শুধু তোমারই জন্য পর্ব-২০+২১+২২

0
811

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২০
#Ornisha_Sathi

সিটের উপর দু পা তুলে গুটিশুটি মেরে আহিয়ানের হাটুর উপর মাথা রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আনিতা। আহিয়ান বসে বসে আনিতার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি যেতেই আয়াহিয়ান আনিতাকে ডেকে তুলে। আনিতা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। প্রায় সারাটা রাস্তা এভাবে আহিয়ানের পায়ের উপর শুয়ে ছিলো ভাবতেই আনিতার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। আহিয়ানের দিকে অসহায় ফেস করে তাকিয়ে বলে,

–“আমি কি সারাটা সময় এভাবেই শুয়ে ছিলাম?”

–“কেন বলতো?”

–“আপনার পা খুব ব্যাথা করছে না? অনেকটা সময় যাবত একই ভাবে বসে ছিলেন পা তো মনে হয় প্রচুর ব্যাথা করছে।”

–“তা তো একটু আধটু ব্যাথা করছেই বাট ব্যাপার না।”

–“আমাকে ডাকলেই তো পারতেন।”

–“তোমার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনি।”

পরবর্তীতে আনিতা আর কিছু বলল না। গাড়ি থেকে নেমে সবাই প্রথম গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বেশ ক্ষানিকটা সময় পর ফাইয়াজের ফোন বেজে উঠলো। ফোনে কথা বলা শেষ করে ফাইয়াজ বলে,

–“দ্বিতীয় গেট দিয়ে বের হবে ওদিকটা যেতে হবে।”

সবাই দ্বিতীয় গেটের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। ফাইয়াজ আর তন্ময় আগে হাঁটছে। ওদের থেকে একটু পিছেই আনিতা। আহিয়ান আনিতার পিছনে হাঁটছে আর মানুষের ভীর দেখলেই আনিতার দু-পাশে হাত দিয়ে ওকে সামলাচ্ছে অন্যের সাথে যাতে টাচ না লাগে সেজন্য। আহিয়ানের কান্ডে আনিতা মুচকি হাসে। দ্বিতীয় গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মিনিট দুয়েক বাদেই আনিতার চাচ্চু ট্রলি টেনে সামনে এগিয়ে আসে। দীর্ঘ চার বছর পর ওর চাচ্চু দেশে ফিরলো। আনিতা গিয়ে ওর চাচ্চুকে জড়িয়ে ধরতেই ওর চাচ্চুও ওকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

–“কেমন আছো আম্মু?”

–“ভালো তুমি কেমন আছো?”

–“আলহামদুলিল্লাহ। ফাইয়াজ কেমন আছিস? আর তোমরা কেমন আছো সবাই?”

শেষ কথাটা আনিতার চাচ্চু ফাইয়াজ আহিয়ান আর তন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলে। ওরা তিনজনেই সৌজন্যমূলক হেসে কথার জবাব দেয়। ফাইয়াজ ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি কিছুটা এগিয়ে আনতে বলে। ফাইয়াজ ওর মামার হাত থেকে ট্রলি নিজের হাতে নিয়ে এগোতে থাকে গাড়ির দিকে। সাথে বাকী সবাইও এগিয়ে যাচ্ছে। আনিতার চাচ্চু ড্রাইভারের পাশের সিটে গিয়ে বসে। ফাইয়াজ তন্ময় গিয়ে গাড়ির ডিকি খুলে তাতে প্রথমে লাগেজ তুলে নেয়। তারপর ট্রলি গাড়ি থেকে পরপর দুটো কার্টন নামিয়ে ডিকিতে রেখে ডিকি আটকে সামনে গিয়ে দেখে মাঝের সিটে আনিতা বসেছে জানালার পাশে তারপর আহিয়ান বসা। ফাইয়াজ তন্ময়কে একদম শেষের সিটে গিয়ে বসতে বললেই তন্ময় বলে,

–“তুই যা আমি সামনে বসে আসছি সামনে বসেই যাবো।”

–“তুই সবসময় এত ত্যাড়ামি করস কেন?”

ফাইয়াজ কথাটা বলে তন্ময়ের উত্তরের অপেক্ষা না করেই মাঝের সিট নামিয়ে পিছনের সিটে গিয়ে বসে। তন্ময়ও বাঁকা হেসে সিট আবার উঠিয়ে সেখানে বসে গাড়ির দরজা লাগিয়ে দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে তার আপন গতিতে।

রাত তিনটা সাড়ে-তিনটার দিকে আনিতাদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামে। গাড়ির শব্দে আনিতার মেজো চাচ্চু দাদু ফুপ্পি সকলেই বেরিয়ে আসে। আনিতার ছোট চাচ্চু গাড়ি থেকে নেমে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে। দীর্ঘ চারটা বছর পর আদরের ছোট্ট ছেলেকে বুকে জড়িয়ে খুশির অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে আনিতার দাদু। সকলেই এখন আনিতার ছোট চাচ্চুকে নিয়ে ব্যস্ত। ফাইয়াজ আহিয়ান তন্ময় আনিতা ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে যায়। গাড়ির ডিকি খুলে সেখান থেকে লাগেজ আর কার্টন দুটো তিনজনে নিয়ে বাসার ভিতরে চলে যায়। আনিতা এলোমেলো পায়ে ভিতরে গিয়েই নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেয়। আহিয়ান ড্রয়িংরুমে লাগেজটা রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে আনিতার রুমে ঢুকে দেখে এলোমেলো ভাবে আনিতা বিছানায় শুয়ে আছে। গলায় ঝুলানো স্কার্ফটা খুলে বিছানার একপাশে রেখেছে। আর পড়নে কূর্তিটা বেশ ক্ষানিকটা উপরে উঠে আছে। জিন্সটাও কিছুটা তুলে রেখেছে যার ফলে পায়ের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। আনিতাকে এভাবে দেখে আহিয়ান প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সাথে সাথেই উলটো ঘুরে আনিতাকে ডাকে। আনিতা আহিয়ানের গলার স্বর পেয়েই তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। পাশ থেকে স্কার্ফটা নিয়ে গলা ঝুলিয়ে নিজের জামা-কাপড় ঠিক করে নেয়।

–“ঘু___ঘুরতে পারেন এবার এ___এদিকে।”

আনিতার কাঁপা-কাঁপা কন্ঠস্বর শুনে আহিয়ান আনিতার দিকে ঘুরে তাকায়। আনিতা লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আহিয়ান বিষয়টি বুঝে সে প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ালো না। কথা ঘুরানোর জন্য বলে,

–“দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে খুব। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

আনিতা মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বোঝাতেই আহিয়ান মৃদু হেসে উলটো ঘুরে। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই আনিতা বলে,

–“কেন এসেছিলেন সেটা না বলেই চলে যাচ্ছেন যে?”

আনিতার কথায় থেমে যায় আহিয়ান। গুটি গুটি পায়ে আনিতার দিকে এগিয়ে আসে। আনিতার দু-গাল ধরে বলে,

–“বলতে এসেছিলাম কাল আমার সারাটা দিন আপনার জন্য বরাদ্দ। কাল সারাদিন একসাথে থাকবো ওকে? আপনার সাথে কলেজ যাবো ঘুরবো আপনার যা যা ইচ্ছে করবো হ্যাপি?”

–“সত্যি বলছেন?”

–“হ্যাঁ, কিছুদিন আগে আপনি খুব মন খারাপ করেছিলেন অনেকদিন যাবত আমার সাথে সময় কাটাতে না পেরে। আপনার খুব ইচ্ছে না সম্পূর্ণ একটা দিন আমার সাথে কাটাবেন? আপনার ইচ্ছে কাল পূর্ন হচ্ছে। রেডি থাকবেন ম্যাডাম ওকে?”

