শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-০৪

0
191

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৪|

ক্যাম্পাসের ভেতর একটা পুকুর আছে। বেশ সুন্দর। প্রিয় সেখানটায় বসে আছে। ওর একপাশে শাওন আর অন্যপাশে তমা ও দিশা বসে আছে। তমা আশপাশটা সুচারু নজরে পর্যবেক্ষণ করছে আর সবকিছুতেই সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করছে। যেমন: রাস্তার পাশের ওই কাপলটা জোস না? একদম মটু-পাতলু টাইপের? ওই মাইয়াটাকে দেখ। বেচারি! পয়সার অভাবে গায়ের কাপড়ও কম। তোদের উচিত তাকে ত্রাণ দেওয়া। পূন্য হবে, বুঝেছিস? পূন্য!

এবার গিয়ে তার চোখ থামল, সিনিয়রদের একটা গ্যাংয়ের দিকে। সেখানে শ্রেয়ান, তাসরিফ, নিলয়, সিয়াম, রাহা, রীতিসহ আরও অনেকে আছে। শ্রেয়ান গিটারের সুর তুলছে। আর বাকিরা গান গাইছে। কী মিষ্টি একটা পরিবেশ!

তা দেখে তমা বলে উঠল,
-“ব্যাংয়ের মতো যেই আওয়াজ, তা দিয়ে আবার গান গায়! আমার কানদুটোর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দুই মিনিট নিরবতা পালন করো, দয়াময় বন্ধুগণস!”

শাওন টিপ্পনী কেটে বলল,
-“তুই কোথাকার শ্রেয়া ঘোষাল?”

দিশা হেসে উঠল। শাওনের কথাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে তমা বলল,
-“ভালো কথা! প্রিয়ু, তুই কি সিরিয়াস ওই শ্রেয়া ঘোষালের প্রতি?”

প্রিয় চোখ রাঙিয়ে বলল,
-“ভাইয়া বল।”

তমা মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
-“ঠ্যাকা পড়েছে? তোকে জিজ্ঞেস করছি, সেটা বল৷ সিরিয়াস?”

প্রিয় শ্বাস ফেলে বলল,
-“এডিক্টেড হয়ে গেছি, দোস্ত। ওকে ছাড়া ভাল্লাগে না। ও ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না।”

তমা নিজেও খানিকটা সিরিয়াস হয়ে বলল,
-“সময় আছে, প্রিয়ু। এখনও অনেক সময় আছে।”

প্রিয় বুঝতে পারছে। কিন্তু শ্রেয়ান ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না। তমা বলতে লাগল,
-“ভালোবাসা ভালো। খুব বেশিই ভালো। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা ভালো না। এতটা মিশে যাস না। পরে উলটা-পালটা কিছু হয়ে গেলে তুই মরেই যাবি।”

প্রিয় হেসে তমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
-“ও থাকতে ভয় কীসের? ও আমাকে মরতে দেবে না।”

এরমধ্যে শ্রেয়ানও প্রিয়র দিকে তাকাল। চোখাচোখির এই মুহূর্তে শ্রেয়ান চমৎকারভাবে হাসল।

_____
দীর্ঘ সময়ের অসুস্থতাজনিত ছুটি শেষে আজ কলেজে এসেছে আয়াত। পরনে সাদা কলেজ ইউনিফর্ম। কাঁধে ছোট্ট একটা ব্যাগ। দুটো ঝুঁটি করা চুলগুলো দু’পাশে এনে রাখা। ছোট্ট গোল মুখটা রোদের বদৌলতে লাল হয়ে গেছে।

তার বন্ধু নেই। সেজন্য ভীষণ ইতস্তত বোধ করছে। তবে তা মনে মনে। বাইরে বাইরে শক্তপোক্ত মেয়ে সে। কেউ দুটো কথা শোনালে পালটা দশটা শোনানোর প্রস্তুতি সে সবসময় রাখে।

হাঁটতে হাঁটতে কিছু একটায় পা পড়তে গেলেই কেউ একজন বলে উঠল,
-“আপু, আপু, ওয়েট! আপু, পা দেবেন না ওখানে।”

আয়াত ত্বরিতে পিছিয়ে গেল। প্রহর এগিয়ে এসে তৎক্ষনাৎ তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা প্র‍্যাক্টিকাল খাতার কাগজটা তুলে নিয়ে বলল,
-“থ্যাংক ইউ, আপু।”

আয়াতের চোখ-মুখ কুঁচকে এলো ক্ষণিকেই। ছেলেটা তার ক্লাসমেট। সে ক্লাসে দেখেছিল। ছেলেটা কি তাকে ক্লাসে দেখেনি? এত আপু আপু করার কী আছে? দুই লাইনের বাক্যে চারবার করে আপু ডাকছে। ছি! কী জঘন্য!

সে তেড়ে উঠে নিজের বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাল,
-“এই অসভ্য! আমি তোর কোন জন্মের বোন লাগি রে?”

