শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
710

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(৩৬)
#অন্তিম_পর্ব।
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

গ্রামাঞ্চলে একটা কথা বলে লোকজন, “দুহিরা বেলা দুহিরা শনি”! মানে তারা মনে করে দুপুর বেলা মানে যোহরের আযানের কিছু সময় পূর্বের সময়টা ভালো না। খারাপ কিছু (খারাপ জ্বীন) ঘুরে বেড়ায়!সুযোগ পেলে মানুষের ক্ষতি করে। মানুষের বিপদ আপদ বেশি হয় বলে মনে করেন গ্রামের সহজ-সরল মানুষজন।তাই এই সময়ে ঘরে অবস্থান করা ভালো।
কিন্তু মানুষের বিপদ কোন দিক থেকে চলে আসে তা তো বলে কয়ে আসে না তাই না?
আলোর সকাল বেলা থেকে চিন চিন করে পেট ব্যথা শুরু হয় কিন্তু কাউকে বলে না, ভাবে ঠিক হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু পরে অল্প ব্যথা থেকে তা বিস্তর আকার ধারণ করে। শেষে সহ্য করতে না পেরে ফাইজা আর তার শ্বাশুড়ি মা কে জানায়।
ফাইজা সাথে সাথে ফয়জান কে কল করে কিন্তু ফোন বন্ধ পায়।তাই কায়েস কে কল করে জানালে কায়েস ফোন পেয়ে দ্রুত আসে এ বাসায়। এসেই সবাইকে বলে তাড়াতাড়ি সব কিছু গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিতে।সে অ্যাম্বুলেন্স কে আসার পথে কল করেছে।অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে।
.
কায়েস, রুহুল আমিন, শফিক মাহমুদ, ফাহমিদা খাতুন, আয়েশা আলো’কে নিয়ে হসপিটালে যায়।
আর বাকিদের মধ্যে রামিসা ছোট বাবু নিয়ে যেতে পারবে না বলে বাসায় রয়ে গেছে আর রামিসা ছোট বাবু’কে একা সামলাতে পারবে না বলে নূর কে রামিসার কাছে রেখে যায় আয়েশা।তারা বাসায় থেকে মহান রাব্বুল আলামীন কে স্মরন করছে যেন সবকিছু সহিসালামত হয়।

ফাইজা গিয়েছে ফয়জান এর কলেজে।তার স্ত্রীর এমন একটি সময় সে পাশে না থাকলে হয় কিভাবে? ফয়জান পাশে থাকলে আলো অনেকটা ভরসা পাবে। কেননা এই পৃথিবীতে আলো’র সবচেয়ে কাছের মানুষ এবং ভরসার মানুষ ফয়জান।

ফাইজা কলেজে ঢুকে দাড়োয়ান মামাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-” ফয়জান মাহমুদ স্যার কোথায় বলতে পারেন?

দাড়োয়ান মামা বললেন,
-” আজকে তো কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে কারণ আজকে প্রিন্সিপাল স্যার সব স্যার ম্যাডাম’দের নিয়ে মিটিং রেখেছেন। এখন মিটিং চলছে।

ফাইজা একটু ভেবে বললো,
-” আমার খুব প্রয়োজন ছিল একটু যদি ফয়জান স্যার কে ডেকে দিতেন তাহলে খুব উপকৃত হবো।
-” মিটিং এর সময়ে ভিতরে প্রবেশ করার নিয়ম নাই তো মা। না হয় আমি কি না যাই বলেন?

ফাইজার মন খারাপ হয়ে গেল।দাড়োয়ান চাচা ওয়েটিং রুম দেখিয়ে বললেন ওখানে বসার জন্য। কিন্তু ফাইজা গেল না বারান্দার একটা চেয়ারে বসে র‌ইলো।দাড়োয়ান মামা জিজ্ঞাসা করলেন, ফয়জান তার কি হয়?ফাইজা উত্তরে বললো তার বড় ভাই।

প্রায় এক ঘন্টা পর একজন একজন করে শিক্ষক, শিক্ষিকা বের হয়ে যাচ্ছেন।ফাইজা দুই হাত দাঁড় করিয়ে এর উপর থুতনি ভর করে বসে আছে।এর মধ্যে আকস্মিক কিছু দেখতে পায় ফাইজা! সাথে সাথে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।এক প্রকার দৌড়ে সামনে যায় আরো স্পষ্ট ভাবে দেখে শিউর হ‌ওয়ার জন্য। তখন দাড়োয়ান মামা বলে উঠলেন,স্যার আপনার বোন এসেছে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ফয়জান খানিকটা অবাক হয়ে বললো, কোথায়?
দাড়োয়ান মামা এদিক ওদিক তাকিয়ে ফাইজা কে দেখতে পেয়ে আঙ্গুল তাক করে দেখালো। ফয়জান দ্রত হেঁটে ফাইজার কাছে গিয়ে বললো,
-” কিরে বোন কোন সমস্যা হয়েছে বাসায়?