–“আচ্ছা। কিন্তু কলেজ টাইমে যদি ঘুম না ভাঙে তাহলে কি হবে?”

–“ব্যাপার না ঠিক টাইমে আমি তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিবো।”

–“আচ্ছা।”

–“হুম এখন তাহলে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো ওকে?”

এই বলে আহিয়ান আনিতার কপালে আলতো ভাবে চুমু দিয়ে বলে,

–“আসছি। আর হ্যাঁ ওভাবে এলোমেলো ভাবে কিন্তু আর শুবে না।”

আহিয়ানের কথায় আনিতা মাথা নিচু করে নিলো। আহিয়ান মুচকি হেসে নিঃশব্দে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। আনিতাও দরজা চাপিয়ে দিয়ে কাবার্ড থেকে একটা লং টি-শার্ট আর প্লাজো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে টাওয়েল চেয়ারের হাতলে রেখে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো।

সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ ফোনের রিংটোনে আনিতার ঘুম ভাঙে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ফোন হাতে নিতে নিতেই কল কেটে গেলো। আনিতা ফোনটা রেখে আবারো ঘুমের প্রস্তুতি নিবে এমন সময় আবারো নতুন উদ্যমে ফোন মহাশয় বেজে উঠলো। আনিতা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে আহিয়ান বলে,

–“ঘুম কি ভাঙেনি এখনো?”

–“হুম ভেঙেছে তো। সেই কোন সকালে ঘুম থেকে উঠেছি আমি।”

–“হুম তা তো ম্যাডামের ঘুম ঘুম কন্ঠ শুনেই স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে আপনি অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেছেন।”

আহিয়ানের কথায় আনিতা দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাটলো। আর ওদিকে আহিয়ান মৃদু শব্দ করে হাসলো। আহিয়ানের হাসির শব্দে আনিতা বলে,

–“ফোন রাখুন। লেট হচ্ছে আমার আপনার জন্য।”

এইটুকু বলেই আনিতা ফোন কেটে দিলো। গায়ে থেকে পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে উঠে বসলো। মিনিট দুয়েক বসে থেকে বিছানা ঠিক করে ব্রাশ নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখে ওর দুই চাচ্চু দাদু সোফায় বসে গল্প করছে। আনিতা সবার সাথে টুকিটাকি কথা বলে কিচেনে গিয়ে প্লেটে করে রুটি তরকারি নিয়ে এসে টেবিলে বসে খেতে শুরু করলো। দেড়টা রুটি খেয়ে প্লেট টেবিলে রেখেই উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে আবার রুমে চলে এলো রেডি হতে।

চুল উচু করে খোপা করে তাতে কাটা লাগিয়ে নিয়ে বোরখা পড়ে নিলো আনিতা। ঠোঁটে হালকা করে ইট কালার লিপস্টিক লাগিয়ে মুখে মাস্ক লাগিয়ে মাথায় হিজাব বাধার টুপি পড়ে স্কার্ফ বেধে রেডি হয়ে নিলো। বেরোনের আগে আহিয়ানের নাম্বারে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিলো। তারপর বা হাতে আহিয়ানের দেয়া ব্রেসলেট পড়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আনিতা কিচেনে গিয়ে ওর আম্মুর কাছে টাকা চাইতেই ওর আম্মু বলল আলমারি থেকে নিয়ে যেতে। আনিতা কিচেন থেকে বের হতেই ওর ছোট চাচ্চু ওকে ডাকে। আনিতা ওর চাচ্চুর দিকে এগিয়ে গেলেই ওর চাচ্চু ওয়ালেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। আনিতা নিতে না চাইলেও একপ্রকার জোর করেই হাতে গুজে দেয়। আনিতার চাচ্চু টাকা দিয়েছে বলে আনিতা আর ওর আম্মুর থেকে টাকা নিলো না। সবাইকে বলে বাসা থেকে বের হয়ে আসতে নিলেই ওর ছোট চাচ্চু বলে,

–“আমি নামিয়ে দিয়ে আসবো কলেজে?”

–“নাহ চাচ্চু আমি একাই যেতে পারবো। আর আমার ফ্রেন্ডরা সামনের মোড়ে ওয়েট করবে আমার জন্য।”

–“আচ্ছা তাহলে সাবধানে যেও।”

–“হুম। আর আমি না আসা অব্দি কিন্তু তুমি কার্টন খুলতে পারবে না।”

–“আচ্ছা ঠিকাছে।”

আনিতা আবার ওর আম্মুকে ডেকে কিছুটা চিৎকার করে বলে,

–“মা আজ আমার আসতে বিকেল হতে পারে। ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরবো। লেট হলে চিন্তা করো না। ফাইয়াজ ভাইয়াও থাকতে পারে সমস্যা হবে না।”

আনিতার আম্মু কিছু বলার আগেই আনিতা বের হয়ে যায় বাসা থেকে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে দশটা বেজে চৌদ্দ মিনিট। প্রথম ক্লাস অলরেডি মিস হয়ে গিয়েছে। আর বাকী ক্লাসও যে করা হবে না সেটা খুব ভালোই বুঝতে পারছে ও। আনিতা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। যে মোড়ে থেকে রোদেলারা রোজ আনিতাকে তুলে নেয় সেখানে যেতেই দেখে আহিয়ান বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে থাকলেও পড়ে আহিয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে ওর বাইকের পিছনে উঠে বসে। আহিয়ান বাইক চালাতে শুরু করে। আনিতা মাঝে কিছুটা দূরত্ব রেখেই আহিয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে বসে আছে। আহিয়ান লুকিং গ্লাসে একবার আনিতাকে দেখে নিয়ে বলে,

–“অস্বস্তি হচ্ছে খুব?”

–“কি__কিছুটা।”

–“একটু সময় দাও কেটে যাবে।”

–“আপনি এখানে একা? ফাইয়াজ আর তন্ময় ভাইয়া কোথায়?”

–“ওরা দুজন আগেই তোমার ফ্রেন্ড দের সাথে চলে গিয়েছে। আমাকে যদিওবা সাথে যেতে বলেছিলো তন্ময় কিছু একটা বলে ফাইয়াজকে নিয়ে চলে যায়।”

–“ফাইয়াজ ভাইয়া যদি কোনোদিন জানতে পারে এসব ভাবতে পারছেন কি হবে?”

–“প্রথমে কিছুটা রাগ দেখালেও পরে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিবো। ফাইয়াজ রাগ করে থাকতেই পারবে না।”

–“কেন?”

