শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-০৫

0
208

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৫|

-“খুব খুব খুব ভালোবাসি, আপু। ছেড়ে যাস না।”

প্রিয় অবাক হয়,
-“পাগল, ছেড়ে যাব কেন?”

প্রহর কান্না না থামিয়ে ওভাবেই সরে এসে সামনে দাঁড়ায়। আধভেজা গলা তার। স্বর ভাঙা। চোখ দুটো কী লাল! নাক টানছে সে। প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
-“কান্না করছিস কেন, বাবু? কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”

প্রহর বলল,
-“আমাদের ব্যাচের একটা মেয়ে আছে, আয়াত। ওর সাথে একটু আগে মেসেঞ্জারে কথা হচ্ছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কী ছাড়া আমি থাকতে পারি না এক দণ্ডও। আমি বললাম, আমার আপু। ও তখন বলল, তুই নাকি আমাদের বাড়ির মেহমান। বিয়ের পর চলে যাবি। তখন ঠিকই একা থাকা লাগবে। ও ভুল বলেনি। তুই আসলেই চলে যাবি। আমি তোকে ছাড়া এই বাড়িটা ভাবতে লাগলাম। কী আশ্চর্য! আমার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল! আপু, আমি কারো সামনে নিজেকে ভাঙতে পারি না। কিন্তু তুই আমাকে বুঝে যাস। কখনই কাউকে বলতে পারি না, আমার এটার প্রয়োজন। কিন্তু সেটা বলার আগেই আমি পেয়ে যাই। তুই না থাকলে, আমি তো মরেই যাব…”

প্রিয় বুঝল। ভেতরটা নরম হলো। এক হাত উঠে এলো প্রহরের মাথায়। কোঁকড়ানো চুলোগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল,
-“এটাই নিয়ম, বাবু। মেয়েদের কোমল, একাধারে শক্ত হতে হয়। মেয়েদের অত্যন্ত বিনয়ী, সেই সাথে রুক্ষমূর্তিও হতে হয়। মেয়েদের দুটো পরিবার হয়। এক পরিবারের মায়া কাটিয়ে, অন্য পরিবার সামলাতে হয়। এটা প্রকৃতির নিয়ম। মেনে নে। আমি তোকে ওয়াদা করতে পারব না যে, বিয়ের পরও এরকমই থাকব। ওয়াদা করলে বোধহয় সেটা ভেঙে যাবে। বিয়ের আগে আর বিয়ের পরে, একটা মেয়ের জীবনের এই দুইটা সময়ের মাঝে থাকে বিস্তর ফারাক। আজ তুই চাইলেই আমি আছি। তুই বলিস না? আমি তোর গণিত বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা—সমাধানের মতো। তখন তা আর থাকব না।”

প্রিয় এটুকু বলে থামল। প্রহর অবাক হয়ে চেয়ে আছে। প্রিয় ক্ষীণ হেসে বলল,
-“আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানিস? তুইও মরবি না। প্রয়োজন পড়লে মানুষ জানোয়ারও হয়ে যায়। সেখানে তুই নিজের প্রয়োজনীয়তাটুকু অবশ্যই মুখে আনতে পারবি। শুধু মনে রাখবি, অন্যায় কিছু করবি না। অন্যায় সুখকর হলেও স্বস্তিদায়ক নয়। ভুল পথে ফুল থাকলেও, তাতে শান্তি থাকে না।”

প্রহর তা বুঝল। খুব ভালোভাবে বুঝে মনের ভেতর কথাটাকে তুলে নিল। সে তার আপুর সব কথা মেনে চলে, এটাকে একটু বেশিই মানে।

হুট করেই কিছু একটা খেয়াল হয়ে যাওয়ায় সে প্রিয়র হাত ধরে টানতে লাগল। টান অনুসরণ করে প্রিয়ও প্রহরের পিছু পিছু গেল। প্রহর তাকে ছাদে নিয়ে গেল। প্রহরের কাছে বাড়ির সব লকের এক্সট্রা কী থাকে, সেই হিসেবে সুবিধা হলো। দরজা প্রহর আগেই খুলে রেখেছিল।

ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল দু’জন। আজ পূর্ণিমা। আকাশ থেকে যেন মুক্তো ঝরছে। প্রিয় ছাদের মেঝেতে পা রেখে সামনে তাকাল। তার দোলনাটার পাশ থেকে কী সুন্দর ডেকোরেশন! বিস্মিত নজরে প্রিয় পাশ ফিরে প্রহরকে দেখল। ঘড়িতে তখন বারোটা বাজতে দুই মিনিট বাকি।

প্রহর ফোন কানে নিয়ে চিপায় গিয়ে আয়াতকে কল দিয়ে বলল,
-“এরপর?”

আয়াত ক্ষেপে উঠল। সব বলে দিতে হবে? আজ সকালে কথার ছলে ছেলেটার পেট থেকে বের করেছে, সে বোনের জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে চায়; কিন্তু কী করবে তা প্রহর বুঝতে পারছে না। তাই বাকিসব আয়াত নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন খানিকটা মাথা খাটাক! তা নয়।

আয়াত বলে উঠল,
-“ওরে ও হাদা, আপুকে ছাদের মাঝে নিয়ে যা। এরপর যেই গান সিলেক্ট করলি, ওটা গা।”

প্রহর আনমনেই মাথা নাড়ল, কেউ দেখল না অবশ্য। মাথা নেড়ে আবার শুধাল,
-“বুঝেছি, তারপর?”

আয়াত অসম্ভব রাগ নিজের মাঝে দমিয়ে বলল,
-“আমার মাথা। আপুকে বলবি, তাকে কতটা ভালোবাসিস। মনে যা আসে, তাই বলবি। এই তুই না স্ক্রিপ্ট লিখে রেখেছিলি?”

-“হ্যাঁ, কিন্তু ভুলে গেছি।”

-“তুই কি জানিস, তুই একটা উন্নতমানের হাদা? আচ্ছা ব্যাপার না, তোকে মানুষ হওয়ার টিপস দেবো নেক্সট ক্লাস থেকে। এখন যা, যা ইচ্ছা হয় বলিস। দরকার হলে, কাল বোটানির ম্যাম যেই টপিকটা পড়তে বলেছিল, ওটা উগলে দিস।”

-“আচ্ছা।”

-“কাজটা শেষ হওয়ার আগে জাস্ট একটা কল দিস, একদম লাথি দিয়ে উগান্ডা পাঠিয়ে দেবো। যা।”

আয়াত কল কেটে দিলো। প্রহর গিয়ে প্রিয়র হাত আবার ধরল। প্রিয়র প্রশ্নাত্মক চোখের দিকে তাকিয়ে তার বিপরীতে দেওয়া প্রহরের স্নিগ্ধ হাসিটা গা হিম করে দিলো প্রিয়র। তার ভাই বদলাচ্ছে। তার ভাইয়ের জড়ত্ব কমছে। ব্যাপারটা বেশ স্বস্তিদায়ক। প্রিয় আলগোছে বলে উঠল,
-“তুই বেশি হাসবি না, নজর লেগে গেলে ভাই পাব কই?”

প্রহর তাও হাসল। তার ষষ্ঠইন্দ্রীয় ইতোমধ্যে কাউন্টডাউন শুরু করে দিয়েছে। ৩..২..১..

প্রহর প্রিয়কে ছাদের দরজা পেরিয়ে সামনে নিয়ে এলো। স্থির দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
-“শুভ জন্মদিন, আপু। শুভ বিংশতম জন্মবর্ষ। আমার ভাগের সুখ আল্লাহ তোকে দিয়ে দিক। ছোটোবেলা থেকে আমি কখনও আবদার করিনি। কখনও তোর কোনো কিছুর ওপর ভাগ বসাইনি। তুই বসিয়েছিস, আর আমি দিয়ে দিয়েছি। কেন জানিস? কারণ আমার তোর হাসিটা ভাল্লাগত।”

প্রহর কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রিয়র থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রহর খুব কম হাসে। অথচ এখন একটু বেশি বেশি হাসছে। কী শীতল হাসি! প্রিয় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রহর মাথার পেছনের চুলগুলোয় হাত ঝেড়ে বলল,
-“মাশাআল্লাহ! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা আমার বোনের। কী সুন্দর!”

