শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-০৩

0
201

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩|

প্রিয়র ঘুম ভাঙল নয়টার দিকে। স্বভাববশত ফোন হাতে তুলতেই নোটিফিকেশন প্যানেলের কিছু ম্যাসেজ সামনে এলো। প্রা-ক্ত-নে-র ইনবক্সের। ত্বরিতে কাল রাতের ঘটনাটা মনে পড়ল। তুমুল অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসে ম্যাসেজটা ওপেন করল।

-“আসলে বিয়েটা সাডেনলি হয়ে যাওয়ায় আর বলা হয়ে ওঠেনি। সে যাক, কিছু কথা আছে আপনার সাথে। যদি শুনতে চান, তো বলি..”

প্রিয় শুনতে চায় না। ইচ্ছে করছে ফোনটা ছুঁড়ে ভেঙে ফেলতে। তা না করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলো,
-“বলুন।”

সবসময় সমস্যা থেকে পালিয়ে বেরালে চলবে না। সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে সেই সমস্যাকে ফেইস করা। প্রিয় এখন সেটাই করবে।

ক্ষণিকের মধ্যে ওপাশ থেকে আবার ম্যাসেজ,
-“আপনি এখনও বাচ্চাই আছেন। ভাবলাম বাস্তবতা আপনাকে কিছুটা ম্যাচিওর অন্তত করবে। কিন্তু নাহ! যেই আপনি, সেই আপনিই আছেন। আর আমি? আমি আপনাকে কোনোদিনও ক্ষমা করব না।”

প্রিয় অবাক হচ্ছে। বিয়ের পর হুট করেই নক দিয়ে এসব কী বলছে? মানে কী চাইছে লোকটা? প্রিয় নিজেকে অত্যন্ত স্বাভাবিক দেখাতে গিয়ে বলল,
-“আর তাতে আমার খুব ছিঁড়ে গেল?”

-“আপনার ল্যাঙ্গুয়েজই বলে দিচ্ছে, আপনি কেমন মানুষের সাথে আছেন আর আপনার ফিউচারটা কী!”

-“আপনার চেয়ে বেটার আছে। ল্যাঙ্গুয়েজ, ফিউচার.. সব!”

-“যাক! আমার বউকে দেখেছেন? এখনও বুকে শুয়ে আছে। দেখতে আপনার মতো সুন্দরী নয়, কিন্তু আমার। আমি যা বলি, তাই শোনে। আমাকে ভালোবাসে। আর রাতে তো..উফ!”

প্রিয়র ঘেন্না লাগছে প্রচণ্ড। সে টাইপ করল,
-“স্বামী-স্ত্রীর সবকিছুই ভীষণ ব্যক্তিগত। আমি বাইরের মানুষ। এসব আমাকে বলার কী মানে?”

ম্যাসেজটায় হাহা রিয়্যাক্ট দিলো সে। তারপর লিখল,
-“আপনাকে কি আমি প্রাইভেট মোমেন্টের ভিডিয়ো দিয়েছি নাকি? আছে সেটাও। দেবো? আচ্ছা, দিচ্ছি।”

প্রিয় “আল্লাহ হাফেজ” লিখে তাকে ব্লক করতে গেল। তার আগে আরও কিছু ম্যাসেজ এলো,
-“আরে, আমার কথা শেষ হয়নি তো। যাস কই? যাবি না। শোন! আমি তোকে ক্ষমা করব না। আর তুইও শান্তি পাবি না। তুই মরতেও পারবি না। আজীবন আফসোস করবি।”

প্রিয় তা দেখল না। আলগোছে ব্লক অপশনে গিয়ে ব্লক করে দিলো। প্রিয় এখনও মানতে পারছে না। কতটা পরিবর্তন! মানুষ বুঝি এভাবেই পালটায়?

