শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-০৮

0
220

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ৮)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
” তুমিই। কেবল তুমিই পারবে আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভালো রাখতে। ”

নিস্তব্দ নিশুতি রাত। গা ছমছম করা রাতের নির্জনতা। দূর হতে ভেসে আসছে দুঃখিনী কানাকূয়োর কলিজা ছেঁড়া ডাক। এ যেনো অতল স্বর্গের ডাক। আয়মান শুভ্রতার কোলে মাথা রেখে চোখ বুঁজে আছে। শুভ্রতা আয়মানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এই মধুর রাতকেও শুভ্রতার কাছে এতো ব্যথাতুর বিরহের রাত মনে হচ্ছে কেনো বারবার। কেনো না পেতেই হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে শুভ্রতা। তার চোখ গড়িয়ে ভোরের শিশিরের মতন টপটপ করে কফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো আয়মানের মুখের উপরে।

আয়মান টের পেতেই বন্ধ আঁখি মেলে ধরলো অসীম মায়ায়। নিবু নিবু চোখে চাইলো শুভ্রতার আঁখিপানে।

” তোমার চোখে জল কেনো? শুভ্ররঙা কাপড় পরার ভয়ে?”

” নাহ।

“তো? বলো? ”

” কাউকে ঠকাতে গেলে নিজেকেই বেশী ঠকতে হয়।”

এটা উপলব্ধি করতে পেরেই চোখে জল এলো।

” চমৎকার বলেছে দর্শনের ছাত্রী। তাহলে আর ঠকাবে?”

আয়মানের কথাটা বেশ করুণ ঠেকলো শুভ্রতার কানে।

” কথা দিচ্ছি। আর ঠকাবোনা। ”

” তাহলে কিছুক্ষণ আগে জানতে চাওয়া আমার সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। প্লিইইজ।”

দুহাত জোড় করে আকুতিমাখা কন্ঠে বলল আয়মান।

শুভ্রতার ভারি সংকোচ হচ্ছে। ইচ্ছে অনিচ্ছেয় তার বলতেই হচ্ছে ভালোবাসি। কেননা এই শব্দটার সাথে একজন মানুষের ভালোথাকা, আনন্দে থাকা পরিপূরক।

” আমি আপনাকে এখন ভালোবাসি। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ভালোবেসে যাবো। আর হাত ও মুখ সরিয়ে নিয়েছি, আসলে এই একই ঘরে অন্যরুমে বাসর করেছি আপনার ছোট ভাইয়ের সাথে। আর আজ আপনার সাথে। কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছে ও ভীষণ খারাপ ও লাগছে। তাই আপনার স্পর্শ নিতে পারছিলাম না হুট করে। আমাকে একটু সময় দেন। ঠিক হয়ে যাবে।”

আয়মান শুভ্রতার কোল থেকে মাথা সরিয়ে উঠে বসলো। বলল,

” আমাদের বাসর হবেনা আজ। যেদিন তুমি চাইবে ঠিক সেদিনই হবে বাঁচলে। আগে মনের গহীনে যে দূর্যোগের ঘনঘটা গিয়েছে এতটা দিন মাস। যেই অসহনীয় যন্ত্রণা ও অনলে পুড়ে পুড়ে প্রেমিক হৃদয় হয়েছে আরো বিশুদ্ব ও খাঁটি। সেই তান্ডললীলা শুনাবো আজ তোমায়।”

বলেই আয়মান শুভ্রতার মাথাকে নিজের প্রশস্ত বুকের মাঝে চেপে ধরলো।
” বুকে মাথা রেখে কান পেতে শোনো হৃদয় কি বলে। শুনতে পাচ্ছো প্রিয়তমা প্রেমিকের পাঁজরভাঙার আর্তনাদ?টের পাচ্ছো বুকের ভিতরের সমুদ্রের দুঃখবিলাস? ”

” হুম পাচ্ছি। আপনি কালই ডাক্তার দেখাবেন। কাশির সাথে রক্ত ঝরে কেনো? এতো খারাপ সিচুয়েশন কি করে হলে আপনার? ”

আয়মান হাহাকার জাগানিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বুক ভরে। জীবনের উপর প্রবল আক্ষেপের ঝড় তুলে বলল,
প্রতিনিয়ত যখন তোমার এড়িয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে দম বন্ধ হয়ে আসতো আমার। তখন থরে থরে নীল বিষাদ জমতে জমতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। বহু বিনিদ্র রজনী কেটেছে আমার ডানা ভাঙা ডাহুকের মতো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। শুভ্রতা বলে যখন তখন চিৎকার করেছি। দেখি আমার চারপাশ ফাঁকা। নেই। কোথাও তুমি নেই।