ভাইয়ের এত কথাতে প্রিয় জমে যাচ্ছে। প্রহর প্রিয়কে নিয়ে দোলনায় বসাল। তার থেকে কিছুটা দূরে গিটারটা গলায় ঝুলিয়ে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙে বসে বলল,
-“আমার পনেরোতম বছর, তুই তখন কলেজে ভর্তি হলি। হাত খরচের টাকা জমিয়ে একদিন একটা ফোন কিনতে চাইলি। আব্বু তোকে তখন ফোন দেবে না, এদিকে তোর সব বন্ধুদের কাছে ফোন আছে। একা যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলি না বলে আমাকে নিয়ে গেলি। আমি আঁড়চোখে একবার এই গিটারটার দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার বোন আমার সেই এক পলক তাকানোকে লক্ষ করে বলেছিল, ‘বাবা, ঠিকই বলে। এই বয়সে ফোন দিলে নষ্ট হয়ে যাব। আমি হুট করেই তা বুঝতে পারলাম এখন। আমাদের ক্লাসের সীমা আছে না? ও ফোনে প্রেম করে ছেলে ধরে পালিয়েছে। তাই ভাবছি, ফোন নেব না। এসেছি যখন, আয় তোকে কিছু কিনে দিই। ওই গিটারটা ভালো লেগেছে, এটা কিনব। তুই অতি শিঘ্রই গান শিখে আমাকে শোনাবি।’
আমি তখন আর তোকে কিছু বলার অবকাশ পাইনি। তুই গিটারটা কিনলি, আমাকে দিলি। বাসার কেউ জানত না, আমি লুকিয়ে রাখলাম। তারপর আয়াতের কাছ থেকে শিখলাম। আজ তোর জন্য একটা গান গাই?”

প্রিয়র চোখ ছলছল করছে। প্রহর সে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-“গানটি আমার আপুকে উৎসর্গ করলাম।”

তারপর গিটারের সুর তুলল। একটা অসম্ভব সুন্দর গান গাইল। বোনকে নিয়ে বেশ সময় কাটাল। ঘড়ির ছোটো কাটা তখন একটার ঘর পেরিয়ে গেছে। তারা দু’জন নিচে চলে এলো।

প্রিয়কে তার রুমের দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে প্রহর নিজের রুমের দিকে এগোল। দ্বার পেরিয়ে ভেতরে আসতেই প্রিয় থম মেরে দাঁড়াল। পরক্ষণেই তড়িঘড়ি করে বিছানায় গিয়ে ফোন হাতে তুলল। শ্রেয়ানের ৬১টা মিসড কলের সাথে ২৬৭টা ম্যাসেজ সে দেখার আগেই ফোনে কল এলো তমার। প্রিয় স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় তা রিসিভ করল, ওপাশ থেকে তমা বলল,

-“কী, ভাই? কই মরেছিস? কত কল, ম্যাসেজ দিচ্ছি!”
-“আব্.. সরি।”
-“তোর সরির নানির কাঁথা পুড়ি। ধুরবাল! মুডটাই খারাপ করে দিলি।”

প্রিয় কিছু বলল না। তমা কিছু প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। ঠোঁটের কোণে এক বিশাল হাসির রেখা ছড়িয়ে বলে উঠল,
-“হ্যাপি বার্থডে, আমার সোন্টুমন্টু বাবুসোনা! দোয়া করি ডজনে ডজনে বাবুর আম্মু হ।”

প্রিয়র কপাল কুঞ্চিত হয়ে এলো,
-“ছি! উইশের কী শ্রী!”