প্রহর থতমত খেয়ে তাকাল। প্রথম দেখায় কে এভাবে তুইতোকারি করে? প্রহর শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-“সরি, আপু।”
-“এই, আবার! আচ্ছা বল তো? তুই কোন ক্লাসে? ক্লাস ফাইভের কচি খোকা?”
-“না। দ্বাদশে।”
-“নাম কী?”
-“প্রহর।”

প্রহর জিজ্ঞেস করল,
-“আপনার নাম?”

আয়াত বড়ো ভাব নিয়ে বলল,
-“মেহেরিন আয়াত সাওদাহ্।”

পরক্ষণেই আবার বলে উঠল,
-“এই তুই আমাকে আপনি-আজ্ঞে করছিস কেন? দেবো থাপ্পড়?”

প্রহর মনে মনে ভাবছে, এ কোন পাগল মেয়ের খপ্পরে সে পড়েছে! আল্লাহ! এবারের মতো বাঁচিয়ে দিক। তারপর যখন কেটে পড়তে নিল, তখনই আয়াত ডেকে উঠল,
-“এই প্রহর, শোন! তুই বোধহয় আমাকে সিনিয়র ভেবেছিস। আমি আসলে তোর ক্লাসমেট। বুঝেছিস?”

প্রহর বুঝে মাথা নড়ল দু’ধারে। এত বাধ্যতা আয়াতের সহ্য না। সে বরাবরই অবাধ্য মেয়ে। কেউ তাকে ডান দিকে যেতে বলে, সে অবশ্যই বাঁয়ে যাবে। যাওয়া নিশ্চিত।

প্রহর তখন বলে উঠল,
-“আমি যাই?”

আয়াত ত্বরিতে বলল,
-“না, যাবি না। আমি ক্যান্টিনে যাব, এরপর ক্লাসে যাব। আমার সাথে আয়।”

প্রহর জবাবে “আচ্ছা” বলতেই, তার সামনে ঝোলানো ব্যাগ থেকে কিছু একটা মুখ বের করে বলে উঠল,
-“মিঁয়াও!”

একটা বিড়াল! আয়াতের বিড়াল ভীতি আছে। সে শুকনো ঢোক গিলে উলটো রাস্তা ধরে কলেজের দ্বিতীয় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। প্রহর দাঁড়িয়ে ভাবছে, ক্যান্টিনে যাবে না-কি ক্লাসে!
____
সামনে প্রিয়র জন্মদিন। বন্ধুরা সবাই মিলে ওর জন্মদিনের প্ল্যানিং করছে। এদিকে প্রিয় ভাবছে, পুরোটা দিন কাটাবে শ্রেয়ানের সাথে। কী মিষ্টি মিষ্টি সব ভাবনা!

সকালে ঘুম ভাঙল শ্রেয়ানের ফোনকলে। প্রিয় কল রিসিভ করে বলল,
-“সুপ্রভাত, জনাব। বলুন, দিনকাল কেমন চলে?”

শ্রেয়ান মুচকি হাসল,
-“শুভ সকাল। আপনিময় দিন তো! ভালো হওয়া আবশ্যক।”

প্রিয় হেসে উঠে বলল,
-“উমম..”
-“ঘুম হয়নি, না? আরেকটু ঘুমোতে চাও? ফোন রাখব?”
-“উঁহু।”

শ্রেয়ান জিজ্ঞেস করল,
-“কী আবদার?”
-“গান শুনব..”
-“এখন?”
-“হু..”
-“আচ্ছা, শোনাব। তবে একটা কন্ডিশন আছে।”
-“কী কন্ডিশন?”
-“লজ্জা পাওয়া যাবে না।”

প্রিয় ভাবল, গান শুনে আবার কে লজ্জা পায়? কেউ পায় না। পাওয়ার কথাও নয়। তাই বলে উঠল,
-“পাব না। গান শোনাও।”

শ্রেয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে গেয়ে ওঠে,
-“যদি আকাশের গায়ে কান না পাতি,
তোমার কথা শুনতে পাব না।
যদি বাতাসকে আমি ছুঁয়ে না দেখি..
যদি বাতাসকে আমি ছুঁয়ে না দেখি,
তোমার শরীর স্পর্শ পাব না।
তোমার কথা শুনতে পাব না।”

প্রিয় ত্বরিতে কল কেটে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফেলে। ছেলেটা কী ভীষণ খারাপ! এভাবেও বুঝি লজ্জা দেওয়া যায়?

ওপাশে কল কেটে দেওয়ায় শ্রেয়ান প্রথমে চুপ হয়ে গেল, পরক্ষণে ব্যাপারটা বুঝে আসতে হো হো করে হাসল। বলা বাহুল্য, শ্রেয়ান নামের ছেলেটা হেসে দিয়ে মেয়ে কাবু করতে বড্ড দারুণ জানে। নয়তো কি এমনি এমনি রক্ষণশীল পরিবারের কোনো মেয়ের সাহসে কুলোয়, এক পুরুষের প্রেমে মজে দিন-দুনিয়া ভুলে যেতে?

