শুধু তোমারই জন্য পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
966

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২৩
#Ornisha_Sathi

–“কেক কাটবে না?”

আহিয়ানের কথায় আনিতা আহিয়ানের বুক থেকে মাথা তুলল। চোখ মেলে আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আনিতার কপালে পড়া চুলগুলো আহিয়ান হাত দিয়ে সরিয়ে বলে,

–“চলো কেক কাটবে।”

কথাটা বলেই আহিয়ান আনিতার হাত ধরে ছাদের অন্য দিকে নিয়ে গেলো। আনিতা সামনে চোখ রাখতেই দেখে ছোট্ট একটা গোল টেবিল লাল আর সাদা নেট কাপড় দিয়ে সাজানো। টেবিলের উপর জুড়ে লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো ছিটানো। আর টেবিলের চারপাশে লাল আর সাদা রঙের মোমবাতি জ্বালানো। আহিয়ান আনিতার হাত ধরে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। টেবিলে ছোট্ট একটা গোল আকৃতির চকলেট কেক। তাতে ইংলিশ ফ্রন্টে লিখা, “হ্যাপি বার্থডে পিচ্চিপাখি”

কেকের পাশ থেকে আহিয়ান নাইফটা উঠিয়ে আনিতার হাতে দিলো। আনিতা নাইফটা হাতে নিলো। আনিতা এক হাতে নাইফ নিয়ে অন্যহাত দিয়ে আহিয়ানের হাত নিজের হাতের উপর রাখলো। দুজনে মিলে একসাথে কেক কাটে। এবং একসাথেই একে অপরকে কেক খাইয়ে দেয়। আহিয়ান ফোন বের করে তন্ময়কে ম্যাসেজ করে। কিছুক্ষণের মাঝেই তন্ময় ছাদে এসে হাজির হয়। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। তন্ময় আহিয়ানের কাছে গিয়ে শপিং ব্যাগটা ওর কাছে দিলো। আহিয়ান আনিতার দিকে ঘুরে শপিং ব্যাগটা আনিতার হাতে দিয়ে বলে,

–“এটা তোমার জন্য।”

–“কি আছে এতে?”

–“সেটা রুমে গিয়ে দেখে নিও।”

আনিতা হেসে মাথা দুলিয়ে ব্যাগটা টেবিলে রাখলো। তারপর এক টুকরো কেক কেটে তন্ময়কে খাওয়াতে নেয়। তন্ময় আনিতার হাত থেকেই কিছুটা কেক নিয়ে আনিতাকে আগে খাইয়ে দিয়ে পরে আনিতার হাত থেকে কেক খেলো। তন্ময় বড় একটা চকলেট বক্স আনিতাকে দিয়ে বলে,

–“হ্যাপি বার্থডে কিউটিপাই। তোমার ভাইয়ের তরফ থেকে তোমার জন্য তার এই সামান্য উপহার।”

–“থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া।”

পরবর্তীতে তন্ময় মুচকি হাসলো। আনিতা চকলেট বক্সটাও টেবিলে রেখে দিলো। আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে তন্ময় বলে,

–“আর দশ মিনিট টাইম দিলাম দুজনকে একসাথে সময় কাটানোর জন্য। আমি নিচে দেখছি কেউ আবার উঠলো কিনা।”

কথাটা বলে আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না তন্ময়। সঙ্গে সঙ্গেই নিচে নেমে গেলো। আহিয়ান আনিতার হাত ধরে একদম ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ আনিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

–“বিকেল থেকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই না?”

–“এতটুকু কষ্ট না পেলে এতটা খুশি হতে পারতাম না।”

–“কষ্ট না দিয়েও তো সারপ্রাইজটা দেওয়া যেতো।”

–“তা যেতো কিন্তু এতটা খুশি তাতে থাকতো না আমার মনে হচ্ছে।”

–“আচ্ছা শোনো না।”

–“শুনছি তো বলুন।”

–“একটা রিকুয়েষ্ট করবো?”

–“রি্ রিকুয়েষ্ট?”

–“হ্যাঁ।”

–“আচ্ছা বলুন কি রিকুয়েষ্ট।”

–“রাখবে তো?”

–“না জেনে কিভাবে বলবো?”

–“কাল বেরোতে পারবে আমার সাথে?”

–“ম্ মানে?”

–“সারাটাদিন একসাথে থাকতে চাই। থাকবে?”

–“এটা ক্ কিভাবে স্ সম্ভব বল্ বলুন? খুব র্ রিস্ক হয়ে যা্ যাবে।”

–“যেতে চাও কিনা সেটা বলো।”

–“ধরা পরে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। মেজো চাচ্চু ছোট চাচ্চু ফাইয়াজ ভাইয়া সবাই বাসায়। একবার যদি কেউ দেখে ফেলে__”

–“এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি শুধু বলো যাবে কিনা?”

–“কিন্তু___”

–“আচ্ছা বাদ দাও।”

বেশ কিছুটা সময় দুজনেই চুপ করে ছিলো। আনিতা আহিয়ানের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে আহিয়ান মুখ কিছুটা গোমড়া করে রেখেছে৷ আনিতা এগিয়ে এসে নিজে থেকে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখে। আহিয়ানও আষ্টেপৃষ্টে আনিতাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। আনিতা আহিয়ানের সাথে নিজেকে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

–“আমি জানি আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। খারাপ লাগছে আপনার। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন এসময় যদি কোনো ভাবে আপনার আর আমার সম্পর্কের কথাটা সবার সামনে চলে আসে তাহলে কিন্তু আমাদের জন্যই খারাপ হবে। এমন কি সারাজীবনের জন্য আমরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নও হতে পারি। কিন্তু আমি আপনাকে একদম হারিয়ে ফেলতে চাই না বিশ্বাস করুন। আপনাকে খুউব বেশিই ভালোবাসি আমি৷ আপনাকে হারিয়ে থাকতে পারবো না আমি।”

–“আমি জানি পাগলি। তুমি যেমন আমাকে হারিয়ে থাকতে পারবে না। আমিও তেমনি পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে।”

আহিয়ান আনিতার দু-গাল ধরে কপালে একটা চুমু খেলো। লজ্জায় আনিতা আবারো আহিয়ানের বুকে মুখ লুকায়। কিছুক্ষণ বাদে হুট করেই ছাদের দরজায় খটখট আওয়াজ হয়। আনিতা আহিয়ানকে ছেড়ে দেয় সাথে সাথেই। আহিয়ান আনিতাকে না ছেড়েই দরজার দিকে তাকায়। ছাদের দরজায় তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। আনিতা ছাড়া পাবার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে কিন্তু আহিয়ান আনিতাকে না ছেড়েই তন্ময়কে বলে,

–“কি চাই?”

–“ইউর টাইম ইজ ওভার। দশ মিনিট সময় দিয়েছিলাম। আর এখন দশ মিনিট শেষ হয়ে বারো মিনিট চলছে।”

–“আর একটু কষ্ট করে পাহাড়া দে ভাই।”

–“তোমরা দুজনে এদিকে আলাদা সময় কাটাবে আর আমি সিড়ির নিচে দাঁড়িয়ে মশার কামোড় খাবো তাই না?”

