শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-০৬

0
182

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৬|

শ্রেয়ানের ভালোবাসা বেহিসেবী হয়ে এসেছে। প্রিয় দিন দিন মুগ্ধ হচ্ছে। শ্রেয়ানের ভার্সিটি লাইফ শেষের দিকে। তুমুল ব্যস্ততা। তবুও এক মুহূর্ত প্রিয়কে একা ছাড়তে নারাজ সে। সারাটাক্ষণে কলে থাকা হয় দু’জনের।
প্রিয় এখন আর পরিবারের সবার সাথে একত্রে খাবার খায় না। নিজের রুমে এনে খায় আর শ্রেয়ানের সাথে কথা বলে। ইদানিং ভার্সিটিতেও ক্লাসবাদে এক্সট্রা টাইম ফ্রেন্ডদের দেওয়া হয় না। কেমন যেন সব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছে সে!

সেদিন শাওনের বার্থডে ছিল। তমা ও দিশা মিলে বিভিন্ন সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছিল। প্রিয় তার মধ্যে থাকার সময় পায়নি বলে তমার কী রাগ! সে রাগ ঝাড়েনি। কেবল বলেছে, ‘শুধু একটু উপস্থিত থাকিস। নাকি তা-ও পারবি না?’

প্রিয় না করেনি। সে অবশ্যই আসবে। বন্ধু না তার? পরক্ষণেই যখন শ্রেয়ানকে বলতে গেল, তখন মনে পড়ল—শ্রেয়ান ওভার পজেসিভ। ছেলেদের সাথে মেশা তেমন একটা পছন্দ করে না। যেতে না করবে না, তবে ফিরে আসার পর কথা বলার সময় কেমন একটা গাল ফুলিয়ে থাকবে। তাই আর তার যাওয়া হয় না। হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে গিফট কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই গিফট শাওন ফেরত পাঠিয়েছিল একটা চিরকুট সাথে। তাতে লেখা ছিল, “বালের গিফট তোর ঘরে সাজায়া রাখ।”

প্রিয় প্রচুর মন খারাপ করেছিল। কিন্তু কিছুই করার নেই। ক’দিন বাদে আবার তমার বার্থডে। এবার না গেলে খারাপ হয়ে যাবে। খারাপ বলতে অতি মাত্রায় জঘন্য যাকে বলা যায়। প্রিয়র সব গোছানো শেষ, এবার শুধু শ্রেয়ানকে জানানো বাকি। জানানোটা এক ধরনের পারমিশন নেওয়া টাইপেরই!

রাত তখন একটার বেশি। প্রিয় কলে ছিল শ্রেয়ানের সাথে। শীত শীত মুহূর্তে ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে শুয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে, হাসছে।
শ্রেয়ান জিজ্ঞেস করল,
-“তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাইছ, প্রিয়শ্রী?”

প্রিয় বলতে চাইছে, কিন্তু কথা আসছে না। শ্রেয়ান আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করায় যেন সুবিধেই হলো। সে বলল,
-“হ্যাঁ। নেক্সট থার্সডে তমার বার্থডে। আমি যাব?”

শ্রেয়ান হিসেব করল। আজ রোববার। পরক্ষণেই কী ভেবে যেন প্রশস্ত হেসে বলল,
-“অবশ্যই। কেন যাবে না?”

প্রিয়র বুকের ওপর থেকে যেন পাথর নামল। যেতে যে পারছে, এই অনেক। শ্রেয়ান কথার টপিক চেঞ্জ করে বলল,
-“ভিডিয়ো কলে এসো, দেখব তোমায়।”

প্রিয় কিছু বলার আগেই শ্রেয়ান ক্যামেরা অন করল, প্রিয়ও নিজের ক্যামেরা ওপেন করল। ডিস্প্লে লাইটের বদৌলতে ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা প্রিয়কে একটা বিড়ালের ছানার মতোই লাগছিল। শ্রেয়ান অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হেসে বলল,
-“ইউ লুক লাইক অ্যা প্রিটি কিটিক্যাট, প্রিন্সেস।”

প্রিয় সামনের সবকটা দাঁত বের ইইই করে হাসল।

চারদিন পর, সন্ধ্যায় যখন প্রিয় রেডি হয়ে শ্রেয়ানকে কল দিয়ে বলল, এখন বেরোবে। তখন শ্রেয়ানের গম্ভীর মুখ তার নজর কাড়ল। প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে?”

