শুধু তোমারই জন্য পর্ব-০৮

0
390

শুধু তোমারই জন্য- ৮

আবিরের মা খেতে ডাকছেন, মিতুলও বসে আছে।
-চলো নীলিবুড়ি, অনেকক্ষণ আমরা এখানে।
-আপনি এমন ভাবে বলছেন, যেন আমি আপনাকে এখানে আটকে রাখছি!
-কিছুটা তো তাই, বলো?
-আপনার টেম্পারেচার একটু কমেছে, কিন্তু শরীর এখনো গরম। জ্বরটা পুরোপুরি কমেনি!
-হু, সকালের চাইতে একটু কম, মাথা ভার লাগছে। আচ্ছা চলো এখন।
আবির আঁচলটা টেনে মাথায় দিয়ে দিলো নীলির। খেতে বসে নীলিকে দেখে মিতুল হাসল। মাকে বললো, দেখো সাজিয়ে দিলাম, সব কিছু খুলে ফেলছে!
আবির বললো, আমি খুলতে বলেছি। ওর চাইতে কানের দুলের ওয়েট বেশি মনে হচ্ছিলো।
মিতুল হাসতে লাগলো। আবিরের মা মিতুলকে ইশারা করে থামতে বললেন। নীলি প্রথমবার এসেছে বলে, মিতুল অর্ডার করে খাবার আনিয়েছে কিছু। আবিরের মা তো আর জানতেন না নীলি আসবে। আবিরের পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলো আবির।
–আবির, আব্বু, এখন একটু ভাত খাবি না?
–না, অন্য কিছু দাও! ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না।
আবিরের মা আবিরকে স্যুপ দিলেন!
মিতুল নীলিকে চিংড়িমাছ দিতে গেলো, আবির বলল , ওর এলার্জি আছে চিংড়িমাছ আর বিফে।
নীলি একবারই বলেছিলো, আবিরের সেটা মনে আছে! নীলি অবাক হলো ভালোও লাগছিলো।পুরো বিষয়টা স্বপ্নের মতো লাগছে নীলির কাছে। এটা সত্যি যে ও প্রথমে বিয়েটা করতে চায়নি, কিন্তু বিষয়টা এমন হবে কল্পনাও করেনি। সব মেয়েদেরই কি স্বামীর প্রতি এই অনুভূতি তৈরি হয়? নীলি ঠিক জানে না! শারিরীক সম্পর্ক কি অন্য টান তৈরি করে? আবিরের কাছাকাছি থাকতে এত ভালো লাগছে, আবির কাছে এলেও ভালো লাগছে!
সেই প্রথম উষ্ণ অনুভূতির রেশটা এখনো কাটেনি।
আবিরের খুব কাছে চলে এসেছিলো। ঘুম ভেঙেছে আবিরের আলতো স্পর্শে , সেই ফিসফিস করে ডাক, নীলি এই নীলি! নীলির মনে হতেই আদর আদর অনুভূতি হয়।
কোথাও কোন তাড়া নেই, কোন ভয় নেই, অদ্ভুত এক নির্ভরতা ছিলো! আবির কি অদ্ভুত ভাবে নীলিকে প্রায়োরিটি দিয়ে গেছে পুরোটা সময়!
ধূর, এই মুহুর্তে আবার মনে হচ্ছে, নীলির গাল লাল হয়ে গেলো! এটা কি এসব ভাবার সময়!
তবে গত কয়েকদিন ধরে অনুভূতিটা নীলিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে মাঝে মাঝেই। কত ভয়ংকর গল্প জানা ছিলো আগে, নীলির অভিজ্ঞতা পুরোপুরি আলাদা। দাদার বন্ধুর আবিরের মতো নাতি থাকতে পারে ধারনাও করেনি। ভেবেছিলো, ফর্মাল প্যান্ট শার্ট পরা, গোঁফওয়ালা অদ্ভুত দেখতে কেউ আসবে, যেমনটা ওদের আশপাশের দুটো বিয়েতে দেখেছে। আবির বিয়ের দিন কি পরেছিলো, মনে নেই তো! ইশ, কাঁদতে কাঁদতে চোখ মেলে দেখেই নি ভালো করে! আফসোস হচ্ছে, এইদিনটা নষ্ট করে ফেললো নীলি!