–“আর একটু প্লিজ ভাই।”

–“একদমই না।”

কথাটা বলেই তন্ময় টেবিলটার কাছে এগিয়ে আসলো। তারপর টেবিল থেকে মোম গুলো নিভিয়ে একটা ব্যাগে রাখলো। নেট কাপড়গুলো খুলেও সেই ব্যাগেই রাখলো। গোলাপের পাপড়ি গুলো নিয়ে একটা আলাদা ব্যাগে রেখে ব্যাগটা ছাদ থেকে ফাইয়াজদের বাসার পিছন দিকে ফেলে দিলো। ছাদের এক কোনে দুটো চেয়ার সমেত টেবিলটা থাকে। তন্ময় টেবিলেটা সরিয়ে আগের জায়গায় রেখে দিলো। আনিতা এবার জোড় করেই আহিয়ানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আহিয়ানের থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো আনিতা। তন্ময় কেকের বাকী অংশটুকু হাতে নিয়ে আহিয়ানদের সামনে এসে দাঁড়ালো। কেকটা তিন টুকরো করে এক টুকরো নিজে খেতে খেতে বলে,

–“তোরা যে একা শেষ করতে পারবি না জানতাম। তাই নিজের টুকু নিজে খেয়ে নিলাম। এখন বাকীগুলো তোরা দুজনে মিলে শেষ করবি।”

–“আমি খাবো না। নিচে যাচ্ছি আমি। তোমরা এসো।”

কথাটা বলে আনিতা চলে আসতে নিলেই তন্ময় আনিতাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

–“তা বললে তো হবে না কিউটিপাই। রাতে তো খেলে না কিছুই। এখন এইটুকু খেতেই হবে।”

–“পারবো না আমি ভাইয়া।”

–“আহিয়ানের জন্য না হলেও আমার জন্য খেয়ে নাও প্লিজ।”

আনিতা অসহায় মুখ করে তাকালো তন্ময়ের দিকে। আহিয়ান মুখ টিপে হাসছে। আনিতা আর কোনো উপায় না পেয়ে কিছুটা কেক খেলো। বাকীটুকু রেখে দিয়ে বলে,

–“আর পারবো না।”

–“ওকেহ আর খেতে হবে না। এইটুকু না হয় তোমার প্রেমিকপুরুষ আহিয়ানই খেয়ে নিবে।”

তন্ময় কথাটা বলেই আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো। আহিয়ানও ঠোঁট কামড়ে ধরে ক্ষানিকটা শব্দ করে হেসে দিয়ে বলে,

–“একদম। এইটুকু আমিই খেয়ে নিবো। সাথে আমার পিচ্চির ঠোঁটের_____”

আনিতা আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো। আনিতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আহিয়ান আর তন্ময় একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিছুটা শব্দ করেই হেসে দিলো।

*

বিকেলে আনিতা পুরো বাসা সাজানো দেখে বেশ অবাক হয়। কখনো সেভাবে ওর বার্থডে সেলিব্রেট করা হয়নি। কিন্তু আজ? আজ এভাবে সব সাজানো কেন তাহলে। রুমে বসে বসে এসব ভাবছিলো আনিতা। অনিমা এসে আনিতার সামনে একটা ব্যাগ রেখে যায়। আর তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে বলে। আনিতা ব্যাগটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখলো। লাল রঙের একটা লং গাউন রাখা। মাঝে খুবই ছোট ছোট গোল্ডেন স্টোন বসানো। কিছুক্ষণ পরই রোদেলা তাসকিয়া জেরিন শুভ জারা জয় সব্বাই একসাথে এসে হাজির হলো। আনিতা ওদের দেখে এগিয়ে গিয়ে বলে,

–“তোরা সবাই?”

–“হ্যাঁ আমরা। চলে এলাম সবাই তোর বার্থডে পার্টি এ্যাটেন্ড করতে।”

শুভর কথায় আনিতা অবাক হলো ক্ষানিকটা। বাহ! ভালোই তো! পার্টি এ্যারেঞ্জ করা হচ্ছে সবাইকে ইনভাইট ও করা হয়েছে। অথচ আনিতা কিছুই জানে না? যাক ভালোই হলো এই সুবাদে বেশ এঞ্জয় করা যাবে। রোদেলা আনিতাকে কিছু ভাবতে দেখে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলে,

–“কিরে? কি ভাবছিস এত? রেডি হয়ে আয়।”

–“হুম। তোরা বস আমি এক্ষুনি রেডি হয়ে আসছি।”

কথাটা বলেই আনিতা জামাটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেশ ক্ষানিকটা বাদে জামা পালটে বের হলো আনিতা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো আঁচড়ে এক সাইডে সিথি করে চুল ছেড়ে দিলো। ঠোঁটে ডার্ক রেড লিপস্টিক চোখে হালকা করে কাজল। ব্যাস এতেই আনিতা রেডি। বরাবরের মতো আহিয়ানের দেওয়া ব্রেসলেট একহাতে পড়ে নিলো। এবং অন্য হাতে রেড এন্ড গোল্ডেনের কম্বিনেশনের পাথরের চুড়ি পড়ে নিলো।

রেডি হয়ে আনিতা বের হয় রুম থেকে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে সরাসরি চোখ পড়ে আহিয়ানের উপর। ফুল ব্লাক ড্রেসআপে আছে ছেলেটা। ইশ্ চোখ সরানো দায় হয়ে যাচ্ছে। সোফায় বসে কি সুন্দর ভাবে হাত নারিয়ে ফাইয়াজ আর তন্ময়ের সাথে কথা বলছে। আহিয়ানের চলাফেরার স্টাইল যেমন ইউনিক ওর কথাবার্তা বলার ধরনও তেমন ইউনিক। আনিতাকে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে জেরিন বলে,

–“কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লি যে? চল।”

জেরিনের কথায় আহিয়ান কথা থামিয়ে আনিতার দিকে তাকায়। আনিতাকে দেখেই যেন একদম থমকে যায় ও। ফর্সা গায়ে লাল ড্রেস আর খোলা চুলে একদম অমায়িক লাগছে আনিতাকে। আহিয়ান তাকাতেই আনিতা ওর থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। আহিয়ান অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে আনিতাকে। আনিতা জেরিনের সাথে অন্যদিকে চলে গেলো। আহিয়ান তখনও ঘাড় ঘুড়িয়ে আনিতাকেই দেখে যাচ্ছিলো। তা দেখে তন্ময় আহিয়ানের মাথা দুহাতে ধরে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিয়ে বলে,

–“সবাই আছে এখানে। যেভাবে আনিতাকে দেখছিস যে কেউ বুঝে ফেলবে তোদের মাঝে কিছু একটা আছে। সো এবার চোখটা সরা ওর থেকে।”

–“কি করে চোখ সরাই ওর থেকে বল তো?”

আহিয়ান আবারো ঘাড় ঘুড়িয়ে আনিতার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। তন্ময় কপাল চাপরে আবারো আহিয়ানকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে বলে,

–“জানিনা। বাট ওর থেকে চোখ সরা।”

–“ওফস তুই না কিচ্ছু বুঝিস না। আগে নিজে প্রেমে পড় তারপর আমিও দেখে নিচ্ছি তোকে।”

–“আচ্ছা দেখিস। এখন তারপরও আনিতার দিকে আর তাকাস না।”

–“হুম।”

রাত ন’টার দিকে বার্থডে পার্টি শেষ হয়ে যায়। জয় আর জারা কিছুক্ষণ আগেই বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছে। ওদের দুজনের বাসা একই দিকে। সেজন্য একসাথেই বের হয়েছে দুজনে। থাকার জন্য বেশ জোরাজোরি করলেও ওরা দুজন রাজি হয়নি। রোদেলা আর তাসকিয়াও বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আনিতা অনেকবার করে বলছে জেরিন শুভ রোদেলা তাসকিয়া ওদের চারজনকে থেকে যেতে কিন্তু ওরা রাজি হচ্ছে না। তখনই ফাইয়াজ এসে আনিতাকে বলে,

–“আনি বুড়ি একটু এদিকে শোন।”

ফাইয়াজের ডাকে আনিতা ওদের চারজনকে “আসছি” বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ফাইয়াজ আনিতাকে ছাদের সিড়ির দিকে নিয়ে বলে,

–“একটা কাজ করে দিতে পারবি?”