–“অনেকগুলো বছর ফাইয়াজ আমাকে চিনে। আমার ব্যাপারে সবই জানে ও। আর ওর কথামতে, আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। সো রাগ করে থাকার প্রশ্নই আসে না। আর আমি ছেলে হিসেবে অতটাও খারাপ না। কিছুটা তো ভালো আছি।”

আহিয়ানের কথার পিঠে আনিতা আর কিছু বলল না। আনিতার ফোন বেজে উঠতেই আনিতা আহিয়ানের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে রোদেলার ফোন। আনিতা ফোন কেটে দিয়ে ম্যাসেজ করে দিলো যে,

–“আসছি আমি কলেজের কাছাকাছিই আছি বেশি একটা সময় লাগবে না।”

ম্যাসেজ সেন্ড করে আনিতা আবার ফোন ব্যাগে রেখে আহিয়ানের কাঁধে হাত রাখলো। কিছুক্ষণ বাদেই কলেজের সামনে পৌঁছে গেলো ওরা। আহিয়ান আনিতাকে নিয়েই কলেজের পার্কিং সাইডে গিয়ে বাইক থামালো। আনিতা বাইক থেকে নেমে গেলেই আহিয়ানও নেমে বাইক লক করে দুজনে একসাথেই কলেজের ভিতর ঢুকলো। কেউ কেউ বেশ কৌতূহল চোখেই তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। কেননা আহিয়ান এই কলেজ/ভার্সিটির স্টুডেন্ট না। ফাইয়াজের বন্ধু কিন্তু প্রায় সময়ই আনিতা আর আহিয়ানকে একসাথে দেখা যায় কলেজে। আনিতারা ক্যাম্পাসে ঢুকে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরই জারা এসে দাঁড়ায় ওদের সামনে। জারা একবার আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর আনিতাকে বলে,

–“কিছু কথা ছিলো তোর সাথে।”

জারার কথা শুনে আনিতা আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

–“ফাইয়াজ ভাইয়ারা সিড়ির দিয়ে উঠলে সেকেন্ড ফ্লোরের বা দিকের রুমটাতে আছে। আপনি যান আমি আসছি।”

আহিয়ান চোখের ইশারায় হ্যাঁ বলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জারা বলে,

–“ভাইয়া থাকুক এখানে সমস্যা নেই।”

জারার কথায় আহিয়ান থেমে যায়। আনিতাও বেশ অবাক জারার মুখ থেকে আহিয়ানকে ভাইয়া বলতে শুনে। কেননা জারা কোনোকালেই আহিয়ানকে ভাইয়া বলতো না। বরাবরই নাম ধরে ডাকতো। আর দু’মাস আগে যখন জানতে পেরেছিলো আহিয়ান আর আনিতা দুজন দুজনকে ভালোবাসে তখন থেকেই আনিতার সাথে কথা বলা অফ করে দিয়েছিলো। একপ্রকার এড়িয়েই চলেছে এ’কদিন। আনিতাও জারার ব্যাপারে তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। এতক্ষণ জারার মুখে বেশ সিরিয়াস সিরিয়াস ভাব থাকলেও এখন হাসি হাসি মুখে বলে,

–“আমার ক্রাশটাকে এভাবে নিয়ে নিলি তুই? দিস ইজ নট ফেয়ার আনিতা। একটু ভাগ তো আমাদেরও বসাতে দিতে পারতি তাই না? জানিস আমাদের কলেজের আরো কিছু সিনিয়ার জুনিয়র মেয়েরা আহিয়ান ভাইয়ার উপর ক্রাশ। যখন জানতে পেরেছে তার গার্লফ্রেন্ড আছে তখন থেকেই সবগুলোর মুখ একদম ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছে।”

–“জানলো কিভাবে? আহিয়ানের গার্লফ্রেন্ড আছে?”

–“যারা যারা আহিয়ান ভাইয়ার উপর ক্রাশড ছিলো তাদের আমি পার্সোনালি নিজ দায়িত্বে আহিয়ান ভাইয়ার মিঙ্গেল হওয়ার খবরটা জানিয়েছি। তোর অনেক হেল্প করে দিয়েছি আপাতত আর কেউ ভাইয়ার উপর নজর দিবে না। সো এখন এই খুশিতে ট্রিট দিবি আমাকে চল।”

আনিতা কিছু বলবে তার আগেই আহিয়ান জারাকে বলে,

–“খুউব ভালো কাজ করেছো শালীকা। উমমম চলো আজ আমি তোমাদের ট্রিট দিবো।”

–“সত্যি বলছেন ভাইয়া?”

–“একদম। কি খাবে বলো?”

–“ফুচকা হলেই হবে আর কিচ্ছু লাগবে না।”

–“ওকে ডান। চলো তাহলে?”

শেষ কথাটা আহিয়ান আনিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে। আনিতাও মৃদু হেসে জারাকে নিয়ে এগিয়ে চলে ফুচকার দোকানের সামনে। আনিতা তো একপ্রকার ভয় পেয়ে গিয়েছিলো জারা কি না কি বলবে সেই ভেবে। কিন্তু জারার কথা শুনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আনিতা ভেবেছিলো জারা আপসেট থাকবে ওর সাথে কথা বলবে না। কিন্তু এখন দেখলো সম্পূর্ণ উলটো। আনিতা ফোন বের করে রোদেলাকে ফোন করে বলল সবাইকে নিয়ে ফুচকার দোকানে আসতে। আহিয়ান সবার জন্য ফুচকা অর্ডার দিয়ে আনিতার পাশে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণের মাঝে রোদেলা তাসকিয়া জেরিন ফাইয়াজ তন্ময় শুভ ছয়জনে এসে বসে ওদের পাশে।

ফুচকা খাওয়া শেষে সবাই মাঠের এক কোনে গিয়ে বসে। ফাইয়াজ আর তাসকিয়া ফুচকা খেয়েই বাইক নিয়ে ঘুরতে চলে গিয়েছে। ওরা মাঠে এসে বসার কিছুক্ষণ বাদে তন্ময় বলে,

–“এখন আর তোরা বসে আছিস কেন? ফাইয়াজ তো নেই। তোরাও চলে যা ঘুরতে। তবে হ্যাঁ ফাইয়াজ আসার আগে আসতে হবে তোদের।”

তন্ময়ের কথায় সবাই সহমত প্রকাশ করে। কিন্তু আনিতার এখন যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। যদি ফাইয়াজ আগেই চলে আসে তাহলে কি হবে? সবটা তো ফাইয়াজ জেনে যাবে তখন? এসব ভেবেই আনিতা বলে,

–“যাবো না আমি। বাই এনি চান্স যদি ফাইয়াজ ভাইয়া আগে চলে আসে তাহলে কি হবে?”

–“ভয় পাচ্ছিস কেন? তাসকিয়াকে আমি বলে দিয়েছি ওরা আসার আগে যেন তোকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দেয়।”

রোদেলার কথায় আনিতা মনে কিছুটা সাহস আনলেও আবার ভয়ে কুঁকড়ে উঠে। ওর ছোট চাচ্চু এখন বাসায়। আশে-পাশে তার অনেক পরিচিত ফ্রেন্ড আছে যারা সকলেই আনিতাকে চিনে। যদি কারো চোখে পড়ে যায় একবার তখন? এই ভেবে আনিতা আহিয়ানের দিকে তাকায় একবার। আহিয়ান উত্তরের আশায় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আহিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলো না আনিতা। রাজি হয়ে গেলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আনিতা আর আহিয়ানও পার্কিং এড়িয়ার দিকে এগিয়ে গেলো। এবার ঢাকা থেকে আসার সময় আহিয়ান আর তন্ময় দুজনেই বাইক নিয়ে এসেছিলো। ফাইয়াজের বাইক বাসায় থাকায় ও তন্ময়ের সাথে করে এসেছে। ফাইয়াজ নিজের বাইকে করেই ঘুরতে বের হয়েছে। আহিয়ান গিয়ে তন্ময়ের বাইকের পাশে থেকে নিজের বাইক বের করে নিলো।

আহিয়ান বাইক বের করে আনিতার সামনে এসে দাঁড়াতেই আনিতা পিছনে উঠে বসে। আহিয়ানের কাঁধে আনিতা হাত রাখতেই আহিয়ান বাইক চালাতে শুরু করে।



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২১
#Ornisha_Sathi

–“কোথায় যাবে বলো?”

–“আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।”

–“ফাইয়াজ ওরা কোনদিকে গিয়েছে জানো?”