শ্রেয়ান বেশ অস্বাভাবিকভাবে বলল,
-“কেন যেন একা একা লাগছে।”

প্রিয় থমকে গেল, শ্রেয়ান এভাবে কখনও বলে না। একাকিত্বের পরিমাণটা মাপতে সে শুধাল,
-“খুব?”
-“খুব বেশিই। এক্সেপশনালি দমবন্ধকর লাগছে।”

শ্রেয়ানের বাবা-মা অন্য শহরে থাকে। পড়াশোনার জন্য এখানে থাকে সে। এদিকে পুরো তিন বেডের এই অ্যাপার্টমেন্টে সে একা থাকে। প্রিয় যখন বলেছিল, এত বড়ো বাসায় একা থাকার দরকার কী? কোনো ফ্রেন্ডের সাথে রুম শেয়ার করলেই হয়। রুম শেয়ার না করুক, অন্তত পাশের রুমে কেউ থাকুক। শ্রেয়ান তখন জানিয়েছিল, সে ডিস্টার্বড হয় আশে পাশে কেউ থাকলে। একা থাকতেই অভ্যস্ত সে।

যেহেতু মানুষ সামাজিক জীব। তাই মাঝে মধ্যে একা লাগাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। প্রিয় চিন্তিত হয়ে বলল,
-“তোমার ফ্রেন্ডসদের আসতে বলো।”

শ্রেয়ান ব্যথিত গলায় বলল,
-“ওরা ব্যস্ত।”
-“কী আশ্চর্য! একজনও নেই? বন্ধুর একাকিত্ব দূর করতে না পারলে কচুর বন্ধু ওরা তোমার?”

শ্রেয়ান জানাল,
-“ওরা আসলে ক’দিন আগে শ্রীমঙ্গলের ট্রিপে গেছে, ৩ দিনের জন্য। আমাকেও যেতে বলেছিল, কিন্তু তোমাকে সময় দিতে পারব না বলে যাইনি।”

প্রিয়র খুব খারাপ লাগতে লাগল। যেই মানুষটা ওকে সময় দিতে পারবে না ট্রিপ ক্যান্সেল করল, সেই মানুষটা যখন একাকিত্বে মরছে—সে তখন কীভাবে ফ্রেন্ডের বার্থডে সেলিব্রেট করতে যায়? চাওয়াটা প্রিয়র গলায় আটকে গেল।

আলগোছে ওড়না আর ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে শ্রেয়ানকে বলল,
-“প্রিয়শ্রীর সাথে ঘুরতে যেতে তো আপত্তি নেই, তাই-না? চলুন! স্যারের মনটা খুশি করে দিতে ম্যাডাম আজ তাকে স্পেশ্যাল কফি ট্রিটে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।”

বাঁকা হাসিটা ওষ্ঠকোণে হানা দিলো শ্রেয়ানের। নিশ্চিতকরণ প্রশ্ন শুধাল,
-“তমার বার্থডে? উনি মন খারাপ করবেন না?”

অবশ্যই করবে। বিষয়টা চেপে গেল প্রিয়,
-“না, করবে না। আমি বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। লোকেশন সেন্ড করে দিচ্ছি। ফটাফট বের হন, মশাই। আজ সারা বিকেল রিকশায় ঘুরব।”

