শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-১১

0
390

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(১১)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

হিমছড়ি পাহাড়ের ঝর্নার পানি অঝোরে ঝরে পড়ছে। মেয়েটি ছবি তোলার কথা ভুলে গিয়ে পানি নিয়ে ছুড়ে মেরে বাচ্চামো খেলায় মেতে উঠেছে।
তায়েস ডান হাতে মেয়েটার ফোন রেখে বাম হাতটা পকেটে গুঁজে রেখে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।ভাবছে,
কি অদ্ভুত এই পৃথিবী।যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি দিন রাত এক করে অথচ সেই মেয়েটি আজকে কিছুদিন যাবত তার পিছু পরে আছে!

হ্যা তাই!
এই সেই মেয়ে!
ইন্সপেক্টর রাকিব হাওলাদার একমাত্র কন্যা,নূর‌আইন বিনতে রাকিব।

তায়েস যখন ফোনের লক বাটনে ক্লিক করে তখন লক স্ক্রীনে আলিফ এর সাথে নূর‌আইন এর হাস্য‌উজ্জ্বল ছবি ভেসে উঠে!
তায়েসের মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠে। নিজের ফোন বের করে আরো একবার নূর‌আইন কে পরখ করে নেয়। না সে কোন ভাবেই ভুল করছে না।এই মেয়েটাই নূর‌আইন বিনতে রাকিব।

তায়েস এই মুহূর্তের কিছু ছবি ক্যামেরা বন্দি করে ইন্সপেক্টর রাকিব হাওলাদার কে সেন্ড করে দেয়।
রাকিব হাওলাদার ছবি গুলো দেখার সাথে সাথে কল করে উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
-“তায়েস আমার মেয়ে কোথায়? আমি এক্ষুনি আসবো ঠিকানা বলো?

তায়েস হোটেলের ঠিকানা টেক্সট করে দিল রাকিব হাওলাদার কে।

পিছন থেকে নূর‌আইন বললো,
-“আপনি আমার ছবি না তুলে এখানে এসে ফোনালাপ করছেন? এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়।

তায়েস নূর‌আইন কে তার ফোন ফেরত দিয়ে বললো,
-“একটু পর সন্ধ্যা নামবে। চলেন হোটেলে ফিরা যাক?

নূর‌আইন কোমরে হাত রেখে বললো,
-“কিন্তু আমার ছবি তুলার কি হবে?
-“আলোকচিত্রকে নাজায়েজ ও পাপ বলে ফতোয়া দিয়েছে ভারতের শীর্ষস্থানীয় মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ। প্রতিষ্ঠানটির মোহতামিম (উপাচার্য) মুফতি আবদুল কাসিম নোমানি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, আলোকচিত্র তোলা নাজায়েজ। শরিয়ার বিচারে পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্ট ব্যবহারের প্রয়োজন ছাড়া মুসলমানেরা ছবি তুলতে পারে না।

তায়েসের এমন নিষেধাজ্ঞা শুনে মাস্কের আড়ালে ঠোঁট উল্টায় নূর‌আইন।
তায়েস হাঁটতে শুরু করলে সেও পিছন পিছন যায়।

হোটেলে ফিরে যার যার রুমে চলে যায়।
রুমে আসার পর তায়েসের খেয়াল হয়,বিরবির করে বলে,ওহ সিট মেয়েটার রুম নাম্বার জানা হলো না। এখন কিভাবে খুজবো? নিশ্চয়ই ছদ্মনামে রুম বুকিং করেছে না হয় আমি চেক করেও পেলাম না কেন?
.
.
রামিসার রাগ পরেছে এতো দিনে।
এখন আলো’র সাথে তার খুব ভাব হয়েছে।
সময় পেলেই গল্পের জুড়ি নিয়ে বসে।
কথায় কথায় আলোকে রামিসা জিজ্ঞাসা করে,
-“ভাবী মনি তোমাদের লাভ স্টরি শুনতে চাই বলবে?