–“রোদেলা তো বলেছে ওরা নবাবগঞ্জ বেড়িবাধের ওদিকে যাবে।”

–“তাহলে তো এদিকে যাওয়া যাবে না। আগে বলবে তো।”

এই বলেই আহিয়ান বাইক ঘুরালো। আবার কলেজের দিকেই বাইক এগিয়ে চলছে। কিছুটা স্পিডেই বাইক চালাচ্ছে আহিয়ান। আনিতা শক্ত করে আহিয়ানের কাঁধ চেপে ধরে বসে আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা কলেজ পেড়িয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো। আহিয়ান বলে,

–“শ্রীনগড় বাইপাস দিয়ে হাইওয়ে ধরে মাওয়া পদ্মা রিসোর্টে যাবে?”

–“আপনার ইচ্ছে।”

–“আপাতত কাছে এই জায়গাটাই আছে মোটামুটি সুন্দর। কোলাহল মুক্ত নিরিবিলি পরিবেশ। তোমায় নিয়ে তো আবার দূরে কোথাও যাওয়া যাবে না। রিস্ক হয়ে যেতে পারে। নয়তো অন্য কোথাও নিয়ে যেতাম।”

–“ওখানেই চলুন সমস্যা নেই।”

–“আচ্ছা।”

বলেই আহিয়ান বাইকের স্পিড আগের থেকে আরো বাড়িয়ে দিলো। এতক্ষণ দুজনের মাঝেই যতটুকু দূরত্ব ছিলো এখন সেটাও ঘুচে গেলো। আনিতা শক্ত করে আহিয়ানের শার্ট খামচে ধরে বসে আছে। লুকিং গ্লাসে আনিতার এমন ভয়ার্ত চেহারা দেখে আহিয়ান বেশ এঞ্জয় করে। দুই ঠোঁট চেপে ধরে আহিয়ান হাসি থামিয়ে বলে,

–“ভয় লাগছে?”

–“কিছুটা। আস্তে চালান বাইক।”

–“ওকে বাট হাইওয়ে-তে উঠে তো আরো স্পিডে বাইক চালাতে হবে। তখন কি করবে? হাইওয়ে-তে তো আর কম স্পিডে বাইক চালানো যাবে না।”

–“সেটা পরে দেখা যাবে। এখন আপনি বাইকের স্পিড কমান।”

আহিয়ান ঠোঁট কামড়ে ধরে ক্ষানিকটা শব্দ করেই হেসে দিলো। ধীরে ধীরে বাইকের স্পিড মাঝারিতে নিয়ে আসলো।

হাইওয়ে-তে উঠে আহিয়ান বাইকের স্পিড আবারো বাড়িয়ে দিলো। হাইওয়ের রাস্তার পাশে ছোট ছোট সাইনবোর্ডে লেখা গতিসীমা ৮০ কিন্তু আহিয়ান এর থেকেও বেশি স্পিডে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। পৌনে এক ঘন্টার মাঝেই আহিয়ান পদ্মা রিসোর্টের পার্কিং-এ এসে বাইক থামালো। আনিতা বাইক থেমে নেমে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আহিয়ান বাইক লক করে আনিতার কাঁধে হাত রাখতেই আনিতা বলে,

–“যাওয়ার সময় এত জোরে বাইক চালাবেন না আগেই বলে দিলাম।”

–“কিন্তু___”

–“হাইওয়ে ধরে যাবো না আমরা। ভিতরের রোড দিয়েই যাবো ওকে? তাহলে তো ধীরে চালাতে পারবেন।”

–“ওকে ম্যাডাম আপনি যা বলবেন তাই হবে।”

এই বলেই আনিতার হাত ধরেই রিসোর্টের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দুটো টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করে দুজনে।

পুরো রিসোর্ট ঘুরে দেখে দুজনে। তারপর রিসোর্টে প্রবেশ করার প্রথমেই যে বড় পুকুরটা ছিলো সেই পুকুরের একদম নিচের সিড়ির উপরের সিড়িতে গিয়ে বসে দুজনে। আহিয়ানের কাঁধে মাথা দিয়ে পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে বসেছে আনিতা। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই বসে থেকে নানান ধরনের কথা বলল দুজনে। আহিয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে একটা বেজে উনপঞ্চাশ মিনিট। আহিয়ান ফোন আবার পকেটে রেখে আনিতাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আনিতার হাত ধরে হেঁটেই রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে এলো দুজনে। আহিয়ান বাইকে উঠে বসতেই আনিতা উঠে বসলো পিছনে। আহিয়ান বাইক চালাতে শুরু করে। আনিতা বলে,

–“এটা তো বাসায় ফেরার রাস্তা না এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

–“ঠান্ডা মাথায় কিডন্যাপ করেছি তোমায়। এখন মেরে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দিবো। তাই এদিক দিয়ে যাচ্ছি।”

–“ওহ আচ্ছা। বেশ তাহলে চলুন আমি রাজি।”

বলে আনিতা আহিয়ানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বসলো। আনিতার এভাবে বসাতে আহিয়ান হুট করেই ব্রেক কষে। আহিয়ানের বুকের ভিতর কেমন যেন উথাল-পাতাল ঢেউ খেলা করছে। কখনো আনিতা নিজ থেকে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরেনি। আজ যে বাইকে করে এসেছে তারপরও এভাবে ধরে বসেনি। হুট করে এভাবে জড়িয়ে ধরে বসাতে আহিয়ান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বাইক থামিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে আনিতার দিকে তাকায় আহিয়ান। আহিয়ানকে হুট করে বাইক থামিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে আনিতার দিকে তাকাতে দেখে আনিতা জিজ্ঞেস করে,

–“কি হলো? বাইক থামালেন কেন?”

–“এই যে আমি বললাম তোমায় মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিবো। একটুও ভয় লাগছে না তোমার? তুমি ভয় না পেয়ে উলটো আমাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে বসলে যে?”

–“প্রথমত, একদমই ভয় লাগছে না আমার। আমি জানি আপনি এমন কিছুই করবেন না। করতে পারেন না। কারন আপনি আমাকে খুউব ভালোবাসেন সেটা আমি জানি। তাই আমাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার যে কথাটা বললেন সেটা মজা করেই বলেছেন। সুতরাং ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর দ্বিতীয়ত, আমি তাকেই জড়িয়ে ধরেছি যাকে আমি ভালোবাসি যে আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসি আমি আপনাকে সারাজীবন আপনার সাথে কাটাতে চাই আমি। সুতরাং জড়িয়ে ধরতেই পারি।”

–“বুঝলাম।”

–“কি বুঝলেন?”

–“এই যে আমার পিচ্ছি-পাখিটা বেশ বড় হয়ে গিয়েছে।”

–“হুম এতদিনে বুঝলেন তাহলে আমি বড় হয়ে গিয়েছি? তাহলে এখন থেকে আমায় একদম পিচ্চি বলে ডাকবেন না।”

–“তা-তো হবে না। আমি এই নামেই ডাকবো।”

বলেই আহিয়ান সোজা হয়ে বসে আবারো বাইক চালাতে শুরু করে। আনিতা এবারে আর কিছু বলল না। আহিয়ানকে এবার হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরে বসলো আনিতা। কিছুটা সময় বাদেই আহিয়ান পদ্মার পাড়ে গড়ে উঠা হোটেলগুলোর সামনে এসে বাইক থামালো। জায়গামতো বাইক রেখে আনিতার হাত ধরে আহিয়ানের পরিচিত একটা হোটেলে গিয়ে বসলো দুজনে। জানালার পাশের একটা টেবিলে মুখোমুখি বসেছে দুজন। জানালা দিয়ে নদীটা দেখা যাচ্ছে আর মাঝে মধ্যেই খোলা হাওয়া আসছে। আনিতাকে বসিয়ে রেখে দোকানীর ওখানে চলে গেলো। বড় একটা ইলিশ কিনে সেটা ভাজতে দিয়ে আবার আনিতার পাশে এসে বসলো।

পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাঝেই একটা ছেলে এসে টেবিলে খাবার দিলো। ধোঁয়া উঠা গরম ভাত আর সাথে ইলিশ মাছ ভাজ আর বেগুন ভাজা। সাথে ইলিশের লেজ ভর্তা। ইলিশ মাছটাতে ডিম হয়েছে। সেটা আর আলাদা করে বের করা হয়নি। ডিমসহ মাছটা কেটে ভেজেছে। খাবার দিয়ে ছেলেটা চলে যাওয়ার সময় আহিয়ান বলে,

–“ইলিশের আস্ত ডিম ভুনা পাওয়া যাবে?”