-নীলি খাচ্ছো না কেন?
নীলি পাশে তাকিয়ে দেখলো আবিরের খাওয়া শেষ, সে তখনো পোলাও নাড়ছে!
-নীলি খাওয়া নিয়ে হেজিটেট করো না, যেটা ইচ্ছে করছে খাও, মন না চাইলে জোর করে খেতে হবে না।
-মামণি আরেকটা চিকেন দিবো! আবিরের মা জিজ্ঞেস করলেন।
আবির বলল, প্লেটের টা নড়েওনি, বলেই হাসলো!
আসলে নীলির ভীষন অস্বস্তি হচ্ছিলো।
একটু টুকটাক মুখে দিয়ে নীলি উঠলো!
মিতুল নীলিকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলো, আবিরের ফোন আসছে একের পর এক।
-ভাইয়া অনেক ব্যস্ত থাকে বুঝলে, তুমি কয়েকদিন পরে বিরক্ত হয়ে যাবে!
-আপু আপনি কি করেন? মানে পড়া শেষ?
নীলি জিজ্ঞেস করলো!
-আমি ফ্যাশন ডিজাইনিংএ একটা কোর্স করছি, টুকটাক ডিজাইন করি।
-আচ্ছা।
-তোমার বিয়ের ড্রেস কিন্তু আমি ডিজাইন করবো, হলুদের শাড়িও।
নীলি ঘাড় নাড়লো হ্যা-বোধক। নীলির মনে হলো মিতুল নীলির চাইতে বড় তো, অথচ নীলি তার ভাবী, কি আশ্চর্য! আবার এটা তো হতেই পারে, অস্বাভাবিক তো না।
আবির বের হয়ে বললো, মা একটু অফিসে যেতে হবে, আজ ফিরবো না আর।
নীলি তৈরি হও, বের হবো!
-জ্বরটা তো কমেনি আব্বু, আজকে বাইরে না থাকলে হয় না?
-সমস্যা নেই মা! তুমি রুমের চাদর পাল্টে দিতে বইলো বুয়াকে, জ্বর জ্বর হয়ে আছে!
নীলি বলল, আপু, শাড়ি পাল্টে আসি?
আবির বলল, কি দরকার, থাকো পড়ে, গাড়িতেই তো যাচ্ছো।
নীলি তৈরি হয়ে বিদায় নিতে গেলো।আবিরের মা নীলিকে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন। নীলি পরতে চাইলো না।আবিরের মা বললেন, প্রথমবার এসেছো মা, এটা দোয়া তেমার জন্য।
তিনি মনে মনে বললেন, হে পরম করুণাময় আল্লাহ, কোন বিপদ না আসুক আমার ছেলের উপর! হুট করে জীবনে আসা মেয়েটাকে কেমন আপন করে নিয়েছে। এভাবেই যেন সবকিছু থাকে।
নীলিকে নিয়ে বের হলো আবির।
আবির একটা গাঢ় নীল রঙের শার্ট পরেছে।
আবিরকে এখন যতবারই দেখছে, নীলির ততোবারই অন্য রকম ভালো লাগছে। এমন কেন হচ্ছে!
-সত্যি অফিসে যাবেন?
-হু,
-জ্বর আছে তো!
-কমে যাবে, প্যারাসিটামল খেয়েছি।
-আমি চলে যাবো?
-কেন, কি কথা হলো তোমার সাথে!
-তো, আপনি তো অফিসে যাচ্ছেন, আমি কই যাবো?
-নীলি, ছোট হলেও অফিসটা আমার, তুমি আমার সাথেই যাচ্ছো! আমার চেম্বারে বসবে, আমি কাজ শেষ করে তারপর ওখানে চলে যাবো।
নীলি বলল, আচ্ছা!
সিগনালে দাঁড়ালো ওরা।
-কি খাবে বলো তো, অর্ডার করে দিই, আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে চলে আসবে?
-কি খাবো!
-কিছুই তো খাওনি, সুন্দর করে নাড়াচাড়া করে রেখে উঠে এসেছো! পাস্তা অর্ডার করি? খাও তো?