তোমাকে ভুলার জন্য সিগারেটের মাত্রা বাড়িয়ে দিই। বাইরে গিয়ে ঠিক করেছি আর আসবোইনা এই দেশে। তুমিহীন আমি এই আলো বাতাস চাইনা। যখন তুমি আমাদের ঘরের বউ হয়ে এলে তখন ব্যথাগুলো আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে ভিতরে। দানবের মতো হামলে পড়তো আমার মনমন্দিরে। সব গুঁড়িয়ে দিতো নিষ্ঠুরের মতো। সিগারেট খেতাম প্রচুর। কিন্তু যেদিন একটানা কয়েকটি সিগারেটের ধোঁয়া উড়াই। সেদিন কাশি বেশি হয় এবং রক্ত বের হয়। এর আগেও এমন হয়েছে কয়েকবার। তবে খুব বেশী নয়।

মা বাবা জোরাজোরি করাতে দেশে আসতে বাধ্য হই। বিশ্বাস করো তোমাকে একটি মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারিনি ছোট ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে। যখনি দেখতাম মনে হতো আমার ভালোবাসাকে দেখছি। তবে মেনে নিয়েছি। কোনো সিনক্রিয়েট করিনি। আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা হলো, মহৎ,ত্যাগ,নিরবে সয়ে যাওয়া। তার ভালো থাকা প্রার্থনা করা। যাকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসি তাকে ঘৃণা করবো,প্রতিশোধ নিবো,তার ক্ষতি করবো,তার অকল্যাণ কামনা করবো। অন্তত আমি এমন প্রেমিক নই।
রিটার্ন টিকেট করে আসি। সামনের মাসে ফ্লাইট। কিন্তু কি বলব শুভ্রতা, স্রস্টার কোন খেলা বুঝলামনা। আমার ভাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো। তুমি কনসিভ করেছো। বাবা মা আমাকে অনুরোধ করলো তোমাকে বিয়ে করতে। ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন হলো। রাজী হলাম বিনাবাক্যে,বিনা যুক্তিতে উৎফুল্ল চিত্তে।

তোমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মতো দেখতে থাকি। কি যে ভালোলাগতো। কল্পনাতীত। এখন তোমাকে পেয়েছি। আর বাইরে যাবনা। আরহাম যে বিজনেস করতো সেটার হাল ধরতে হবে। ”

শুভ্রতা আয়মানের বুকে লুটিয়ে পড়লো অবোধ শিশুর ন্যায়। দুহাত দিয়ে আয়মানের গলা পেঁচিয়ে ধরলো। তার নিরব অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে আয়মানের কালো ঘন লোমশ বুকখানি। আধভাঙ্গা গলায় বলল,

” আমাকে ছুঁয়ে কথা দিন আপনি। ভুলেও সিগারেট মুখে নিবেন না আর?

” কথা দিলাম। আর খাবনা। কষ্ট হবে ছাড়তে। তুমিই হলে আমার বড় নেশা। এ নেশা যখন নাগালে পেয়েছি। এখন তামাম দুনিয়ার সব নেশা ছেড়ে দিতে পারি হাসতে হাসতে। ডাক্তারও দেখাতে হবেনা তুমি থাকতে। তুমিই আমার বড় ডাক্তার। ”

কিঞ্চিৎ ফুরফুরে মেজাজে বলল আয়মান।

” আচ্ছা এত আবেগ, এত মায়া কোথায় পান আপনি আমার জন্য। হুঁ?”

দুষ্টমিষ্ট কন্ঠে বলল শুভ্রতা।

” প্রেমে পড়নিতো কভু। বুঝবে কি করে সখী। প্রেমতো করেছি শুধু আমিই একা একা। আচ্ছা আমাকে কেনো ইগনোর করতে শুভ্রতা?”