–“কি কাজ শুনি?”

–“তাসকিয়াকে যেভাবেই হোক আজকে রেখে দিতে হবে। প্লিজ কোনো ভাবে আজকে ওকে বাড়ি যাওয়া থেকে আটকাতে হবে তোর।”

–“এতে আমার লাভ কি?”

–“তোর লাভ কি মানে? এই যে এত কষ্ট করে তোর বার্থডে সেলিব্রেট করার জন্য ছোট মামাকে দিয়ে বড় মামাকে রাজি করালাম। তোকে সারপ্রাইজ দিলাম আর তুই বলছিস তোর লাভ কি?”

–“হ্যাঁ আমার লাভ কি? আমি বলেছিলাম তোমাকে এসব করতে?”

–“এই যে এত এত গিফট পেলি সবই কিন্তু আমার জন্য।”

–“হুম তো?”

–“প্লিজ ওকে রেখে দে না আজকের জন্য। বড় ভাইয়ের এই রিকুয়েষ্টটা রাখ।”

–“ভেবে দেখছি।”

–“এইটুকুর জন্য আবার ভেবে দেখতে হবে?”

–“আমি যা বলবো তাই করতে পারবে?”

–“কি? করতে হবে শুনি।”

–“প্রথমত, তুমি আম্মুকে রাজি করাবে আজকে আমি আর আমার ফ্রেন্ডদের তোমাদের বাসায় থাকার জন্য।”

–“আমি কিভাবে রাজি করাবো?”

–“সেটা জানি না। আর দ্বিতীয়ত, আজ তো আকাশে অনেক বড় চাঁদ উঠেছে। সো গভীর রাত অব্দি আমাদের নিয়ে বাইকে করে ঘুরতে হবে। মানে লং ড্রাইভ যাকে বলে। তোমায় আর তাসকিয়াকে আলাদা ভাবে সময় কাটাতে দিবো নো সমস্যা। এখন বলো রাজি আছো কিনা?”

–“পারবো না আমি।”

–“ওকেহ তাহলে আমিও তাসকিয়াকে আটকাতে পারবো না।”

–“এই না না প্লিজ।”

–“তাহলে বলো তুমি রাজি?”

–“ওকে__ওকে আমি রাজি।”

–“আচ্ছা তাহলে তোমার কাজ হয়ে গিয়েছে। তুমি যাও গিয়ে আম্মুকে রাজি করাও আমি ওদের নিয়ে আসছি তাদের বাসায়।”

কথাটা বলেই আনিতা ওখান থেকে আবার রুমে চলে এলো। নানান টালবাহানা দিয়ে ওদের সবাইকে আজ রাত থাকতে রাজি করালো। বেশ কিছুটা বাদে ফাইয়াজ এসে আনিতা রোদেলা তাসকিয়া জেরিন শুভ ওদের নিয়ে ফাইয়াজদের বাসায় গেলো। আজ রাত ওরা ওখানেই থাকবে। শুভ আর ফাইয়াজ একসাথে থাকবে তন্ময় আর আহিয়ান একসাথে। আর ওরা চারজন একই রুমে শুবে বলে ঠিক করেছে।

রোদেলা তাসকিয়া জেরিন তিনজনে মিলে আড্ডা দিচ্ছে। আর আনিতা শুয়ে শুয়ে আহিয়ানের কথা ভাবছে। আহিয়ান আজ সারাটাদিন আনিতার কাছে চেয়েছিলো। কিন্তু আনিতা সেটা দিতে পারেনি। তাই তো কোনোভাবে ফাইয়াজকে রাজি করালো আজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর ওদের সবাইকে নিয়ে বাইকে করে লং ড্রাইভে বের হওয়ার জন্য। দিন কাটাতে পারেনি তাতে কি? গভীর রাত অব্দি একসাথে ঘুরবে আজ ওরা। মনে মনে এসব ভেবে মৃদু হাসলো আনিতা। এখন অপেক্ষা শুধু ফুপ্পি আর আংকেলের ঘুমানোর।



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২৪
#Ornisha_Sathi

কিছুক্ষণ বাদে দরজায় খটখট শব্দ হতেই রোদেলা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। ফাইয়াজ দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। ফাইয়াজকে দেখেই রোদেলা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। ফাইয়াজ ভিতরে ঢুকে সবাইকে বলল,

–“কোনোপ্রকার শব্দ না করে পা টিপে টিপে বের হও রুম থেকে। ফাস্ট।”

–“কিন্তু কেন? কোথায় যাবো?”

–“বাইকে করে লং ড্রাইভে।”

রোদেলা পালটা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। ফাইয়াজকে দেখে রোদেলা তাসকিয়া জেরিন তিনজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। আনিতাকে দেখতে না পেয়ে ফাইয়াজ জিজ্ঞেস করলো,

–“বুড়িটা কোথায়? ওকে দেখছি না যে।”

–“ও তো সেই কখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে মনে হয়।”

জেরিনের কথায় ফাইয়াজ বিস্মিত চোখে তাকালো। ওর যেন জেরিনের কথাটা ঠিক হজম হলো না। যে কিনা লং ড্রাইভে যাওয়ার জন্য লাফালাফি করলো। লং ড্রাইভে যাওয়ার জন্য ফাইয়াজকে এভাবে রাজি করালো সে-ই কিনা এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে? কি এক আশ্চর্য কথা! ভাবা যায় এ-সব?

–“ওরে ডেকে তুলে রাস্তায় এসো তোমরা। ওখানেই ওয়েট করছি আমরা তোমাদের জন্য।”

কথাটা বলে ফাইয়াজ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। জেরিন ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,

–“তোরা যা আমি আনিতাকে নিয়ে আসছি।”

জেরিনের কথায় ওরা দুজন নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বাসা থেকে বের হয় গেলো। জেরিন বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে নিচ্ছিলো আনিতাকে ডাকতে সে-সময়ই আহিয়ান উপস্থিত হয় সেখানে। আহিয়ানকে দেখে অবাক হয়ে জেরিন বলে,

–“তুমি? এখানে? ফাইয়াজ ভাইয়া বা অন্য কেউ দেখলে সমস্যা হবে তো।”

–“দেখবে না কেউ। আনিতা কোথায়? এখনো ঘুম থেকে উঠেনি?”

–“নাহ মাত্রই ওকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।”

–“আচ্ছা তুমি সরো আমিই ডেকে তুলছি ওকে।”

জেরিন কিছু না বলে বিছানার দিক থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। আহিয়ান বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে আনিতার মুখের উপর থেকে কাঁথা সরালো। আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে আনিতাকে ডাকলো বার কয়েক। কিন্তু আনিতা উঠবে তো দূরে থাক সারাও দিচ্ছে না। জেরিনও এগিয়ে গিয়ে ডাকতে শুরু করলো আনিতাকে। আনিতা পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। কাল অনেক রাত অব্দি জেগে থাকায় আজ এই অবস্থা। জেরিন আবারো বলে,

–“আনিতা লং ড্রাইভে যাবি না? সব্বাই চলে গিয়েছে কিন্তু। উঠ না জানু প্লিজ।”

–“উঠছি।”