_____
সকালে অফিস আছে। এখন আর বিছানায় পড়ে থাকলে চলবে না। সারারাত ঘুমোতে না পারায় প্রিয়র চোখ দুটো লালচে হয়ে আছে। বেশ সময় ধরে শাওয়ার নিল। চোখে পানি দিলো বারংবার। রেডি হয়ে রুম থেকে বেরোতেই ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। সে প্রিয়কে দেখে এগিয়ে এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
-“মন খারাপ?”

প্রিয় সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
-“না তো।”
-“মিথ্যে বলবি না। চল, আজ শাহজাহান মামার তোকে ফুচকা খাওয়াব।”

প্রিয় ভীষণ অসহায় মুখ করে বলল,
-“একদমই সময় নেই, সরি!”
-“আচ্ছা যা। জলদি ফিরিস আজ, বেরোব।”

প্রিয় বেরোতে গেলেই ওর ভাই চোখ গরম করে আবারও ডেকে উঠল,
-“এই! খেয়ে যা। না খেয়ে এক কদম বেরোবি না।”

প্রিয় ডাইনিং টেবিল থেকে ব্রেড হাতে নিয়ে চিবাতে চিবাতে বলল,
-“আজই শেষবার! আর হবে না।”

ওকে আর কিছু বলতে না দিয়েই প্রিয় দৌড় লাগাল। আজ ড্রাইভার নিল না প্রিয়। ড্রাইভ করতে করতে ধানমন্ডি ১০ দিয়ে যাচ্ছিল, পাশের পানশী রেস্টুরেন্ট ক্রস করার সময় হুট করে আবারও তার মনে পড়ল সেই সাড়ে ছ’বছর আগের সংঘর্ষ; ৬৮টা টিউলিপের গল্প।

_____
অফিশিয়ালি প্রপোজ করেছে আজ শ্রেয়ান তাকে। রিলেশনশিপের ৬ মাস উপলক্ষে ট্রিট দিতে প্রিয়কে পানশীতে নিয়ে এসেছে সে। বেশ কিছুক্ষণ কথা-বার্তা শেষে হুট কতেই ৬৮টা টিউলিপ দিয়ে হাঁটু মুড়ে এত এত মানুষের দৃষ্টির মধ্যমণি হয়ে মেঝেতে বসে পড়ে বলেছে,
-“আল্লাহ চাইলে টেনেটুনে আর ৬৮টা বছর বাঁচার ইচ্ছা আছে আমার। জীবনের বাকি ৬৮টা বছরের দায়িত্ব নেবে, প্রিয়শ্রী?”

মানুষ দেখছে! সন্ধ্যা সন্ধ্যা মুহূর্তে শ্রেয়ানের এমন কাজে প্রিয় বিস্ময়ে দু’হাতে ইতোমধ্যে মুখ ঢেকে ফেলেছে। চোখ দুটো আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে। সেই চোখ দুটো আকৃতিতে বেশ বড়ো, গোল গোল। শ্রেয়ান ফিক করে হেসে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। এক হাতে প্রিয়কে জড়িয়ে কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বলল,
-“আমার প্রিয়তমা।”

সেদিন তারা খুব ঘুরেছে। সেমিস্টার ফাইনাল চলছে প্রিয়র। ভীষণ রকমের রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠায় সন্ধ্যার পর বান্ধবীদের সাথে বাইরে ঘোরাঘুরি কিংবা কারো বাসায় বসে গল্প করাটা প্রিয়র জন্য ছিল ‘কদাপি নহে’-সূচক ব্যাপার। তবুও এই দুঃসহ কাজটা আজ প্রিয় করেছে। বাসায় বলেছে, গ্রুপ স্টাডি করতে হবে। সেজন্যই বেরোতে পেরেছে। একবার অবশ্য ওর বাবা বলেছিলেন, মা’কে নিয়ে যেতে। তখন প্রিয় মুখ ফুলিয়ে বলেছিল,

-“এখনও বাচ্চা আছি? ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে তো!”