–“হ্যাঁ হবে।”

–“আচ্ছা তাহলে বড় দুটো ডিম ভুনা দিয়ে যাও এখানে।”

–“আচ্ছা।”

বলেই ছেলেটা চলে গেলো। কিছুক্ষণের মাঝে আবার ইলিশের ডিম নিয়ে হাজির হলো ছেলেটা। টেবিলে ডিমের প্লেট রেখে আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে যায়। ছেলেটা যেতেই আনিতা বলে,

–“এখানে মাছের সাথে ডিম তো ছিলোই। তাহলে আবার আলাদা করে ডিম ভুনা আনালেন যে?”

–“তোমার যে ইলিশ মাছের ডিম খুব পছন্দের সেটা আমি জানি তাই আনালাম।”

–“কিভাবে জানলেন?”

–“লাস্ট টাইম যখন আমরা এখানে খেতে এসেছিলাম তখন ইলিশের ডিম খাওয়ার সময় ফাইয়াজ বলেছিলো। এখন এত কথা বলা অফ করে খাওয়া শুরু করো।”

আনিতা কিছু না বলে মুচকি হাসলো। দুজনেই খাওয়া শুরু করলো। আনিতা দু/তিন লোকমার মতো ভাত খেয়েছে বেগুন ভাজা আর ইলিশের লেজ ভর্তা দিয়ে। এখন বসে শুধু মাছ খাচ্ছে। মাঝে মধ্যে আহিয়ান নিজের প্লেট থেকে মাছের কাটা বেছে আনিতাকে দিচ্ছে। আর মাছের পেট থেকে ডিম ছাড়িয়ে সেটাও আনিতার প্লেটে তুলে দিচ্ছে। শেষমেশ আনিতা রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কথা বললে আহিয়ান বলে,

–“আচ্ছা রাগ করতে হবে না। আর দিচ্ছি না হ্যাপি তো? এবার নিজের খাবারটা শেষ করো।”

আনিতা এক পিস মাছ আর আহিয়ানের কাটা বেছে দেওয়া মাছ আর ডিমের টুকরোটা খায়। সাথে একটা ভুনা ডিম খায়। আরো খাওয়ার জন্য আহিয়ান বেশ জোর করে আনিতাকে। কিন্তু আর খায়নি ও। এতেই নাকি ওর পেট ভরে গিয়েছে। তাই আহিয়ানও আর জোর করে না। আহিয়ান নিজের খাওয়া শেষ করে। কয়েক পিস মাছ বেশি হয়েছে মাছগুলো আহিয়ান সেই ছেলেটাকে ডেকে দিয়ে দিলো। তারপর বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে।

মাওয়া থেকে আসার সময় আহিয়ান রাড়িখালের কাছাকাছি এসে বলে,

–“স্যার জগদীশ চন্দ্রের বাসায় যাবে?”

–“এটাও চিনেন আপনি?”

–“তোমাদের এখানকার বলে যে আমি চিনবো না এমন তো না। একসময় অনেক নাম ছিলো এই জায়গার ফাইয়াজের সাথে এসেছিলাম তাই কিছুটা চিনি-জানি।”

কথাটা বলেই আহিয়ান রাড়িখাল বাজার ছাড়িয়ে একটু সামনে এগিয়েই স্যার জগদীশ চন্দ্রের পুরোনো সেই বাড়ির রাস্তায় ঢুকে পড়ে। বাড়িটার পাশেই রাড়িখাল স্কুল এন্ড কলেজ। আহিয়ান বাড়ির গেটের কাছেই বাইক থামিয়ে দুটো টিকিট কেটে নিয়ে ভিতরে ঢুকে।

পুরোটা জায়গা দুজনে ঘুরেফিরে একটা দোলনায় গিয়ে বসে। এখানে আনিতা এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে। রাড়িখাল বাজার থেকে কিছুটা ভিতরে গেলেই আনিতার বড় আন্টির বাসা। ওর খালাতো ভাইয়ের সাথে এখানে এসেছিলো একবার আর তারপর ফ্রেন্ডরা মিলে এসেছিলো দু/তিনবার। আহিয়ানের কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে আনিতা। আহিয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে তিনটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। সময় দেখে আহিয়ান ফোন পকেটে রাখতেই আনিতার ফোনে ম্যাসেজ আসলো। তাসকিয়ার ম্যাসেজ। আনিতা ম্যাসেজ ওপেন করে দেখে সেখানে লিখা,

–“কোথায় তোরা? আমি আর ফাইয়াজ কলেজে ফিরে আসছি আসতে ২০/২৫ মিনিট লাগতে পারে। এর আগে তোদের ফিরতে হবে কিন্তু।”

আহিয়ান আনিতার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো দোলনা থেকে। হাঁটা লাগালো দুজনে। যেখানে বাইক রাখা ছিলো সেখানে এসে আহিয়ান বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো। আনিতা গিয়ে বসতেই বাইক চালাতে শুরু করে।

সতেরো মিনিটের মাথায় আহিয়ান কলেজের পার্কিং সাইডে এসে বাইক থামায়। আনিতা নেমে দাঁড়াতেই আহিয়ান নেমে বাইক লক করে তন্ময়কে ফোন লাগায়। তন্ময় ফোন রিসিভ করতেই আহিয়ান জিজ্ঞেস করে,

–“কোথায় আছিস তোরা?”

–“ভার্সিটির মাঠের বটগাছের নিচে আছি। এখানেই আয়।”

–“ওকে রাখছি।”

আহিয়ান ফোন কেটে পকেটে রেখে দেয়। আনিতাদের কলেজ আর ভার্সিটির মাঝ দিয়ে একটা মাঝারি আকারের রাস্তা গিয়েছে। তাই ভার্সিটি আর কলেজ দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। আনিতা কলেজের মাঠ দিয়েই সেকেন্ড গেইট দিয়ে বের হয়ে রাস্তা পাড় হয়ে ভার্সিটির মাঠে যায়। কলেজ চারিদিকে দেয়াল করা থাকলেও ভার্সিটির মাঠের দক্ষিণ আর পশ্চিম দিক ঘেঁষে ভার্সিটির দেয়াল। পূর্ব আর উত্তর দিকের জায়গাটা ফাঁকা পড়ে আছে। দক্ষিণ দিকের দেয়ালের এপাশেই বড় বটগাছটা ঘিরে চারিদিকে গোল করে বসার মতো জায়গা বাঁধানো। সেখানেই তন্ময় শুভ রোদেলা জেরিন আর জারা বসে আছে। আনিতা আর আহিয়ান ওদের কাছে চলে গেলো। আনিতা গিয়ে রোদেলার পাশে বসে পড়লো আর আহিয়ান তন্ময়ের পাশে।

মিনিট ছয় পরেই ফাইয়াজ ওদের সামনে এসে বাইক থামালো। ওদের দুজনকে দেখে তন্ময় বলে,

–“এতক্ষণে আসার সময় হলো?”