ঘুম কাতুরে কন্ঠে আনিতা চোখ বন্ধ রেখেই কথাটা বলল। একটু নড়েচড়ে গায়ে থেকে কাঁথা সরিয়ে ফেলল আনিতা। আনিতাকে এভাবে এলোমেলো ভাবে দেখে আহিয়ান অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সাথে জেরিনও। আহিয়ান হালকা কেঁশে সরে দাঁড়ালো ওখান থেকে। দ্বিতীয় বারের মতো আহিয়ান আনিতাকে এভাবে এলোমেলো অবস্থায় দেখলো। আনিতার পরনের কালো টি-শার্ট কিছুটা উপরে উঠে আছে যার ফলে পেটের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। কাঁধের দিক থেকেও টি-শার্ট কিছুটা সরে গিয়েছে। আহিয়ান অন্যদিকে ঘুরে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো। জেরিন তড়িঘড়ি করে আনিতার পাশে গিয়ে বসে ওর টি-শার্ট ঠিক করে দিয়ে আনিতাকে ডেকে বলে,

–“এই আনিতা, জানু উঠ না। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছিস তুই।”

–“প্রবলেম কি? তুই আর আমিই তো।”

–“আজ্ঞে না। তুই আর আমি না। আহিয়ানও আছে।”

–“কিইইই? আগে বলবি তো আমায়।”

কিছুটা চিৎকার করে কথাগুলো বলেই আনিতা উঠে বসলো। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে আনিতার খুব। সাথে জেরিনও বেশ লজ্জা পেয়েছে। আহিয়ান উলটো দিকে ঘুরে থেকেই বলে,

–“বাইরে আছি আমি। তোমরা দুজনে তাড়াতাড়ি আসো। সবাই অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য।”

কথাটা বলে আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে আহিয়ান রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আহিয়ানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আনিতা জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো। এতক্ষণ যেন দম বন্ধ হয়ে ছিলো। জেরিনও যেন এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কি একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলো। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। আনিতা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর ফোন হাতে নিয়ে দুজনে একসাথেই বের হলো বাইরে যাওয়ার জন্য।

আনিতা আর জেরিন পা টিপে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আনিতারা বাসা থেকে বের হতেই ফাইয়াজ সেখানে এসে উপস্থিত হলো। ফাইয়াজ ওদের দুজনকে দেখে বলে,

–“এতক্ষণে তোর ঘুম ভাঙলো? যাই হোক রাস্তায় যা তোরা। আমি গেট আটকে আসছি।”

আনিতা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে জেরিনের হাত ধরে রাস্তার দিকে হাঁটা লাগালো। আনিতা রাস্তায় বেরোতেই দেখে আহিয়ান তন্ময় শুভ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে ফাইয়াজের বাইকও রাখা। কিছুক্ষণের মাঝেই ফাইয়াজ চলে এলো। ফাইয়াজ এসে বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দিতেই তাসকিয়া ওর পিছনে গিয়ে বসলো। আর জেরিন আগেই শুভর বাইকে বসে পড়েছে। দোটানায় পড়ে গেলো আনিতা। আহিয়ানের বাইকে উঠবে নাকি তন্ময়ের? নিজে থেকে আহিয়ানের বাইকে গিয়ে বসলে যদি ফাইয়াজ কিছু ভাবে তখন কি হবে? আনিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহিয়ান তন্ময় রোদেলা তিনজনেই ব্যাপারটা বুঝলো। তন্ময় রোদেলাকে ইশারা করতেই রোদেলা গিয়ে তন্ময়ের বাইকে বসে পড়লো। আনিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফাইয়াজ বলে,

–“আনি বুড়ি___কি হলো? দাঁড়িয়ে আছিস কেন তুই? আহিয়ানের বাইকে উঠ।”

–“আহিয়ান ভা্ ভাইয়ার বাইকে?”

–“হ্যাঁ উঠ। আহিয়ানের বাইকটাই তো খালি পড়ে আছে।”

আনিতা আর কিছু না বলে আহিয়ানের বাইকে চেপে বসলো। সবাই বাইক চালাতে শুরু করে। সবার উদ্দেশ্য নদীর পাড়ে যাবে। আনিতাদের বাসা থেকে বাইকে গেলে আনুমানিক এক ঘন্টার মতো লাগতে পারে মৈনটঘাট যেতে। অনেকের কাছে সেটা মিনি কক্সবাজার নামেও পরিচিত। আর এই রাতের বেলা চাঁদের আলোয় নদীর পাড়ে যাওয়াটাই ওদের কাছে বেটার মনে হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর আহিয়ান আনিতাকে বলে,

–“আনি___”

–“হুম।”

–“খুউব সুন্দর লাগছিলো আজ তোমায়।”

আনিতা কিছু না বলে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বসলো। আহিয়ানও মৃদু হেসে আনিতার এক হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। আনিতা আহিয়ানের পিঠে মাথা রেখে বলে,

–“আপনি আমার কাছে আজ সারাটা দিন চেয়েছিলেন। সেটা আমি দিতে পারিনি। তার জন্য সত্যিই এত্তগুলা সরি।”

–“আরেহ পাগলী সরি বলছো কেন? তুমি তো ভুল কিছু বলোনি। তাছাড়া শুরুতে একটু খারাপ লাগা কাজ করলেও পরে আমি রিয়ালাইজ করতে পেরেছি তুমি একদম ঠিক ছিলে।”

–“আপনার যে কোনো অভিযোগ নেই এটাই অনেক।”

পরবর্তীতে আহিয়ান আর কিছু বলল না। বেশ ক্ষানিকটা সময় দুজনেই চুপ করে রইলো। আহিয়ান আনিতার হাতের উপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে আবার বাইক চালানোতে মনোযোগ দিলো। আহিয়ান নিজেই নিরবতা ভেঙে বলে,

–“তা ম্যাডামের হঠাৎ করে রাতের বেলা লং ড্রাইভে যাওয়ার ইচ্ছে হলো যে? কারন কি?”

–“আপনার সাথে সময় কাটানোর জন্য।”

–“সেজন্যই বুঝি আমার বাইকে উঠতে আপনি দ্বিধা করছিলেন?”

–“তেমন কিছু না। ফাইয়াজ ভাইয়া ছিলো বলেই উঠিনি।”

–“ফাইয়াজ ছিলো বলে নিজে থেকে বাইকে উঠো নি মানলাম। বাট তাই বলে ভাইয়া ডাকবে?”

–“ভুল কিছু বলেছিলাম কি?”

–“মানে কি?”

–“মানে খুব সহজ। ফাইয়াজ আমার ভাই হয়। আর ভাইয়ের বন্ধুও তো ভাই-ই হয় তাই না? সেই হিসেবে আমি কোনো ভুল কিছু বলিনি।”

আনিতার কথায় আহিয়ান বাইক থামিয়ে দিলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে আনিতার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,

–“ভাইয়ের বন্ধু ভাই-ই হয় তাই না? আমি তোমার ভাই হই?”