নীলি ” হ্যা” বললো। আবির অর্ডার করে দিলো।
নীলি ভাবতে লাগলো, আচ্ছা অফিসে কতক্ষণ থাকবে আবির, অবশ্য সমস্যা নেই, আবিরের পাশে বসে থাকতেও নীলির খারাপ লাগবে না বোধহয়।
২৩
আবিরের ফোন ভাইব্রেট করছে।ও ফোন তুললো, রিশাদ করেছে।খাবার অর্ডার রিশাদের নম্বরে করা ছিলো। আবির অনেক সময়ই করে, হয়ত ঢাকার বাইরে থেকে ফিরছে, অফিসে আছে এমন কারো নম্বর দিয়ে অর্ডার করে দেয়।
– আবির, বের হইছিস?
-হু, আছিস তো?
-আছি, ফুড ডেলিভারিম্যান ফোন করেছিলো। তোর শরীর কেমন এখন? বাসায় ছিলি না?
-হু ছিলাম তো, অফিসে সবাই আছে? আগের থেকে বেটার আছি।
-নুহাশ নাই, গাজীপুরে গেছে। সরি রে, তোকে বের করতে হলো, ভাবছিলাম সামলাতে পারবো, কিন্তু ব্যাংককের ক্লায়েন্ট ডিল তোর করা তো, কিছু কাজ করতেই হবে।
-বুঝতে পারছি। আসতেছি।
-তুই কি ডিল ফাইনাল উপলক্ষে এত মিষ্টি অর্ডার করেছিস?
আবির হো হো করে হেসে বলল, আসতেছি। কাছাকাছি আছি!
আবিরের কাজটা জরুরি। বছর দুই ধরে থাই একটা কোম্পানির সাথে কাজ করতে চাইছে, কিন্তু নতুন বলে, ওদের কাছে কাজটা আসে না, বড় কোন কোম্পানি পেয়ে যায়। এবারে দুটো ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ করেছে আবির। বেশ প্রিপারেশন নিয়ে প্রেজেন্টেশনটা করা ছিলো। ব্যাংককে জরুরি মিটিং এটা নিয়েই ছিলো।
ওরা পজেটিভ উত্তর দিয়েছে আজ সকালে, এখন বাকি ডকুমেন্টস পাঠাতে হবে।কয়েকটা রেডিও করতে হবে।
আবির কাউকে দিয়ে এই কাজ করাতে চায় না।
তাই শরীর খারাপ নিয়েও অফিসে আসছে।
নীলির ফোন বাজছে।
-হ্যালো মা!
-কি করছো, রুটিন দিয়েছে?
-হু
-কবে শেষ হবে পরীক্ষা।
১৪ ছিলো, কিন্তু নীলি বললো, ভাইভা মিলে ২৫ তারিখ লেগে যাবে, এখনো জানে না।
আবির কবে সময় পাবে কক্সবাজার যেতে, তার উপর নির্ভর করবে আসলে, বাড়ি কবে যাবে।
-খেয়েছো দুপুরে?
-হু,
-ঠিক আছে, রাখছি!
নীলির মা ফোন রাখলেন। মেয়েটা ইদানিং কথা বলতে চায় না। সে ফোন না করলে ফোনও করে না। মনে হয় রাগ করে আছে, পরীক্ষার পরে ছাড়াছাড়ির ঝামেলা শেষ হলে আবার ঠিক হবে হয়ত। নীলিকে নিয়ে আবির অফিসে ঢুকলো, রিশাদকে রুমে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলো নীলির সাথে।
রিশাদ হাসতে হাসতে বললো, এজন্য সকালের জ্বর দুপুরে ভালো হয়ে গেলো নাকি!
নীলি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো। রিশাদ নীলিকে দেখে ভাবলো, আবিরের হুট করে বউপাগল হয়ে যাওয়ার কারন আছে, মেয়েটা একেবারে “ইনোসেন্ট বিউটি” যাকে বলে, সেরকম।
আবির রিশাদকে বললো, আগে কাজ শেষ করি, তারপরে আলাপ করিয়ে দিবো সবার সাথে।নুহাশের সাথে তো দেখা হবে না আজ! ব্যাটা মিস করলো!