–“খুব লেট হয়ে গেলো বুঝি?”

ফাইয়াজের কথায় আনিতা আর আহিয়ান বাদে সবাই একসাথে বলে,

–“একদমই না।”

–“তাহলে এখন বাসায় যাওয়া যাক?”

শুভর কথায় সবাই সম্মতি জানায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সকলেই। কলেজের পাশেই জারার বাসা তাই ও বিদায় নিয়ে চলে গেলো। জেরিন আর শুভর বাসা পাশাপাশি হওয়াতে জেরিন শুভর বাইকে করেই গেলো। তাসকিয়া ফাইয়াজের দিকে কিছুটা চেপে বসে রোদেলাকে বলল বসার জন্য। রোদেলা আর না দাঁড়িয়ে বাইকে উঠে বসলো। ফাইয়াজ আনিতাকে বলে,

–“তোরা থাক এখানে আমি ওদের দুজনকে নামিয়ে দিয়ে আসছি।”

–“নাহ ভাইয়া তুমি বরং বাসায় চলে যেও আমি এখান থেকে রিকশা নিয়েই যাচ্ছি।”

–“রিকশায় যেতে হবে না তাহলে তন্ময়দের সাথেই চলে যা।”

–“কিন্তু ভাইয়া___”

–“আরেহ আনিতা চলো তো। ভাই বলো তো আমাকে তাই না? তাহলে আমি থাকতে তুমি কেন রিকশায় করে যাবে?”

তন্ময়ের কথায় ফাইয়াজ সহমত প্রকাশ করে। তারপর বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় তাসকিয়া আর রোদেলাকে পৌঁছে দিতে। ফাইয়াজ যেতেই তন্ময় বলে,

–“এত ভয় পাওয়ার কি আছে আনিতা? আহিয়ানের সাথে যাও তুমি আমিও তো সাথে আছি নাকি?”

আনিতা মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানায়। তারপর তিনজনেই কলেজের পার্কিং সাইডে আসে। আহিয়ান আর তন্ময় বাইক বের করে। আহিয়ান আনিতার সামনে এসে দাঁড়াতেই আনিতা বাইকে উঠে বসে। তন্ময় আর আহিয়ান দুজনে একসাথেই বাইক স্টার্ট দেয়। সকালে আনিতা যেখান থেকে আহিয়ানের বাইকে উঠেছিলো সেখানে আসতেই আনিতা বলে,

–“এখানেই নামিয়ে দিন আমায়। আমি এখান থেকে একাই যাবো।”

আনিতার কথা শুনে আহিয়ান বাইক থামিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে আনিতার দিকে তাকায়। তন্ময়ও বাইক থামিয়েছে পাশেই। আহিয়ান বলে,

–“কিন্তু আনি___”

–“প্লিজ। ছোট চাচ্চু বাসায় এখন কিছু বুঝে ফেললে পরে সমস্যা হবে।”

–“কিছু হবে না আনিতা আর তোমার চাচ্চু তো আহিয়ানকে চিনে। জানে তো আমরা ফাইয়াজের বন্ধু। কাল তো গাড়িতে দুজনে একসাথে বসেই এসেছিলে কিছু বলেছিলো?”

তন্ময়ের কথায় আনিতা বলে,

–“কাল আর আজকের একসাথে যাওয়া-আসাটা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। যদিওবা তোমাদের দুজনকে আমাদের বাসার সবাই খুব ভালো করেই চিনে তবুও আমি রিস্ক নিতে চাই না।”

এই বলে আনিতা বাইক থেকে নেমে গেলো। আনিতা তন্ময়কে ইশারা করতেই তন্ময় বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় বাসার দিকে। আনিতা আহিয়ানের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর হাত দুটো ধরে বলে,

–“আপনিও চলে যান। আমি এতটুকু রাস্তা একাই যেতে পারবো।”

–“তোমাকে একা রেখে___”

–“আমি প্রতিদিন এখান দিয়ে কলেজে যাওয়া-আসা করি। আর হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটের রাস্তা তারপরই তো আমাদের বাসা। যেতে পারবো আমি। আপনি যান প্লিজ।”

আহিয়ান কিছু না বলেই চলে গেলো। আনিতা বেশ বুঝতে পারলো কিছুটা রাগ করেছে জনাব। কিন্তু কিছু করার নেই তো। কিছুটা সাবধানে তো চলতেই হবে। আনিতাও বাসার দিকে হাঁটা ধরলো।

বাসায় ফিরে আনিতা আহিয়ানের নাম্বারে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দেয় ও বাসায় পৌঁছেছে। বোরখা খুলে কিছুটা সময় ফ্যানের নিচে বসে থেকে কাবার্ড থেকে লং টি-শার্ট আর জিন্স নিয়ে টাওয়েল হাতে গোসল করতে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আনিতা ফোন হাতে নিয়ে দেখে আহিয়ান কোনো রিপ্লাই করেনি। বুঝলো তার রাগ এখনো পড়েনি। মুচকি হাসে আনিতা। ভেবে নিলো পরে ঠিক রাগ ভাঙিয়ে নিবে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে ছাদে উঠতে ইচ্ছে করলো না তাই অনিমার হাতে জামা-কাপড় দিয়ে দিলো ছাদে দিয়ে দেওয়ার জন্য। যদিওবা রোদ নেই এখন কিন্তু বাতাস আছে তাতে মোটামুটি শুকিয়ে যাবে। রুমে এসে চুল থেকে টাওয়েল খুলে বারান্দায় নিয়ে শুকোতে দিলো। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফাইয়াজের বারান্দা লক্ষ্য করলো। ফাইয়াজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আহিয়ান সিগারেট টানছে। আনিতাকে দেখেই উল্টো ঘুরে সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে শূন্যে। দুটো কারনে বেশ রাগ হলো আনিতার। প্রথমত, আহিয়ান ওকে দেখেও না দেখার ভান করে উলটো ঘুরে গেলো। আর দ্বিতীয়ত, ওকে দেখেও হাত থেকে সিগারেট ফেলল না। আহিয়ান জানে আনিতা সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না তারপরও খাচ্ছে। আনিতা বারান্দায় আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে রুমে চলে আসলো। ঘুম হয়নি কাল খুব ক্লান্ত লাগছে আর রাগটাও আপাতত কমানোর দরকার তাই একটা ঘুম প্রয়োজন। তাই ওভাবেই শুয়ে পড়লো আনিতা। ক্লান্ত থাকায় অল্প কিছু সময়ের মাঝেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_২২
#Ornisha_Sathi

সন্ধ্যার কিছুটা পরে আনিতার ঘুম ভাঙে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। এখন বেশ হালকা লাগছে নিজেকে। বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে এক মগ কফি বানিয়ে সোফায় এসে বসলো। আনিতা বসার কিছুক্ষণ বাদেই ওর ছোট চাচ্চু বাসায় ঢুকলো। আনিতাকে দেখে বলে,

–“ঘুম ভেঙেছে তোমার? তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমার জন্য নিয়ে আসা গিফট গুলো দিচ্ছি তোমাকে।”

–“ওকে চাচ্চু।”