–“না মানে__”

–“না মানে করছো___””

–“ভা্ ভালোবাসি আপনাকে।”

আনিতার মুখ থেকে “ভালোবাসি আপনাকে” কথাটা শুনে আহিয়ান থেমে গেলো। আচমকা আনিতা যে এখন এই কথাটা বলবে সেটা আহিয়ান ভাবতে পারেনি। আহিয়ানের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে আনিতা। আহিয়ান মুচকি হেসে আবারো ঘুরে বাইক চালানো শুরু করলো।

বেশ কিছুটা সময় বাদে একে একে সবাই নদীর পাড়ে এসে বাইক থামালো। জেরিন শুভ রোদেলা তন্ময় চারজনেই নেমে গেলো বাইক থেকে। ফাইয়াজ আর তাসকিয়া নামার আগেই আনিতাদের বাইক এসে থামলো ফাইয়াজের বাইকের পাশে। তন্ময় ফাইয়াজকে বলে,

–“এক কাজ কর ফাইয়াজ___এখানে আমরা আমরা আছি আমরা হই হুল্লোড় করবো এতে তোদের ডিস্টার্ব হতে পারে। তার থেকে বরং তোরা দুজন অন্য দিকটায় যা। ডিস্টার্বও হলো না। আর আলাদা সময়ও কাটাতে পারলি।”

আনিতা এবার লাফ দিয়ে আহিয়ানের বাইকের পিছন থেকে নেমে গেলো। ফাইয়াজের সামনে গিয়ে ওর হাত ধরে বলে,

–“তন্ময় ভাইয়া কিন্তু কথাটা খারাপ বলেনি। কি সুন্দর রাত। আকাশে থালার মতো বড় চাঁদ। আর এমন জ্যোৎস্না রাতে প্রেয়সীর হাতে হাত রেখে নদীর পাড়ে সময় কাটানোর ফিলিংস। আহ কি রোমান্টিক! এমন সুযোগ কিন্তু আর পাবে না ভাইয়া।”

আনিতার কথায় আহিয়ান আর ফাইয়াজ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়৷ বাকীরা আনিতার কথা শুনে মুখ টিপে হাসছে। ফাইয়াজ আনিতার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

–“রোমান্টিকের কি বুঝিস রে তুই? আমাকে তুই ফিলিংস রোমান্টিক এসব শিখাচ্ছস? ভুলে যাস না আমি তোর বড় ভাই।”

–“তাহলে তুমিও ভুলে যেও না যে তুমি আমারই বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে রিলেশনশিপে আছো।”

আনিতা নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফাইয়াজের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাটা বলল। ফাইয়াজ আর কথা না বাড়িয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে নদীর অন্যদিকে চলে গেলো। আহিয়ানও ততক্ষণে বাইক থেকে নেমে পড়েছে। ওরা সবাই মিলে নদীর এক কিনারে ঘাসের উপর বসে পড়ে। আহিয়ান গিয়ে আনিতার পাশ ঘেঁষে বসে ওর কাঁধে মাথা রাখে। আনিতা আহিয়ানের মাথাটা নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,

–“কি হচ্ছেটা কি? সবাই আছে তো এখানে।”

–“থাকুক না সমস্যা কি?”

–“আপনার সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। সরুন তো আপনি।”

কথাটা বলে আনিতা ওখান থেকে ওঠে পড়ে। আহিয়ান যখন আনিতার কাঁধে মাথা রেখেছিলো আনিতা তখন সবার দিকে তাকিয়ে দেখেছে। ওদের দেখে সবাই মুখ টিপে হেসেছে। লজ্জা লাগে না এমন করলে? তাই শেষে বাধ্য হয়েই উঠে পড়লো ওখান থেকে। তন্ময় ইশারা করতে আহিয়ানও উঠে আনিতার পিছু নিলো। কিছুটা দূরে গিয়ে আহিয়ান পিছন থেকে আনিতাকে জড়িয়ে ধরলো। ক্ষানিকটা কেঁপে উঠলো আনিতা।

কিছুটা সামনে এগিয়ে নদীর কিনারা ঘেঁষে কিছুটা জায়গায় ঘাস দেখে আহিয়ান আর আনিতা ওখানে গিয়ে বসলো। আহিয়ান আনিতার পিছনে বসে আনিতাকে জড়িয়ে ধরলো। আনিতাও নিঃশব্দে আহিয়ানের বুকের সাথে নিজের পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলো ক্ষানিকটা সময়।

–“আনি__”

–“হুম বলুন।”

–“কাল ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি।”

আহিয়ানের কথা শুনে আনিতা পিছন ঘুরে আহিয়ানের মুখোমুখি হয়ে বসলো। মূহুর্তেই আনিতার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। কান্না মিশ্রিত নয়নে আনিতা আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আহিয়ান আনিতার গালে হাত রেখে বলে,

–“আরেহ পাগলী আমি কি একেবারে চলে যাচ্ছি নাকি? আবার আসবো তো কখনো। আর তাছাড়া বারবার এখানে এসে থাকাটা কেমন দেখায় না? ফাইয়াজ যতই আমার বন্ধু হোক তোমরা কিছু না ভাবো আশেপাশের মানুষ তো আর এটাকে ভালো চোখে দেখবে না বলো?”

–“কিন্তু তাই বলে কাল-ই? এবার এসেছেন তিনদিন হলো মাত্র।”

–“তোমার যখনই আমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে আমাকে জাস্ট একটা বার জানাবে তুমি আমি এসে তোমার সাথে দেখা করে যাবো প্রমিস।”

–“আর কিছুদিন থেকে গেলে হয় না?”

–“বোঝার চেষ্টা করো। অন্যের অফিসে জব করতে হয় এত বার বার ছুটি নিলে বা অফিস মিস দিলে জবটা তো আর থাকবে না আমার।”

আনিতা কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আহিয়ান মৃদু হেসে আনিতার চোখের কোনে জমে থাকা পানিটুকু নিজের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মুছে দেয়। দুহাতে আনিতার গাল ধরে বলে,

–“প্রতি সপ্তাহে একবার করে তোমার কলেজে এসে দেখা করে যাবো তোমার সাথে। এবার হ্যাপি তো?”

এবারেও আনিতা কিছু বলল না। চুপচাপ আহিয়ানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। সাথে সাথে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আনিতার চোখের কার্নিশ বেয়ে। আহিয়ান কিছু না বলে আনিতার মাথায় একটা চুমু খেয়ে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে।

বেশ ক্ষানিকটা পর আনিতা আর আহিয়ান তন্ময়দের ওখানে চলে আসলো। বাসা থেকে অনেকটা দূরে এসেছে ওরা। তার উপর এই রাতের বেলা একা বেশিক্ষণ থাকাটা রিস্ক মনে করেই ওরা সবার কাছে চলে এলো। ফাইয়াজ আর তাসকিয়া এখনো আসেনি। আহিয়ান ফোন বের করে একবার সময় দেখে নিলো। ঘড়ির কাটায় এগারোটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। ফাইয়াজকে ফোন দিলো বেশ কয়েকবার কিন্তু রিসিভ হলো না। চিন্তায় পড়ে গেলো সবাই। এটা শহর না যে অনেক রাত অব্দি মানুষের আনাগোনা থাকবে। এটা গ্রাম যে কোনো মূহুর্তে যে কোনো ধরনের বিপদ হয়ে যেতে পারে। আহিয়ান ফাইয়াজকে ম্যাসেজ করে এখানে চলে আসতে বলল।

ওরা সবাই মিলে পাশের একটা রেস্তোরাঁ খোলা দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে বসলো। নিজেদের জন্য কফি অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ফাইয়াজ আর তাসকিয়া আসার। ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেলে কফি খেতে শুরু করে ওরা। বেশ ক্ষানিকটা বাদে ফাইয়াজ আর তাসকিয়া এসে হাজির হলো রেস্তোরাঁয়। ওদের চোখমুখ দেখে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছিলো। দুজনের চোখমুখ-ই ভার। তাসকিয়ার চোখ তো ছলছল করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি কেঁদে দিলো মেয়েটা। আনিতা উঠে গিয়ে ফাইয়াজকে জিজ্ঞেস করে,

–“কি হয়েছে ভাইয়া? তোমাদের চোখমুখ এমন লাগছে কেন? কোনো কিছু হয়নি তো?”

ফাইয়াজ চুপ করে রইলো। কোনো প্রকার জবাব দিলো না। ততক্ষণে বাকী সবাইও ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু কেউ-ই কোনো জবাব দিচ্ছে না। আনিতা ফাইয়াজের থেকে উত্তরের আশা ছেড়ে দিয়ে তাসকিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাসকিয়ার দু কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,

–“কি হয়েছে বল না? তোরা দুজন যদি এভাবে চুপ করে থাকিস তাহলে আমরা বুঝবো কি করে?”