শ্রেয়ান তৈরি ছিল আগে থেকেই। ফ্রেন্ডস গ্রুপ থেকে কল আসায় শ্রেয়ান রেডি হওয়ার কথা বলে কল কেটে দিয়ে গ্রুপ কলে জয়েন হলো। সবার চেহারা ভেসে আসছে স্ক্রিনে। সবাই একত্রে আছে। তন্মধ্যে এক বন্ধু বলে উঠল,
-“থ্যাংক ইউ দোস্ত, এই ট্রিপের ট্রিটটা দেওয়ার জন্য।”
____
শ্রেয়ান প্রিয়র সব বিষয়ে মতামত রাখে। বিষয়টা প্রিয়র কাছে খুব ভালো লাগে। একসাথে লাঞ্চে-ডিনারে গেল, সবসময় শ্রেয়ান ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। কী আহ্লাদী মেয়েটা! রাস্তাঘাট তাদের প্রেমের সাক্ষী! শ্রেয়ানের কতশত পাগলামির সাক্ষী।

শ্রেয়ান একটু বেশিই অদ্ভুত। নিজের জিনিস কেবল নিজের মানে। সেই জিনিসে অন্য কারো সামান্য পরিমাণের নজর তার দুনিয়া এলোমেলো করে দেয়। সে খুন করতে পারে নিজের জিনিসকে নিজের করার জন্য।

ছোটোবেলায় তার যে কোনো খেলনায় অন্য কারো স্পর্শ এলে, সে খেলনাটিকে ভেঙে ফেলতে দুইবার ভাবত না। ভীড়ে যায় না সে, কালভদ্রে যাওয়ায় যদি স্পর্শ এড়াতে ব্যর্থ হয় তবে সে সেই পোশাকটাকে পুড়িয়ে দিত। তার খাবার থালাও অন্য কেউ ছুঁত না। সবকিছুতে একটা আধিপত্য বজায় ছিল। বড়োলোক বাবার একমাত্র ছেলে হওয়ায় মর্জিমাফিক সব করেছে। নিজের জিনিসকে কেবল নিজের করেই রেখেছি।
বাবার গণ্ডি পেরিয়ে আসার পরও শ্রেয়ান বুঝল না, প্রিয় কোনো জিনিস নয়; সে রক্তমাংসে গড়া মানুষ।

যখন প্রিয়কে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে ফেলেছে শ্রেয়ান, তখন সে বিজয়ী হলো। এখন আর রোজ ফোন দেওয়ার দায় নেই। যখন ইচ্ছে হয়, এখন কিউট লিটল গার্লের কিউট কিউট কথাগুলো শোনা দরকার, তখন শোনে। এমন না যে, শ্রেয়ান প্রিয়কে ভালোবাসে না। ভীষণ বেশিই ভালোবাসে। ভালোবাসার জন্য কী দরকার? দু’জনের মনের সম্মতি! আর? আকর্ষণ, মায়া, অধিকারবোধ.. এসবই তো? সব দুজনের মনেই এক্সট্রা লোডেড।

কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন,
পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়,
নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।

আস্তে-ধীরে বন্ধুদের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকল প্রিয়র। প্রিয় তা ঘূনাক্ষরেও টের পেল না। সে কিছু আমলেই নিল না। এভাবেই চলতে চলতে কথা বলা বন্ধ হতে লাগল, প্রিয় বুঝতেই পারল না তার বন্ধুত্ব-বিচ্ছেদও ঘটে গেল অতিশিঘ্রই।
এই বিচ্ছেদটা একদিনে ঘটেনি। খুবই ধীরে-সুস্থে সময় নিয়ে হয়েছে। তখন শ্রেয়ানের সাথে প্রিয়র সম্পর্কের তিন বছর শেষ হয়েছে। প্রিয় সম্পূর্ণভাবে শ্রেয়ানে ডুব মেরেছে। শ্রেয়ানের ইশারায় ওঠে-বসে। ছেলেটা বশীকরণটা দারুণভাবে পারে। এখন যদি সে প্রিয়কে বলে, সূর্য সর্বদা পশ্চিমে ওঠে। প্রিয় বিপরীতে বিনাবাক্যব্যয়ে তাই মেনে নেব। এদিকে পুরো পৃথিবীর মানুষের বিপক্ষে গিয়ে হলেও সে বলবে, “সূর্য পশ্চিমে উদয় হয়।”