আনিতার চাচ্চু আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। বিকেলে বাসায় ফিরে আনিতা নিজেই বলেছিলো কার্টন খুলে ফেলতে। তাই ওর চাচ্চু বিকেলেই খুলে ফেলে। আনিতাকে ডেকেছিলো কয়েকবার কিন্তু আনিতা ঘুমিয়ে থাকায় উঠে আসেনি। কিছুক্ষণ বাদে আনিতার চাচ্চু আনিতার পাশে এসে বসলেন। আনিতার দিকে কিটক্যাট আর স্নিকার্সের বড় দুই প্যাকেট চকলেট এগিয়ে দিলো। আর পকেট থেকে নতুন ফোন বের করে দিলো। আনিতা ফোন পেয়ে তো মহাখুশি। আনিতা ওর চাচ্চুকে জড়িয়ে ধরে বলে,

–“থ্যাংকিউ চাচ্চু।”

আনিতার চাচ্চু ওকে একহাতে জড়িয়ে নেয়। তখনই আনিতার আম্মু ড্রয়িংরুমে এসে আনিতার হাতে নতুন ফোন দেখে বলে,

–“আবার ওকে ফোন দিলি কেন? আগের তো একটা ফোন ছিলোই।”

–“ওটা তো তোমার পুরোনো ফোন ছিলো আম্মু।”

–“তাতে কি? ছিলো তো।”

–“আনিতা আমার কাছে চেয়েছিলো আগে। বলেছিলাম আসার সময় নিয়ে আসবো। তাই দিলাম। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে ফোন পেয়ে যা ইচ্ছে তাই করবে। যদি কখনো কিছু শুনেছি তাহলে সেটা কিন্তু তোমার জন্য ভালো হবে না আগেই বলে দিলাম আম্মু। মনে থাকেব?”

আনিতার চাচ্চুর কথায় আনিতা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ওর চাচ্চুর একটা ফোন আসাতে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। আনিতার আম্মুও নিজের রুমে চলে যান। এদিকে আনিতা বসে বসে ভাবছে। কোনোভাবে যদি চাচ্চু ওর আর আহিয়ানের কথাটা জেনে যায় তখন কি হবে? ওকে তো একদমই মেরে ফেলবে। ওর আব্বু চাচ্চু খুবই ভালো কিন্তু এসব বিষয়ে খুবই স্ট্রিক্ট। কিন্তু সত্যি তো চাপা থাকে না। একসময় না একসময় সেটা ঠিক সবার সামনে আসবে। তখন কি করবে আনিতা? ওর আব্বু চাচ্চুদের সামনে দাঁড়াবে কি করে?

আপাতত এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রুমে চলে গেলো। এসব নিয়ে যত ভাববে ততই মাথা ধরবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে ভেবে এখন এসব ভাবা বাদ দিলো। আনিতা রুমে গিয়ে আগের ফোন থেকে মেমোরি কার্ড আর সিমকার্ড খুলে নতুন ফোনে ভরে নিলো। অনিমা আনিতার কাছে এসে আনিতার আগের ফোন নিয়ে বলে,

–“এবার থেকে তাহলে এই ফোন আমার।”

আনিতা কিছু না বলে মুচকি হাসলো। আনিতাকে হাসতে দেখে অনিমা ফোন নিয়ে চলে গেলো ওখান থেকে। আনিতা উলটে পালটে নতুন ফোনটা দেখছে।

রাত দশটা বেজে নয় মিনিট। হুট করে আহিয়ানের কথা মনে পড়লো আনিতার। বিকেলে বাসায় ফেরার পর একটা বারের জন্যও ওর সাথে কথা হয়নি। আহিয়ান না ওর ম্যাসেজের উত্তর দিয়েছে আর না কোনো ফোন করেছে। বিছানার উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে আহিয়ানের নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েও করলো না। তন্ময়কে ফোন লাগালো। তন্ময় ফোন রিসিভ করে বলে,

–“হ্যাঁ আনিতা বলো।”

–“কোথায় আছো তোমরা?”

–“আমি আর ফাইয়াজ তো বের হয়েছি একটু।”

–“তা তোমার ওই গুনধর বন্ধু আহিয়ান কোথায়?”

–“আসার সময় তো ওকে ছাদেই দেখলাম। ”

–“আচ্ছা তাহলে পরে কথা বলছি আমি রাখছি।”

–“ওকে।”

আনিতা লাইন কেটে দিলো। ড্রয়িংরুমে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই। আনিতা ওর আম্মুর রুমে গিয়ে বলল,

–“ফুপ্পির বাসায় যাচ্ছি আমি।”

–“এত রাতে ও বাসায় কেন যাবি? এখন খেয়ে নিবি চল। তারপর ঘুমাবি। কাল সকালে যাস।”

–“আজ আমি ফুপ্পির সাথে ঘুমাবো আসছি।”

–“আরে আনিতা শোন। খেয়ে তো যা____”

আনিতা কিছু না শুনেই বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আনিতা ওর ফুপ্পির সাথে দেখা না করেই ছাদে উঠে গেলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে আহিয়ানকে পেলো না। তাই আবার নিচে নেমে এলো। বেশ ক্ষানিকটা সময় ওর ফুপ্পির সাথে গল্প করলো।

মিনিট পাঁচেক পর ফাইয়াজ এসে ওর আম্মুকে ডেকে বলল টেবিলে খাবার দিতে। আনিতার আম্মু খাবার গরম করে টেবিলে দিতে দিতেই আনিতার আংকেল চলে আসেন দোকান থেকে। আনিতা ওর ফুপ্পির কাজে কিছুটা সাহায্য করে। ইতিমধ্যেই ফাইয়াজ তন্ময় ফাইয়াজের আব্বু-আম্মু চেয়ার টেনে বসে পড়েন। আনিতা ওর ফুপ্পির চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আহিয়ানকে কোথাও দেখা গেলো না। তন্ময় আহিয়ানকে ডাকতে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আহিয়ান এসে চেয়ার টেনে বসে। একবারের জন্যও আনিতার দিকে তাকালো না। আনিতার বেশ রাগ হচ্ছে এবার আহিয়ানকে এভাবে দেখে। আনিতার ফুপ্পি সবাইকে খাবার সার্ভ করতে গেলে আনিতা বলে,

–“আজ আমি সবাইকে দিয়ে দিচ্ছি তুমি বসো।”

–“তুইও খেতে বোস। তোর দিতে হবে না।”

–“আহ! ফুপ্পি দাও না।”

–“তুই পারবি না।”

–“পারবে মা। এখন থেকেই একটু আধটু শিখিয়ে দাও নয়তো বিয়ের পর কথা শুনতে হবে। তার থেকে ভালো না এখনই কিছুটা প্র‍্যাক্টিস করে নিক।”

ফাইয়াজের কথায় আনিতা রাগ দেখিয়ে বলে,

–“তুমি তোমার বউকে নিয়ে চিন্তা করো আমায় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

এই বলে আনিতা একে একে সবার প্লেটে খাবার দিয়ে দিলো। শুধুমাত্র ফাইয়াজের প্লেট ছাড়া। ফাইয়াজ কিছুটা অবাক হয়ে বলে,

–“সবাইকে দিলি আমাকে দিলি না কেন?”