তাসকিয়া কিছু না বলে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আনিতার সাথে সাথে সেখানে উপস্থিত সকলেই চমকে উঠে তাসকিয়াকে এমন কান্না করতে দেখে। আনিতা তাসকিয়ার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–“কাঁদছিস কেন জানু? বল না আমাকে কি হয়েছে? ভাইয়া তোকে কিছু বলেছে নাকি ভাইয়া ঝগড়া করেছে তোর সাথে? বল না আমায়। কিছু না বলে যদি শুধু কেঁদেই যাস তাহলে বুঝবো কি করে আমরা?”

আনিতার প্রশ্নের জবাবে ফাইয়াজ যে কথাটা বলল তা শুনে সবাই চমকে উঠে। ওরা কেউ ভাবতে পারেনি এমন কিছু হবে বা হতে পারে। তাসকিয়া এখনো কিছু না বলে শুধু ফুঁপিয়ে কাঁদছে।



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২৫
#Ornisha_Sathi

–“ফারদিন বিয়ে করে ফেলেছে।”

–“মানে? কি সব বলছো তুমি? ফারদিন এরকমটা করতে পারে না।”

ফাইয়াজ রোদেলার কাঁধে হাত রেখে বলে,

–“এরকমটাই হয়েছে।”

রোদেলা ঝাড়ি মেরে নিজের কাঁধ থেকে ফাইয়াজের হাত সরিয়ে দিলো। তাসকিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর হাত দুটো ধরে বলে,

–“তা্ তাসকিয়া ফাইয়াজ ভাইয়া এটা কি বলছে? বল না সবটা মিথ্যা।”

–“এটাই সত্যি দোস্ত।”

রোদেলা তাসকিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। সাথে সাথেই আনিতা ধরে ফেলে ওকে। হাটু ভেঙে নিচে বসেই কাঁদতে শুরু করে রোদেলা। এখানে কি হচ্ছে আহিয়ান আর তন্ময় কিছুই বুঝতে পারছে না। তন্ময় এগিয়ে গিয়ে শুভকে জিজ্ঞেস করতেই শুভ জানালো,

–“ফারদিন রোদেলার উডবি আর তাসকিয়ার ভাই।”

রোদেলার বিয়ে ঠিক হয়ে ছিলো কথাটা শুনতেই তন্ময়ের মুখটা ছোট হয়ে গেলো। তন্ময় কেন যে এই কথাটা ঠিক মানতে পারছে না। রোদেলার কান্নাটাও ঠিক সহ্য হচ্ছে না ওর। তন্ময় সেখান থেকে সরে রেস্তোরাঁর বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। আহিয়ান বলে,

–“মানে রোদেলার উডবি হলে আবার অন্যকাউকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে কেন?”

–“সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

–“আচ্ছা এসব নিয়ে পরে কথা হবে। আপাতত বাসায় ফেরা যাক। রোদেলাকে সামলাতে হবে।”

জেরিন আর আনিতা দুজনে রোদেলাকে মেঝে থেকে উঠিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসালো। এতক্ষণের হাসি খুশি পরিবেশটা মূহুর্তেই যেন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। আনিতা রোদেলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলো। রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আনিতা বলে,

–“রোদ কাঁদিস না প্লিজ। এভাবে কাঁদলে অসুস্থ হয়ে পড়বি তো।”

রোদেলা আনিতার কোমড় জড়য়ে ধরে আনিতার পেটে মুখ গুজে কিছুটা শব্দ করে কান্না করে দিলো। তাসকিয়া দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। রোদেলার সামনে আসার মুখ নেই যে ওর। তাসকিয়াই খুব করে চেয়েছিলো রোদেলাকে ওর ভাবী বানাবে। তাসকিয়ার জন্যই দু বছর আগে রোদেলা আর ফারদিনের আংটি বদল হয়। তাসকিয়া তো ওর ভাইকে দেখে ভেবেছিলো ও রোদেলাকে ভালোবাসে। তাহলে আজ কি হলো এইটা? তাসকিয়ার সব ভাবনা ভুল করে দিয়ে ওর ভাই অন্য কাউকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসলো? নিজের হাতেই নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের লাইফটা শেষ করে দিলো। এসব ভেবেই তাসকিয়া দূরে দাঁড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ওর নিজেকেই সবচেয়ে বেশি দোষী মনে হচ্ছে ফারদিনের করা কাজের জন্য।

রোদেলা এখনো আনিতার পেটে মুখ গুজে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। সবাই ওর কান্না থামানোর চেষ্টাও করছে কিন্তু কিছুতেই থামছে না রোদেলা। আনিতা রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রোদেলা কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

–“আনি ফারদিন আমার সাথে এরকমটা কিভাবে করতে পারলো বল? আমি যে উনাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি। একটা ছোট্ট বাড়ি, একটা সংসার, ফুটফুটে একটা বাচ্চা, এবং ফারদিন আর আমি। ভালোবাসায় ভরপুর থাকবে আমাদের ঘর। কিন্তু___কিন্তু কি হলো এইটা? ফারদিন যে আমার সবকিছুকে তুচ্ছ করে দিয়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিলো। কিভাবে সহ্য করবো এইটা আমি? ওই মানুষটা গত দুই বছর যাবত আমার হয়েও আজ সে কেন আমার হলো না? কেন সে আজ অন্যের স্বামী বল না আনিতা? কেন সে মানুষটা আমার হয়েও আমার হলো না?”

ওখানে উপস্থিত সকলেই নিশ্চুপ। কেন-না এর উত্তর ওদের কারোরই জানা নেই। রোদেলার মতো করে ওরা কেউ-ই ভাবতে পারেনি ফারদিন এমন কিছু করতে পারে। শুভ এগিয়ে এসে রোদেলার কাঁধে হাত রেখে বলে,

–“রোদ প্লিজ এভাবে কাঁদিস না ইয়ার। আগে বাড়ি চল। তারপর আমরা আমাদের সকল প্রশ্নের জবাব ফারদিন ভাইয়ার থেকে নিবো। এখন কান্না করে না প্লিজ লক্ষীটি।”

রোদেলা তখনও হেঁচকি তুলে কেঁদেই যাচ্ছে। তন্ময় বাইরে থেকে ভিতরে এসে আনিতাকে কিছু একটা ইশারা করে। তন্ময়ের ইশারায় আনিতা সরে দাঁড়ায় ওখান থেকে। তন্ময় রোদেলার সামনে হাটু গেড়ে বসে রোদেলার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

–“এই যে ম্যাডাম আপনাকে এভাবে কাঁদতে দেখে যে আমার__আমাদের সবার ভীষণ রকমের কষ্ট হচ্ছে সেইটা কি আপনি বুঝতে পারছেন? আমার তো মনে হয় না বুঝতে পারেন আপনি। আমি যে ইনফ্যাক্ট আমরা সবাই যে রোদেলা কে চিনতাম আমার তো মনে হচ্ছে না এইটা সেই রোদেলা। রোদেলা তো অনেক স্ট্রং তাই না? এতটুকুতেই কি আমাদের রোদেলা ভেঙে পড়তে পারে? উঁহু কক্ষনো পারে না। আমরা সবাই তো আছি তোমার সাথে। তাহলে এভাবে কাঁদছো কেন তুমি? তুমি না তোমার ফ্রেন্ডদের কষ্ট সহ্য করতে পারো না? তুমি না তোমার ফ্রেন্ডদের জন্য নিজের জীবনও বাজি রাখতে পারো? তাহলে আজকে সেই তুমি-ই কেন তোমার ফ্রেন্ডদের এভাবে কষ্ট দিচ্ছো বলো তো? তুমি যে এভাবে কাঁদছো এতে তো সবাই কষ্ট পাচ্ছে। সব্বাই তোমার জন্য কাঁদছে তাকিয়ে দেখো একবার। তুমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছো আর সাথে তোমার ফ্রেন্ডদেরও কষ্ট দিচ্ছো। কেন বলো তো?”