এর মধ্যে ফোনে আবারও কল এলো। প্রিয় কান থেকে ফোন উঠিয়ে দেখল, শ্রেয়ান। অজানা এক আশঙ্কা প্রিয়র মনে দলা পাকাল। প্রিয় ঘাবড়ে গিয়ে কল কেটে দিলো তমার। পুনরায় শ্রেয়ানের কল আসার আগে নোটিফিকেশন প্যানেলে শ্রেয়ানের কল-ম্যাসেজের হিস্ট্রি তার চোখ এড়াল না। গা জড়িয়ে এলো, হিমশীতল বাতাসে গায়ের লোমকূপ অবধি কেঁপে কেঁপে উঠল।
প্রিয় কল রিসিভ করে তড়িঘড়ি করে নিজের সাফাই গাইল,
-“এক্সট্রেমলি সরি, শ্রেয়ান। প্লিজ রাগ কোরো না। আই’ল এক্সপ্লেইন। প্লিজ!”

ওপাশে শ্রেয়ান চুপ হয়ে ছিল। প্রিয়র না থেমে বলে যাওয়া সবগুলো বাক্য শুনে সে হাসল খানিকটা। থেমে থেমে দু’পাশে ঘাড় নেড়ে বলল,
-“ইট’স ওকে!”

প্রিয় বিচলিত হলো শ্রেয়ানের অবিচল গলায়। শ্রেয়ান তাকে অভয় দিলো, কিছু হয়নি, কিচ্ছু না। বি ইজি! প্রিয় ইজি হলো বেশ সময় নিয়ে। কথোপকথনের সময় যখন মিনিট পনেরো গড়াল। চারপাশের উত্তেজিত আবহাওয়া নরম হলো, শান্ত হলো, শ্রেয়ান তখন জিজ্ঞেস করল,
-“১১টা ৫৯ থেকে, ১টা ৫০ অবধি কী কী করলে?”

প্রিয় সরলমনে সব বলতে লাগল। প্রথমে প্রহরের কথা, এরপর তমা! বলতে লাগল—এটা ছিল ভাইয়ের সাথে কাটানো বেস্ট মোমেন্ট এভার! প্রিয় বলতেই থাকল। বুঝল না, ওপাশের মানবের শক্ত-সামর্থ্য শরীরটা তা শুনে শুনে পাথরের ন্যায় কঠিন হয়ে গিয়েছে, হাত হয়ে উঠেছে মুষ্টিবদ্ধ। হাসিটা সড়ে এসেছে। প্রিয়র কথা শেষ হয়ে এলে শ্রেয়ানের ঠোঁটে আবারও সামান্য হাসি হানা দিলো, বলে উঠল,
-“তোমার প্রায়োরিটি লিস্টে কার অবস্থান কোথায়, বলো তো?”

প্রিয় বলতে গিয়ে প্রথমেই তার ভাইয়ের নামটা বলল। তারপর বুঝল, সবাই সবার নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে প্রিয়র প্রায়োরিটি লিস্টে। কোনো একজনকে আগে-পিছে করা যায় না। তারপর মাথায় একটা দুষ্টুমি খেলা করল। প্রিয় তাতে সায় দিয়ে বলল,
-“প্রথমে প্রহর, এরপর আব্বা, এরপর আম্মা, তমা, শাওন, দিশা..”

নেহাতই মজার ছলে শ্রেয়ানের নামটা প্রিয় সবার শেষে বলল। তার ধারণা, এখনই শ্রেয়ান রাগ করবে, মুখ ফুলোবে! তারপর বড়ো অভিমানী গলায় বলবে, ‘আমি এত পরে?’

প্রিয়র মজার ধরনটা শ্রেয়ান ধরতে পারল, বুঝল সবই। তবে মেয়েটাকে অবাক করে দিয়ে বড়ো নির্লিপ্ত থাকল। হেসে হেসে বলল,
-“আমি ভীড় পছন্দ করি না, কিউটিপাই।”

প্রিয় সে কথার দ্বারা শ্রেয়ানের মন্তব্যটা বুঝল না। খেয়াল করল না, শ্রেয়ান তাকে উইশ করেনি। কেবল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সে। মুখ খানিকটা গোমড়া করল। ছেলেটা কেন রাগ করল না? এতটা নির্লিপ্ত কেন থাকবে? রিয়্যাক্ট করুক!

চলবে…