প্রিয়র বাবা নাসিরুদ্দিন সাহেব বলেছেন,
-“হাসলে হাসবে।”

এখনই না আবার বলে বসে, ‘যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের সময় তো এত গ্রুপ স্টাডি হতো না। কই? আমরা কি পরীক্ষায় খারাপ করেছি? ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ করেছি। সাথে চার সাবজেক্টে লেটার মার্ক। এটা পেয়ে দেখাতে পারবে?’

তারপর শুরু হবে লেকচার। এভাবে হলে, প্রিয়র আর যাওয়ার য-ও হবে না। প্রিয় তৎক্ষনাৎ ভেবে-টেবে বেশ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে ফেলে,
-“বাবা, তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করো? মানে তোমার মেয়েকে অবিশ্বাস করো?”

মেয়ের মুখের ওমন কথায় নাসিরুদ্দিন সাহেব নড়ে-চড়ে বসলেন। পারমিশন দিলেন, যাওয়ার। তবে ড্রাইভার নিয়ে যেতে হবে। আর রাত নয়টার মধ্যে বাড়ির ভেতর থাকতে হবে। প্রিয় ড্রাইভারকে দুটো সিগারেটের লোভ দেখিয়ে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিল। ঘুরে-ফিরে সাড়ে নয়টার দিকে এসে দেখে, যেখানে গাড়ি ছিল সেখানেই আছে। আর পাশে ড্রাউভার অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে রাস্তায় গাড়ি গুনছে। প্রিয়র হাসি লাগল।

বাসায় ফিরে বাঁধল আরেক ঝামেলা। হাতের ৬৮টা টিউলিপ নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করা যেন এক প্রকার যুদ্ধই বলা চলে। এদিকে সাইলেন্ট হয়ে মরে পড়ে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে প্রিয় আরেকবার আতকে উঠল। বিগত আধ ঘন্টায় ৫০টার বেশি কল। মা, বাবা ক্রমাগত কল দিচ্ছেই। এখন কী করবে? সে টুপ করে প্রহরকে কল লাগাল। ছোটো ভাইটা কী সুন্দরভাবে এক চুটকিতে সব ম্যানেজ করে নিতে জানে। এখন সেই তার একমাত্র ভরসা।

প্রহর কল রিসিভ করে বলল,
-“আপু, কই তুই?”

প্রিয় ভয়ে জমে গিয়ে বলল,
-“আছি, ওপাশের আপডেট দে।”

প্রহর বলতে লাগল,
-“আব্বু অফিসের কাজে ফেঁসে গেছে। তবুও ৫ মিনিট পর পর কল দিচ্ছে। আম্মু বসার ঘরে বসে আছে। তোকে কল দিচ্ছে, অথচ তুই ফোন পিক করছিস না। আপাতত এ-ই। তুই কই?”

-“আমি বাসার নিচে।”

প্রহর ফোন হাতে প্রিয়র জানালার ধারে গিয়ে দেখল, প্রিয় অসহায়ত্বকে আয়ত্ত্ব করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রহর বলল,
-“আপু, ওপরে আসছিস না কেন?”
-“তুই কি আম্মুকে একটু ওখান থেকে সরাতে পারবি?”
-“পারব।”
-“গ্রেট। আমি সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছি। আম্মু সরলেই দরজা খুলে দিবি। ওকে?”
-“ওকে।”

প্রহর হুট করেই নিজের রুমে চলে গেল। পড়ার টেবিল সদ্য করা হোমওয়ার্কসহ বেশ কিছু বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে গ্লাস ভর্তি পানি ঢেলে ওখান থেকে ফেলে দিলো। টেবিল, বইসহ মেঝেতেও পানি পড়ল।

প্রহর তখন প্রায় চিৎকার করে উঠল,
-“আম্মু! একটু এদিকে আসো। জলদি।”

নাহার বেগম আসতেই প্রহর বলল,
-“ইশ! কতক্ষণ ধরে হোমওয়ার্ক করলাম। সব গেল! আম্মু একটু মুছে দেবে?”