এইটুকু বলে তন্ময় থামলো। রোদেলাও কান্না প্রায় থামিয়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে শুধু হেঁচকি তুলছে। তন্ময় আবারো বলতে শুরু করে,

–“আমি জানি তোমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কি করা যেতে পারে বলো? কাঁদলেই কি তোমার কষ্ট শেষ হয়ে যাবে? যাবে না তো। তাহলে কেন অযথা কাঁদছো? ফারদিন তোমার হওয়ার ছিলো না তাই সে আজ অন্যের হাজবেন্ড। আর অন্যের হাজবেন্ডের জন্য তুমি কেন কাঁদবে? এখন তার প্রতি তোমার কোনো অধিকার নেই। বড়জোড় তুমি তার থেকে তোমার প্রশ্নের জবাব গুলো পেতে পারো এর থেকে বেশি কিচ্ছু না। ফারদিন তোমার কপালে লিখা ছিলো না তাই তাকে তুমি হারিয়েছো। মানতে শিখো এইটা। এমনটা হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার জন্য উত্তম কিছু রেখেছে। হয়তো বা এতেই তোমার ভালো সেজন্যই আল্লাহ ফারদিনকে তোমার জন্য লিখেননি। তোমার জন্য নিশ্চয়ই এর চেয়েও আরো ভালো কিছু আছে। এখন কান্নাকাটি অফ করো তো। অনেক কেঁদেছো আর না। বাসায় ফিরবো এবার সবাই। চলো।”

কথাগুলো বলেই তন্ময় রোদেলার চোখের পানি মুছে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর সবাইকে ইশারা করে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলো। আনিতা রোদেলাকে নিয়ে বাইরে আসতেই তন্ময় রোদেলার হাত ধরে টেনে নিজের বাইকের পিছনে বসিয়ে দিলো। রোদেলা কোনোমতে তন্ময়কে ধরে বসতেই তন্ময় বাইক স্টার্ট দেয়। ঘন্টা খানেক এর মাঝে ওরা সকলে বাড়িও পৌঁছে যায়৷

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রোদেলা আর ফারদিন। একপাশেই ফারদিনের নতুন বিয়ে করা বউ মাথায় ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর অন্য পাশে তাসকিয়া আনিতা শুভ ফাইয়াজ জেরিন তন্ময় আর আহিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সকাল হতেই ওরা চলে এসেছে তাসকিয়াদের বাড়ি। রোদেলার সকল প্রশ্নের জবাব ফারদিনের থেকে নিতে। রোদেলা একবার ফারদিনের বউয়ের দিকে তাকালো। শ্যাম বর্নের গোলগাল মায়াবী চেহারার অধিকারী মেয়েটি। ভয় ভয় মুখ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিন রোদেলার হাতদুটো ধরে বলে,

–“রোদ ইজ জাস্ট এন এক্সিডেন্ট। ট্রাস্ট মি।”

–“বিয়ে করে বউ নিয়ে এসে এখন বলছেন এটা শুধুই একটা দূর্ঘটনা? আপনার কথা শুনে খুউব হাসি পেলো ফারদিন।”

–“রোদ আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। এই মেয়েকে ভালোবাসি না এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে বিয়ে করিনি ওকে। বিশ্বাস করো।”

রোদেলা ঝামটা মেরে ফারদিনের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ফারদিন অবাক চোখে দেখছে রোদেলাকে। রোদেলা মেয়েটার দিকে একপলক তাকিয়ে ফারদিনকে বলে,

–“লজ্জা করে না আপনার? পাশেই নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে তারই সামনে আমাকে ভালোবাসার কথা বলছেন? ভুলে যাবেন না ওই মেয়েটি আপনার স্ত্রী। বিয়ে হয়ে গিয়েছে আপনাদের।”

–“বলছি তো এটা একটা দূর্ঘটনা। আমি বা ইশফা আমরা কেউ-ই ইচ্ছাকৃত ভাবে বিয়েটা করিনি। আর আমরা একে অপরকে আগে থেকে চিনতামও না। তুমি কেন বিশ্বাস করতে চাইছো না আমাকে? ইশফাকে আমি কোনোদিনও নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না। ভালোবাসতে পারবো না আমি ওকে। কয আমি সত্যিই শুধু তোমাকে ভালোবাসি।”

এতক্ষণে সবাই জানতে পারলো ফারদিন যে মেয়েটাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে তার নাম ইশফা। রুমের ভিতর শুধু ফারদিন আর রোদেলাই কথা বলে যাচ্ছে। বাকী সবাই নিরব দর্শকের মতো সবটা দেখে যাচ্ছে। ইশফা মেয়েটিও চুপচাপ মাথা নিচু করে সবটা শুনছে। চোখে পানি টলমল করছে ইশফার। মাঝে মধ্যে ফারদিনের চিৎকারে কেঁপে কেঁপে উঠছে। রোদেলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

–“আপনি যতই চিৎকার চেঁচামেচি করুন না কেন তাতে তো আর সত্যিটা পালটে যাবে না ফারদিন। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাই হোক না কেন বিয়েটা যে আপনাদের হয়ে গিয়েছে এটা তো আর মিথ্যে না? এই সত্যিটা তো আপনাকে মানতেই হবে।”

–“হ্যাঁ স্বীকার করছি আমি আমাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রোদ তোমাকে হারাতে পারবো না আমি। ছয় মাস সময় দাও আমাকে ইশফাকে ছেড়ে দিবো। ওকে আমার চাই না। ইভেন তুমি ব্যাতিত অন্য কোনো মেয়েকে আমার চাই না। আমি জাস্ট তোমাকে চাই।”

–“এই ভুলটা ভুলেও করবেন না ফারদিন। আপনি ভাবলেন কি করে ইশফাকে ছেড়ে দিলেই আমি আপনার হয়ে যাবো?”

–“রোদ ভালোবাসি আমি তোমাকে।”

–“একসময় ভালোবাসতেন। এখন থেকে শুধুই ইশফাকে ভালোবাসবেন আপনি। আসছি।”

কথাটা বলে রোদেলা চলে আসতে নিলেই পিছন থেকে ইশফা রোদেলাকে ডেকে উঠে,

–“আপু__”

হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায় রোদেলা। পিছন ঘুরে ইশফার দিকে এগিয়ে যায়। ইশফার সামনে দাঁড়িয়ে রোদেলা বলে,

–“বলো।”

–“উনি যা বলছেন সব সত্যি আপু। উনি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে বিয়ে করেননি। কি থেকে কি হয়ে গেলো মাঝখান থেকে আমার জন্য আপনার লাইফটা শেষ হয়ে গেলো।”

–“নাহ পাগলী এভাবে বলছো কেন?”

