেয় সিয়াকে। আদিবা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতেই সিয়া ফ্যাঁকফ্যাঁক করে কাঁদতে কাঁদতে বলে “আমার পুতুল পরে গেছে নিচে।”
বেলকনি দিয়ে পুতুল পরে গেছে নিচে। এটার জন্যই এভাবে কান্না করছে সিয়া। আদিবা হেঁসে ফেলে মেয়ের এমন মায়াবী কান্না দেখে। আদিবার হাসি দেখে সিয়ার বেশ অভিমান হয় তাই সিয়া ছোট ছোট চোখ করে মুখ ফুলিয়ে বলে “মাম্মাম তুমি খুব পঁচা।”
ঠোঁট উল্টিয়ে আদিবা বলে “কেনো আম্মু? মাম্মাম কি ফেলেছি তোমার পুতুল?”
“তাহলে তুমি হাসছো কেনো?”
সিয়াকে বুকে জড়িয়ে খুব আদুরে কন্ঠে আদিবা বলে “আমি হাসছি কারণ তোমার পুতুল পরে না গেলে কি আমার পুতুল আমার কোলে আসতো?”
আদিবার কথা শোনে ফিক করে হেঁসে ফেলে সিয়া।

সন্ধ্যায় আহান নিজের রুমে প্রবেশ করতেই দেখে সিয়া ঘুমে বিভোর আর তার পাশেই বসে বসে হুমায়ুন আহমেদ এর অপেক্ষা বইটা পড়তেছে আদিবা। আহান যে এসেছে সেইদিকে কোনো লক্ষ নেই আদিবার। আহান হালকা কেঁশে বলে উঠে “কেউ কি অপেক্ষা বই পড়তে পড়তে কারো জন্য অপেক্ষা করছে?”
আহানের কন্ঠ শুনে চমকে উঠে হঠাৎ করে আদিবা। আহান হাসতে হাসতে এসে আদিবার পাশে বসে। আদিবা হাতের বইটা রেখে পাশের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আহানের দিকে এগিয়ে দেয় মুচকি হাসির সাথে। আহান ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলে “জানো আজ সকালে এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও তোমাকে আমি এই ঘরে একা রেখে চলে গিয়েছি অফিসে। আর সারাদিন তোমার জন্য আমার একটুও চিন্তা হয়নি কারণ কি জানো?”
খুব নরম কন্ঠে আদিবা বলে “কেনো?”
“কারণ আমি জানি আমার বউটা খুব শক্ত ধাঁচের। অল্প আঁচড়ে তার কিছুই হবেনা। আর আফিয়া একটু চঞ্চল আর অহংকারী জেদি বে’য়া’দ’প হলেও ওর বুদ্ধি কম। মাথা মোটা একটা মেয়ে।”
আদিবা মুচকি হাসে। তৃষ্ণার্থভাবে দেখছে আদিবার হাসি আহান।
আদিবা বিছানার এক কোণে হেলান দিয়ে বসা ছিলো। আহান পা সোজা করে হুট করে আদিবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। আদিবা কিছু বলেনা, নরম হাতে আহানের চুল টেনে টেনে দিচ্ছে আর লজ্জায় কুটিকুটি হচ্ছে। বেশ আরাম পাচ্ছে আহান, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এমন একটা প্রিয় মানুষের ছোয়া বড্ড বেশি প্রয়োজন হয় মানুষের। ভালো না বাসলে কেউ বুঝতেই পারবেনা এই অনুভূতি গুলো। ভালোবাসা সত্যি নিদারুণ। আহান নেশালো কন্ঠে বলে উঠে “খুব বেশিই তৃষ্ণা পেয়েছে গো।”
বোকা কন্ঠে আদিবা বলে “এমা এখনই তো এক গ্লাস পানি ঢকঢক করেই খেলেন তবুও বুঝি তৃষ্ণা মিটলোনা? আরেক গ্লাস দিবো কি পানি নাকি ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে দিবো? বাহিরে গরম বেশি তো তাই হয়তো এতো বেশি খারাপ লাগছে আপনার।”
“হুসসস বেশি কথা বলো। এমনিতেই তো কাজের কথা জিজ্ঞেস করলে অস্পষ্ট বাদি হয়ে যাও আর এখন বুঝেও না বোঝার মতো হয়ে বকবক করে যাচ্ছো।”
“কি করলাম আবার আমি? আপনিই তো বললেন তৃষ্ণা পেয়েছে।”
“হুম পেয়েছে তৃষ্ণা। কিন্তু এই তৃষ্ণা মনের তৃষ্ণা। যে তৃষ্ণা তুমি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো কেউ পারবেনা মিটাতে।”
আদিবা চুপ হয়ে যায় একাবারে। আহানের মতিগতি ঠিক লাগছেনা দেখে আদিবা ইশারা দিয়ে সিয়াকে দেখিয়ে দেয়। আহান বলে আমার মেয়ে আমার মতোই, ঘুমালে কোনো হুস থাকেনা আর না ডাকা অব্ধি ঘুম থেকে উঠেওনা।”
এটা বলেই আহান আদিবার দিকে তাকায় অন্যরকম দৃষ্টিতে।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।