উদ্বিগ্ন ধরা গলায় আকূল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আয়মান।

” এটার একটি ছোট্ট উল্লেখযোগ্য কারণ আছে। অতি সংক্ষেপে বলি। আমার দূর সম্পর্কের এক ফুফাতো বোন ছিলো। নাম জোছনা। তখন সে ক্লাস টেনে পড়ে। প্রেমের সম্পর্ক ছিলো তাদের পাশের বাড়ির এক ছেলের সাথে। নাম সৌরভ। কঠিন ভালোবাসাবাসি নাকি ছিলো দুজনের। আমরা এমনো শুনেছি জোছনার হেঁটে চলার পথ দেখে, জোছনাদের বাগানের গাছ দেখে, বিলের মাঝে জোছনাদের রাজহাঁস দেখেও নাকি অনাবিল সুখ পেতো সেই প্রেমিক সৌরভ। দুই পরিবার জানাজানি হলো। নেমে এলো জোছনার উপরে পরিবারের নিষ্ঠুরতা। হঠাৎ এক কাক ডাকা ভোরে জোছনা গলায় দড়ি দিলো। কারণ সেদিন সৌরভের বিয়ের দিন ছিলো। সে ছিলো নাকি মা বাবার বাধ্য ছেলে। তাই জোছনাকে বিয়ে করা তার সম্ভব হয়নি।এই ঘটনা শুনে আমি অনেক ভয় পেয়ে যাই। আমিও অনেক নরম মনের। ভাবলাম এমন কিছু আমার লাইফে হলে আমিওতো বেঁচে থাকতে পারবোনা। মরে যাবো। এবং ছেলেদের উপর আস্থাটাও কমে যায়। এই আশংকা থেকেই আপনার আবেগ,চাওয়া,অনুরাগ,পাগলামো,প্রেম আমার কাছে গুরুত্ব পায়নি। আমি লজ্জিত! অনুশোচিত! ভালোবাসার পরিবর্তে আপনাকে অজস্র অশ্রু ও নির্ঘুম রাত উপহার দিয়েছি বলে।”

বিচ্ছেদের কথার ফুলঝুরি শেষ না হতেই রাত ফুরিয়ে ঊষালগ্নের আভাস দেখা দিলো পূর্ব দিগন্তে। আয়মান বলল,

আসো মিষ্টি মুখ করাই তোমাকে। এটা বাসরঘরের প্রথম সৌজন্যতা। সকালে উপমা বা অন্য কেউ যদি দেখে সব খাবার অক্ষত। মাইন্ড করবে। ঢেকে রাখা ট্রে থেকে আয়মান একটি সাদা রসগোল্লা কাঁটা চামচে গেঁথে নিলো। শুভ্রতার মুখে পুরে দিলো। পরক্ষণেই বলল,

” ওহ হো। না জেনেই আন্দাজে খাইয়ে দিলাম। তোমার কোন মিষ্টি পছন্দ? ”

” আমি কালো জাম খাই বেশী। কিন্তু এখন আপনার হাতে এটাই মজা লেগেছে।”

আয়মান আপ্লুত চোখে চাইলো শুভ্রতার দিকে। অস্ফুট স্বরে বলল,
আমার শুভ্রতা। আমার ভালো থাকার মেডিসিন।

” আপনি এখন সুস্থবোধ করছেন? ”

” আলহামদুলিল্লাহ। পুরোপুরি সুস্থতাবোধ করছি। মন ভালোতো শরীর ভালো।”
বলেই আয়মান হেসে ফেললো।

শুভ্রতা আয়মানকে রসগোল্লা খাওয়ানোর জন্য কাঁটা চামচ হাতে নিতেই আয়মান বলল,

” নো নো নো। তোমার হাত থেকে খাবো।প্লিজ”

শুভ্রতা ভ্রুকুঁচকে হেসে ফেললো। তিন আঙ্গুল দিয়ে রসগোল্লার অর্ধেক নিলো। আয়মানের ঠোঁটের কাছে নিতেই,আয়মান শুভ্রতার কবজি চেপে ধরে রসগোল্লা খেয়ে নিলো। শুভ্রতার তিন আঙ্গুল নিজের মুখে পুরে চেটেপুটে খেয়ে নিলো।
বলল,

” আহ! কি আকন্ঠ সুধা। কি অমৃত!”

শুভ্রতা গোপনে শিহরিত হলো। লাজুকলতার মতো চুপসে গেলো।

” লজ্জা পেলে হবেনা। এসব তোমার শাস্তি। আমাকে পোড়ানোর জন্য। সবেতো শুরু।”

শুভ্রতা মেঘমুখ করে কন্ঠে গভীরতা এনে ভাবুকের ন্যায় বলল,

” সত্যিই বলেছেন আয়মান। আমার শাস্তি পাওয়া উচিত আপনার অনুভূতির মূল্যায়ন না করে এতটা নরক যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য। আমারই মরে যাওয়া উচিত আপনার আগে। আমি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই।”

চলবে…৮