শ্রেয়ান ছাড়া প্রিয় কিছুই বোঝে না। শ্রেয়ানও বাবার বিজনেসে সবে বসেছে। ব্যস্ততা এসেছে। এখন আর প্রিয়কে সে আগের মতো সময় দিতে পারে না। প্রিয় সারাক্ষণ ম্যাসেজ করে যায়। ঘন্টা পর পর শ্রেয়ানের একটা ম্যাসেজ পেলেই সে খুশি হয়ে যায়। এদিকে শ্রেয়ানের এত ব্যস্ততা প্রিয় মানতে পারছে না। কেমন যেন লাগে, কেমন অদ্ভুত লাগে! বাড়ির মানুষদের সাথে দূরত্ব তো হয়েছে সেই কবেই। প্রহরের সাথে শেষ কবে পাশাপাশি বসে কথা বলেছে, তারও হদিস নেই।

এই প্রিয়র সাথে আগের প্রিয়র তফাৎ অনেক। প্রিয় অগোছালো হয়ে পড়েছে। ওজনের তারতম্যটা চোখে পড়ার মতো। চেহারা মলিন, অনুজ্জ্বল। ত্বক উষ্কখুষ্ক। আগের সেই পারিপাট্য, সেই যত্নটা আর নেই। এই প্রিয় ভীষণ রগচটা। শ্রেয়ান বাদে দুনিয়ার যে কেউ তার সামনে এলেই, সে অজানা কারণবশত খেঁকিয়ে ওঠে।

বিগত তিনদিন ধরে শ্রেয়ান তার ম্যাসেজের রিপ্লাই দেয় না, কল পিক করে না। শ্রেয়ান তাকে আগেই বুঝিয়ে বলেছিল, সে ব্যস্ত থাকবে। প্রিয় বুঝেছিল অবশ্য। কিন্তু এখন মানতে পারছে না। ব্যস্ততা কি এতই বেশি যে একটা ম্যাসেজ করার সময় পাচ্ছে না? আচ্ছা, শ্রেয়ান প্রিয়র সাথে কথা না বলে কীভাবে থাকছে? কষ্ট হচ্ছে না? প্রিয়র তো দমবন্ধ হয়ে আসছে। কান্না পাচ্ছে ওর।

ম্যাসেজ করতে করতে সারারাত ঘুমাল না। পরে ননস্টপ কল দিতে লাগল। চৌদ্দবারের মাথায় কলটা পিক করল শ্রেয়ান। প্রিয় হ্যালো বলতেই শ্রেয়ান বলে উঠল,
-“কাজ করছি, সোনা। প্লিজ ডিস্ট্রার্ব কোরো না।”

প্রিয় ভেজা গলায় শুধাল,
-“আমার কথা কি একটুও মনে পড়ে না? কীভাবে পারছ? কষ্ট হচ্ছে না?”

শ্রেয়ান আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারল না, গম্ভীরগলায় একপ্রকার হুঙ্কার ছুড়ল,
-“এসব ফালতু কথা শোনানোর জন্য কল দিয়েছ? তোমাকে কি এখন কোলে বসিয়ে গল্প করব? বুঝতে পারছ না, ব্যস্ত আছি?”

প্রিয় কেঁপে উঠল। মুহূর্তেই জোরেশোরে কেঁদে দিলো। শ্রেয়ান শোনেনি সেই কান্না। কল কেটে পুনরায় নিজ কাজে মত্ত হলো।

প্রিয় সইতে পারছে না কিছুই। কান্না করতে করতে এক হাতের নখ দিয়ে অন্য হাত খামচাতে লাগল। নখ বড়ো আর বেশ ধারালো হওয়ায় চামড়া ছিঁড়ে রক্ত অবধি বেরিয়েছে। প্রিয় কান্না করতে করতে ব্যথায় খেয়াল দিচ্ছে না। এক পর্যায়ে সে নিজের মাথার চুল টানতে লাগল। গায়ের যেখানে যেখানে পারে উদ্ভ্রান্তের মতো খামচাতে লাগল। যন্ত্রণা তো বুকের ভেতর হচ্ছে, সেটা কীভাবে মেটাবে? পারছে না তো সে!

চলবে..