–“আ’ম সরি আপু। আপনি চিন্তা করবেন না আমি এখান থেকে চলে যাবো। ছয় মাসের আগে তো ডিভোর্স দেওয়া পসিবল না। অন্তত ছয়টা মাস আপনার ফারদিনের নামের পাশে আমার নামটা সহ্য করুন। ছয় মাস পরেই চলে যাবো আমি।”

–“একটা থাপ্পড় মারবো। তোমাদের কিভাবে বিয়ে হয়েছে সেটা এখন আর জানতে চাচ্ছি না আমি। আমি জাস্ট এতটুকুই জানি যে তোমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আল্লাহ আমাকে ফারদিনের জন্য লিখেননি তাই আমি ওর হইনি। কিন্তু আল্লাহ নিজে তোমার আর ফারদিনের জুড়ি লিখেছেন। ফারদিনের বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমি চাইলেও যে তোমাদের সম্পর্কটা ভাঙতে পারবো না। আর আমি এইটা চাই-ও না।”

–“আপু উনি আপনাকে খুউব ভালোবাসেন। ভালো থাকতে পারবে না আপনাকে ছাড়া।”

–“এখন থেকে তোমাকে ভালোবাসবে ফারদিন। আর তুমি পারবে না ওকে ভালো রাখতে? নিজের ভালোবাসা দিয়ে ওর মন থেকে আমাকে মুছিয়ে দিয়ে নিজের জায়গা করে নিতে পারবে না তুমি?”

–“আপু___”

–“আপু বলে ডেকেছো তো? তাহলে আপু হয়ে কিভাবে তোমার সংসারটা ভেঙে দিই আমি বলো তো? আর আপু বলে যেহেতু ডেকেছোই তাহলে আপুর এই আবদারটুকু রেখো। ফারদিনকে খুউব ভালো রেখো কেমন?”

রোদেলা ইশফার হাত ছেড়ে উলটো ঘুরে কয়েক পা এগিয়ে যায়। আবার কিছু একটা মনে হতেই দু পা পিছিয়ে ফারদিনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

–“আপনার কাছেও আমার একই চাওয়া। এই বাচ্চা মেয়েটাকে প্লিজ কষ্ট দিয়েন না। আগের সব কিছু ভুলে যান। এখন নতুন করে ইশফাকে নিয়ে বাঁচতে শুরু করুন। ও-ই এখন আপনার সহধর্মিণী। আপনার ভালো খারাপ সব কিছুর সঙ্গী। ওকে কখনোই কষ্ট দিয়েন না। ধীরে ধীরে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

–“তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু ঠিক করতে চাই না আমি রোদ।”

–“ভালোবাসেন তো আমায়?”

–“হ্যাঁ আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”

–“তাহলে আমার কথাটা রাখবেন আশা করি। আমাকে যদি ভালোবেসে থাকেন তাহলে আমাকে ভুলে ইশফাকে নিয়ে সবকিছু নতুন করে শুরু করুন। ও আপনার স্ত্রী এখন থেকে ওকেই ভালোবাসবেন আপনি। আর কাউকে না। এমন কি আমাকেও না।”

কথাটা বলেই কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো রোদেলা। রোদেলার পিছু পিছু আনিতা ওরা সকলেই বেরিয়ে গেলো। তাসকিয়ার আম্মু এসে রোদেলার হাত ধরে ওকে থামিয়ে দেয়। ওনার চোখেও পানি। বড্ড ভালোবাসেন তো রোদেলাকে। আর এমন কিছু যে হতে পারে এটা উনারা কেউ-ই ভাবতে পারেনি। তাসকিয়ার আম্মু রোদেলার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

–“আমাকে মাফ করে দিস মা। আমার ছেলের হয়ে আমি তোর কাছে মাফ চাচ্ছি। তোকে এই বাড়ির বউ করে আনার বড্ড শখ ছিলো যে আমার। চেয়েছিলাম তোর ইন্টার কমপ্লিট হলেই আমার ফারদিনের বউ করে ঘরে তুলবো তোকে। আমাদেরই ভুল হয়েছিলো। দু বছর আগেই যদি আংটি বদল করে না রেখে সরাসরি তোকে বউ করে ঘরে তুলতাম তাহলে আজ এই দিনটা আসতো না।”

তাসকিয়ার আম্মুর কথায় রোদেলা কান্না মিশ্রিত চোখেই কিছুটা হেসে দেয়। রোদেলা তাসকিয়ার আম্মুর হাতদুটো ধরে বলে,

–“আমি তোমার ছেলের বউ হওয়ার ভাগ্য নিয়ে দুনিয়াতে আসিনি আন্টি। এখন যে তোমার ছেলের বউ হয়ে ঘরে এসেছে তাকে হাসিমুখে গ্রহণ করো। এটাই চাই আমি। আর কিচ্ছু না।”

বিনিময়ে তাসকিয়ার আম্মু আর কিচ্ছু বললেন না। মৃদু হাসলেন একটুখানি। রোদেলাও মুচকি হেসে বের হয়ে এলো বাসা থেকে। সাথে আনিতা ওরা সকলেই এলো। তাসকিয়া ওদের বাসাতেই আছে। তাসকিয়াদের বাসা থেকে বের হয়ে মেইন রোডে উঠে রোদেলা আনিতাকে বলে,

–“আচ্ছা আমি তাহলে বাসায় যাচ্ছি।”

–“এই একদম না। তুই আমাদের বাসায় যাবি। আন্টিকে ফোন করে বলে দিয়েছি আমি। ফাইয়াজ ভাইয়া গিয়ে তোর জামা কাপড়ও নিয়ে এসেছে। সো এখন তুই সোজা আমাদের বাসায় যাবি। তুই আর আমি একসাথে থাকবো অনেক অনেক মজা করবো আমরা কেমন?”

–“ভালো লাগছে না আনি। আমি কয়েকটা দিন একা থাকতে চাই প্লিজ।”

–“উঁহু এটা তো হচ্ছে না সোনা। তোমাকে আমি একা কিছুতেই ছাড়ছি না। পরে শয়তানের পাল্লায় পড়ে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসিস তখন আমরা আমাদের এই কিউট ফ্রেন্ডটাকে কোথায় পাবো শুনি?”

–“আনিতা বোঝার চেষ্টা কর। সত্যিই ভালো লাগছে না আমি একা থাকতে চাই।”

–“আমি কিচ্ছু বুঝতে চাইছি না। তুই চল তো আমাদের সাথে।”

আনিতা একপ্রকার জোর করেই রোদেলাকে নিয়ে তন্ময়ের বাইকের পিছনে বসিয়ে দিলো। জেরিনও গিয়ে শুভর বাইকে বসে পড়লো। আনিতা ফাইয়াজের বাইকে উঠতে নিলেই ফাইয়াজ বলে,

–“আহিয়ানের সাথে যা। রোদেলার ব্যাগ বাসায় রেখে আসছি আমি। আর তাছাড়া আমার একটু কাজও আছে। কাজটা সেড়েই আসছি। তোরা ইনফর্ম করে দিস আমাকে কোথায় আছিস সেটা।”

–“কেন বাসায় যাবো না এখন আমরা?”

–“নাহ। বাসায় গেলে রোদেলার ফাঁকা ফাঁকা লাগবে সবকিছু। মন খারাপ থাকবে। তাই আগে ওর মন ভালো করতে হবে।”

–“আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ওক্কেহ ডান। আমি ম্যাসেজ করে দিবো তোমাকে।”

বিনিময়ে ফাইয়াজ কিছু না বলে মৃদু হেসে বাইক চালিয়ে চলে গেলো। আনিতা গিয়ে আহিয়ানের বাইকের পিছনে বসে পড়লো।

–“তোহ চলেন।”

–“কোথায়?”

–“রোদেলার মন ভালো করতে হবে তো।”

–“ওকেহ চলো।”

সবাই মিলে বাইক স্টার্ট দেয়। বাইক স্টার্ট দিতেই তন্ময় বলে,

–“আনিতা আমরা যাবো টা কোথায়?”

–“যেদিকে দু-চোখ যায় ভাইয়া। আমাদের জাস্ট একটা কথা মনে রাখতে হবে। যে করেই হোক আমাদের রোদের মন ভালো করতেই হবে।”

–“ওকেহ ডান।”



চলবে।

ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। আর গল্পটা কেমন হচ্ছে অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং🥰 ]