–“নিজের খাবার নিজে নিয়ে খাও। বিয়ের পর তো তাই করতে হবে। তার থেকে ভালো না এখন থেকেই অভ্যাস করে নাও।”

এই বলে আনিতা ওখান থেকে চলে যেতে নিলেই ওর ফুপ্পি ডেকে উঠে। আনিতা পিছন ফিরতেই ওর ফুপ্পি জিজ্ঞেস করে,

–“কোথায় যাচ্ছিস তুই? খেতে বোস বলছি।”

–“পেট ভরা ফুপ্পি খাবো না। আমি রুমে যাচ্ছি ঘুমোবো।”

–“শোন আনিতা__”

আনিতা আর এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে এ বাড়িতে ওর জন্য বরাদ্দ করা রুমে চলে গেলো। আনিতা যাওয়ার কিছুটা সময় বাদে অল্প কিছু খেয়ে আহিয়ানও খাবার ছেড়ে উঠে গেলো। পর পর দুজনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তন্ময় মুখ টিপে হাসলো। দুজনের মাঝে যে মান অভিমান চলছে সেটা তন্ময় বেশ বুঝতে পারছে। আহিয়ানের আনিতাকে এড়িয়ে চলার বিষয়টা তন্ময় জানে। উল্টো দিকে আনিতার অভিমানী মুখটাও তন্ময়ের ভালো লাগছে না। ওর ইচ্ছে করছে আনিতাকে গিয়ে সবটা বলে দিতে। কিন্তু লাস্ট মোমেন্টে এসে যদি সবটা বলে দেয় তাহলে তো আর সারপ্রাইজ থাকলো না। তাই তন্ময় চুপ করে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।

সাড়ে এগারোটা বাজে। আনিতার ঘুম আসছিলো না। তাই চুপিচুপি ছাদে চলে গেলো। আনিতাকে ছাদে যেতে দেখে তন্ময় আগেই ছাদের কারেন্ট অফ করে দিলো। আনিতা ছাদে গিয়ে লাইট অন করার জন্য সুইচ টিপ দিলো ঠিকই কিন্তু লাইট জ্বলে উঠলো না। ফোনটাও নিয়ে আসেনি আনিতা তাই বেশ রাগ হলো নিজের উপর। আনিতা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে আকাশে অর্ধেক চাঁদ উঠেছে। অর্ধেক চাঁদের আলোতেই চারিপাশ কিছুটা আলোকিত লাগছে। কেন যেন একটুও ভয় লাগছে আনিতার। ছাদের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আনিতা। ওর বা দিকে পা বাড়াতে নিলেই মৃদু বাতাস এসে আনিতার শরীরে লাগতেই কিছুটা কেঁপে উঠলো। আনিতার হাতের ডান দিকে চোখ যেতেই দেখলো রেলিং ঘেঁষে একটা ছেলের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। চাঁদের হালকা আলোতে আনিতা স্পষ্ট বুঝতে পারলো অবয়বটা আহিয়ান ছাড়া অন্য কারো না। ধীর পায়ে এগিয়ে আনিতা আহিয়ানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আহিয়ান তখনো উলটো ঘুরে সিগারেট টানছে। ও বুঝতেই পারেনি ওর পিছনে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। আনিতা গলা ঝেড়ে বলে,

–“বলছিলাম কি লাইটার হবে আপনার কাছে?”

আনিতার গলা পেয়ে আহিয়ান চমকে পিছন ফিরে তাকালো। আহিয়ান এই সময় আনিতাকে একদমই ছাদে আশা করেনি। আহিয়ান আমতা আমতা করে বলে,

–“তুমি? তুমি এসময় ছাদে কেন?”

–“সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি। যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দিন আপনি।”

–“কি?”

–“লাইটার হবে আপনার কাছে?”

–“লাইটার দিয়ে তুমি কি করবে?”

–“সিগারেটের টেস্ট কেমন সেটাই দেখবো।”

–“মানে?”

–“আপনার এত মানে বুঝতে হবে না। লাইটার আছে কিনা সেটা বলুন।”

–“নাহ নেই।”

–“স্মোক করছেন অথচ লাইটার নেই বলছেন? ওকে কোনো ব্যাপার না।”

কথাটা বলে আনিতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আহিয়ান অন্যদিকে ঘুরে আবার সিগারেট মুখে নিতে গেলেই আনিতা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। তারপর দাঁত কেলিয়ে বলে,

–“লাইটার লাগবে না। এটাতেই হবে।”

আনিতা সিগারেট মুখে দিতে গেলে আহিয়ান ওর হাত চেপে ধরে। আনিতার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে মাটিতে ছুড়ে পা দিয়ে পিষে ফেলে। আহিয়ান রেগে আনিতার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

–“কি করতে যাচ্ছিলে কি তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?”

–“হ্যাঁ মাথা তো ঠিকই আছে।”

–“স্মোক করবে না ইভেন সিগারেট ছুঁবেও না একদম তুমি।”

–“তাহলে আপনি স্মোক করছিলেন কেন?”

–“আমি স্মোক করবো বলে কি তোমাকেও করতে হবে নাকি?”

–“হ্যাঁ করবো।”

–“একদম না।”

–“তাহলে আপনিও আর স্মোক করবেন না। আপনি জানেন স্মোক করা আমি একদম পছন্দ করি না তারপরও আপনি আমার সামনে স্মোক করছেন। আপনার সাহস তো কম বড় না।”

–“আমার সাহসের কিছুই দেখোনি তুমি।”

–“দেখতে চাইও না। আপনি আগে বলুন আর স্মোক করবেন না।”

–“ভেবে বলবো।”

–“আচ্ছা সেটা পরে দেখছি। কলেজ থেকে ফেরার পর থেকেই আপনি এভাবে আমাকে এড়িয়ে চলছেন কেন?”

–“আমার যেভাবে খুশি আমি সেভাবে চলবো।”

–“কিন্তু আমাকে এভাবে এড়িয়ে চলতে পারেন না। কষ্ট হয় আমার এতে। আমাকে এভাবে কষ্ট দিতে পারেন না আপনি।”

–“পারি সব করতে পারি আমি।”

–“আমাকে কাঁদাতেও পারেন?”

–“হ্যাঁ এটাও পারি।”

আহিয়ানের কথায় আনিতার চোখদুটো ছলছল করে উঠে। আহিয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে টাইম দেখে নিলো একবার। তন্ময়কে একটা ম্যাসেজ সেন্ড করে আবারো ফোন পকেটে রাখলো। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে ওখান থেকে চলে আসতে নিলেই আহিয়ান আনিতার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। এক টান মেরে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আনিতাকে। চোখের পলক ফেলতেই আনিতার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আহিয়ান এক হাতে আনিতার চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে অন্যহাত দিয়ে আনিতার কোমড় চেপে ধরলো।

–“হ্যাপি বার্থডে পিচ্ছি-পাখি। ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটার্ন অফ দ্যা ডে।”

আহিয়ান কথাটা বলার সাথে সাথেই ছাদের লাইটিং জ্বলে উঠলো। আনিতা চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আহিয়ানের দিকে আবার তাকায়। এই মূহুর্তে আনিতার চোখ-মুখে খুশির ঝিলিক। আহিয়ান আনিতাকে আর একটু নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,

–“তোমাকে আমি কাঁদাতেও পারি আর হাসাতেও পারি। ভালোবাসি তোমাকে আমি। তোমাকে হাসানোর কাঁদানোর অধিকার শুধুমাত্র আমার। তোমার সাথে আমার যা ইচ্ছে করতে পারি আমি। আমিই হাসাবো আবার আমিই কাঁদাবো। আমিই রাগ করবো আবার আমিই তোমার রাগ অভিমান সব ভাঙাবো। আমিই তোমার সাথে ঝগড়া করবো তোমাকে বকাঝকা করবো আর সারাজীবন আমিই তোমাকে ভালোবাসবো। আর আমিই আদর করবো তোমাকে।”

শেষ কথাটা আহিয়ান আনিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে। আহিয়ানের শেষ কথায় আনিতা কেঁপে উঠে কিছুটা। হুট করেই আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ লুকায় আনিতা। আহিয়ান ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হেসে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে।



চলবে।

[ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। আর গল্পটা কেমন হচ্ছে অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং🥰 ]