আহাম্মক বনে গেল আলো এ কথা শুনে।
স্যারের সাথে কিনা তার লাভ স্টরি!যা কখনোই মনে আনেনি আলো। বিয়েটা তো হুট করেই হয়ে গেল। সবটা তার বাবা রহমান সাহেব এর মতামতে।
তবে আলো ইস্তিখারা নামায পড়ে আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করে বিয়েটা করে।
আর বিয়ে তো ফরয ইবাদত।যেটা পালন না করলেই নয়। তাছাড়া আইরিন সুলতানার মৃ’ত্যুর পর আলো’কে যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে তার থেকে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন তার কাছে আল্লাহ তা’আলার একটা রহমত বলে মনে হয়েছে।যদিও ফয়জান তার শিক্ষক বলে একটু অমত ছিল কিন্তু এখন আর নেই।
ফয়জান কে কলেজে যতটা কঠোর মনে হয়েছে,ব্যক্তিগত জীবনে ততটাও কঠোর নয়।
কয়েকদিনে আলো বুঝতে পেরেছে ফয়জান খুব ভালো মানের অধিকারী।
সে সর্বদা আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করে সে যেন ফয়জান এর যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠতে পারে। ফয়জান এর বেগম হতে পারে।

-“কি হলো চুপ করে আছো যে? আমাকে বলবে না?

আলো ওরনা টা আরেকটু সামনে টেনে কপালের অংশ ঢেকে বললো,
-“তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা তবে সত্যি এটাই যে আমি বিয়ের কয়েক ঘণ্টা পূর্বে জানতে পারি আমার বিয়ে! তা-ও আবার আমার কলেজ টিচারের সাথে! কথাটা শুনতেই তৎক্ষণাৎ বাবাকে বলেছিলাম আমি এই বিয়ে করবো না কিছুতেই।

তারপর মত পাল্টে বিয়ে করি।এই হলো আমাদের লাভ স্টরি।

রামিসা সবটা শুনে বললো,
-“তারমানে ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করতো।আর সেই কারণেই তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখে।তাই না?

রামিসার এ কথা শুনে লজ্জায় লাল রঙা ধারন করে আলোর ফর্সা মুখশ্রী।
রামিসার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“এশার নামায পড়তে হবে আমি যাই। তুমিও পড়ে নাও।

তারপর এখান থেকে প্রস্তান করে আলো। নিজের রুমে ফিরে দুই হাতে নিজের মুখশ্রী চেপে ধরে। কিছু মূহুর্ত কল্পনা করে নিজের মতো করে সাজিয়ে তুলে।

গত এক বছর শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারে না আলো। বুকে আকাশ সম যন্তনা নিয়ে চোখ বুজে আল্লাহ তা’আলার কাছে এই কষ্ট থেকে মুক্তি চাইতো।
এরপর আইরিন সুলতানার মৃ’ত্যুর পর আরো মুষড়ে পড়ে আলো। চোখ বুজে থাতেও যেন কষ্ট হতো প্রচুর।
অথচ এই কয়েকদিন ধরে আলো শান্তিতে ঘুমাতে পারে। চোখ দুটো বুজলেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। ফয়জান তাকে নিজের সর্বাঙ্গে আগলে রাখে। আলোও মুখ লুকানোর ঠাঁই পায়। আহ্ কি শান্তি আল্লাহ।

তাছাড়া দুইটা মা, দুইটা বাবা, দুইটা বোন পেয়েছে। দুই বাবা বাহিরে থেকে আসার সময় হাতে করে আলোর জন্য চকলেট, আইসক্রিম,চিপস নিয়ে আসে।
আলোর তখন মনে হয় দুই বাবা ছোট্ট আদরের মেয়ে সে।

রামিসা নাক ফুলিয়ে যখন বলে, হুম এখন তো তোমারা আরেক মেয়ে পেয়ে গেছ, আমি তো তোমাদের কেউ না।
তখন পিছন রাখা আরেক হাত বের করে ভিন্ন আরেকটি প্যাকেট রামিসার হাতে দেয় তার দুই বাবা।
রামিসা খুশিতে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,থ্যাংক ইয়ু।

আলো মুচকি হাসে এদের ভালোবাসা দেখে। মনে মনে বলে,মা শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের বন্ধন অটুট রাখুন আমীন! সুম্মা আমীন!