_______
প্রিয়শ্রীর জন্মদিন! রাত ১১টা ৩০-এ প্রিয় ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। সে অবগত, একটু পরই ম্যাসেজের বন্যা বয়ে যাবে। মূলত ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে একটি স্পেশ্যাল মানুষের কল বা ম্যাসেজের অপেক্ষায়। সেই স্পেশ্যাল মানুষটা কে, তা বলার প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রিয় বেশ ভালো করেই জানে, শ্রেয়ান তাকে সারপ্রাইজ দেবে। শ্রেয়ান কিছু তো করবেই! আচ্ছা, যদি হুট করেই আজ বেরোতে বলে? যদি সেইদিনের মতো বাড়ির সামনে এসে আবদার করে বসে,
-“প্রিয়শ্রী, নিচে আসতে পারবে? চলো একটু হাঁটি।”

প্রিয় আজ তাই বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে চাবির গোছাটা নিজের কাছে এনে রেখেছে। আজ তার শ্রেয়ানের আবদার সে ফেলবে না, কিছুতেই না। ভাবতে ভাবতে আনমনে হেসে উঠল।

ঠিক তখনই দরজায় করাঘাত হলো। প্রিয় ফোনটা উলটো করে বিছানার একপাশে রেখে গিয়ে দরজা খুলল। ওপাশে প্রহর দাঁড়িয়ে। বেশ অগোছালো ভঙ্গিমায় প্রিয়কে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়কে চমকানোর জন্য সে আরও একটি কাজ করল। হুহু করে কেঁদে উঠল অকস্মাৎ। দ্বাদশের কোনো ছেলে বুঝি এভাবে কাঁদে? সে তো দেখেনি।

প্রিয় খেয়াল করল, ধীরে ধীরে তার মনটাও কাঁদছে। ছোটোবেলায় তার এই বাচ্চা ভাইটাকে কাঁদানোর জন্য সে মাঝে মধ্যেই চিমটি কাটত। খানিকটা বড়ো হওয়ার পর ওর খেলনাগুলো ভেঙে দিত। ছোটোভাইকে কাঁদাতে তার কী যে আনন্দ লাগত! কিন্তু, যখনই মা মারত-বকত.. প্রিয় নিজেই কেঁদে দিত। তার ভাইকে সে ছাড়া অন্য কেউ কাঁদাবে কেন? বিষয়টা প্রিয় একদমই মেনে নিতে পারত না।
বুঝ আসার পর প্রহর যখন পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতে গিয়ে প্রথমবার মার খেয়ে বাড়ি ফিরল, প্রিয় প্রহরকে পূনরায় সেখানে নিয়ে গিয়ে ছেলেদের দেখিয়ে বলেছিল,
-“এই প্রহর, বল তো কে মেরেছে তোকে?”

প্রহর নাক টানতে টানতে আঙ্গুল তুলে দেখায়। প্রিয় গিয়ে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে সেই ছেলেটাকে চার-পাঁচটা থাপ্পড় মেরে প্রহরের হাত ধরে চলে আসে। আপুর ওই মার দেখে এমনিতেই প্রহরের কান্না থেমে গেছিল। অবাক হয়ে প্রহর জিজ্ঞেস করেছিল,
-“আপু, ওদের মারলে কেন?”

প্রিয় থামে, হাসে। তারপর বাচ্চাটার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
-“আব্বু বলেছে, কেউ মারলে, তাকেও মারতে হয়। কেউ একবার মারলে, তাকে চারবার মারতে হয়। যখন ওরা দেখবে, তুমি দূর্বল। তখন ওরা আরও বেশি বেশি মারবে। আবার যখন ওরা তোমার শক্তি সম্পর্কে জানবে, তখন মাথা তুলে তাকাতেও পারবে না। তোমায় ভয় পাবে। ভয় দেখিয়ে চলার মধ্যে একটা পৈশাচিক আনন্দ আছে।”

প্রহর কী বুঝেছিল, জানা নেই। তবে থমকানো নজরে বেশ কিছুক্ষণ তার আপুর দিকে তাকিয়ে ছিল। এরপর থেকে প্রিয় কখনই প্রহরকে একা খেলতে পাঠায়নি, নিজেও সাথে এসেছে। ভাইটা একটু বেশিই সহজসরল তো! কেউ কিছু বলে যদি? তার থেকেও বেশি ভয়, ভাইটা যদি কাঁদে? ছেলেটার কান্না সে একদমই সহ্য করতে পারে না।

অথচ আজ সে তাকে জড়িয়ে ধরে কীভাবে ফোঁপাচ্ছে! প্রিয় তাকে নিজে থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে প্রহর কান্নাভেজা গলায় প্রথমবারের মতো বলে,
-“খুব খুব খুব ভালোবাসি, আপু। ছেড়ে যাস না।”

চলবে..