ফাইজা আনমনে বললো,
-” না।
-” তাহলে কলেজে কি দরকারে এসেছিস?

এবার ফাইজার টনক নড়ে। সে হকচকিয়ে বলে উঠে তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলো!ভাবীমণি কে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে।ভাবীমণির পেইন শুরু হয়েছে।এ কথা শুনে ফয়জান এক মুহুর্ত ও দেরি না করে ফাইজা কে নিয়ে চলে গেল হসপিটালে।
.
.
সারাদিন নরমাল ডেলিভারির জন্য ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেন শেষে না পেরে সিজারিয়ান করা হয় আলোকে।
রাত আটটা বেজে উনিশ মিনিট আলোর কোল আলো করে ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম হয়।এ সংবাদের সাথে আরেকটি সংবাদ আসে ফয়জান এর ফোনে।যা শুনে ফাহমিদা খাতুন জ্ঞান হারান! রুহুল আমিনের অবস্থা সুচনীয়।
শফিক মাহমুদ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন ফ্লোরে। ফয়জান আর কায়েস ছুটলো স্থানীয় থানার উদ্দেশ্যে!

ইতিমধ্যে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে, গত দুই বছর যাবত যত ক্রি’মিনাল খু’ন হয়েছে তাদের খু’নি আজ সন্ধ্যায় নিজ থেকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন! খু’নি একজন নারী যার নাম ফাইজা চৌধুরী!

দুটো পরিবার ভে’ঙ্গে গুড়িয়ে গেল প্রায়!এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে কিনা আজো অজানা।
.
.
ছয় বছর পর,
বদলে গেছে সবকিছু। চৌধুরী বংশের দুই পরিবারে এখন আর কারো মধ্যে চঞ্চলতা দেখা যায় না।কেউ আর প্রাণ খুলে হাসতে জানে না,প্রায় ভুলেই বসেছে হাসতে।
রামিসা আর আলো তাদের ছেলে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে এসেছে। আজকে স্কুলে গার্ডিয়ান দের নিয়ে মিটিং ডাকা হয়েছে।তাই দু’জনেই মিটিং রুমে।

“রাদ শাহমাত” আর “তাকিয়া” পাশাপাশি বসার কারণে আজোও মিস তাদের দাড় করিয়ে রেখেছে!এটা নতুন নয়,নিত্যদিন এক‌ই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
ক্লাসের রুলস অনুযায়ী ছেলেরা বসবে এক সাইডে মেয়েরা বসবে আরেক সাইডে।অথচ রাদ শাহমাত আর তাকিয়া এই রুলস এর অবাধ্য হয়ে প্রতিদিন একসাথে বসে। তাদের শা’স্তি দিতে দিতে টিচার’রাও ক্লান্ত। কিন্তু তাদের দাবি তারা একসাথেই বসবে। টিচার রাও মানতে নারাজ কেননা আজকে তারা রুলস ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয়ে এক‌ই কাজ করবে।
.
খাবার টেবিলে তাকিয়া বললো,
-” আচ্ছা আম্মু আমি আর রাদ ভাইয়া একসাথে বছলে মিছদের কি সমোছছা হয় বলতে পারো?

আলো ব্যাপারটা জানে,এ নিয়ে টিচাররা অনেক বার বিচার ও দিয়েছে।তাই তাকিয়া কে বোঝাতে বললো,
-” তোমার রাদ ভাইয়া হচ্ছে একজন ছেলে।আর মাহরাম পুরুষদের সাথে মেয়েদের মেলামেশা করা আমাদের উচিৎ নয়।এতে আমাদের গুনাহ হবে।

তাকিয়া ভাবনার ভঙ্গিতে বললো,
-” মাহরাম পুরুষ মানে কি?
-” মাহরাম পুরুষ মানে যাদের সামনে নারীর পর্দা ফরজ। মানে মাহরাম পুরুষের সামনে আমাদের মেয়েদের যাওয়া নিষেধ।

ছোট্ট তাকিয়া কি বুঝলো জানিনা তবে এরপর থেকে রাদ শাহমাত এর থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করে।যার ফলে রাদ শাহমাত খুবই ব্যাথিত হয়। প্রতিজ্ঞা করে সে তাটিয়ার সাথে কখনোই কথা বলবে না।
.
.
ফয়জান, আলো, রামিসা, নূর আর কায়েস এসেছে কেন্দ্রীয় জে’লখানায়! দীর্ঘ আট বছর পর (জেলখানা তে বছর হিসেব করে ৯ মাস হিসেবে)আজকে ফাইজার মুক্তির পাওয়ার দিন!তাই তারা নিতে এসেছে ফাইজা কে।

জে’লের কিছু ফর্মালিটি শেষে তায়েস সাথে করে ফাইজা কে নিয়ে এলো।রামিসা দূর থেকে বোন কে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এতে ফাইজাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না।
তারপর কায়েস ছাড়া সবাই এসে ফাইজাকে জরিয়ে ধরে চোখের পানি ফেলে।ফাইজা জিজ্ঞাসা করে বাসার তিন ছোট সদস্যরা কোথায়?রামিসা বললো, ওদের বাসায় রেখে এসেছি।চলো দেখতে পাবে।

ফাইজা কে দেখে ব্যথিত হয় সবাই। আগের থেকে কেমন রোগা হয়ে গেছে ফাইজা। গায়ে পুরনো পোশাক।ডার্ক সার্কেল পরে গেছে চোখে, চেহারা মলিন।একেই হয়তো জে’লখানা বলে।

আসার পথে সবার আড়ালে কায়েস বললো,
-” তাহলে বিয়ে না করার এই ছিল কারণ?

ফাইজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-” বিয়ে করলে খু’ন করে প্রতি’শোধ নিতে পারতাম?আর না নিজের সমস্ত অন্যায়ের স্বীকা’রোক্তি করতে পারতাম?
-” তাদের বিচার তো এমনিতেই আল্লাহ তা’আলা করবেন।
-” আপনার সাথে তর্কে জড়াতে একদম ইচ্ছে নেই।
.
সেদিন ফয়জান এর কলেজে গিয়ে ধ’র্ষক কে শনাক্ত করতে পারে ফাইজা‌। হুবহু সেই হাতের ট্যাট্যু!মাস্কের আড়ালে সেই মুখ!ফাইজার চিনতে এতটুকু ভুল হয়নি।
অতঃপর,
পরিকল্পনা করে ধ’র্ষক কে কু’পিয়ে হ’ত্যা করে ফাইজা। সে আর কেউ নয় মানুষ রুপি অমা’নুষ সমির চন্দ্র সূত্রধর!যিনি ফয়জান এর কলিগ এবং তার বোনের ধ’র্ষক।
.
.
বাসায় ফিরে যখন জানতে পারলো তার মা আর এই পৃথিবীতে নেই! তখন দুনিয়ার আঁধার নেমে এলো ফাইজার।তার মা তার শোকে স্টক করে মৃ’ত্যুবরণ করেছেন!এর থেকে মর্মা’ন্তিক ঘটনা আর কি আছে? এতোটা বছর জে’লে কাটিয়ে ও হয়তো এতো কষ্ট পায়নি ফাইজা,যতটা না তার মায়ের মৃ’ত্যুর খবর শুনে পেল। ইচ্ছে করেই তাকে আগে জানানো হয়নি কারণ এই শোকে ফাইজা ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যেত। যেখানে তার পাশে কেউ থাকতো না তখন।

রুহুল আমিন ও অসুস্থ হয়ে আছেন, মেয়ের চিন্তায় ডায়বেটিস হয়ে গেছে। অপরদিকে আয়েশা আর শফিক মাহমুদ ও ভালো নেই। তাদের খুব আদরের মেয়ে ফাইজা।
.
পরিবারের ক্ষুদে তিন সদস্য, রাদ শাহমাত,তাকিয়া আর তায়েস আর নূরের মেয়ে তানহা। সবাই ফাইজা কে দেখে তাকিয়ে থাকে।ফাইজা কাছে গিয়ে তাদের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
-” আমাকে চিনো না তাই না?

ফাইজা ভেবেছিল বাচ্চা গুলো বলবে চিনে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সবাই ফুফি মণি বলে চিৎকার করে উঠল।এই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ফাইজা কেঁদেই দিল।
তার ভাই বোনরা তার অনুপস্থিতে তার ছবি দেখিয়ে বাচ্চা গুলোকে আগেই তাকে চিনিয়ে রেখেছে।এ ভেবেই ফাইজা খুশিতে আপ্লুত হয়ে পড়ে।
.
.
মাস খানেক পর,
অন্যসব সুখী দাম্পত্যির মতো ফাইজা ও সুখে জীবন কাটাতে শুরু করে মিরাজ এর সাথে!
হ্যা সেই মিরাজ যে মা এবং তার খালামণির সাথে ফাইজা কে দেখতে এসেছিল।মিরাজ একজন এডভোকেট। সেই সুবাদে সব কিছু জেনে শুনেই ফাইজা কে বিয়ে করে।
ফাইজা জেলে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার দেখা করতে যায় সে।

বর্তমানে,
ফাইজা খোলা আকাশের নিচে বসে আছে। মিরাজ দুটো আইসক্রিম হাতে নিয়ে ফাইজার পাশে বসে একটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-” নাও?
-“আমার আইসক্রিম পছন্দ আপনি কি করে জানলেন?

মিরাজ ফাইজার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে আইসক্রিম লাগিয়ে দিয়ে বললো,
-“সিক্রেট বলবো না!

এতে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকায় ফাইজা যা দেখে বিস্তৃত হাসে মিরাজ।
এখন আর তাদের জীবন শুধুই শুভ্র নীলাভ আকাশ। যেখানে মেঘের আনাগোনা নেই।

🍀 সমাপ্ত 🍀