আলো ভাবে এতো শান্তি তার কপালে আল্লাহ তা’আলা রেখেছেন বলেই এতো দিন দূরর্ভুগ পোহাতে হয়েছে।
.
.
আয়েশা আর ফাহমিদা খাতুন নামায পড়ে গল্প করছে বসে। সামনে দুটি বিয়ের রিসিপশন আছে।এ নিয়ে কতো প্লান তাদের।
প্রথমে কায়েস আর ফাইজার বিয়ে হবে তারপর ফয়জান আর আলোর বিয়ের রিসিপশন। আত্মীয় স্বজনদের জানানোর জন্য এই আয়োজন। না হয় ফয়জান আর আলো’র বিয়ের রিসিপশন না করলেও হতো।

যাই হোক, আয়েশা আর ফাহমিদা খাতুন ঠিক করলেন আগামীকাল থেকে শপিং করা শুরু করবেন। এত্ত এত্ত শপিং আগে থেকে না করলে পরে সময় সুযোগ হয়ে উঠবে না। তাছাড়া ফাহমিদা খাতুন এর নতুন ফ্লাট গুছাতে অনেক সময় লাগবে। সবকিছু ক্রয় করতে হবে। একটা সংসারে কি না লাগে?

ফাহমিদা খাতুন এগুলো ভাবলেই শিউরে উঠেন। এতো কাজ আল্লাহ।
আয়েশা আশ্বস্ত করে বলে,
-“চিন্তা করিস না।বড় কাজ গুলো তো লোক দিয়ে করানো যাবে,যেমন ফার্নিচার সেটিং এগুলো। আর গুছানো গুলো আমরা সবাই একটা একটা করে করে ফেলবো ইনশা আল্লাহ।
.
.
তায়েস ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে রিসোর্ট এর দিকে গেল। গতকাল যেখানে বসে ছিল সেখানে। হয়তো মেয়েটার সাথে দেখা হতে পারে এই ভেবে।

গিয়ে দেখলো নূর‌আইন আগে থেকে ওখানে বসে আছে। ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার দরুন তায়েস কে দেখতে পায়নি এখনো।তায়েস এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“হাই।

নূর‌আইন বিনিময়ে মুচকি হেসে বললো,
-“আমার মনে হয়েছিল আপনি এখানে আসবেন।

তায়েস সোফায় বসতে বসতে বললো,
-“এমনটা কেন মনে হলো আপনার?
-“এমনিতেই হয়েছে।
-“আচ্ছা।

নূর‌আইন ফোন রেখে বললো,
-“তো আপনার সেই মানুষটির খুঁজ পেয়েছেন? সে আপনার কি হয় বললেন না কিন্তু?

তায়েস কথা ঘুড়াতে বললো,
-“তেমন কিছু না বাদ দিন তার কথা।
তো ডিনার করেছেন?
-“না।
-“চলেন একসাথে করি?
-“আচ্ছা চলেন।

তারপর দুজনে টুকটাক কথা বলতে বলতে রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেয়ে নেয়।এর মধ্যে কথায় কথায় তায়েস নূর‌আইন এর রুম নাম্বার জেনে নেয়। এখন শুধু সকাল হ‌ওয়ার অপেক্ষা।
.
.
আলো ব্যাতিত সবাই গল্পের আসর জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।এটা ওটা নিয়ে মজা করছে।কায়েস প্রথম থেকে খেয়াল করে আসছে ফাইজা কখনো ভুল করেও আসে না। এতে খুব ব্যাথিত হয় কায়েস।প্রিয় মানুষের হাসি যে কত্ত সুন্দর হয় সে বলে বুঝানো যাবে না। কিন্তু কায়েসের সে সৌভাগ্য হয়নি আদৌও।
এখন যখন সবাই হাসছে তখনো শান্ত ভাব ভঙ্গিতে বসে আছে ফাইজা।

একটু পর উঠে চলে যায় এখান থেকে। কায়েস ভাবলো ফাইজার বুঝি খুব হাসি পাচ্ছে তাই লুকিয়ে হাসতে যাচ্ছে।

ফাহমিদা খাতুন জিজ্ঞাসা করলে বলে,
-“একটু ছাদে যাচ্ছি মা। কিছুক্ষণ পর চলে আসবো আমি।

এ কথা শুনে তায়েসের মাথায় দুষ্টুমি ভর করলো। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সেও উঠে চলে গেল ছাদে।
প্লান করলো ছাদে গিয়ে ফাইজা কে ভয় পাইয়ে দিবে।
অথচ সে নিজেই ভয় পেয়ে গেল।

ফাইজা চিৎকার করে কাঁদছে ফ্লুরে বসে!
ঢাকা শহরের যানযট এবং মানুষের কোলাহলের কারণে এ চিৎকার কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না।…..

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।