রিশাদ পিওন সগীরকে ডেকে মিষ্টি দিতে বললো, সব স্টাফদের।
নীলি দেখলো অফিসটা ছোট নয়। বেশ বড়, অনেক স্টাফও আছে, এটা আবির, রিশাদ আর নুহাশের জয়েন্ট কোম্পানি। একসাথেই কাজ করছে তিন জন।
-নীলি বুড়ি, আমি এখন একটু কাজ করবো, তুমি বসো! পাস্তা দিয়ে গেছে, বসে খাও।
নীলি আবিরের চেম্বারে সোফায় পা তুলে বসলো!
কিন্তু বোরিং লাগছিলো, তাই উঠে আবিরের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।কতক্ষণ উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো!
-আপনি কি খুব ব্যস্ত?
-হু, একটু!
-কখন শেষ হবে?
-সময় লাগবে, ঘন্টা দুয়েক!
-এতক্ষণ লাগবে! এতক্ষণ আমি কি করি!
-তুমি পাস্তাটা নাও, নিজে খাও, আমাকেও খাইয়ে দাও!
কাজ করছি দেখছো না!
ইশ্, কিভাবে অর্ডার করছে দেখো!বাসায় বসেও মাথায় পানি ঢালিয়েছে!
নীলি পাস্তার প্লেটটা নিয়ে আবিরের পাশে দাঁড়ালো।
-কই, এই যে,
আবির খুব স্বাভাবিক ভাবে হা করে নিলো, যেন বিষয়টা একটা অধিকার, অভ্যস্ততা। এত তাড়াতাড়ি সেটা তৈরি হলো কি করে নীলি বা আবির কেউই জানে না।
-আচ্ছা কি কাজ করছেন??
-কিছু কাগজপত্র তৈরি করছি।
-কোথাও জমা দিতে হবে?
-হু!
আবির আবার নিলো পাস্তা। নীলির দিকে না তাকিয়েই নিলো। একটা কাজ শেষ করার পরে, আবিরের মনে হলো, নীলি আমার জন্য খুব লাকি! ওর সাথে বিয়ের পরপরই মিটিংটা ছিলো, দুটোই পজেটিভ রেজাল্ট। ডিল হলে কোম্পানি এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
-নীলি, তুমি খাও, খাচ্ছো না কেন?
-আপনি তো দেখেননি, খাচ্ছি না বুঝলেন কিভাবে!
আবির নীলির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আর খাবো না। তুমি সোফায় গিয়ে আরাম করে বসে খাও।
আমি এখন কাজ করবো, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কথা বলা যাবে না। ওকে?
নীলির ভীষন রাগ হলো, মানে কি, নীলি কি বিরক্ত করছে!
আবির বুঝলো, নীলির হাত ধরে বলল, শোনো নীলিবুড়ি, বিয়ের পরপরই থাইল্যান্ড গেলাম না, ওখানে দুটো কোম্পানির সাথে মিটিং ছিলো, ওরা আমাদের স্যাম্পল পছন্দ করেছে, ওদের এখন বাকি ডকুমেন্টস পাঠাতে হবে।
সব ঠিক হলে অনেক বড় একটা অর্ডার পাবো আমরা!
তুমি তো আমার জন্য খুব লাকি দেখছি, তোমার সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর দু’বছর ধরে চেষ্টা করতে থাকা ডিলটা ফাইনাল হতে যাচ্ছে।
নীলি এতো কিছু বুঝতে চাইলো না।
সে সোফায় গিয়ে একটু পাস্তা খেলো, তারপর কতক্ষণ ফোনে ফেসবুকিং করলো! তারপর ঘুমিয়ে গেলো।
আবিরের কাজ শেষ হলো দেড় ঘন্টা পরে, আবির কাজে ডুবে থাকলে আর কিছু খেয়াল থাকে না।
সোফায় তাকিয়ে দেখে নীলি ঘুমাচ্ছে।
আবিরের খুব হাসি পেলো, একটা অপরিচিত অফিসে এসে সোফায় বসে এভাবে ঘুমিয়ে পড়া যায়! কত্ত বোর ফিল করেছে মেয়েটা!
তাও চুপচাপ ছিল, অনেক লক্ষি মেয়ে, ভীষণ মিষ্টি।
আবির নীলি পাশে গিয়ে হাঁটু ভাজ করে বসে ডাকল, নীলি, এই নীলি!
নীলি চমকে উঠে বসল ঘুম থেকে।

চলবে

শানজানা আলম