নাহারা বেগম রুমে আসতেই প্রহর কিছু একটার বাহানা দেখিয়ে বেরিয়ে যায়। সোজা গিয়ে সদর দরজা খুলতেই প্রিয় হুড়মুড়িয়ে নিজের রুমের দিকে দৌড় দেয়। নাহারা বেগম শব্দ পেয়ে আওয়াজ উঁচুতে তুলে বলে ওঠে,
-“কে?”

প্রহর বলল,
-“আপু এসেছে, আম্মু।”

নাহারা বেগম পানি ওভাবে রেখেই প্রিয়র ঘরে ঢুকল। প্রিয় ইতোমধ্যে ফুলগুলো লুকিয়েছে। নাহারা বেগম প্রিয়কে জিজ্ঞেস করল,
-“কী ব্যাপার? ফোন তুলছিলে না কেন?”

প্রিয় ফোনটাও ফুলের সাথে লুকিয়ে ফেলেছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বিবশ গলায় বলল,
-“তমার বাসায় ভুলে ফেলে এসেছি, আম্মু।”
-“আর এত দেরি হলো কেন? ১০টা বাজে, খেয়াল আছে?”
-“আমি তো নয়টার আগেই বেরিয়েছিলাম, আম্মু। এখন রাস্তায় এত জ্যাম থাকলে আমি কী করব?”

নাহারা বেগম সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
-“জ্যাম ছিল?”

প্রিয় ভেতর থেকে ভড়কে গেলেও বাইরে থেকে শক্ত হয়ে বলল,
-“তোমার মেয়েকে বিশ্বাস না হলে ড্রাইভার আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করো।”

নাহারা বেগম আর কিছু বললেন না। তপ্ত শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
-“খাবার বাড়ব? নাকি খেয়ে এসেছ?”
-“খেয়ে এসেছি, আম্মু।”
-“আচ্ছা, ঘুমিয়ে যাও।”

তিনি চলে গেলেন। প্রিয় বুকে হাত রেখে শ্বাস ফেলে বিছানায় বসে পড়তেই সামনে প্রহর এসে দাঁড়াল। প্রিয় তার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোটো অথচ লম্বায় ৮ ইঞ্চি বড়ো ভাইকে চোখ তুলে দেখল। পরনে ছাই রঙের টিশার্ট আর একটা মেরুন রঙের টু-কোয়াটার প্যান্ট। কোঁকড়ানো চুল আর চোখে গোল চশমা। প্রহর হুট করেই হেসে দিয়ে বুকে হাত গুঁজে জিজ্ঞেস করল,
-“হাও ওয়াজ দ্যা ডেইট?”

একই ভঙ্গিমায় প্রিয় নিজেও হাসল,
-“জোস!”

প্রহর যেতেই দরজা আটকে প্রিয় কাবার্ড থেকে ফোন বের করল। শ্রেয়ানের মিসড কল। প্রিয় কল ব্যাক করল৷ শ্রেয়ান রিসিভ করেই বলল,
-“পৌঁছেছ?”
-“হুঁ।”
-“একবার কল দিয়ে জানাবে না? টেনশনে ফেলে দিতে খুব মজা লাগে?”

প্রিয় হেসে উঠল,
-“খুব মজা লাগে।”

সে রাতও তাদের প্রেমের সাক্ষী ছিল। রাত ফুরোয়, ভোর হয়..কথারা শেষ হয় না। সে কত কথা, কত স্বপ্ন, কত কত প্রমিস! কে জানত, এর পরিণতিতে থাকবে ভয়াবহতা? মানুষ তো থাকে না, অভ্যেস ঠিকই থেকে যায়। সেই রাত জাগার রেশ প্রিয়র কাটেনি। এখনও জাগে। আগে মুচকি মুচকি হাসত, আর এখন চুপ হয়ে আকাশ দেখে। আকাশে লক্ষ তারার সমাবেশেও চাঁদ নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। প্রিয়কে না শ্রেয়ান একবার চাঁদ সম্বোধন করেছিল?

চলবে..